NYANY(ন্যানি) by Trijit kar ত্রিজিৎ কর


// ১ //


-" বাবা রে! এদিকটা তো খুব কুয়াশা! গাড়ি চালাতে পারবেন?"- জানলার বাইরে দিয়ে তাকিয়ে একটু উদ্বিগ্ন স্বরেই জিজ্ঞেস করলাম।


-" এ তো কিছুই না ম্যাডাম! বৃষ্টি হলে ভোরের দিকে এর চেয়েও ঘন কুয়াশা হয়। এমন কুয়াশা যে আপনার এক হাত দূরের জিনিসও দেখতে পাবেন না!"- এরিক গাড়ির কাঁচ তুলে দিয়ে একটা বেশ মোটা সিগারেট ধরালো। তারপর গাড়ির সামনের কাঁচে চোখ রেখে একবার আড় চোখে আমায় দেখল। 


-" কি যেন নাম আপনার?"-  এরিকের চোখের দৃষ্টি বড্ড ধারালো। আমায় পুরো দস্তুর একবার মেপে নিচ্ছে। আদৌ ওরা যাকে কন্ট্যাক্ট করেছিল সে আমিই কি না! 


-" আমি ঐশী। ঐশী চক্রবর্তী। আপনারা যে নার্সিং সেন্টারে ফোন করেছিলেন। আমাকে ওখান থেকেই পাঠানো হয়েছে। আইডি কার্ড দেখতে চান কি?"


-" নো নো ইটস ওকে, ইটস ওকে। বাড়ি গিয়ে সেসব দেখে নেওয়া যাবে। ইউ আর বেঙ্গলি রাইট? মাই ওয়াইফ ইস্ অলসো বেঙ্গলি। বেঙ্গলি গার্লস আর সুইট।" - সামনের কাঁচে আমার দিকে তাকিয়ে একটা হালকা মাদকীয় গলায় কথাটা বলল এরিক। মধ্য তিরিশের ছিমছাম, ফর্সা, সুদর্শন এই আমেরিকান পুরুষটির কথার মধ্যে কি অন্য কোনো ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে? কে জানে! আমি এর কোনো উত্তর দিলাম না। 


গাড়ির ঝাপসা হয়ে আসা কাঁচ দিয়ে বাইরের জঙ্গল ঘেরা রাস্তার দিকে চোখ রাখলাম। আমেরিকার টেক্সাসের নাম আপনারা শুনেছেন বোধহয়? সেই টেক্সাস যেখানে বহু বছর আগে চেইনস'র সেই কুখ্যাত সিরিয়াল কিলিংগুলো ঘটেছিল। সেই টেক্সাস থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার পার করে এই ছোট্ট নিরালা শহর। 


যদিও আদৌ এটাকে শহর বলা উচিৎ কি না জানি না! তবে ছোটখাটো একটা ভিলেজ নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে। আমেরিকার মত ধোপদুরস্ত দেশেও যে এমন সব নিরালা, চির সবুজের মখমলে ঘেরা, শান্ত জনপদ আছে ভাবাও যায় না। শহরটার নাম "মিস্ট"। কি একটু অবাক হলেন, তাই না! আমিও হয়েছিলাম। ভারী অদ্ভুত না নামটা? সেই জন্ম থেকেই এ দেশে আছি, অথচ কুয়াশার নামে শহরের নাম হতে পারে এমন কখনও শুনিনি। এই শহর, এই শহরের নাম সবটাই যেন এক রহস্যময় কুয়াশায় ঘেরা।


-" আপনি কি জন্ম থেকেই এখানে নাকি আগে ইন্ডিয়াতেই থাকতেন?"- এরিকের সিগারেট প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। অবশিষ্ট অংশটুকুতে টান মারতে মারতে সেও দেখলাম বাইরের কুয়াশা ঢাকা জঙ্গলের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।


-" উঁহু আমি বর্ন এন্ড ব্রট আপ এখানেই। বাবা ইন্ডিয়ান, মা এ দেশের। আলব্যামায় থাকি। বাবা এদেশে এসেছিলেন কাজের সূত্রে, তারপর বিয়ে করে আর দেশে ফেরেননি। বাবার কাছে ইন্ডিয়ার কথা অনেক শুনেছি , বাট যাওয়া হয়নি কখনও!"


এরিক এবার গাড়ির কাঁচ নামিয়ে সিগারেটটা বাইরে ছুড়ে ফেলল।


-" আই সি! এখান থেকে ঘন্টা তিনেকের পথ। আপনি চাইলে ঘুমিয়ে নিতে পারেন। এতটা ট্রেন জার্নি করে এসেছেন।"- এরিক এবারে গাড়িতে স্টার্ট দিল। সঙ্গে সঙ্গেই গাড়িটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। ঠিক যেন একটা বড়সড় জীব দীর্ঘক্ষণ ঘুমানোর পর এবার গা ঝাড়া দিয়ে আবার যাত্রার জন্য তৈরি হচ্ছে।


-" ইটস ওকে। আমার এখন ঘুম পাচ্ছে না। ঘুম পেলে ঘুমিয়ে পড়ব। আসলে জায়গাটা এত সুন্দর। ছিমছাম, নিরিবিলি। পুরো পথটা দেখতে দেখতে যেতে ভীষণ ইচ্ছে করছে।"


অদ্ভুতভাবে আমার এই কথাটা শোনার পর এরিক শুধু মিটিমিটি হাসলো। তারপর গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, " দেখুন কতক্ষণ জাগতে পারেন! এই পথ কেউ পুরোটা দেখতে পারে না!" কথা শেষ করে ফের সেই মিটিমিটি হাসি। 


-" মানে?"


আমার কণ্ঠের অস্বস্তিটা বোধহয় এরিক খানিকটা আন্দাজ করতে পেরেছে বলে মনে হল। ভীষণ স্মার্টভাবে প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দিল ও, 

-" আরে আমি তো জাস্ট মজা করছিলাম। ডোন্ট টেক ইট সিরিয়াসলি! আপনি বরং রেস্ট নিন, আর আপনাকে এসব বলে বিরক্ত করব না।" 


সেই ভালো। আমিও আর কথা বাড়াতে চাইছি না। গাড়ি ইতিমধ্যেই চলতে শুরু করেছে। এতক্ষণ টের না পেলেও, এখন বেশ বুঝতে পারছি সারারাত জেগে নাইট জার্নির ফলে শরীরটা এখন একটু অবসন্ন লাগছে। যদিও যে পথ দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলেছে তা আমার অবসন্নতা জুড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।


 গাড়িটা যতই শহরের ভিতরে ঢুকছে ততই রাস্তা যেন ক্রমশ সরু হয়ে যাচ্ছে, আর দুই ধার দিয়ে গাড়িটাকে জাপটে ধরার জন্য এগিয়ে আসছে ঘন গভীর জঙ্গল। জঙ্গলের ওপর ধোঁয়ার মত ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা কুয়াশার আস্তরণ। এতই ঘন কুয়াশা যে একহাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। 


বাইরের কুয়াশা মাখা ঘন জঙ্গল দেখতে দেখতে প্রায় চোখটা লেগেই এসেছিল আচমকা মাঝরাস্তায় গাড়ি থামার ঝাঁকুনিতে নড়ে চড়ে বসলাম। মাঝরাস্তায় হঠাৎ করে গাড়ি কেন থামল তা জিজ্ঞেস করতে যাব তার আগেই গাড়ির বাইরে কুয়াশা ভেদ করে এক বৃদ্ধার অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠল। বৃদ্ধার লালচে কমলা চুলগুলি ঘাড় পর্যন্ত ছাটা, মুখে অজস্র বলিরেখা। বৃদ্ধা একটা লালচে কোট জাতীয় কিছু পরেছেন, কাঁধে একটা সবজে রঙের ঝোলা ব্যাগ।


বৃদ্ধাকে দেখে এরিকের মুখটা আচমকাই কঠিন হয়ে উঠল। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে স্থানীয় ভাষায় বিরক্তির সঙ্গে কিছু একটা বলল মহিলাকে। মহিলাটিও সেই ভাষায় উত্তেজিত হয়ে কি যেন বললেন। আমি ছাই এইসব নেটিভ ল্যাঙ্গুয়েজ কিছুই বুঝি না। বোকার মত দুজনের মুখের দিকে হাঁ করেই চেয়ে আছি। কি কথা হচ্ছে বুঝতে পারছি না, তবে কোনো একটা বিষয়ে যে কথা কাটাকাটি চলছে এটা বুঝতে পারছি।


একসময় এরিক বিরক্ত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল-" লিফট চাইছে। আপনার কোনো অসুবিধা নেই তো?" 


-" না না, আমার কোনো অসুবিধা থাকবে কেন!"


-" বেশ। বাট এর সঙ্গে বেশি কথা বাড়াবেন না। এর মাথায় একটু গন্ডগোল আছে।"- এরিক আমাকে সতর্ক করে বৃদ্ধার দিকে ফিরল। তারপর স্থানীয় ভাষায় ফের একবার ধমকে উঠল। বৃদ্ধাও স্থানীয় ভাষায় কিছু একটা গজগজ করতে করতে গাড়িতে এসে উঠলেন। তারপর আমার পাশে বসে আমার দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত হাসি হাসলেন। এরপর নিজের মনেই নিজের সঙ্গে নেটিভ ভাষায় কি যেন বিড়বিড় করতে লাগলেন।


 কে জানে কেন! বৃদ্ধাকে আমার ঠিক সুবিধার মনে হল না। এরিকও দেখলাম বেশ বিরক্ত। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ির গতি আগের চাইতে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিল। ভাবটা এমন, যত তাড়াতাড়ি এই আপদকে বিদায় করা যায় তত ভালো!


এদিকে আকাশ আরও কালো করে এসেছে। যত এগোচ্ছি ততই যেন চারিদিকে জঙ্গলের পরিমাণ বাড়ছে। একসময় রাস্তার দু ধারে থাকা গাছগুলো তাদের বিশাল বিশাল ডালপালা দিয়ে মাথার ওপরের আকাশটাকে এমনভাবে ঢেকে দিল, যে এই ভর সকালবেলাতেও মনে হল পৃথিবীর বুকে কুয়াশা গায়ে জড়িয়ে ধূসর সন্ধ্যে নেমে এসেছে। 


বাইরের প্রকৃতি দেখতে দেখতে একমনে এইসব ভাবছি, আচমকাই মনে হল পাশের থেকে কেউ একজন আমায় ফিসফিস করে ডাকছে। সেদিকে ফিরতেই দেখি পাশের বৃদ্ধা এইবার অদ্ভুতভাবে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ইনিই কি আমায় ডাকছিলেন? আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই তিনি নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে আমায় চুপ করার ইশারা করলেন। আর তারপরই একবার আড় চোখে এরিকের দিকে তাকিয়ে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের ভিতর হাতটা ঢোকালেন। 


এই বুড়ি ঠিক কি করতে চাইছে  কিছু বুঝে উঠবার আগেই দেখলাম উনি ওনার ব্যাগ থেকে একটা পুতুল বের করলেন। হ্যাঁ ওটা পুতুলই তো...একটা মেয়ে পুতুল। কিন্তু জিনিসটা ঠিক যেন স্বাভাবিক পুতুলের মত না। পুতুলটার হাত আর পা গুলো কেমন যেন বেশিই লম্বাটে! চোখদুটোও স্বাভাবিকের থেকে বেশ বড়। পুতুলটার ডান হাতে কি একটা ছোট মত জিনিস ধরে রয়েছে। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত যা, তা হল পুতুলটার হাসি। হঠাৎ দেখলে মনে হবে পুতুলটা যেন আপনার দিকে তাকিয়েই হাসছে। আর হাসিটা না ঠিক কেমন একটা যেন... ঠিক নরম্যাল না, কেমন একটা অ্যাবনরম্যাল ধরণের হাসি। কে জানে কেন  পুতুলটার এই হাসিটা দেখেই আমার ভিতর ভিতর কেমন একটা অদ্ভুত অস্বস্তি শুরু হল। 


বৃদ্ধা দেখলাম পুতুলটাকে নিজের মুখের সামনে ধরে নেটিভ ভাষায় কিসব যেন বলছেন ফিসফিস করে। যদিও আমি তার বিন্দু বিসর্গ কিছুই বুঝতে পারছি না। এইরকম বলতে বলতেই হঠাৎ কি হল, বৃদ্ধা একরকম আমার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। তারপর ঠিক আমার মুখের সামনে পুতুলটা নাড়াতে নাড়াতে আবারও ফিসফিস করে কি যেন বলতে লাগলেন। তবে এইবার আমি হঠাৎ খেয়াল করলাম বৃদ্ধা এখন আর দুর্বোধ্য নেটিভ ভাষায় কোনো কথা বলছেন না। বরং তিনি কথা বলছেন বিশুদ্ধ ইংরেজিতে! তিনি এইবার আচমকাই আমাকে ধরে প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন,


 -"ইউ...ইউ ইয়াং লেডি... ডোন্ট পুট অফ দা লাইটস...আদারওয়াইজ শি উইল কাম..."


