অনেকের মতে আর্যশেখর ছিলেন যাকে ইংরাজিতে বলে চাইল্ড প্রডিজি। তাঁর যখন দশ বছর বয়স তখন একদিন স্টেটসম্যান পত্রিকার প্রথম পাতায় নীচের দিকে এক লাইন লেখা তাঁর চোখে পড়ল–সান রাইজেজ টুডে অ্যাট সিক্স থার্টিন এ এম। আর্যশেখর কাগজ হাতে নিয়ে পিতা সৌম্যশেখরের কাছে উপস্থিত হলেন। 

বাবা। 

কী রে? 

কাগজে এটা কী লিখেছে। 

কী লিখেছে? 

ছটা বেজে তেরো মিনিটে সূর্য উঠবে। 

তা তো লিখবেই। সেই সময়ই তো সূর্য উঠেছে। 

তুমি ঘড়ি দেখেছিলে? 

ঘড়ি দেখতে হয় না। 

কেন? 

জানাই থাকে। 

কী করে? 

বিজ্ঞানের ব্যাপার। অ্যাস্ট্রনমি। 

আর যদি ঠিক সময় না ওঠে। 

ঘড়ি ভুল। 

যদি ভুল না হয়? 

তা হলে আর কী। তা হলে প্রলয়। 

সেদিন থেকে আর্যশেখরের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার সূত্রপাত। এর দুবছর পরে আবার আরেকটি প্রশ্ন নিয়ে আর্যশেখরকে পিতার কাছে যেতে হল। 

বাবা। 

হুঁ। 

চাঁদ আর সূর্য কি এক সাইজ?

দূর বোকা। 

তা হলে? 

সূর্য ঢের বড়। 

কত বড়? 

লক্ষ লক্ষ গুণ। 

তা হলে এক সাইজ মনে হয় কেন? 

সূর্য অনেক দূরে, তাই। 

ঠিক যতখানি দূর হলে এক সাইজ মনে হয়, তত দূরে? 

হুঁ। 

কী করে হল? 

জানি নে বাপু। আমি তো আর সৃষ্টিকর্তা বিধাতা নই। 

এখানে বলা দরকার, সৌম্যশেখর বৈজ্ঞানিক নন। তাঁর পেশা ওকালতি। বাপের সঙ্গে কথা বলে আর্যশেখর বুঝলেন চন্দ্র-সূর্যের আয়তন আপাতদৃষ্টিতে এক হওয়াটা একটা আকস্মিক ঘটনা। তাঁর মনে এই আকস্মিকতা প্রচণ্ড বিস্ময় উৎপাদন করল। পাঠ্যপুস্তকের কথা ভুলে গিয়ে তিনি বাপের আলমারি খুলে দশ খণ্ডে সমাপ্ত হার্মওসয়ার্থ পপুলার সায়েন্স থেকে গ্রহ নক্ষত্র সম্বন্ধে পড়তে আরম্ভ করলেন। বলা বাহুল্য, এ কাজে তাঁকে ঘন ঘন অভিধানের সাহায্য নিতে হয়েছিল। কিন্তু তাতে নিরুদ্যম হননি, কারণ কল্পনাপ্রবণতার সঙ্গে একাগ্রতার আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর চরিত্রে। 

তাঁর চতুর্দশ জন্মতিথিতে আর্যশেখর পিতার টেবিলের দেরাজ খুলে তিনখানা অব্যবহৃত ডায়রি বার করে তার মধ্যে সবচেয়ে যেটি বড় তার প্রথম পাতায় লিখলেন–আমার মতে সৌরজগতের অন্য কোনও গ্রহে প্রাণী থাকলেও তা মানুষের মতো কখনওই হতে পারে না, কারণ এমন চাঁদ আর এমন সূর্য অন্য কোনও গ্রহে নেই। যদি থাকত, তা হলে আমাদের মতো মানুষ সেখানে থাকত। কারণ আমার মতে চন্দ্ৰসূর্য আছে বলেই মানুষ মানুষ। 

