সুখময় সেনের বয়স পঁয়ত্রিশ। এই বয়সেই সে চিত্রকর হিসাবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। পোর্ট্রেটেই তার দক্ষতা বেশি। সমঝদারেরা বলে সুখময় সেনের আঁকা কোনও মানুষের প্রতিকৃতি দেখলে সেই মানুষের জ্যান্ত রূপ দেখতে পাওয়া যায়। বহু প্রদর্শনীতে তার আঁকা পোর্ট্রেট দেখানো হয়েছে, শিল্প সমালোচকেরা তার প্রশংসা করেছে। 
কিন্তু শিল্পীরা সবসময় এক পথে চলতে ভালবাসে না। সুখময় এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম নয়। সম্প্রতি তার মনে হয়েছে–পোর্ট্রেট তো অনেক হল, এবার একটু অন্য ধরনের কিছু আঁকলে কেমন হয়। এই অন্য ধরনটা সুখময়ের ক্ষেত্রে হল ল্যান্ডস্কেপ বা প্রাকৃতিক দৃশ্য। এই প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকার উদ্দেশ্যেই সুখময় হাজির হয়েছে শিলং শহরে। 
সুখময় এখনও বিয়ে করেনি, তার বাপ-মা দুজনেই জীবিত। দুটি বোন আছে, তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। সুখময় শিলং-এ একাই এসেছে, কারণ শিল্পীর জীবনের একাকিত্বের প্রয়োজনীয়তা সে প্রবলভাবে অনুভব করে। যখন সে ছবি আঁকে তখন তার পাশে কেউ উপস্থিত থাকলে সেটা সে মোটেই পছন্দ করে না। অবিশ্যি পোর্ট্রেট আঁকা হলে যার ছবি আঁকা হচ্ছে তাকে থাকতেই হয়, কিন্তু আর কেউ নয়। সব শিল্পীর মধ্যেই এই প্রবণতা লক্ষ করা যায়, কিন্তু সুখময়ের মধ্যে এর মাত্রাটা একটু বেশি। 
তাই শিলং-এ এসে সেখানকার বিখ্যাত লোকের ছবি সে যখন আঁকছিল ঘাসের উপর ইজেল রেখে, তখন একটি দ্বিতীয় প্রাণীর আবির্ভাবে সে মোটেই সন্তুষ্ট হল না। 
বাঃ, আপনার আঁকার হাত তো খাসা মশাই! হল

আগন্তুকের প্রথম মন্তব্য। 
এর কোনও উত্তর হয় না, তাই সুখময় স্মিতহাস্য করে তার তুলি চালিয়ে চলল। 
আমি চিত্রকরদের খুব উঁচুতে স্থান দিই, বললেন আগন্তুক। একজিবিশনে যাই সুযোগ পেলেই। আপনার কি কখনও কোনও প্রদর্শনী হয়েছে? 
এটা একটা প্রশ্ন, কাজেই এর উত্তর দিতে হয়। সুখময় সংক্ষিপ্ততম উত্তরটি বেছে বলল, হ্যাঁ। আপনার নামটা জানতে পারি কি? 
সুখময় নাম বলল। 
আগন্তুকের দৃষ্টি উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। বলেন কী মশাই। আপনার নাম তো আমার বিলক্ষণ জানা। আমি যতদূর জানি আপনি তো ল্যান্ডস্কেপ আঁকেন না। আপনার ছবির প্রদর্শনীতে আমি গিয়েছি। সেগুলো সবই পোর্ট্রেট। আপনি হঠাৎ সাবজেক্ট চেঞ্জ করলেন কেন? 
স্বাদ বদলের জন্য।বলল সুখময়। এ ভদ্রলোক তার পাশ সহজে ছাড়বেন বলে মনে হয় না। সুখময় অভদ্রতা এড়ানোর জন্য বাধ্য হয়েই একটা প্রশ্ন করল। 
আপনি কি শিলং-এই থাকেন? 
আজ্ঞে না। আমার এক শালা থাকে, লাবানে, আমি তার বাড়িতে দিন দশেকের জন্য এসে উঠেছি। আমার নাম গণেশ মুৎসুদ্দি। কলকাতায় থাকি; একটা ইনশিওরেন্স কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। 
সুখময় যে এতক্ষণ এই ভদ্রলোককে বরদাস্ত করেছে তার একটা কারণ হল এই যে, ভদ্রলোকের চেহারায় বেশ একটা ব্যক্তিত্বের ছাপ আছে, কণ্ঠস্বর ভাল, নাক চোখা, চাহনি বুদ্ধিদীপ্ত। এইরকম চেহারা দেখলে আপনা থেকেই সুখময়ের পোট্রট করার ইচ্ছেটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। 
তা আপনি কি মানুষের ছবি আঁকা ছেড়ে দিলেন? গণেশ মুৎসুদ্দি প্রশ্ন করলেন। 
পোর্ট্রেট তো অনেক হল, বলল সুখময়, তাই এবার ল্যান্ডস্কেপের দিকে ঝুঁকেছি।
আপনি আমার একটা ছবি এঁকে দেবেন? 