কথাগুলো শুনতে শুনতে লক্ষ্য করলাম বৃদ্ধার চোখে মুখে ক্রমশ কালো মেঘের মত জমাট বাঁধছে একটা আদিম অকৃত্রিম ভয়। কিন্তু কেন! কেন আচমকা এই বৃদ্ধা গাড়িতে উঠে আমায় এইসব কথা বলছেন! আমি কিছু বুঝে উঠবার আগেই আচমকা প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়িটা থেমে গেল।


তারপরের মুহূর্তেই খেয়াল করলাম সামনের দরজা খুলে এরিক হন্তদন্ত হয়ে গাড়ির থেকে নেমে পড়ল। তারপর প্রচন্ড জোরে নেটিভ ভাষায় চিৎকার  করতে করতে পিছনের দরজা খুলে গাড়ির থেকে টানতে টানতে বের করল বৃদ্ধাকে। বৃদ্ধাও দেখলাম এইবার প্রচন্ড জোরে চিৎকার করতে লাগলেন। কথাবার্তার সুর শুনেই বুঝতে পারলাম দুজনেই দুজনকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করছে!


 এইবার আচমকা কথার মাঝখানেই গাড়িতে উঠে এসে দড়াম করে দরজাটা লাগিয়ে লাগিয়ে দিল এরিক। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই সেই বৃদ্ধা প্রায় প্রেতের মত আছড়ে পড়ল গাড়ির কাঁচের ওপর। তারপর শিশিরমাখা গাড়ির কাঁচে আঙুল বুলিয়ে কি যেন লিখতে লাগল অদ্ভুত দ্রুততার সঙ্গে। 


এরিক আর দেরি করল না। প্রায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হাওয়ার বেগে গাড়ি ছুটিয়ে দিল। পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম জঙ্গলের পথে একলা দাঁড়িয়ে বৃদ্ধা এখনও পুতুলটা হাতে তুলে ধরে পাগলের মত নাড়িয়ে চলেছেন আর চিৎকার করে চলেছেন। ঘন কুয়াশা আর জঙ্গলের পথে তার অবয়ব ক্রমশ ছোট হতে হতে একসময় মিলিয়ে গেল পথের বাঁকে।


-" সরি ফর দা ডিস্টারবেন্স। আমারই ভুল হয়েছে ওকে গাড়িতে তোলা। মাথাটা পুরোই পাগল হয়ে গেছে। ব্লাডি বিচ!"- এরিক এখনও রাগে ফুঁসছে।


-" ইটস ওকে। আর কতক্ষণ?"- আমি জিজ্ঞেস করলাম।


-" এখনও দেড় ঘন্টা।"


দেড় ঘন্টা! এখনও! হতাশ মুখে গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাতে যাবো এমন সময় প্রায় ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম। অবাক হয়ে দেখলাম, জানলার কাঁচে শিশিরের মধ্যে সেই বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে দাগ কেটে গোটা গোটা ইংরেজি অক্ষরে লিখে রেখে গেছে একটা অদ্ভুত শব্দ,


" ন্যানি" !


// ২ //


- " ঐশী...ঐশী...উঠে পড়ুন! আমরা চলে এসেছি!"-এরিকের গলার আওয়াজে ঘুমের রেশটা কেটে গেল।


-" এ বাবা! কখন চোখ লেগে গেছে দেখেছেন। খেয়ালই করিনি। ভাবলাম পুরো রাস্তাটা জেগে থাকবো..."


হাই তুলতে তুলতে গাড়ির থেকে নেমে পড়লাম। হাতের রেডিয়াম ঘড়িতে সময় দেখলাম বেলা সাড়ে এগারোটা। এই সাত সকাল বেলাতেই এখানে চারিদিকে কেমন একটা যেন অন্ধকার ঝিম ধরা ভাব। গাছে গাছে হাওয়া বইছে না, দূরে কোনো পাখিদের কলকাকলি শোনা যাচ্ছে না। শুধু বিরাট লম্বা লম্বা গাছগুলো কুয়াশার চাঁদরে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। পুরো জায়গাটাই যেন অস্বাভাবিক রকমের নিস্তব্ধ।


-" মাই গুডনেস, আপনারা এখানে থাকেন কী করে? সকাল এগারোটাতেই এই পরিবেশ। রাত নামলে কি হবে কে জানে!"- জঙ্গলের ভিতর একটি সরু পথ ধরে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।


-" এই শহরটা এরকমই। অনেক দূরে দূরে একেকটা বাড়ি। তাও জঙ্গলের মধ্যে। আমরা এখানে একান্ত দরকার ছাড়া রাতে কেউ বেড়াই না। বুঝতেই পারছেন রাত বিরেতে জঙ্গলে নানা রকম ভয় আছে..."- শেষ কথাগুলো বলার সময় এরিক একবার পিছন ফিরে দেখল আমায়। ওর চোখে মুখে সেই রহস্যময় হাসি। আচ্ছা এরিক কি আমায় ইচ্ছে করে ভয় দেখাচ্ছে! কিন্তু কেন? এটাও কি একরকমের মজা!


-" নাও দিস ইস্ আওয়ার হোম। ওয়েলকাম ম্যাডাম!"- হাটতে হাটতে কি এক অদ্ভুত চিন্তায় হারিয়ে গেছিলাম, হঠাৎ এরিকের কথা শুনে চমকে উঠলাম। সামনে তাকাতেই দেখি জঙ্গলের মধ্যে একটা বিরাট দোতলা কাঠের বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটার বেশ পুরোনো দিনের, তবে নিয়মিত দেখভালের দরুণ বাড়িটা এখনও বেশ জেল্লাদার। বাড়ির সামনের দরজাটা অস্বাভাবিক লম্বা। তারপাশে একটা লাল সাইনবোর্ড। তাতে খোদাই করে লেখা " অ্যান্ডারসন ম্যানশন"!


বাড়ির ভিতরটাও বেশ বড়, সুন্দর ও ছিমছাম। বাড়িতে ঢুকেই এরিক ওর স্ত্রী মৌসুমীর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিল। এই মৌসুমীর দেখভাল করার জন্যই আমায় এখানে আনা হয়েছে। মাস কয়েক আগে কোনো একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় নাকি মৌসুমীর কোমরের নিচ থেকে পুরোটাই প্যারালাইজড হয়ে যায়। তারপর থেকে সে এই বিছানাতেই বন্দী। এখানেই খাওয়া শোওয়া, এখানেই যাবতীয় যা কিছু। মৌসুমী দেখলাম খুব একটা মিশুকে নয়। যথা সামান্যই দায় সাড়াভাবে কথা বলল আমার সঙ্গে।  


যাইহোক আমার কাজপত্র এরিকের থেকে সবটা বুঝে নিলাম। তারপর এরিক দোতলায় আমায় আমার ঘরটা দেখিয়ে দিল। এই দোতলাটা কিন্তু একতলার মত অতটা বড় না। দুটো মোটে ঘর। একটায় থাকবো আমি আরেকটায় এরিকের দুই ছেলে মেয়ে, রণ আর এডা। দুজনকে ডেকেই এরিক আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। রণ পড়ে ক্লাস এইটে আর এডা ক্লাস সেভেন। এরিকের সামনে দুজনের কেউই দেখলাম আমার সঙ্গে কথা বলার বিশেষ কোনো আগ্রহ দেখালো না। যদিও এডাকে দেখে মনে হল মেয়েটা কিন্তু বেশ মিশুকে। হয়তো বাবার সামনে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে।


যাইহোক আমার ঘরটা কিন্তু আমার বেশ পছন্দ হল। একজনের পক্ষে বেশ বড় ঘরটা। ঘরে আসবাব পত্রও তেমনকিছু নেই। শুধু একধারে একটা বিছানা আর একটা ছোট্ট কাঠের আলমারি। বিছানার পাশের জানলাটা দিয়ে লক্ষ্য করলাম বাড়ির সামনের জঙ্গলঘেরা পথটা সলজ্জ ভঙ্গিতে উঁকি দিচ্ছে। আরেকটা অদ্ভুত জিনিসও খেয়াল করলাম। অবশ্য এ বাড়িতে ঢুকতেই ব্যাপারটা খেয়াল করেছি। এ বাড়ির সব ঘরগুলোর দরজাই অস্বাভাবিক রকমের লম্বা, একেবারে সিলিং ছুঁই ছুঁই। আমার ঘরের দরজাটাও এর ব্যতিক্রম নয়। যদিও এর কারনটা অবশ্য বুঝতে পারলাম না।


এরিক আমায় রেস্ট নিতে বলে নীচে চলে গেল। এর কয়েক মিনিট পরেই আমার দরজায় একটা বাচ্চা মেয়ের মিষ্টি কন্ঠস্বর পাওয়া গেল-" মে আই কাম ইন?"


যা ভেবেছি ঠিক তাই। এডা। আমি হাসলাম।

-" নিশ্চয়ই, ভিতরে এসো।"


-" হাই আমি এডা। তুমি তো মমের নতুন নার্স। তোমায় কী বলে ডাকবো?" এডার বাচনভঙ্গি বয়স আন্দাজে বেশ স্মার্ট। 


-" উমমম...কল মি সুইটহার্ট। ওকে?"- আমি চোখ টিপলাম।


এডা দেখলাম আমার কথায় খুব মজা পেয়েছে। খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপর নিজে থেকেই আমার বিছানার ওপর বসে বলল-" আচ্ছা বেশ, তোমায় সুইটহার্ট বলেই ডাকবো। আমার সঙ্গে রোজ স্নেক এন্ড ল্যাডার খেলতে হবে কিন্তু। রাজি?"


-" রাজি। তবে তোমার মা যখন ঘুমাবেন তখন। তোমার মা অসুস্থ না, সবসময় তো খেলতে পারব না।"


মা অসুস্থ হওয়ার কথাটা শুনে এডার চোখে মুখে একটা অদ্ভুত অস্বস্তির ছাপ ফুটে উঠল যেন। আহা রে!বাচ্চা মেয়েটা বোধহয় মায়ের অসুস্থ হওয়াটা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। আমি সঙ্গে সঙ্গে কথা পাল্টালাম।


-" চিন্তা করো না এডা, মম ঠিক হয়ে যাবে। দেখো।"


এডা এবার একটু হাসল। 


-" আচ্ছা এডা, তোমরা এই এত বড় বাড়িতে মাত্র চারজন থাকো কী করে? ভয় লাগে না?"- সুটকেস থেকে জামাকাপড় গুলো বের করে আলমারিতে ঢোকাতে লাগলাম। 


এডা দেখলাম আমার কথা শুনে এইবার অদ্ভুত চুপ মেরে গেল। ওর মুখটা একেবারে যেন ছোট্ট হয়ে গেছে। জানলা দিয়ে বাইরের কুয়াশামাখা জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে কি যেন এক মনে ভাবছে ও। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল - " কে বলেছে তোমায় আমরা এখানে চারজন থাকি? মোটেই এই বাড়িতে আমরা চারজন থাকি না। এই বাড়িতে এখন আমরা মোট বারোজন থাকি। তুমি এলে, নাও উই আর থার্টিন।"


হাতের কাপড়গুলো আমার হাতেই ধরা রইল। আমি অবাক হয়ে তাকালাম এডার দিকে। কী বলছে এডা! এই বাড়িতে ওরা মোট বারোজন থাকে! মানে? এরিক তো এ ব্যাপারে কিছু বলল না। ও যে বলল যে বাড়িতে ওরা চারজনই থাকে। এ বাড়িতে আরও কেউ থাকলে তো এরিক নিশ্চয়ই বলত, তাই না? আর বারোজন এ বাড়িতে থাকবেই বা কোথায়। অত ঘরই তো নেই! আমি এডাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাওয়ার আগেই হঠাৎ দরজা থেকে একটা প্রচণ্ড ধমক ভেসে এল,


-" এডা! ইউ আর এগেইন টেলিং দিস থিংস টু আওয়ার গেস্ট! মম কি বলেছে মনে নেই!"


ঘাড় ঘোরাতেই দেখি দরজায় রণ দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখ থমথমে আর গম্ভীর। প্রচন্ড রেগে ও এডাকে চোখে চোখে কি সব যেন ইশারা করছে। এডাও দেখলাম রণের ধমকে একদম চুপসে গেল। কোনো কথা না বলেই মাথা নিচু করে সুরসুর করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। 


রণ আমার দিকে তাকিয়ে এবার একই রকম গম্ভীরভাবে বলল-" প্লিজ ডোন্ট লিসেন টু এডা। ও এরকম ভুলভাল মজা করতে খুব ভালোবাসে। বিশেষ করে মানুষকে ভয় দেখানো ওর ফেভারিট হবি। ট্রাই টু অ্যাভয়েড হার। থ্যাংক ইউ।"


গড়গড় করে কথাগুলো বলে চোখের নিমেষে দরজা থেকে গায়েব হয়ে গেল রণ। 


শুধু আমি খানিকক্ষণ বোকার মত চেয়ে রইলাম দরজার দিকে। এডা কি সত্যিই আমায় ভয় পাওয়ানোর জন্য মজা করে কথাগুলো বলল? নাকি এডার কথাগুলো আসলে সত্যি! কে জানে কেন, আমার কানে শুধু অ্যালার্ম ক্লকের মতো বাজতে লাগল এডার বলা শেষ কথাদুটো,


-" এই বাড়িতে এখন আমরা মোট বারোজন থাকি। তুমি এলে, নাও উই আর থার্টিন।"


তুমি এলে, নাও উই আর থার্টিন... নাও... উই... আর থার্টিন...