এর পরের বছর আর্যশেখর হঠাৎ একদিন

খেলাচ্ছলে মুখে মুখে দুরূহ গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে শুরু করলেন। যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ তো আছেই, তা ছাড়া আরও আছে যা একেবারে উচ্চমান গণিতের পর্যায়ে পড়ে। যেমন আকাশে ঘূর্ণায়মান চিল দেখে তার গতির মাত্রা, মাটি থেকে তার উচ্চতা এবং তার বৃত্তপথের পরিধি নির্ণয় করে ফেললেন আর্যশেখর। গৃহশিক্ষক মণিলাল মজুমদার ছাত্রের এই অকস্মিক ব্যুৎপত্তিতে অপ্রস্তুত হয়ে চাকরি ছেড়ে দিলেন। সৌম্যশেখরও ছেলের এই কাণ্ডে যুগপৎ বিস্মিত ও পুলকিত হলেন। তাঁর এবং তাঁর কয়েকটি বন্ধু ও মক্কেলের উদ্যোগে ক্রমে শহরের বিশিষ্ট গণিতজ্ঞদের দৃষ্টি আর্যশেখরের প্রতিভার দিকে আকৃষ্ট হল। প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিতের অধ্যাপক জীবনানন্দ ধর নিজে এসে সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে আর্যশেখরকে নানারকম ভাবে পরীক্ষা করে তাঁকে দীর্ঘ প্রশংসাপত্র লিখে দিয়ে গেলেন। তিনি লিখলেন, মুখে মুখে গণিতের সমস্যা সমাধানে উত্তরকালে আর্যশেখর সোমেশ বসুকে অতিক্রম করে গেলে আমি আশ্চর্য হব না। আমি এই অলৌকিক প্রতিভাসম্পন্ন বালকের দীর্ঘজীবন কামনা করি। 

অতিরিক্ত আয়ের একটা সম্ভাবনা সামনে পড়লে অনেক অর্থবান ব্যক্তিও সহজে সেটাকে উপেক্ষা করতে পারে না। সৌম্যশেখরের অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল, সুতরাং পুত্রের অসামান্য প্রতিভার সাহায্যে আয়ের পথটা কিঞ্চিৎ সুগম করে নেবার পরিকল্পনা তাঁর পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। তবে ছেলেকে না জানিয়ে কিছু করার ইচ্ছা তাঁর ছিল না, তিনি আর্যশেখরকে ডেকে পাঠালেন। 

ইয়ে, একটা কথা ভাবছিলাম বাবা। 

কী? 

আমার তো জানিসই–মানে, আজকাল যা দিন পড়েছে–সেই অনুপাতে তো খুব একটা ইয়ে হচ্ছে –মোটামুটি চলে যায় আর কি। তা তোর যখন এমন একটা ইয়ে দেখা যাচ্ছে, সবাই বাহবা দিচ্ছে,

মানে এও তো ধর গিয়ে একটা ম্যাজিক! তা সেটা যদি আর পাঁচজনকে দেখাবার সুযোগ দেওয়া যায়–মানে বেশ ভাল একটা জায়গাটায়গা দেখে ভাল ব্যবস্থা-ট্যাবস্থা… 

বলতে বলতে এবং সেইসঙ্গে ছেলের ক্ষুব্ধ বিস্মিত ভাব দেখে সৌম্যশেখর নিজেই লজ্জা বোধ করলেন। কয়েক মুহূর্তের জন্য কথা থামিয়ে তারপর সুর পরিবর্তন করে বললেন, তোর যদি আপত্তি থাকে। 

তা হলে কোনও প্রশ্নই ওঠে না। 

তামাশা আর প্রতিভা এক জিনিস নয় বাবা। পিতার ব্যবহারে আর্যশেখরের মনে নতুন প্রশ্নের উদয় হল। এমন প্রতিভাবান পুত্রের এমন হীন মনোবৃত্তিসম্পন্ন বাবা হয় কী করে? পিতাপুত্রের চরিত্রের এই বৈপরীত্যই কি স্বাভাবিক, না এটা একটা ব্যতিক্রম? 