সুখময় রীতিমতো বিস্মিত। এ ধরনের প্রস্তাব ভদ্রলোকের কাছ থেকে সে আশা করেনি। গণেশ মুৎসুদ্দি ঘাসের উপর বসে পড়ে বললেন, আমি একটা অভিনব অফার দিচ্ছি আপনাকে। আপনি পোর্ট্রেট আঁকবেন, তবে সাধারণ পোর্ট্রেট নয়। 
কীরকম? 
সুখময়ের মনে এখন বিরক্তির জায়গায় কৌতূহল দেখা দিয়েছে। তার হাতের তুলি হাতেই রয়ে গেছে; সে তুলি আর কাজ করছে না। 
গণেস মুৎসুদ্দি বললেন, আমার প্রস্তাবটা শুনুন, তারপর আপনার যা বলার বলুন। আমার মনে হয় এটা আপনি উড়িয়ে দিতে পারবেন না। 
সুখময় এখনও কোনও আন্দাজ করতে পারছে না ভদ্রলোক কী বলতে চান। ভদ্রলোকও একটু সময় নিয়ে তাঁর প্রস্তাবটা দিলেন। 
ব্যাপারটা হল এই–আপনি আমার একটা ছবি আঁকুন, কিন্তু সেটা হবে এখনকার চেহারা নয়। আজ থেকে ঠিক পঁচিশ বছর পরে আমার যে চেহারা হবে সেইটে আপনার অনুমান করে আঁকতে হবে। আজ হল ১৫ অক্টোবর ১৯৭০। আপনার ছবিটা আমি উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে আপনার কাছ থেকে কিনে নেব। তারপর আজ থেকে পঁচিশ বছর পরে–অর্থাৎ ১৫ অক্টোবর ১৯৯৫–আমি আবার ছবিটি নিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করব। আমার কথার নড়চড় হবে না। যদি দেখা যায় যে আপনার অনুমান ঠিক হয়েছে এবং ছবির সঙ্গে আমার তখনকার চেহারা মিলে গেছে, তা হলে আমি আপনাকে আরও কিছু টাকা পুরস্কার দেব। রাজি? 
প্রস্তাব যে অভিনব তাতে সন্দেহ নেই। এমন প্রস্তাব কোনও ব্যক্তি কোনও শিল্পীকে করেছে বলে সুখময়ের জানা নেই। সুখময় প্রস্তাবটা উড়িয়ে দিতে পারল না। এটা একটা চ্যালেঞ্জই বটে! একজন লোকের আজকের চেহারা পঁচিশ বছরে কী রূপ নেবে সেটা অনুমান করা দুঃসাধ্য ব্যাপার।
কিন্তু তাও সুখময় একটা আকর্ষণ অনুভব করল। সে বলল, ছবি না হয় আমি আঁকলাম, কিন্তু পঁচিশ বছর পরে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ হবে কী করে? 
আমিই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব, বললেন গণেশ মুৎসুদ্দি। আপনার এখনকার ঠিকানা আপনি আমাকে দিন, আমিও আমার ঠিকানা দিচ্ছি। যার ঠিকানা বদল হবে, সে অন্যকে জানাবে। এই ব্যাপারে যেন অন্যথা না হয়, নইলে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এইভাবে ঠিক পঁচিশ বছর পর আপনার পোর্ট্রেটটি সঙ্গে নিয়ে আমি আপনার সঙ্গে দেখা করব। যদি চেহারা মেলে তা হলে আপনি আরও পাঁচ হাজার পাবেন! না হলে অবশ্য টাকার আর কোনও প্রশ্ন উঠছে না; কিন্তু এটাও বুকুন যে, আপনার কোনও লোকসান হচ্ছে না, কারণ আপনার পারিশ্রমিক আমি এখনই দিয়ে দিচ্ছি। 
সুখময় একটু ভেবে বলল, আমি রাজি আছি। শিলং-এই কাজটা হবে তো? 
তা তো হতেই পারে। আমি এখানে আরও দশদিন আছি। তার মধ্যে আপনার পোর্ট্রেট হয়ে যাবে? 
পোর্ট্রেট করতে দিন পাঁচেকের বেশি লাগবে না। আমি আরও সাতদিন আছি। কালই শুরু করা যাবে তো! 
নিশ্চয়ই। 
কিন্তু এমন উদ্ভট প্ল্যান আপনার মাথায় এল কী করে? 
আমি মানুষটাই একটু রগুড়ে আর খামখেয়ালি। আমাকে যারা চেনে তারা আমার এদিকটা জানে। আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়নি, তাই আপনার কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে। 
আপনার বয়স এখন কত? 
সাঁইত্রিশ। পঁচিশ বছর পরে আমার বয়স হবে বাষট্টি। আপনি তো বোধহয় আমার চেয়ে ছোট? 
আমার বয়স পঁয়ত্রিশ, বলল সুখময়। 
আশা করি আমরা দুজনেই আরও পঁচিশ বছর