থার্টিন খুব আনলাকি একটা সংখ্যা, তাই না?


এডা কি আমায় কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছিল? কে জানে!


// ৩ //


এখন রাত সাড়ে এগারোটা। আমি আমার খাটে শুয়ে একমনে ডায়েরি লিখছি। ডায়েরি লেখা আমার সেই ছোটবেলার অভ্যেস। রাতে ঘুমানোর আগে মনের কথা উজাড় করে ডায়েরিতে লিখতে না পারলে ঠিক যেন শান্তি হয় না!


এদিকে বাইরে এখনও ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। দুপুর দুপুর নাগাদই চারপাশ ক্রমশ অন্ধকার হয়ে এসেছিল। জানলা দিয়ে তাকিয়ে মনে হল ভর দুপুর বেলায় এই নিবিড় বনানীর বুকে কেউ যেন আস্ত আলকাতরার শিশি উল্টে দিয়েছে। এরপর একটু বিকেল গড়াতেই ঝমঝম করে নামল বৃষ্টি। তারপর সারা সন্ধ্যে এই চলছে। এখানে তো এমনিতেই সব ফাঁকা ফাঁকা, লোকজন নেই। রাত আটটা বাজতে না বাজতেই এরিক গেটে তালা ঝুলিয়ে দিল। তারপর রাত নটা সাড়ে নটার মধ্যে ডিনার। দশটার মধ্যে গুড নাইট, সুইট ড্রিমস...যে যার নিজের ঘরে। 


আমার অবশ্য এত তাড়াতাড়ি ঘুমানোর অভ্যেস নেই কোনোকালেই। তারমধ্যে নতুন জায়গা, এরকম একটা পরিবেশ। আরোই ঘুম আসতে চাইছে না। এদিকে রাত বাড়তেই বৃষ্টিটা অনেকটা ধরে এসেছে, কিন্তু একটা ঘন কুয়াশার আস্তরণ ক্রমশ ধোয়ার ছড়িয়ে পড়ছে জঙ্গলের ভিতর।


আজকের সারাদিনের যাবতীয় অদ্ভুত ঘটনাগুলো ডায়েরিতে লিখতে লিখতে একেবারে ডুবে গিয়েছিলাম। হঠাৎ দরজায় খুট করে একটা শব্দ হওয়ায় নড়ে চড়ে বসলাম। এই ঘরের দরজাটা এতখানি উঁচু যে ছিটকিনি দিতে পারিনি। পিছন ফিরতেই খেয়াল করলাম দরজাটা আপনা থেকেই মৃদু খুলে গেছে। সেই খোলা দরজার পিছন থেকে সরু প্যাসেজওয়ের জমাট বাধা অন্ধকার উঁকি দিচ্ছে ঘরের ভিতর। কে জানে কেন ঐদিকে তাকাতেই পেটের কাছে কেমন একটা চিনচিন অনুভূতি হল। ঠিক যেন মনে হল ওই জমাট বাধা অন্ধকারে কেউ একটা ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে একমনে আমায় দেখছে।


আমি দু একবার উকি ঝুঁকি মেরে ভালো করে দেখলাম। উহু কেউ নেই। হয়তো কোনোভাবে হাওয়ায় খুলে গেছে। ওদিক থেকে নজর ঘুরিয়ে ফের মনোনিবেশ করলাম ডায়েরি লেখায়। এরপর আবার কিছুক্ষণ সব চুপচাপ...আচমকা খেয়াল করলাম আমার ঘাড়ের কাছটায় কেমন যেন একটা ঠান্ডা শিরিশিরে অনুভূতি হচ্ছে। ঠিক যেন মনে হচ্ছে পিছন থেকে কেউ একটা একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার দিকেই! 


এইবার পিছন ঘুরতেই বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠল। অবাক হয়ে দেখলাম আমার ঘরের দরজার একটা পাল্লা হাট করে খোলা। সেখান দিয়ে আমার ঘরের দিকে জুলজুলু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাইরের অন্ধকার করিডোর। ঠিক যেন মনে হল কেউ একটা ওই করিডোরে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমায় দেখছিল, আমি পিছনে ফিরতেই মুহূর্তের মধ্যে যেন সরে গেল। 


ভয় জিনিসটা আমার বরাবরই একটু কম। কিন্তু এইবার সত্যি সত্যি বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডের প্রবল চিৎকার শুনতে পেলাম। বুঝতে পারলাম গলার কাছটাও কেমন যেন শুকিয়ে আসছে। খাট থেকে নেমে দরজা পর্যন্ত যেতে মনে জোর পেলাম না। খাটে বসেই কোনোমতে ঢোক গিলে আওয়াজ দিলাম-" ক...ক...কে? হু ইজ দেয়ার?"


জমাট বাঁধা অন্ধকারের মধ্যেই এইবার কি যেন একটা নড়ে চড়ে উঠল। 


-" কে! হু ইজ দেয়ার!"- ভয়ের মাথায় একটু যেন বেশি জোরেই চেঁচিয়ে ফেললাম। তবে আমার আওয়াজে কাজ হল। এইবার অন্ধকার থেকে জিনিসটা ক্রমশ দরজার সামনে এগিয়ে আসতে লাগল। এর পর কয়েক সেকেন্ড...আমি দুরু দুরু বুকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছি দরজার দিকে...তার পরক্ষণেই একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললাম।


-" ও এডা! তুমি ! এত রাতে আমার ঘরে!"


দরজার সামনে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে এডা। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছে ও আমায় কিছু বলতে চায় কিন্তু বলবার সাহস পাচ্ছে না।


-" কী হয়েছে এডা? একা শুতে ভয় করছে? আমার সাথে শোবে?"


খাট থেকে নেমে আমি এডার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলাম। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে হাত বুলিয়ে দিলাম কাঁধ পর্যন্ত বেয়ে আসা ঘন চুলে।


কিন্তু ভারী আশ্চর্যজনক ভাবে এডার মুখভঙ্গি একটুও পাল্টাল না। ওর মুখটা আগের মতই ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। এইবার নিজে থেকেই আমার দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড অস্বস্তির সঙ্গে ও বলল,


-"  ড্যাড বলে এই সমস্ত কিছু আমার জন্যই শুরু হয়েছে। সো আই থিংক আমার তোমায় সাবধান করে দেওয়া উচিত!"


- " সাবধান করে দেওয়া উচিৎ? কীসের থেকে সাবধান করে দেওয়া উচিৎ এডা?" 


আমার প্রশ্নের উত্তরে এডা অদ্ভুতভাবে কিছুক্ষণ কোনো উত্তর দিল না। শুধু একদৃষ্টিতে ভয়ার্ত চোখে চেয়ে রইলো আমার দিকে। তারপর আচমকাই আমার দুই কাঁধ জাপটে ধরে বলল,


-" যেটা বলছি প্লিজ মন দিয়ে শোনো। রাতে ঘুমানোর সময় প্লিজ ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিও না। যাই হয়ে যাক না কেন প্লিজ প্লিজ প্লিজ, ডোন্ট পুট অফ দা লাইটস!"- ছোট্ট এডার কন্ঠস্বর এবার যেন প্রায় কাঁদো কাঁদো শোনাচ্ছে। যেন ভয়ঙ্কর কোনো আতঙ্ক ধারালো ছুরির মত বিধে আছে ওর বুকের ভিতর।


-" কী হয়েছে এডা? তুমি এরকম কথা বলছো কেন? রাতে ঘুমানোর সময় আলো নেভালে কী হবে? আমি তো সব আলো না নিভিয়ে ঘুমাতেই পারি না..."


আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমার দুই কাঁধে প্রচন্ড ঝাকুনি অনুভব করলাম। তার পরক্ষণেই এডা আমার দুই কাঁধ একরকম খামচে ধরে চেঁচিয়ে উঠল -" নো নো নো... ঘরের সব আলো নেভানো যাবে না, যাবে না, যাবে না...প্লিজ ঘরের সব আলো নিভিও না...ঘুমানোর আগে ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিলে..."


-" নিভিয়ে দিলে?"


-" শি উইল কাম!'


 শেষ কথাগুলো বলার সময় সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল এডার। কে জানে কেন ওর কথাগুলো শোনামাত্রই আমার সারা গায়ে কেমন যেন কাটা দিয়ে উঠল। মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়া বাচ্চা মেয়েটার ভয়ার্ত চোখের দিকে তাকিয়ে কোনোমতে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করলাম-" ঘুমানোর আগে সব আলো নিভিয়ে দিলে কে আসবে এডা!"


আমার প্রশ্ন শুনে এডার মুখটা এবার যেন আরও অন্ধকার হয়ে গেল। একমুহূর্তের জন্য মনে হল বেচারি বাচ্চা মেয়েটা বোধহয় আতঙ্কে কেঁদেই ফেলবে এবার। নিজের থেকেই এডা এবার এক পা এক পা করে পিছিয়ে যেতে লাগল অন্ধকার করিডোরের দিকে। তারপর একদম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আচমকাই প্রায় ফিসফিস করে বলে উঠল একটাই শব্দ!


-" ন্যানি!"


ন্যানি! এই শব্দটা শোনামাত্রই আমার সর্বাঙ্গ যেন ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। মনে পড়ে গেল সকালে আসার পথে সেই বুড়িটার কথা। সেও তো একই কথা বলেছিল তাই না! ডোন্ট পুট অফ দা লাইটস...আদারওয়াইজ শি উইল কাম... সেও তো গাড়ির কাঁচে ইংরেজি হরফে লিখেছিল এই নামটাই! ন্যানি! কিন্তু কেন!


 দরজার দিকে তাকাতেই এবার চমকে উঠলাম। এডা নেই! আমার কয়েক সেকেন্ডের চিন্তার ফাঁকে সে কখন যেন মিলিয়ে গিয়েছে প্যাসেজ ওয়ের মধ্যে। দরজা খুলে একবার ভালো করে দেখলাম করিডোরটা। উহু নেই! বোধহয় এক ছুট্টে ঘরে ঢুকে গিয়েছে এডা। 


আমি ঠোঁট কামড়ালাম। মনে হল এই অন্ধকার করিডোরটা ক্রমশ যেন গিলে খেতে আসছে আমায়। আর এক মুহূর্তও ওখানে না দাঁড়িয়ে ঘরে ঢুকেই দড়াম করে বন্ধ করে দিলাম দরজাটা। সামনের খোলা জানলা দিয়ে তখন ভেসে আসছে হিমেল হাওয়া। বিছানার ওপর রাখা ডায়রির পাতা সেই হাওয়ায় উড়তে উড়তে হঠাৎ একটা পাতায় এসে থেমে গেল। অদ্ভুত বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম সেই পাতার উপরে বড় বড় করে ছাপার হরফে একটা কোটেশন লেখা -


I FEAR NOT THE DARK ITSELF, BUT WHAT MAY LURK WITHIN IT.


// ৪ //


খাটের ওপর চোখ খুলে শুয়ে আছি। ঘরের ভিতর এখন মিশমিশে অন্ধকার। খাটের পাশে খোলা জানলাটা দিয়ে বাইরের ঠান্ডা হাওয়া এসে পায়ের পাতায় আঁচড় কাটছে। সারা ঘর জুড়ে জাঁকিয়ে বসেছে শিরশিরে একটা ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজ। ঘুমানোর পক্ষে যাকে বলে আদর্শ পরিবেশ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় ঘুমটাই আসছে না!


একে এডার বলা কথাগুলো কানের সামনে ভীমরুলের মত ভোঁ ভোঁ করছে, তারওপর সকালে গাড়ির সেই অদ্ভুত ঘটনাটা বারংবার সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত ঝলসে ঝলসে উঠছে চোখের সামনে। বৃদ্ধার সেই অদ্ভুত হাসি, হাতে ধরা সেই লম্বা মেয়ে পুতুলটা, ফিসফিস করে বলা সেই কথাগুলো...আর সব শেষে গাড়ির কাঁচে সেই শব্দটা যেটা এডাও বলে গেল কিছুক্ষণ আগে...ন্যানি!


কে জানে কেন, এই ন্যানি শব্দটা এই একদিনেই কেমন যেন পেরেকের মত গেঁথে গেছে মাথার ভিতর। যতবারই অন্যকিছু ভাবার চেষ্টা করছি ততবারই এই শব্দটা ফিরে ফিরে আসছে। বিশেষ করে এই ঘুমানোর সময়টা। কোনোভাবে মাথা থেকে যেন বেরই করতে পারছি না। আর যতবার এই শব্দটা মাথায় আঁচড় কাটছে ততবারই মনে হচ্ছে, উঁহু, সব লাইটগুলো নিভিয়ে ঘুমানো বোধহয় ঠিক হচ্ছে না! যদি সত্যিই কিছু হয়...তখন?