আর ব্যতিক্রমই যদি হয়, তা হলে তার বৈজ্ঞানিক কারণ কী? আর্যশেখরের অবসরের অভাব ছিল না, কারণ তাঁর গাণিতিক প্রতিভা প্রকাশ পাবার কিছুদিনের মধ্যেই সৌম্যশেখর তাঁকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন। এই অবসরে আর্যশেখর হেরিডিটি ও প্রজনন সম্পর্কে গম্ভীরভাবে অধ্যয়ন আরম্ভ করে দিলেন। অচিরেই তিনি জীবনের মাহাত্ম উপলব্ধি করলেন। মানুষের শরীরে কয়েকটি পরমাণুর মধ্যে তার নিজের এবং তার ঊর্ধ্বতম ও অধস্তন পুরুষ পরম্পরার আকৃতি ও প্রকৃতির নির্দেশ লুকিয়ে রয়েছে। কী আশ্চর্য! 

আর্যশেখর আরেকবার বাপের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। 

বাবা, আমাদের বংশলতিকা নেই? 

বংশলতিকা? কেন? 

আছে? 

থাকলেও তা উইয়ে খেয়েছে। কেন, তুই কি জাতিস্মর-টাতিস্মর হলি বলে মনে হচ্ছে? 

না, ভাবছিলাম, আমার পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ প্রতিভাবান ছিলেন কিনা। তোমার আর

ঠাকুরদাদার কথা তো জানি। তার আগে? 

সাতপুরুষের মধ্যে কেউ ছিলেন না, এ গ্যারান্টি দিতে পারি। তার আগের কথা জানি না। 

ঘরে ফিরে এসে আর্যশেখর চিন্তা শুরু করলেন। বাপের দিকে সাতপুরুষের মধ্যে কেউ নেই। মাতৃকুলেও তথৈবচবরং সেখানে সম্ভাবনা আরও কম। গুণের দিক দিয়ে নীহারিকা দেবী অত্যন্ত সাধারণ শ্রেণীর মহিলা। তিনি এখনও তাঁকে খোকা বলে সম্বোধন করেন বলে আর্যশেখর পারতপক্ষে তাঁর কাছে। ঘেঁষেন না। 

হেরিডিটির প্রভাব অনিশ্চিত। পরিবেশ? এনভায়রনমেন্ট? তেত্রিশ নম্বর পটুয়াটোলা লেন কি সেদিক দিয়ে খুব প্রশস্ত বলা চলে? বোধহয় না। তা হলে? 

কিন্তু শুধুমাত্র হিসেব দিয়েই কি সত্যিকার কিছু প্রমাণ হয়? বাবার বাবা তার বাবা করে বংশলতিকা জিনিসটাকে তো টেনে একেবারে সৃষ্টির আদিতে নিয়ে যাওয়া যায়। জিনের প্রভাব কি তখন থেকেই প্রবাহিত হয়ে আসছে না? কে জানে আজ থেকে বিশ হাজার বছর আগে আর্যশেখরের পূর্বপুরুষ কে বা কেমন ছিলেন! এমনও তো হতে পারে তিনি আলতামিরার গুহায় দেয়ালে বাইসনের ছবি এঁকেছিলেন। এইসব আদিম গুহা চিত্রকরদের জিনিয়াসের পর্যায়ে ফেলা যায় না? অথবা হরপ্পা মহেনজোদরোর মতো শহরের পরিকল্পনা করেছিলেন যাঁরা তাঁদের? অথবা বেদ উপনিষদের রচয়িতাদের? এঁদের মধ্যে কেউ যদি আর্যশেখরের পূর্বপুরুষ হয়ে থাকেন তা হলে আর চিন্তার কোনও কারণ থাকে না। কিন্তু তবু তাঁর মনটা খচখচ করতে লাগল। সৌম্যশেখরের মতো কল্পনা-বিমুখ বৈষয়িক-চিন্তাসর্বস্ব স্থূল ব্যক্তি যে তাঁর জন্মদাতা হতে পারেন, এর কোনও বৈজ্ঞানিক সমর্থন তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। 

ভাবতে ভাবতে সহসা একটি সম্ভাবনা এসে তাঁর মনে দুরমুশের মতো আঘাত করল। 

তিনি যদি জারজ সন্তান হয়ে থাকেন? যদি

সৌম্যশেখরের ঔরসে তাঁর জন্ম না হয়ে থাকে? 

কথাটা মনে হতেই আর্যশেখর বুঝলেন, এ প্রশ্নের উত্তর একমাত্র তাঁর বাবাই দিতে পারেন এবং সে উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত তাঁর শান্তি নেই। সত্যান্বেষণের খাতিরে পুত্র পিতাকে প্রশ্ন করবে, এটা আর্যশেখরের কাছে খুবই স্বাভাবিক বলে মনে হল। 

নশো চব্বিশ পৃষ্ঠার সুবৃহৎ ল ডাইজেস্টে নিমগ্ন সৌম্যশেখর পুত্রের প্রশ্ন প্রথমবার অনুধাবন করতে পারলেন না। 

যমজ সন্তান? কার কথা বলছিস? 

যমজ নয়, জারজ। আমি জানতে চাই আমি জারজ সন্তান কিনা। 

একথায় সৌম্যশেখরের ওষ্ঠদ্বয় বিভক্ত হল। তারপর তাতে কম্পনের আভাস দেখা দিল। তারপর সে কম্পন তাঁর সমস্ত দেহে সঞ্চারিত হল। তারপর তাঁর কম্পমান ডান হাত কাছে আর কিছু না পেয়ে একটি ভারী কাঁচের পেপারওয়েট তুলে আর্যশেখরের দিকে নিক্ষেপ করল। আর্যশেখর আনাদ করে রক্তাক্ত মস্তকে ভূলুণ্ঠিত হলেন। 

আরোগ্যলাভের পর বোঝা গেল আর্যশেখরের অলৌকিক গাণিতিক প্রতিভাটি নষ্ট হয়েছে। কিন্তু তাঁর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেল। 

.

আর্যশেখরের যখন উনিশ বছর বয়স, তখন একদিন সন্ধ্যায় গঙ্গার ধারে একটি শিরীষ গাছের নীচে উপবিষ্ট অবস্থায় বৃক্ষস্থিত কোনও পক্ষীর বিষ্ঠা তাঁর বাম স্কন্ধে এসে পড়ায় তিনি সহসা মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কে সচেতন হলেন। যথারীতি তিনি এ বিষয়ে অধ্যয়ন শুরু করলেন। তাঁর ধারণা ছিল নিউটনের আপেলের ঘটনাটা বুঝি কিংবদন্তি। প্রিন্সিপিয়াতে নিউটনের নিজের লেখায় সে ঘটনার উল্লেখ দেখে তাঁর ধারণার পরিবন হল। তাইকো ব্রাহি গ্যালিলিও থেকে শুরু করে কোপারনিকাস, কেপলর, লাইবনিৎস-এর রাস্তা দিয়ে ক্রমে

আর্যশেখর আইনস্টাইনে পৌঁছে গেলেন। আর্যশেখরের বিদ্যায় আইনস্টাইন জীর্ণ করা সম্ভব নয়, কিন্তু পাঠ্য-অপাঠ্য বোধ্যদুর্বোধ্য সবরকম পুস্তকই আদ্যোপান্ত পাঠ করার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল আর্যশেখরের। অবিশ্যি বর্তমান ক্ষেত্রে তাঁর পড়ার আগ্রহের একটা কারণ ছিল এই যে, তিনি জানতে চেয়েছিলেন মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কে শেষ কথা বলা হয়ে গেছে কিনা। আইনস্টাইন পড়ে এইটুকু তিনি বুঝলেন যে মাধ্যাকর্ষণ কী তা জানা গেলেও মাধ্যাকর্ষণ কেন, তা এখনও জানা যায়নি। তিনি স্থির করলেন, এই কের অম্বেষণই হবে আপাতত তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য। 