অবশ্য আলো জ্বালিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা যে আমি করিনি তা নয়। কিন্তু একটা ছোট আলো জ্বললেও আমার আবার ঘুম আসে না। সেই ছোটবেলা থেকেই। ফলে অনেকক্ষণ চেষ্টা করে শেষমেশ ক্ষান্ত দিয়েছি। ধুস যা হওয়ার হবে! একবার ঘুমিয়ে পড়লেই এক ঘুমে রাত কাবার। আর এডার মত বাচ্চার কথায় এতটা গুরুত্ব দেওয়া বোধহয় বোকামি! বাচ্চাদের কত কি বলে ভয় পাওয়ানো হয়! হয়তো এটাও তেমনই কিছু...


খাটে শুয়ে একমনে এসব ভাবছি হঠাৎ একটা শব্দে একটু চমকে উঠলাম। শব্দটা ভেসে আসছে দূরে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে।


ঠুক ঠুক ঠুক ঠুক...


 শব্দটা খুব চেনা! হাতুড়ি দিয়ে কাঠের উপর পেরেক পুতলে এমন শব্দ হয়। কিন্তু কি অদ্ভুত! এত রাতে এই গভীর জঙ্গলে কেউ হাতুড়ি দিয়ে পেরেক পোতার কাজ করতে যাবে কেন? 


ঠুক ঠুক ঠুক ঠুক ঠুক...


কে জানে আমার মাথা কাজ করছে না। চোখের পাতা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। বুঝতে পারছি এবার ঘুমিয়ে পড়ব। শুধু ঘুমিয়ে পড়ার আগে এক মনে শুনছি সেই আওয়াজটা...


ঠুক ঠুক ঠুক ঠুক ঠুক...


 জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আওয়াজটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে এই বাড়ির দিকেই!


*** 


সেই আওয়াজটা শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতেই পারিনি। হঠাৎ ঘুমটা ভাঙল একটা তীব্র অস্বস্তিতে। প্রথমটা ঘুম ভেঙে ঠিক কেন অস্বস্তি হচ্ছে বুঝতে পারলাম না। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই ঘুম জড়ানো চোখে হঠাৎ মনে হল খুব লম্বা কেউ একজন আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আমার মুখের ওপর ঝুকে আছে। ব্যাপারটাকে বোঝামাত্রই বুকের ভিতর এতটাই অস্বস্তি হল যে ধড়মড় করে ঘুম জড়ানো চোখেই উঠে বসলাম। তারপর বালিশের পাশেই রাখা টর্চ জ্বেলে ভালো করে দেখলাম চারপাশটা। উঁহু কেউ কোথাও নেই! 


এত ভুল দেখলাম! ঠিক যেন মনে হল না অন্ধকারের মধ্যে বেশ লম্বা কেউ একজন আমার মাথার পাশটায় দাঁড়িয়েছিল! তার মাথাটা ঝুঁকে পড়েছিল আমার মাথার উপর... একদৃষ্টিতে সে তাকিয়েছিল আমার দিকেই। এতটা ভুল হল? 


কে জানে হবে হয়তো! মাথার মধ্যে এত জিনিস ঘুরছে। কোনো বাজে স্বপ্ন দেখেছি হয়তো। টর্চটা অফ্ করে আবার শুয়ে পড়লাম। চোখের পাতা এখনও ভারী। একটু চেষ্টা করতেই আবার তন্দ্রা তন্দ্রা ভাবটা আসতে শুরু করল। আর ঠিক তখনই আবার সেই একই অস্বস্তিটা শুরু হল। চোখ বন্ধ করেই মনে হল আমার ঠিক মুখের উপর কেউ একটা ঝুঁকে আছে। আমার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে সে এক দৃষ্টিতে দেখছে আমায়। আমি চোখটা খুললেই তার মুখটা ঠিক আমার মুখের ওপর দেখতে পাবো। 


ব্যাপারটা না ঠিক বলে বোঝাতে পারব না, কিন্ত অস্বস্তিটা এতটাই বাড়তে লাগল, যে তন্দ্রা ভাবটা তো কেটে গেলই, অন্ধকারের মধ্যেই বিছানার ওপর আবার ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। বুকের ভিতর হৃৎপিন্ডটা লাফাচ্ছে, গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এবারেও টর্চ জ্বালিয়ে চারপাশটা দেখে নিলাম। না, আগেরবারের মতই কেউ নেই!


কি মনে হল। আবার শুয়ে পড়লাম। তবে এবার আর ঘুমালাম না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে মনে মনে এক দুই তিন গুনতে শুরু করলাম...ঠিক দশ গুনতেই আবার অস্বস্তিটা টের পেলাম। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ফের মনে হতে লাগল আমার মাথার পাশে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে। তারপর আমার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এইবার আর পুরো চোখ খুললাম না। ধীরে ধীরে অল্প একটুখানি চোখের পাতাটা খুললাম। আর তার সঙ্গে সঙ্গে আমার সারা শরীর যেন বরফের মত জমে গেল।


আমি অন্ধকারের মধ্যেই স্পষ্ট দেখলাম একটা খুব লম্বা নারীমূর্তি আমার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখটা অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঝুঁকে পড়েছে আমার মুখের ওপর। আমায় দেখে তার মুখের মধ্যে ফুটে উঠেছে একটা অদ্ভুত হাসি....উহু ঠিক নরম্যাল হাসি নয়। একটা...একটা ভয়ঙ্কর রকমের অ্যাবনরম্যাল হাসি।


এরপর কয়েক সেকেন্ড সব চুপচাপ, আমার নিঃশ্বাস প্রায় থেমে গেছে। আচমকা সেই নারীমূর্তি তার ডান হাতটা আমার মাথার ওপর তুলে ধরল। আর ওই অন্ধকারেই স্পষ্ট দেখলাম ওর হাতে ধরা আছে একটা হাতুড়ি! এইবার তার হাসিটা আরও চওড়া হল। ওর হাতটা আরও চেপে বসল হাতুড়ির হাতলে! এইবার আর থাকতে পারলাম না।


-" অ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা..."


প্রচন্ড চিৎকার করতে করতে ধড়মড় করে উঠে বসলাম বিছানায়। তারপর পাগলের মত খাট থেকে লাফিয়ে নেমে এক দৌড়ে গিয়ে জ্বালিয়ে দিলাম ঘরের লাইটটা।


আমার হাত পা সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। গায়ের প্রতিটা রোমকূপ এখনও শিরশির করছে ভয়ে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে প্রচন্ড। টিউব লাইটের আলোয় ভালো করে এবার চেয়ে দেখলাম চারিদিকটা। উহু, কেউ কোথাও নেই। তাহলে আমি যা দেখলাম ও...ওটা কী ছিল! আমি যা দেখেছি তা তো ভুল হতে পারে না...ও...ওটা আমার পাশেই দাঁড়িয়েছিল...ঠিক আমার মুখের ওপরে ঝুকে ছিল ওর মুখ...আর ওর হাতে ধরা ছিল...


কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ হঠাৎ ঘরের দেওয়ালের দিকে চেয়ে চমকে উঠলাম। আরে ওটা কী? দেওয়ালে পেরেক দিয়ে একটা কাগজের টুকরো পোঁতা না? কিন্তু এটা তো ছিল না ঘরে!


কোনোমতে ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম। তারপর দেওয়ালে গাঁথা কাগজের টুকরোটার দিকে তাকাতেই আবারও একবার বুকের ভিতর সেই চাপা অস্বস্তিটা টের পেলাম। দেখলাম দেওয়ালে পোঁতা ছোট্ট কাগজের টুকরোটায়  ইংরেজি হরফে বড় বড় করে লেখা আছে,


"  Only 7 Days Left !!! 

    

WANNA PLAY WITH ME?"

// ৫ //


এরমধ্যেই দেখতে দেখতে তিনদিন কেটে গেল। সেদিন রাত্রের সেই দৃশ্যগুলো একরকম মন থেকে মুছে ফেলারই চেষ্টা করেছি। যদিও পুরোপুরি তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এখনও যতবার সেই দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ঝলসে ঝলসে ওঠে ততবার বুকের ভিতর সেই অস্বস্তিটা আবার অনুভব করতে পারি। 


 সেইদিন সারারাত ঘরের আলো জ্বালিয়ে বসেছিলাম। দু চোখের পাতা ক্ষনিকের জন্যেও এক করতে পারিনি। কি বলবো, এত ভয় সারাজীবনে কখনও পাইনি। পুরো হাত পা জমে বরফ হয়ে গেছিল একেবারে। পরেরদিন সকালে এরিককে সবটা বলতেই ও হো হো করে হেসে উঠল,


-" আপনি কি রাতে সিগারেটের সঙ্গে অন্য কিছু মিশিয়ে খান নাকি?"


- " মানে? আপনার মনে হচ্ছে আমি মজা করছি!"- আমি বিরক্ত মুখে এরিকের দিকে তাকালাম।


-" না মজা করছেন না। বাট ভুলভাল বকছেন শিওর। আমরা এতদিন এ বাড়িতে আছি, কই আমাদের সঙ্গে তো এরকম কিছু ঘটেনি! আই গেস, কাল ওই পাগল বুড়ির কথা শুনে আপনি খুব বেশি ভাবছিলেন ওটা নিয়ে। সেইজন্য হয়তো কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন।" একতলার ড্রয়িং রুমে বসে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছিল এরিক। আমার দিকে তাকিয়ে এবার ভ্রুকুটি করল।


-" কিন্তু! এডাও যে কাল রাতে আমায় সাবধান করে গেল! সেটাও মিথ্যে?"


এডার কথাটা শোনামাত্রই এরিকের মেরুদন্ড আপনা আপনি সোজা হয়ে গেল। এরিক চোয়ালটা শক্ত করেই সিগারেটে আরেকটা টান দিল।


-" কী বলেছে আপনাকে এডা?"


এরিকের কন্ঠস্বর অস্বাভাবিক ঠান্ডা। মুখটা দেখেও আমার ঠিক সুবিধার মনে হল না। কে জানে বাবা, সত্যি কথা বললে যদি মেয়েটাকে বকা ঝকা করে। কী লাভ! এডা তো আমার ভালোর জন্যই বলতে এসেছিল। আমি কায়দা করে সঙ্গে সঙ্গে কথাটা ঘুরিয়ে দিলাম,


-" কিছুই না, এই রাতে যেন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি এই আর কি! ছাড়ুন ওসব কথা বাদ দিন। আমি বরং আমার কাজে লেগে পড়ি। থ্যাংক ইউ রাতটা আপনি সামলে নিলেন বলে। আমি তো ভেবেছিলাম আমাকেই পেশেন্টের সঙ্গে থাকতে হবে। মানে সেটাই তো হয় ইউজুয়ালি..."


-" না না রাতে আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমাবেন।" এরিকের মুখের ধোঁয়াশা একটু যেন কাটল। শূন্যে আরেক রাশ ধোয়া ছাড়ল সে।


 -" মৌসুমী তো আমারই ওয়াইফ ম্যাডাম। ওর জন্য এটুকু করতে পারবো না? ইউনিভার্সিটিতে একসঙ্গে পড়তাম আমরা। ভালোবেসে বিয়ে। ওর জন্য আমি আমার সারাদিনটাই দিতে পারি। কিন্তু নিজের কাজ আর বাচ্ছাদুটোর জন্য তা সম্ভব নয়। সেইজন্যই আপনাকে আনা। নইলে এই দুমাস কোনোমতে তো চালিয়ে দিলাম..."


একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অবশিষ্ট সিগারেটটা ছাইদানে গুঁজে দিল এরিক। 


-" চিন্তা করবেন না মৌসুমী আবার ভালো হয়ে যাবে। আমি কাল চেক করলাম। পায়ে সেরকম কোনো ড্যামেজই তো নেই। এরকম ক্ষেত্রে পেশেন্টরা অনেক ক্ষেত্রেই আগের লাইফ ফিরে পান।"


আমার কথায় এরিকের মুখটা রৌদ্রজ্জ্বল হয়ে উঠল। সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল ও।


-" বেশ আমি তাহলে বেরিয়ে পড়ি। আগের দিনই তো দেখলেন, এখান থেকে "মিস্ট" স্টেশন তিনঘন্টার রাস্তা। ওই স্টেশনটা ক্রস করলেই আমার অফিস। আর দেরি করা ঠিক হবে না।"


কথাটা বলে এরিক আমার মুখের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল। তারপর আচমকাই বলল,


" একটা কথা বলছি শুনুন। কালকেই বলে দেওয়া উচিৎ ছিল আমার। যাইহোক। এডার সঙ্গে না বেশি মিশবেন না। কথাবার্তাও কম বলবেন। ইনফ্যাক্ট না বললেই ভালো। শি ইজ নট ভেরি নর্মাল।"


শেষ কথাগুলো উচ্চারণ করার সময় খেয়াল করলাম এরিকের মুখটা আচমকাই কালো হয়ে গেল। 


-" নর্মাল না! আপনি কি বলতে চাইছেন বলুন তো? আই মিন আমার কিন্তু এডাকে দেখে একদম নর্মালই মনে হল।"


 এরিক দেখলাম এবার ধীর পায়ে আমার একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর গলার পারদ কয়েক ডিগ্রী নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল-" যারা ভিতরে ভিতরে সবথেকে বেশি অ্যাবনর্মাল হয়, তাদেরকেই কিন্তু বাইরে থেকে দেখতে একদম নরম্যাল লাগে ম্যাডাম। আপনি বাইরের লোক। নিজের মেয়ের ব্যাপারে সব আপনাকে বলা সম্ভব না।সেজন্যই বলছি এডার থেকে দূরে থাকুন। সরি টু সে বাট এডা আপনার কোনো বড় ক্ষতিও করে দিতে পারে।"


উঁহু, এরপরে আর আমি কোনো কথা বলার সুযোগ পাইনি। এরিক নিজের থেকে হন্তদন্ত বেরিয়ে গেছিল অফিসে। তবে এরিকের বলা কথাগুলো সূঁচের মত গেঁথে গিয়েছিল আমার কানে। যাইহোক এরপর দুদিন রাতে দরজা ভেজিয়ে লাইট জ্বালিয়েই ঘুমিয়েছি। খুব যে ঘুম হয়েছে তা নয়। তবে ওই অস্বস্তিটা আর হয়নি। সত্যি বলতে চেষ্টা করেছিলাম ঘর অন্ধকার করে শুতে। কিন্তু পারিনি। অন্ধকার ঘরে চোখটা বন্ধ করা মাত্রই মনে হয়েছে ঠিক আমার মুখের ওপরে কেউ একটা ঝুঁকে পড়ে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। অসম্ভব অস্বস্তিতে ধড়ফড় করে উঠে বসেছি, তারপর একরকম বাধ্য হয়েছি লাইট জ্বালিয়ে শুতে।


-" সুইটহার্ট, আজ দুপুরবেলা আমার সঙ্গে চুপি চুপি ঘুরতে বেড়াবে?"- আজ সকালবেলা এডা এসে বায়না ধরে বসল। এরিকের বারণ সত্ত্বেও এই মেয়েটাকে আমি ঠিক দূরে ঠেলতে পারিনি। কি নিষ্পাপ সারল্য মাখা মুখখানা। মাঝে মাঝে কথা বলতে বলতে ভাবের ঘোরে চলে যায় বটে, দু একখানা অদ্ভুত কথাও বলে ফেলে বটে। কিন্তু তবুও। ও তো বাচ্চাই। বাচ্চাদের কথা অত ধরতে আছে নাকি! 


এডার সঙ্গে আমার এই বন্ধুত্ব কিন্তু আসলে খুব লুকিয়ে চুরিয়ে। আমাদের মধ্যে নীরবেই এই সেটেলমেন্ট হয়ে গেছে। সবার সামনে আমরা দূরে দূরে থাকি। কথা বলি না। সকালে এরিক অফিস চলে যায়। রণ স্কুল। তারপর এডা আমার ঘরে আসে।এডার নাকি এখন শরীর খারাপ চলছে। রোজ সকালেই স্কুলে যাওয়ার আগে পেটে ব্যথা আর বমি হয়। সেজন্য কদিন স্কুলে যাচ্ছে না। যদিও আমার একথা ঠিক বিশ্বাস হয় না। কেমন যেন মনে হয় এডা আমার সঙ্গে গল্প করবে বলেই স্কুল কামাই করে।


-" বলো না সুইটহার্ট, যাবে তো?"- এডা আমার খাটে উঠে আমার গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল।


-" তোমার মমকে একা রেখে কী করে যাই এডা?"


-" মম তো দুপুরবেলা ঘুমায়। রণও স্কুল থেকে ফেরে দেরি করে। কোনো প্রবলেম হবে না। মম জাগার আগেই আমরা চলে আসব।" আমার ঘরের জানলা দিয়ে বাইরের জঙ্গলের দিকে উঁকি মারল এডা।


-" উমমম...আচ্ছা বেশ, যাবো।"


যেমন কথা তেমন কাজ। একটু দুপুর গড়াতেই মৌসুমী প্রতিদিনের মত ঘুমিয়ে পড়ল। সেই ফাঁকে আমি আর এডা চুপিচুপি বেরিয়ে পড়লাম জঙ্গলের পথে। 


দুপুরবেলা আবার এই অরণ্যের অন্য রূপ। ইদানিং রোজই বিকেলের আগে আগে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। ফলে এইসময়টা পুরো জঙ্গলটাই একটা গুমোট অন্ধকার নিজের গায়ে জড়িয়ে রাখে। আলো আছেও আবার আলো নেইও। অদ্ভুত একটা গা ছমছমে পরিবেশ। ঠিক যেন ফ্যাকাসে নীলচে টোনের একটা থমথমে সিনেমার দৃশ্য। আমি আর এডা সেই দৃশ্যের ভিতর একে অপরের সঙ্গে হেঁটে চলেছি জঙ্গলের পথে।


-" আমরা কোথায় যাচ্ছি এডা?"- জঙ্গলের ভিতর সরু পথ ধরে যেতে যেতে উপরের দিকে চাইলাম। গাছপালার ঘন আবরণ ভেদ করে উকি মারছে মেঘে ঢাকা আকাশ।


-" মায়ের আর আমার ফেভারিট প্লেসে। আর একটু খানি সুইটহার্ট।"


 এডার পিছন পিছন যেতে যেতেই হঠাৎ একটা জিনিস দেখে চমকে উঠলাম। যে পথ দিয়ে আমরা এগোচ্ছি সেই পথের দুইধারে লম্বা লম্বা গাছগুলোর গায়ে অসংখ্য পেরেক পোঁতা। জিনিসটা দেখে এতটাই অবাক হলাম যে রীতিমত দাঁড়িয়েই পড়েছিলাম। হঠাৎ এডার চিৎকারে চমকে উঠলাম,


-" ডোন্ট টাচ! খবরদার ওগুলোতে হাত দিও না! শি ডাজ নট লাইক ইট।"


সামনে ফিরতেই দেখি এডা থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ওর ভয়ার্ত দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে গাছগুলোর গা থেকে কাঁটার মত বেরিয়ে আসা পেরেকগুলোর দিকে।


-"কে এগুলোতে হাত দেওয়া পছন্দ করে না এডা?" একটা প্রচন্ড অস্বস্তি বুকে চেপে কোনোমতে এডাকে জিজ্ঞেস করলাম। 


অদ্ভুতভাবে এডা এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। শুধু বলল- "লেটস গো সুইটহার্ট। আমরা প্রায় চলেই এসেছি।"


এই বলে নিজের মনে হাঁটা দিল সামনের দিকে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমার হঠাৎ করে কেন যেন মনে হল এই গভীর অচেনা এভাবে এডার সঙ্গে একা একা আসাটা আমার উচিৎ হয় নি! একেবারেই উচিৎ হয়নি! বিশেষ করে এরিকের সেদিন ঐভাবে সাবধান করে দেওয়ার পর!


// ৬ //


-" জায়গাটা কেমন? সুন্দর না? আমি আর মা মাঝে মাঝেই এখানে ঘুরতে আসতাম দুপুরে।"


এডার কন্ঠস্বরে একরকম চমকে উঠলাম। সুন্দর? এই জায়গাটা? কোন দিক থেকে? 


এডা আমায় যেখানে নিয়ে এসেছে সেটা জঙ্গলের মাঝখানে গাছগাছালি ঘেরা একটা অতি পুরোনো কবরখানা! এখানে এক হাত দূরে দূরে মাটির ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য শ্যাওলা ধরা পাথরের ফলক। অধিকাংশ ফলকের গায়ের লেখাগুলি আর পড়া যায় না। তবে ফলকগুলির উপস্থিতিই জানান দেয়, তাদের নীচে মাটির গভীরে শুয়ে আছে এই জঙ্গল আর কুয়াশা ঘেরা শহরেরই কোনো না কোনো অধিবাসী। 


আমি চারপাশটা আরেকবার ভালো করে চেয়ে দেখলাম। দুপুর গড়িয়ে এবার বৃষ্টি নামার সময় হয়েছে। চারদিকটা একেবারে অন্ধকার করে এসেছে। মাঝে মাঝে গাছগুলোর ফাঁক গলে মৃদু মৃদু ভেসে আসছে শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া। একে তো জায়গাটা প্রচন্ড স্যাৎস্যেতে তারমধ্যে এরকম একটা অন্ধকার গা ছমছমে পরিবেশ। আমার প্রায় দমবন্ধ হয়ে আসছে। যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে বেরোনো যায় ততই ভালো।


-" কাম হেয়ার সুইটহার্ট। একটা জিনিস দেখাবো।"

এডা কবরখানার ভিতর একটা ফলকের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে আমায় ডাকলো।


আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম এডার দিকে। সামনে যেতেই দেখলাম এডা যে ফলকটির গায়ে হাত বোলাচ্ছে সেটি বেশ ভালো অবস্থায় আছে। তার উপরের লেখাগুলোও পড়া যাচ্ছে দিব্যি। ওখানে পাথরের ওপর জ্বলজ্বল করছে একটা নাম।

অ্যানাবেলা এন্ডারসন।


-" শি ইজ মাই এলডার সিস্টার। সাত বছর বয়সে ও মারা যায়। ওর মৃত্যুর পর রণ আর আমি হয়েছি। মম বলে যেখানটা তুমি দাঁড়িয়ে আছো, ঐখানটায় দাঁড়ালে নাকি বেলার কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। বেলার নাকি এই মাটির নীচে থাকতে দমবন্ধ হয়ে আসে..."


কথাগুলো বলতে বলতে নিজের থেকেই চুপ করে গেল এডা। তারপর পাথরের মূর্তির মত নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কবরটার দিকে। ওর চোখটা ছলছল করছে। একসময় ওর ঠোঁটদুটো আপনিই নড়ে উঠল। শুনলাম স্পষ্ট বাংলায় এডা গান করছে,


-" যখন পড়বে না পায়ের চিহ্ন এই বাটে,

   আমি বাইব না,

  আমি বাইব মোর খেয়াতরী এই ঘাটে, 

  যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে..."


গানটা গাইতে গাইতে এডার চোখ দিয়ে জল পড়ছে অঝোর ধারায়। একরকম ফোঁপাতে ফোঁপাতেই ও গেয়ে চলেছে, 


-"চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,

  মিটিয়ে দেব গো,   

মিটিয়ে দেব লেনা দেনা,

বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে...

 তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

তারার পানে চেয়ে চেয়ে,

 নাইবা আমায় ডাকলে,

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে..."


এডার করুণ কণ্ঠে এই গান শুনতে শুনতে আমার বুকের ভিতরটাও নিজের অজান্তেই কেমন যেন মুষড়ে উঠল। আর নির্বাক হয়ে শুনতে পারলাম না। দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরলাম এডাকে। তারপর ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতেই বললাম,

-" আর গেও না এডা, প্লিজ আর গেও না। তোমার গলায় এই গান শুনতে ভালো লাগে না।"


এডা আমায় আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

-" মম যখনই এখানে আসতো বেলার সঙ্গে দেখা করতে, তখনই এই গানটা গাইতো। বেলার নাকি এই গানটা খুব পছন্দ ছিল। মা বলে এই গানটা শুনলেই বেলা নাকি ঘুমিয়ে পড়ে।"


এডা এবার আমায় জড়িয়ে ধরেই আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে হাঁটু গেড়ে বসলাম। তারপর ওর কপালে চুমু দিয়ে বললাম-" এডা, মৃত্যুর পর ভালো মানুষেরা এই দুনিয়ায় আর থাকে না। তারা আকাশের স্টার হয়ে যায়। চিন্তা করো না। বেলা যেখানে আছে ভালো আছে।"


এডার কান্না এবার খানিকটা কমে এল। অশ্রুসজল চোখেই আমার দিকে তাকিয়ে ও বোকার মত জিজ্ঞেস করল-" আচ্ছা সুইটহার্ট, আমি মরে গেলেও কি আকাশের স্টার হয়ে যাবো?"


-" ছিঃ এডা! এমন বলে না। তুমি মরবে কেন? তুমি এখনও অনেক বছর বাঁচবে।"


এডার মুখটা এবার একদম ছোট্ট হয়ে এল।

-" ড্যাড চায় না আমি বেশিদিন বাঁচি। ড্যাড হেটস মি। ড্যাড বেলাকেও পছন্দ করত না। ড্যাড মমের কাছ থেকে আমাদের দুজনের বেলাতেই ছেলে চেয়েছিল..."


এডার কথাগুলো শুনে আমি প্রায় আকাশ থেকে পড়লাম। এসবের মানে কী! সত্যিই কি এরিক এইরকম ধ্যান ধারণার মানুষ? আজকালকার যুগে আমেরিকার মত এত উন্নত একটা দেশেও কারুর ছেলে মেয়ে নিয়ে বাদ বিচার থাকতে পারে!