।সেইদিনই আর্যশেখর স্থির করলেন যে, তিনি যাবতীয় তুচ্ছ ঘটনার দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখবেন। অনেক আবিষ্কারের পশ্চাতেই যে নিউটনের আপেলের মতো একটি করে তুচ্ছ ঘটনা রয়েছে, এটা তাঁর জানা ছিল। 

দুঃখের বিষয়, প্রায় তিন মাস ধরে সহস্রাধিক তুচ্ছ ঘটনা লক্ষ করেও তিনি তাদের মধ্যে এমন কিছু দেখতে পেলেন না, যার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অনেক আগেই হয়ে যায়নি। অগত্যা আর্যশেখরকে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হল। উপলব্ধির আদিতে ধ্যান–এই বিশ্বাসে তিনি তাঁর বাড়ির তিনতলার ছাতে চিলেকোঠায় গিয়ে ধ্যানস্থ হতে মনস্থ করলেন। 

প্রথম দিনই–সেদিন ছিল রবিবার, ছাতে উঠে চিলেকোঠার তক্তপোশে বসে চক্ষু মুদ্রিত করার অব্যবহিত পূর্বে জানলা দিয়ে পাশের বাড়ির ছাতে একটি তুচ্ছ ঘটনা তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। প্রতিবেশী ফণীন্দ্রনাথ বসাকের সপ্তদশ বর্ষীয়া কন্যা ডলি বাহু উত্তোলন করে ধৌতবস্ত্র রজ্জুতে আলম্বিত করছে। এই দৃশ্যে মুহূর্তের মধ্যে আর্যশেখরের মন মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কিত এক আশ্চর্য নতুন জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। 

সাতদিনের মধ্যে ফুলস্ক্যাপ কাগজের একশো

তেত্রিশ পৃষ্ঠাব্যাপী একটি প্রবন্ধে তিনি তাঁর উপলব্ধি লিপিবদ্ধ করলেন। বর্তমান সংক্ষিপ্ত জবানিতে তার বিস্তারিত বিবরণ সম্ভব নয়, তবে তাঁর মূল বক্তব্য ছিল এই। মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব নিম্নগামী। মাধ্যাকর্ষণের মতো জীবনবিরোধী শক্তি সত্ত্বেও প্রাণ সৃষ্টি হল কী করে? তার কারণ সূর্য। কিন্তু সূর্যের প্রভাব চিরস্থায়ী নয়, পার্থিব মাধ্যাকর্ষণের নৈকট্য ও অবিরাম প্রভাব ক্রমে সূর্যের প্রভাবকে পরাভূত করে। ফলে প্রথমে জরার প্রকোপ এবং শেষে মৃত্যু এসে প্রাণশক্তিকে গ্রাস করে। শুধু যে জড়পদার্থেই এই দুই প্রভাবের পরস্পর বিরোধ দেখা যায় তা নয়; মানুষের কাজে, চিন্তায়, হৃদয়াবেগে, মানুষে মানুষে সম্পর্কে–সবকিছুতেই এটা বর্তমান। মানুষের যত হীন প্রবৃত্তি, সমাজের যত অনাচার অবিচার দুঃখ দারিদ্র যুদ্ধবিগ্রহ, সবই মাধ্যাকর্ষণজনিত। আর যা কিছু সুন্দর ও সতেজ, যা কিছু উন্নত, যা কিছু মঙ্গলকর, সবই সূর্যের প্রভাবে। মাধ্যাকর্ষণ আছে বলেই কোনওদিন পৃথিবীর কলঙ্ক দূর হবে না। অনেকদিন আগেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত–কিন্তু সূর্য তা হতে দেয়নি। ধ্বংসের পাশে সৃষ্টির কাজ চলে এসেছে আবহমান কাল থেকে। 

প্রবন্ধটি শেষ করে আর্যশেখর চিলেকোঠা থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে সূর্যের উদ্দেশে, তারপর প্রতিবেশী ডলির উদ্দেশে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন। ঠিক সেই সময় চাকর ভরদ্বাজ এসে বলল তাঁর বাপ নীচে ডাকছেন। 

সৌম্যশেখর কদিন থেকেই ছেলে সম্পর্কে চিন্তা করছিলেন। স্ত্রী নীহারিকার মৃত্যু হয়েছে গত বছর। ছেলের একটা হিল্লে দেখে যেতে পারলেন না বলে মৃত্যুশয্যায় তিনি আক্ষেপ করেছিলেন। 

হাতের কাগজ পাকিয়ে নিয়ে আর্যশেখর বাপের সামনে এসে দাঁড়ালেন 

তুই কী হচ্ছিস বল তো? সাপ না ব্যাঙ না বিচ্ছু? 