-" এসব কথা বাদ দাও এডা। চলো আমরা বাড়ি ফিরে যাই। দেখো কেমন অন্ধকার করে এসেছে। এক্ষুণি বৃষ্টি নামবে। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা উচিৎ হবে না..."


আমার কথা শেষও হয়নি, হঠাৎ খেয়াল করলাম এডা আচমকাই ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করেছে। আমার ঠিক পিছনে কিছু একটা দেখে ওর মুখটা একেবারে সাদা হয়ে গেছে। প্রাণপণে কিছু একটা বলবার চেষ্টা করছে ও, কিন্তু ওর গলা থেকে একটা চাপা গোঙানির স্বর ছাড়া কিছুই বেড়াচ্ছে না। এইবার আচমকাই কাঁপতে কাঁপতে ঠিক আমার ঘাড়ের পিছনের দিকে হাত তুলে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে কি যেন একটা দেখাল ও। 


আমিও পিছনে ঘাড় ঘোরালাম। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল আমার সারা শরীরটা পাথরের মত ভারী হয়ে গেছে। আমি স্পষ্ট দেখলাম কয়েক হাত দূরেই জঙ্গলের অন্ধকারের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা দীর্ঘ নারীমূর্তি। স্বাভাবিক মানুষের থেকে তার উচ্চতা অনেকটাই বেশি। লালচে খয়েরি রঙের একটা লম্বা ফ্রকের মত পোশাক তার হাঁটু পর্যন্ত ঝুলছে। নারী মূর্তিটির শরীর অসম্ভব শীর্ণ। মুখটা একেবারেই যেন কঙ্কালসার। সেই মুখেই ঝোলানো রয়েছে একটা কান এঁটো করা অস্বাভাবিক হাসি। ঠিক যেমনটা হাসি শিকারীর মুখে ফুটে ওঠে তার শিকার ধরা পড়লে। অন্ধকার ভেদ করে সে ধীর পায়ে এবার এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। 


-" রান...রান! শি ইস্ কামিং!" - এডার প্রচন্ড চিৎকারে আমার সারা শরীরটা যেন ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আচমকা অনুভব করলাম আমার শরীরটা যেন হঠাৎ করেই পালকের মত হালকা হয়ে গেছে এবং সেটা ক্রমশই মাটি ছেড়ে উঠে যাচ্ছে শূন্যে।


-" আআ!"- শূন্যে ভাসতে ভাসতেই খেয়াল করলাম এডা আমার দিকে তাকিয়েই ভয়ঙ্কর রকম চিৎকার করতে শুরু করেছে। ওর বীভৎস চিৎকার এই অন্ধকার জঙ্গলে বোবার মত দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর গায়ে মাথা খুটতে লাগল। এর ঠিক পরের মুহূর্তেই শরীরে হ্যাচকা একটা টান অনুভব করলাম, আর তার সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকফুট দূরে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়লাম একটা পাথরের ফলকের সামনে। চোখ তুলতেই সারা শরীরটা যেন কাঠ হয়ে গেল। দেখলাম সেই ফলকের ওপর খোদাই করে লেখা আছে,


" Don't Disturb

 Here Sleeps The Angry Tall Girl

 NANY"


ব্যাস এরপর যে কি হল তা আমার নিজেরও মনে নেই। শুধু বুঝতে পারলাম প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে, সারা শরীরে প্রচন্ড যন্ত্রনা নিয়েই আমি অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাগলের মত দৌড়াচ্ছি। আমার আগে আগেই বীভৎস চিৎকার করতে করতে দৌড়াচ্ছে এডা। আর আমাদের ঠিক পিছনে হিংস্র শিকারীর মত আমাদেরকে ধাওয়া করছে একটা বিকট লম্বা নারীমূর্তি, যার ডান হাতে ধরা আছে একটা হাতুড়ি! দৌড়াতে দৌড়াতেই তার চেরা গলায় বিকট চিৎকারে থরথর করে কেঁপে কেঁপে উঠছে এই আদিগন্ত বনানী। আমার মাথার ভিতর সমস্ত চিন্তা যেন দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি কিছুই বুঝতে পারছি না। চারিদিকের এই জঙ্গল যেন গোলগোল ঘুরছে আর হিংস্র দানবের মত আমাদের গিলে খাওয়ার জন্য এগিয়ে আসছে ক্রমশ।


আমরা শুধু দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। দৌড়াতে দৌড়াতেই স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি এই ভয়ঙ্কর অরণ্যের সব দিক থেকে ভেসে আসছে শুধু তারই কন্ঠস্বর,


" The game is on buddy!

 wanna play with me?"


// ৭ //


- " কী ভেবে আপনি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে আমার মেয়েকে নিয়ে জঙ্গলে চলে গেলেন! মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি দেখছি। ওর কিছু হয়ে গেলে কী হত। দেখুন মেয়েটার কেমন জ্বর এসেছে। যে কাজের জন্য এসেছেন সেটা করলেই তো হয়। আমার মেয়েকে নিয়ে এত টানাটানি কিসের!" 


নিজের বিছানাতে বসেই এডার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল মৌসুমী। ওর চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে গিয়েছে। প্রচন্ড রাগে ও যেন সাপের মত ফুঁসছে। ওর পাশেই দাঁড়িয়ে কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে এরিক। আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ও।


-" এতটা ইরেস্পন্সিবল ব্যবহার আপনার থেকে এক্সপেক্ট করিনি ম্যাডাম। আমি আপনাকে সেদিনকেই বললাম এডার থেকে দূরে থাকুন। স্টে এওয়ে ফ্রম হার। তারপরেও আপনি কী করে ওকে নিয়ে একা একা জঙ্গলে বেরিয়ে পড়লেন! আপনি জানেন এই জঙ্গলে কী কী হতে পারে? কোনো ধারণা আছে আপনার!" 


এরিকও দেখলাম আমার দিকে কটমট করে তাকাচ্ছে। ওর চোখে মুখে একইসঙ্গে বিরক্তি আর রাগ। ঠিক যেমনটা দেখেছিলাম সেইদিন ওই বৃদ্ধা গাড়িতে ওঠার পর। আমি অবশ্য ভিজে গায়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সবকথা মাথা নিচু করে হজম করছিলাম। তবে এবার এরিকের চোখে চোখ রেখেই জিজ্ঞেস করলাম-" ন্যানি কে এরিক? তোমরা কেন ন্যানির ব্যাপারে আমায় কিছু বলো নি। হোয়াই আর ইউ গাইজ ব্লাডি হাইডিং ইট ফ্রম মি?"


আমার কথা শোনা মাত্রই এরিকের মুখটা দেখলাম একেবারে কালো হয়ে গেল। মৌসুমীর দিকে নীরবে একবার তাকাল ও। তারপর আচমকাই একটা মিথ্যে হাসি হেসে বলল-" ন্যানি! হু ইজ ন্যানি! আমরা কোনো ন্যানি ফ্যানিকে চিনি না..."


- " স্টপ লাইং এরিক। আমি নিজের চোখে ন্যানির কবর দেখে এসেছি। এবং শুধু কবরই না। আমি আর এডা দুজনেই...."- গলার স্বরটা যেন গলার মধ্যেই পেঁচিয়ে গেল আমার। কোনোমতে একটা ঢোক গিলে বললাম,

-" আমরা দুজনেই ন্যানিকে দেখেওছি। শি ওয়াজ ট্রাইং টু কিল আস!''


 আমার শেষ কথাটা শোনামাত্রই মৌসুমী এডাকে জাপটে ধরল তৎক্ষণাৎ। তারপর পাগলের মত এডার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ওর কপালে চুমু খেতে লাগল। এরিক এবার এডার দিকে তাকিয়েই শান্ত গলায় বলল-" দেখুন ঐশী। সব কথা বলার একটা সময় থাকে। পরিস্থিতি থাকে। আপনি যা যা জানতে চাইছেন আপনাকে সবটা বলবো। বাট নট নাও। যান আপনি ঘরে গিয়ে চেঞ্জ করে নিন।"


এরিকের কথা শুনে আমিও আর কথা বাড়ালাম না। সেই কোন দুপুর থেকে জঙ্গলের মধ্যে পাগলের মত দৌড়াচ্ছি। আমরা তো দৌড়াতে দৌড়াতে জঙ্গলের মধ্যে পথই হারিয়ে ফেলেছিলাম। ভাগ্যিস সেই বৃদ্ধার সঙ্গে জঙ্গলের মধ্যেই দেখা হয়ে গেছিল! নইলে আমাদের বাড়ি খুঁজে পাওয়া বোধহয় সম্ভবই হত না।


আমি মৌসুমীর ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগোলাম। এই ভিজে কাপড়ে বেশ কাঁপুনি দিচ্ছে এখন। ঘড়ির ডায়ালে সময় দেখলাম সাড়ে সাতটা। বাইরে বৃষ্টিটা ধরে এসেছে। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর জঙ্গলটা যেন আরও নিঃস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। কান পাতলে দূর দূরান্ত পর্যন্ত কোনো শব্দ পাওয়া যায় না। এরকম নিঃস্তব্ধতা আমার একদম ভালো লাগে না, মনে হয় জেম দমটা বন্ধ হয়ে আসছে। 


নিজের ঘরে এসে জামা কাপড় বদলানোর সময় টের পেলাম কপালে বেশ গুরুতর চোট লেগেছে।

কনুই আর পায়ের কাছটাও ছড়ে গিয়েছে, তবে কপালের চোটটাই বেশি। নিজের ওষুধের বাক্স থেকে একটা পেইনকিলার বের করে খেলাম। চোখের সামনে এখনও জঙ্গলের দৃশ্যগুলো ভাসছে। 


সঙ্গে সেই বৃদ্ধার কথাগুলোও। বৃদ্ধার নাম ম্যাডাম অগ্রে। আমাদের চিৎকার শুনেই নাকি উনি জঙ্গলের মধ্যে এসেছিলেন। ভদ্রমহিলাকে আগেরদিন যতটা খারাপ আর পাগল ভেবেছিলাম উনি মোটেই ততটা নন। আমাকে আর এডাকে রীতিমত বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় আবার আমায় বললেন খুব সাবধানে থাকতে। পারলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে। এই মিস্ট শহরটা নাকি মোটেই খুব একটা ভালো নয়। আর যদি কখনও কিছু দরকার হয় তাহলে অবশ্যই যেন ওনার বাড়ি যাই। মেইন রাস্তা ধরে সামনের দিকে আধঘন্টা হাঁটলেই ওনার বাড়ি পেয়ে যাবো।


একমনে এইসব ভাবছি হঠাৎ নিচ থেকে রনের ডাক পড়ল। এত তাড়াতাড়ি তো ডিনার হওয়ার কথা নয়। একচুয়ালি এখানে ডিনার এরিক রান্না করে। ওর অফিস থেকে ফিরতে ফিরতেই সাড়ে সাতটা আটটা বেজে যায়। তারপর এসে ডিনার বানায়। আজ মৌসুমীর ফোন পেয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। যাইহোক নিচের থেকে এরিকের গলা পাওয়ার কয়েক সেকেন্ড পরেই রণের নীচে নামার শব্দ পেলাম। 


আর তার ঠিক পরক্ষণেই আমার একটা অদ্ভুত ইচ্ছা হল। বিছানা থেকে চট করে উঠে বেরিয়ে পড়লাম নিজের ঘর থেকে। তারপর সোজা গিয়ে ঢুকলাম রণ আর এডার ঘরে। এ ঘরটাও আমার ঘরের সাইজের। শুধু এই ঘরে একটার বদলে দুটো বিছানা। এডা নাকি আগে আমার ঘরটায় থাকত। এখন আমি আসায় এই ঘরে শিফট করেছে দাদার সঙ্গে। যদিও ও থাকতে চেয়েছিল নীচে মায়ের সঙ্গে, কিন্তু এরিক পারমিশন দেয়নি।


ঘরের এদিক ওদিক বিভিন্ন জিনিস মন দিয়ে দেখছি। রণ কমিকসের খুব ভক্ত। ওর বিছানা জুড়ে বিভিন্ন কমিকস ছড়ানো। অন্য দিকে এডার বিছানা গোছানো ছিমছাম, দেখলেই বোঝা যায় একটা মেয়ে এই বিছানায় শোয়। এডার বিছানার ওপরেই একটা ড্রয়িং খাতা খোলা আছে দেখলাম। কি মনে হল ড্রয়িং খাতাটা নিয়ে আঁকাগুলো দেখতে শুরু করলাম। এডার আঁকার হাত খুব একটা ভালো না, একেবারেই এমচারিশ। প্রথমদিকে কয়েকটা কাঁচা হাতের সিনারি আঁকা। কয়েকটা পাতা উল্টাতেই একটু চমকে উঠলাম। 


দেখলাম একটা পাতায় একটা লম্বা মেয়ের ছবি আঁকা । তার এক হাতে ধরা হাতুড়ি। নীচে ইংরেজিতে লেখা ন্যানি। 


এরপরের পাতা উল্টোতেই আরেকটা মেয়ের ছবি। কাঁধ পর্যন্ত কমলা রঙের চুল। নীচে লেখা, এমিলি, ন্যানির প্রথম বন্ধু। এরপরের পাতায় আরেকটা মেয়ের ছবি। নীচে লেখা, ফ্লোরিয়া, ন্যানির দ্বিতীয় বন্ধু।এইভাবে তৃতীয়, চতুর্থ করতে করতে আট নম্বর পাতায় পৌঁছে বুঝতে পারলাম বুকের ভিতর একটা অজানা কারণে হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। আট নম্বর পাতাটা উল্টাতে কেন জানি না প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে। এসবের মানে কী! উহু আমি যা ভাবছি তা হতে পারে না। একটা জোরে শ্বাস নিলাম তারপর পাতাটা ওল্টালাম। আর সঙ্গে সঙ্গেই বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। দেখলাম ওই পাতায় কাঁচা হাতে আঁকা আছে একটা মেয়ের প্রতিকৃতি। বুঝতে অসুবিধা হল না ছবিটা আমারই। ছবিটার নীচে লেখা,

সুইটহার্ট, ন্যানির নবম বন্ধু। পাশে ব্র্যাকেটে লেখা,

 only 3 days left !  