সেটা আমার জিনের স্বরূপ না বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে না।

কীসের স্বরূপ? 

জিন। 

তোর তো অর্ধেক কথার মানেই বুঝি না। 

সবাই তো সবকিছু বোঝে না। আমি কি ওকালতির কিছু বুঝি? 

আমার ওকালতির জোরে খাচ্ছ সেটা বোঝো তো? তবে তোমার যা বয়স তাতে বসে বসে বাপের পয়সায় খাওয়াটায় কোনও বাহাদুরি নেই। কাজেই ওসব জিনফিন বলতে এসো না আমার কাছে। তুমি ছাতের ঘরে বসে যাই করো না কেন, এটা জেনে রেখো যে, আর পাঁচটা বাউণ্ডুলে বখাটে বেকারের সঙ্গে তোমার কোনও প্রভেদ নেই। আর এক বছর সময় দিলাম। তার মধ্যে যা তোক একটা চাকরি দেখে নেবে। ডিগ্রি-ফিগ্রি যখন হল না তখন বেশি কিছু আশা করি না আমি। তবে স্বাবলম্বী তোমায় হতে হবে। তারপর অন্য কাজ। 

অন্য কী কাজ? 

বংশবৃদ্ধির কথাটাও তো ভাবতে হবে। না কি তুমি বিয়ে করবে না বলে ঠিক করেছ? 

হ্যাঁ। করবে না? 

না। কেন, সেটা জানতে পারি? প্রথমত, আমার প্রজনন ক্ষমতা সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। সৌম্যশেখরের বিষম লাগল। আর্যশেখর তাঁকে প্রকৃতিস্থ হবার সময় দিলেন। দ্বিতীয়ত, আমার জীবনের মধ্যাহ্নে যখন সূর্যের প্রভাব সবচেয়ে প্রবল, তখন আমার কাজ ও চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটে এটা আমি চাই না। 

তুই কি কোনও ধর্মে-টর্মে দীক্ষা নিয়েছিস নাকি? 

তা বলতে পারো। 

কী ধর্ম? 

সেটা আমার ব্যক্তিগত ধর্ম। নামকরণ এখনও হয়নি। 

মুহূর্তকালের জন্য সৌমশেখরের আশা হয়েছিল যে, তিনি বুঝি পুত্রের রহস্য উদঘাটন করতে পেরেছে। এখন বুঝলেন, সেটা ঠিক না। কিছুক্ষণ

তিনি ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন। বিশেষ করে তার চোখের দিকে দৃষ্টিতে পাগল হবার কোনও লক্ষণ আছে কি? সৌম্যশেখরের প্রপিতামহ শেষজীবনে উন্মাদ হয়ে এক মহাষ্টমীর দিন উলঙ্গ অবস্থায় গ্রামসুদ্ধ লোকের সামনে পূজামণ্ডপে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। আর্যশেখরকে এ ঘটনা তিনি কখনও বলেননি। সৌম্যশেখরের মনে পুত্র সম্বন্ধে একটা স্নিগ্ধ করুণার ভাব জেগে উঠল। হাজার হোক একমাত্র ছেলে, সবেধন নীলমণি। যা করছে করুক–বেঁচে থাকলেই হল। আর মাথাটা খারাপ না হলেই হল! 

ঠিক আছে। তুমি এসোখন। 

আর্যশেখর প্রবন্ধটি লিখেছিলেন ইংরাজিতে–কারণ এ জাতীয় লেখার কদর কোনও বাঙালি পাঠক করবে একথা তিনি বিশ্বাস করেননি। এবার তিনি সৌম্যশেখরের পুরনো রেমিংটনের সাহায্যে অপটু হাতে অনেক পরিশ্রমে প্রবন্ধটির চার কপি টাইপ করলেন। শেষ হলে পর তিনি অনুভব করলেন, তাঁর হাত-পা কোমর-পিঠে টান ধরে ব্যথা হয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া একটানা ঘরের মধ্যে থেকে-থেকে দমও প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। 

আর্যশেখর হাত থেকে নেমে এলেন। গোলদিঘির ধারে একটু হেঁটে আসবেন মনে করে বাড়ি থেকে বেরোতেই দেখলেন, গেরুয়া পাঞ্জাবি পায়জামা পরিহিত শ্মশ্রুগুলম্বাকেশবিশিষ্ট একটি শ্বেতাঙ্গ যুবক তাঁর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক চেয়ে দেখছে। 

আর্যশেখরকে দেখে যুবক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল মহাবোধি সোসাইটির অবস্থানটা তাঁর জানা আছে কিনা। আর্যশেখর বললেন, চলো তোমায় আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। আমি ওদিকেই যাচ্ছি। 

যাবার পথে আর্যশেখর যুবকের পরিচয় পেলেন। তাঁর নাম বব গুডম্যান। নিবাস টোলিডো ওহায়ো। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনো ত্যাগ করে ভারতবর্ষে এসেছেন প্রেম ও আলোর সন্ধানে।

আর্যশেখরের ছেলেটিকে ভাল লাগল। সেইদিনই রাত্রে তাঁকে তাঁর প্রবন্ধটি পড়তে দিলেন। বললেন, তুমিই প্রথম আমার এ লেখা পড়ছ। তোমার মন্তব্য জানার আগ্রহ রইল। 

.

পরদিন সকালে গুডম্যান ফুলস্ক্যাপের তাড়া ঝোলায় নিয়ে চিনাবাদাম খেতে খেতে এসে বললেন–ইটস্ গ্রেট, গ্রেট। ইয়্যা–ইউ গট সামথিং দেয়ার–ইয়্যা। 

আর্যশেখর চাপা গলায় তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়ার পর গুডম্যান বললেন, কিন্তু তোমার লেখায় এত পেসিমিজম কেন? মাধ্যাকর্ষণকে পরাস্ত করার কত উপায় তো তোমার দেশেই রয়েছে। তুমি লেভিটেশনের কথা জানো না? তোমাদের দেশের যোগী পুরুষদের কথা তুমি জানো না? 

গুডম্যান এবার তাঁর ঝোলা থেকে একটি কাগজের মোড়ক বার করে আর্যশেখরের হাতে দিলেন। মোড়ক খুলে দেখা গেল তাতে রয়েছে একটি চারচৌকো চিনির ডেলা। অন্তত দেখলে তাকে চিনি বলেই মনে হয়। গুডম্যান বললেন, এটা সুগার কিউবই বটে, কিন্তু এর মধ্যে এককণা অ্যাসিড রয়েছে। মাধ্যাকর্ষণকে জব্দ করার মতো এমন জিনিস আর নেই। তুমি খেয়ে দেখো। নানান প্রতিক্রিয়া হবে–ভয়। পেয়ো না। আমার মনে হয় এটা খেলে পর তোমার মন থেকে পেসিমিজম দূর হয়ে যাবে। 

গুডম্যান প্রদত্ত মোড়কটি হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরে আর্যশেখর সটান চলে গেলেন তিনতলার ছাতে। আশ্বিনের অপরাহে স্নিগ্ধ পড়ন্ত রোদে মাদুরে বাবু হয়ে বসে তিনি চিনির ডেলাটি মুখে পুরে চিবোতে আরম্ভ করলেন। 

কয়েক ঘণ্টা কিছুই হল না। তারপর এক সময়ে আর্যশেখর অনুভব করলেন তিনি সূর্যের দিকে উখিত হচ্ছেন। এক অনির্বচনীয় মাদকতায় তাঁর দেহমন আচ্ছন্ন হল। নীচের দিকে চেয়ে দেখলেন ধূলি-ধূধূসর। কলকাতা শহরকে তেহেরানের