// ৮ //


একে সারা শরীরে যন্ত্রনা, তারওপর এত দৌড়ানোর ধকল। শরীর একেবারে অবসন্ন হয়েছিল। ডায়েরি লিখতে লিখতেই বুঝলাম আজ একবার খাটে পিঠ ঠেকালেই মরার মত ঘুমাবো। ডিনার করার পরই এডাকে দেখে আসলাম। মায়ের পাশে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। মৌসুমী আমাকে এডার কাছে যেতে দিল না। দূর থেকেই বলল,

-" জ্বর আছে এখনও। নামে নি। ওষুধ দিয়েছি। নেমে যাবে রাতেই। আপনি ঘুমাতে যান।"


ডায়রিটা লেখা শেষ করে দড়াম করে বন্ধ করে দিলাম। হাতের রেডিয়াম ঘড়ি জানান দিচ্ছে সময় কাটায় কাটায় রাত এগারোটা। নাঃ এবার ঘুমানো দরকার। এই কদিনে লাইট জ্বেলে ঘুমানো দিব্যি অভ্যেস হয়ে গেছে। ফলে ডায়রিটা নিজের জায়গায় রেখে খাটে শরীরটা এলিয়ে দিলাম। আজ জানলাটা বন্ধ করে দিয়েছি। খাটে শুয়ে আর জঙ্গল দেখার উপায় নেই। 


অবশ্য সেই সুযোগটুকুও পেলাম না। বিছানায় শোওয়া মাত্রই দু চোখের পাতা বেয়ে গাঢ় তন্দ্রা নেমে এল। তারপরেই অবচেতন মনে একটা অর্থহীন সিনেমার মত আজ সারাদিনের বিভিন্ন দৃশ্য একের পর এক ফুটে ফুটে উঠতে থাকল কোনো কারণ ছাড়াই। এডার কান্না, গভীর জঙ্গলের ভিতর সেই নিশুতি কবরখানা, মৌসুমীর গম্ভীর মুখ, রণের চাহুনি, সেই বৃদ্ধার কথাগুলো... সব... সব ক্রমশ দলা পাকিয়ে গিয়ে একটা অর্থহীন চলচ্চিত্র নিজেকে মেলে ধরতে লাগল অবচেতন পর্দায়। একসময় সমস্ত অন্ধকার হয়ে গভীর ঘুমের দেশে হারিয়ে গেলাম আমি। 


ঘুমটা ভাঙল ঠিক মাঝরাতে। ঠিক তিনদিন আগের সেই দমবন্ধ করা অস্বস্তি! ঘুমাতে ঘুমাতেই চোখ বন্ধ করে মনে হল আমার মুখের ওপর কেউ একটা ঝুঁকে পড়েছে। তার মুখ একদম ঠিক আমার মুখের ওপরেই। ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই শরীরের প্রত্যেকটা রোমকূপে রোমকূপে ছড়িয়ে পড়ল একটা ঠান্ডা শিরশিরে অনুভূতি। 


চোখ মেলতেই চেয়ে দেখলাম সারা ঘর জুড়ে জাঁকিয়ে বসেছে মিশমিশে অন্ধকার। খাটের পাশের জানলাটাও দেখলাম হাট করে খোলা! সেই জানলা দিয়েই মধ্যরাতের কুয়াশামাখা নিঃস্তব্ধ জঙ্গল আমার ঘরের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে উঁকি মারছে। 


কী হল! আমি তো তো লাইট জ্বালিয়ে শুয়েছিলাম। লাইট নিভল কী করে? আর জানলাটাই বা এমন খুলল কে? আমি জানালায় ছিটকিনি দিয়েছিলাম স্পষ্ট মনে আছে। যাইহোক খাট থেকে নেমে ঘরের আলোটা জ্বালাতে গিয়েই বুঝলাম আসল কান্ড। কারেন্ট অফ। তিন চারবার সুইচ টিপলেও টিউবলাইট কোনো সাড়াশব্দ দিল না। আগের মতই মুখ কালো করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। 


এদিকে আমার বুকের ভিতর তখন অসম্ভব ছটফটানি শুরু হয়েছে। এই অন্ধকার ঘরে একলা একলা সারারাত কাটাবো কী করে! এবার তো অন্ধকার ঘরে ঘুমই আসবে না। এদিকে বাইরে বেরিয়ে কাউকে যে বলব কিছু তারও উপায় নেই। কিইবা বলবো! এরিক মৌসুমী নিজেরাই ব্যস্ত এডাকে নিয়ে। এখন নিশ্চয়ই অঘোরে ঘুমাচ্ছে। রনও ওর ঘরে কাউকে এলাও করবে না। তাহলে! 


একটা জোরে শ্বাস নিলাম। বুঝতে পারলাম আমার পেটের ভিতর একটা অচেনা অস্বস্তি ধারালো দাঁত দিয়ে ক্রমশ কামড় বসাচ্ছে। উহু! ভয় পেলে চলবে না। গুটিগুটি পায়ে বিছানায় গিয়ে উঠলাম। জানলাটা বন্ধ করে দিলাম টেনে। তারপর মাথার পাশে টর্চটা জ্বালিয়ে শুয়ে পড়লাম। হে ঈশ্বর! আজকের রাতটা উদ্ধার করো। কাল সকালেই আমি ঐ বৃদ্ধার কাছে যাবো। ওই বৃদ্ধা নিশ্চয়ই সবটা জানে। এরিকরা কিছু বলবার আগে ওনার থেকেই সবটা শোনা প্রয়োজন।


একমনে ঠাকুরের নাম জপতে জপতে গায়ে চাদরটা দিয়ে দিলাম। তারপর জানলার দিকে মুখ করে চোখ বুঝলাম। মনে মনে আবার গুনছি এক, দুই, তিন...ঠিক দশ আসতেই আবার সেই অস্বস্তি। ঠিক মনে হল আমার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে কেউ একজন মুখের ওপর ঝুঁকে আছে। চোখটা খুললেই তাকে আমি দেখতে পাবো। নিঃশ্বাসটা প্রায় বন্ধ করে কোনোমতে আলতো করে চোখ খুললাম। আর সঙ্গে সঙ্গেই পাগলের মত লাফ মারলাম বিছানার থেকে মেঝেতে। আমার লাফ মারার সঙ্গে সঙ্গেই আমার বালিশের ওপর একটা হাতুড়ির সুতীব্র আঘাত এসে পড়ল।


ন্যানি! আমি স্পষ্ট দেখলাম সেই বিকট লম্বা মেয়েটি এখন বিছানার ধারে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসছে। ও...ও আমায় মারবার জন্য হাতুড়িটা তুলে ধরেছিল। আর এক মুহূর্ত দেরি হলেই আমার মাথাটা আর আস্ত থাকতো না! আজ রাতই হত আমার শেষ রাত!


ন্যানি এবার খাটের ওপার থেকেই আমার দিকে তাকিয়ে সেই এবনরম্যাল হাসিটা আবার হেসে উঠল। তারপর আস্তে আস্তে খাটের উপর হামাগুড়ি দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। ওর চোখে মুখে একটা ভয়ঙ্কর নৃশংসতা। ঠোঁটে খেলা করছে ঠান্ডা হাসি। 


আমি আর দেরি করলাম না। একলাফে মেঝে থেকে উঠে দৌড় লাগালাম বাইরের দিকে। কিন্তু দরজার ওপর আছড়ে পড়তেই বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠল। 


একি! দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ! কিন্তু কেন? হোয়াই! কে বন্ধ করেছে দরজাটা বাইরে থেকে! আমার নিঃশ্বাসটা যেন বন্ধ হয়ে এল!


-" হোয়াট দ্য ফাক ইজ গোয়িং অন হেয়ার! খোলো! প্লিজ খোলো! দরজাটা প্লিজ খোলো কেউ! ইউ বাস্টার্ড ওপেন দা ব্লাডি ডোর!" - প্রচন্ড চিৎকার করতে করবে আমি পাগলের মত দরজাটা ধাক্কাতে লাগলাম। আমার প্রতিটা আঘাতে লম্বা কাঠের দরজাটা আর্তনাদ করে উঠতে লাগল। কিন্তু না! কেউ দরজাটা খুলল না। এর ঠিক কয়েক সেকেন্ড পর একসময় হঠাৎ অনুভব করলাম আমার ঠিক ঘাড়ের কাছেই একটা শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল। তারপরের মুহূর্তেই ওই অন্ধকার ঘরের মধ্যেই আমার কানের সামনে কেউ একটা চেরা গলায় ফিসফিস করে বলে উঠল,


-" The game is on buddy

  Wanna play with me!"

// ৯ //


মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রনা নিয়ে চোখ খুললাম। প্রথম কিছুক্ষণ চোখের সামনে সবটা ঝাপসা মনে হল। তার পরক্ষণেই টের পেলাম আমি আমার ঘরের খাটে শুয়ে আছি। খাটের পাশের জানলাটা হাঁ করে খোলা। সেখান দিয়ে আবছায়া কুয়াশা মাখা জঙ্গল কৌতূহলী চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে।


 বাইরে এখন ভোর হচ্ছে। অন্ধকার সালোয়ার গায়ের থেকে খুলে ফেলে ক্রমশ একটা হালকা আকাশী রঙের মসলিন গায়ে জড়িয়ে নিচ্ছে এই অরণ্য। মাঝে মধ্যে ঠান্ডা শিরশিরে হাওয়া ভোরের পাখির মত উড়তে উড়তে এসে ঢুকে পড়ছে ঘরের ভিতর। এখানে ভোরের দিকে খুব ঠান্ডা পড়ে। স্বাভাবিক ভাবেই বিছানায় শুয়েই বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে।


চোখ খোলার পর বেশ কিছুক্ষণ বোকার মতই বাইরের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মাথার ভিতর কোনোকিছুই যেন কাজ করছে না। এর ঠিক কয়েক সেকেন্ড পরেই চোখের সামনে ঝলসে উঠল কাল রাতের দৃশ্যগুলো। সেই অন্ধকার ঘর, সেই বাইরে দিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজা...আর ন্যানি! কথাগুলো মনে পড়তেই প্রচন্ড অস্বস্তিতে ধড়মড় করে উঠে বসার চেষ্টা করলাম। আর ঠিক তখনই টের পেলাম ব্যাপারটা।


আমি বিছানা থেকে উঠতে পারছি না। কী হল ব্যাপারটা! ঘাড় ঘুরিয়ে ভালো করে দেখতেই চমকে উঠলাম! এ কি! আমার হাত আর পা দুটো খাটের সঙ্গে এইভাবে দড়ি দিয়ে বাঁধা কেন! কে বাঁধল আমায় এভাবে? 