গালিচার মতো বর্ণাঢ্য ও মনোরম দেখাচ্ছে। মাথার উপরের আকাশ সর্পিল। গতিবিশিষ্ট অজস্র বিচিত্র বর্ণখণ্ডে সমাকীর্ণ। আর্যশেখর বুঝলেন সেগুলো ঘুড়ি, কিন্তু এমন ঘুড়ি তিনি কখনও দেখেননি। একটি বর্ণখণ্ড তাঁর দিকে এগিয়ে এল। আর্যশেখর পরম আত্মীয়তাবোধে বাহু সম্প্রসারিত করে সেই বর্ণখণ্ডের দিকে নিজেকে নিক্ষেপ করলেন। তারপর তাঁর আর কিছু মনে নেই। 

ডাক্তার বাগচির নির্দেশমতো ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে মিহিজাম যাবার আগে আর্যশেখর একজন পেশাদার টাইপিস্টকে দিয়ে তাঁর মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কিত প্রবন্ধটি পঞ্চাশ কপি টাইপ করিয়ে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশের বাছাই করা বিজ্ঞানী ও মনীষীদের পাঠালেন। এই ভাগ্যবানদের মধ্যে একজনের উত্তর মিহিজাম যাবার ঠিক আগের দিন আর্যশেখরের হস্তগত হল। ইংল্যান্ডের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত পদার্থবিদ প্রফেসার কারমাইকেল প্রবন্ধের জন্য ধন্যবাদ দিয়ে লিখেছেন–আই ফাউড ইট মোস্ট ইন্ট্রিগিং। 

মিহিজাম পর্বের ঘটনা সংক্ষিপ্ত, সুতরাং তার বিবরণও সংক্ষিপ্ত হতে বাধ্য। 

১৯শে অক্টোবর–অর্থাৎ মিহিজাম পৌঁছবার পরের দিন আর্যশেখর ডায়রিতে লিখলেন–পাখি পাখি পাখি পাখি। পাখি ইজ পাখি। মোস্ট ইন্ট্রিগিং; সূর্যের সবচেয়ে কাছে যায় কোন প্রাণী? পাখি। ও বার্ড, হাউ ইয়োর ফ্লাইট ক্লাউটস মাধ্যাকর্ষণ! 

২রা নভেম্বর চাকর ভরদ্বাজ দেখল আর্যশেখর কোত্থেকে জানি একটা বাবুইয়ের বাসা নিয়ে এসে বিছানার উপর পা ছড়িয়ে বসে গভীর মনোযোগে বাসার বুনন-পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করছেন। 

পরের দিন আর্যশেখর নিজেই খড়কুটো সংগ্রহ করে এনে নিজের হাতে একটি বাবুইয়ের বাসা তৈরি করতে শুরু করলেন। সেদিন রাত্রে তাঁর ডায়রিতে লেখা হল– 

ম্যানস হাইয়েস্ট অ্যাচিভমেন্ট উড বি টু রাইজ টু

দ্য লেভেল অফ বার্ডস। 

১৩ই নভেম্বর বাবুর ফেরার দেরি দেখে ভরদ্বাজ তাঁকে খুঁজতে বেরোলো। আধঘণ্টা খোঁজার পর আর্যশেখরকে সে পেল অজ্ঞান অবস্থায় ধানখেতের পাশে একটি বাবলা গাছের নীচে। গাছে একটি কাঁটার সঙ্গে বাঁধা তৈরি বাবুইয়ের বাসা। 

স্থানীয় ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন, সানস্ট্রোক। সৌম্যশেখর কলকাতা থেকে চলে এলেন। তিনদিন ঘোর বিকারের পর পিতা ও ভৃত্যের সামনে আর্যশেখরের মৃত্যু হল। 

শেষনিশ্বাস ত্যাগ করার ঠিক আগে একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন আর্যশেখর–মাগো! 

------

শারদীয়া অমৃত ১৩৭৫