ঠিক ডাঙায় তোলা মাছের মত আমি প্রচন্ড জোরে ছটফট করতে লাগলাম খাটের ওপর শুয়েই। আমার ছটফটানিতে পুরো খাটটা কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। কিন্তু না, কোনো লাভ হল না! আমার হাত আর পা দুটো এতটাই শক্ত করে বাধা যে আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করলেও আমি তা খুলতে পারবো না। 


-" হোয়াট দ্য হেল ইজ গোয়িং অন হেয়ার! কে আমায় এভাবে বেঁধেছে। এরিক! এরিক!"- খাটে শুয়েই প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু কি অদ্ভুত আমার গলার থেকে একটা চাপা গোঙানি ছাড়া আর কিচ্ছু বেরোল না। আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম আমি আমার ঠোঁটদুটোও এক বিন্দু নাড়াতে পারছি না। আমার মুখটাও কাপড় দিয়ে শক্ত করে বাঁধা।


এইবার বুকের ভেতরটা সত্যিই একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেল। প্রচন্ড আতঙ্কে আরও কয়েকবার প্রচন্ড জোরে ছটফট করতে লাগলাম, টেনে ছিড়তে চাইলাম হাতে দড়িগুলো। আর ঠিক তখনই পাশের থেকে একটা কন্ঠস্বর ভেসে এল,


-" লাভ নেই ম্যাডাম। যতই চেষ্টা করুন, ও দড়ি খুলবে না। আপনিই শুধু শুধু ক্লান্ত হয়ে পড়বেন।"


চমকে উঠে পাশে ফিরতেই দেখি খাটের পাশেই একটা চেয়ারে এরিক বসে আছে। ওর মুখে সেই মাদকীয় হাসি। ওর হাতে একটা ধারালো কিচেন নাইফ

 সেটা দিয়েই অত্যন্ত শান্তভাবে একটা আপেল কাটছে এরিক। 


এরিককে দেখামাত্রই আমি আরও ছটফট করে উঠলাম। মুখে কথা বলার উপায় নেই। এই শারীরিক ছটফটানির মধ্যেই দিয়েই আমি যেন চিৎকার করে উঠলাম-" এসবের মানে কী এরিক? আমায় এভাবে দড়ি দিয়ে বেঁধেছে কে!"


-" আমি!"- এরিক আপেল কাটতে কাটতেই অত্যন্ত শান্তভাবে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। 


-" আমিই আপনাকে এভাবে বেঁধে রেখেছি ম্যাডাম। সরি টু সে, আরও দুদিন আপনাকে এভাবেই থাকতে হবে।" 


আমি আবারও ছটফট করে উঠলাম প্রচন্ড। কিন্তু কি অদ্ভুত! এরিকের মুখভঙ্গিতে কোনোই পরিবর্তন এল না। একইরকম শান্তভাবে আপেল কাটতে কাটতে সে ফের বলল,


-" মিস ঐশী, আপনাকে বলেছিলাম এডার থেকে দূরে থাকতে। কিন্তু আপনি আমার কথা শুনলেন না! আমার কথা শুনলে হয়তো জীবনের শেষ দুটো দিন স্বাধীনভাবেই কাটাতে পারতেন।"


"জীবনের শেষদুটো দিন!"  কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আরও জোরে পাগলের মত ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলাম বিছানার উপর। আমার ঝাঁকুনি দেখে এরিক আবারও মৃদু হাসল। তারপর চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। এইবার আচমকাই খেয়াল করলাম ওর মুখের হাসিটা কেমন যেন ম্লান হয়ে এসেছে। ফ্যাকাসে মুখে জানলা দিয়ে বাইরের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ নিজের মনে কি যেন ভাবল এরিক। একসময় ওর ঠোঁটদুটো নিজের থেকেই নড়ে উঠল,


-" কী জানেন তো ঐশী, এই মিস্ট শহরটাই অদ্ভুত। এই শহরের রাস্তা আর জঙ্গলের মত এই শহরের মানুষগুলোর জীবনও ঘন কুয়াশায় মোড়া। এই শহরের বাকিদের মত আমিও কখনও চাইনি জানেন আমার মেয়ে হোক। কিন্তু ভগবান আমায় সেই মেয়েই দিলেন! কি আর করা  যাবে বলুন।" 


একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল এরিক। তারপর আমার দিকে অদ্ভুত করুণভাবে তাকিয়ে বলল, 

-" আই অ্যাম সরি ঐশী। আমার কিচ্ছু করার নেই। আর মাত্র দুদিন এই খেলা চলবে। তারপরেই আপনার চিরতরে মুক্তি। প্রমিস।"


এইবার কেন জানি না এরিকের কথা শুনে প্রচন্ড আতঙ্কে আমার দুচোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল বেরিয়ে এল। পাগলের মত গোঙাতে গোঙাতে খাটের ওপরই ছটফট করতে লাগলাম। 


কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হল না। এরিক আমাকে এভাবেই রেখে দিয়েই দরজাটা বাইরে দিয়ে লক করে নীচে চলে গেল। 


আমি পড়ে রইলাম একা। অসহায়! ঠিক ফাঁদে পড়া শিকারের মত! হাজার চেষ্টা করলেও যার এই ফাঁদ কেটে বেড়ানোর কোনো উপায়ই নেই!


// ১০ //


এখন প্রায় মাঝরাত। আমি ঠিক মরার মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি বাইরের অন্ধকার জঙ্গলের দিকে। আমার হাত পা মুখ এখনও বাধা। আজ সারাদিন এইভাবে শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমার চোখের জল সব শুকিয়ে গিয়েছে। সারাদিন অক্লান্তভাবে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে একসময়ে হাতে, পায়ে, কোমরে শুরু হয়েছে অসহ্য ব্যাথা। কপালের ব্যাথাটার কথা না হয় বাদই দিলাম।


আজ দুপুর পর্যন্তও অজস্র প্রশ্ন আমার মাথার মধ্যে মৌমাছির মত ভনভন করছিল। কিন্তু সেগুলোও একসময় ধীরে ধীরে আমার চেতনার পর্দা থেকে মুছে গেল। তার বদলে মনের ভিতর ক্রমশ জাঁকিয়ে বসতে লাগল একটা অদ্ভুত শূন্যতা। তারপর কতক্ষণ এইভাবে কেটে গেছে আমি জানি না। কোনো চিন্তা নেই, কোনো ভাবনা নেই। শুধু জানলা দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি তো আছি। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তারপর সেই যে বৃষ্টি নামল, এখনও ঝিরঝির করে হয়েই চলেছে।


এইভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একসময় দরজায় খুট করে একটা আওয়াজে চমকে উঠলাম। ঘরের ভিতরটা মিশমিশে অন্ধকার। তবুও তারমধ্যেই বেশ বুঝতে পারলাম ঘরের লম্বা দরজাটা একসময় ধীরে ধীরে খুলে গেল। আর তারপরেই দরজার বাইরে কি যেন একটা নড়ে চড়ে উঠল।


সত্যি বলতে জিনিসটা খেয়াল করতেই বুকের ভেতরটা কেমন ধক করে উঠল। সারা শরীর জুড়ে সেই ঠান্ডা শিরশিরে অনুভুতিটা টের পেলাম। এবার অন্ধকারের মধ্যেই স্পষ্ট দেখলাম সেই কালো ছায়ামূর্তি অত্যন্ত ধীরে ধীরে ঠিক ধূর্ত শিকারীর মত নিঃশব্দে ঘরের ভিতর প্রবেশ করল। আর তারপর ক্রমশ এক পা এক পা করে অতি সন্তর্পনে এগিয়ে আসতে লাগল আমার দিকে।


আমার এরমধ্যেই হাত পা প্রায় বরফের মত ঠান্ডা হয়ে গেছে। আমার অবশিষ্ট শক্তিটুকু দিয়ে প্রাণ পণে ঝাঁকুনি দিতে যাব তার আগেই আচমকা একটা টর্চের আলো আমার মুখের ওপর এসে পড়ল। প্রথমটা চোখটা কুঁচকে গেলেও, পরে চোখটা খুলতেই সারা শরীর আতঙ্কে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। দেখলাম আমার বিছানার সামনে টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে আছে রণ! এডার দাদা! ওর মুখ অস্বাভাবিক থমথমে আর গম্ভীর। ও বাঁ হাতে ধরে আছে টর্চ, আর ডান হাতে...একটা ধারালো কিচেন নাইফ!


ও...ওটা দিয়ে কী করবে রণ! এই অন্ধকার ঘরে টর্চের আলোয় ওর ওই ভয়ঙ্কর থমথমে মুখটা দেখে আমার বুকের ভেতরটা যেন বরফ হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম প্রচন্ড আতঙ্কে নিঃশ্বাসটা প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। রণ ধীরে ধীরে একেবারে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর আমার দিকে তাকাতেই ওর মুখে ফুটে উঠল একটা অদ্ভুত শীতল হাসি। এইবার  টর্চের আলোতেই চকচক করে উঠল ওর ধারালো ছুরিটা! আর দেখতে পারলাম না, সঙ্গে সঙ্গে চোখটা বন্ধ করে নিলাম।


আর এর ঠিক কয়েক সেকেন্ড পরই অনুভব করলাম  আমার ডান হাতের বাঁধনটা হঠাৎই ক্রমশ আলগা হয়ে যাচ্ছে। চোখ খুলে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম রণ একমনে আমার হাতের দড়িটা ছুরি দিয়ে কাটছে! কিন্তু কেন? 


কিছু বুঝে উঠবার আগেই আমার ডান হাতটা মুক্ত হয়ে গেল, তারপর একে একে বা হাত। দুটো পা। সবশেষে নিজেই নিজের মুখ থেকে বাঁধনটা খুলে ফেলে বুক ভরে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললাম যেন। আমি কিছু বলতেই যাবো তার আগে রণ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে আমায় সাবধান করে দিল,


-" শশশ...কোনো কথা নয়। জাস্ট ফলো মি।"


আমিও কোনো কথা বললাম না। খাট থেকে নেমে নিঃশব্দে ফলো করতে লাগলাম রণকে। ওর পিছন পিছন আমার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম, প্রায় পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম নীচে। তারপর ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেই দমবন্ধ করে এগোতে লাগলাম রণের পিছন পিছন। এরিকদের বেডরুমটা পেরোনোর সময় বুকের ভিতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। ইচ্ছে হল ছুট্টে গিয়ে শেষ একবার দেখে আসি এডা কেমন আছে। কিন্তু তা সম্ভব নয় ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এইবার রণ আমায় নিয়ে এল বাড়ির একদম পিছন দিকে সিঁড়ির নীচে একটা ছোট্ট ঘরের সামনে। এটা সম্ভবত পুরোনো জিনিস পত্র রাখার ঘর। 


ঘরের দরজাটা অত্যন্ত সন্তর্পনে খুলল রণ। সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধকার ঘরের ভিতর থেকে আমার নাকে এসে ঝাপটা মারল একটা গুমোট ভ্যাপসা গন্ধ। রণ এবার ঘরের ভিতর ঢুকেই ফিসফিস করে উঠল,

-" আর ইউ দেয়ার?"


- " ইয়েস, আমি এখানেই আছি।"

অন্ধকার ঘরের ভিতর থেকে ভেসে আসা কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম! এডা!

সঙ্গে সঙ্গেই রণের টর্চ জ্বলে উঠল। আর তার পরক্ষণেই অনুভব করলাম একটা ছোট মেয়ে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরল আমায়।


-" আর ইউ অলরাইট সুইটহার্ট!"


আমি হাটু গেড়ে বসলাম। টর্চের আলোয় এডার মুখটা একইসঙ্গে ফ্যাকাসে আর বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। আমায় দেখে ওর চোখ ছলছল করছে। আমি ওর কপালে চুমো দিয়ে বললাম-" এই যে তোমায় দেখলাম। এখন আমি একদম ঠিক আছি!" 


আমার কথা শুনেই এডার মুখে হাসি ফুটল। ও কিছু বলতে যাবে তার আগেই রণ আবার ফিসফিস করে উঠল,

-" কুইক! হারি আপ। ড্যাড যেকোনো সময় জেগে যেতে পারে। এদিকে এসো।"


রণের দিকে তাকাতেই দেখি ও একটা বড় জানলার পাল্লা গুলো সড়াচ্ছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে ওকে হেল্প করলাম। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ঘরের মধ্যে একটা লম্বা জানলার মুখট হাঁ হয়ে গেল। জানলাটার কোনো গরাদ নেই। দিব্যি ঘরের ভিতর থেকে বাইরে চলে যাওয়া যায়। 


রণ এইবার আচমকাই আমার হাতটা চেপে ধরল। তারপর ফিসফিস করেই বলল,

-" আমি তোমায় হেল্প করলাম, তার বদলে তোমাকেও আমায় একটা হেল্প করতে হবে।"


-" কী হেল্প?"


রণের চোখটা এবার ছলছল করে উঠল। গলাটাও কেমন যেন ধরে এল ওর,

-" দিস ব্লাডি টাউন ইস্ কার্সড। প্রমিস মি, তুমি এডাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যাবে। এই শহর থেকে অনেক অনেক দূরে নিয়ে চলে যাবে ওকে। এই শহরে থাকলে ও বাঁচবে না, ন্যানি উইল কিল হার!"


শেষ কথাগুলো বলতে বলতে রণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। আমি বোকার মত রণের দিকে স্থির দৃস্টিতে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। রণের মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, 

- " বেশ, তাই হবে। আমি আমার সঙ্গে এডাকে নিয়ে চলে যাবো।"


এরপর কয়েক মুহূর্ত রণ আর এডার মধ্যে ফিসফিস করে কাঁদতে কাঁদতে কিসব কথা হল। চোখের জলে ভাই বোন শেষ বিদায় বার্তা জানাল একে অপরকে। তারপর আমি আর এডা জানলা দিয়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে।


আমাদের সামনে মধ্যরাতের কুয়াশামাখা জঙ্গলে তখন একটানা ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। আমি এডার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। 


এ শহর থেকে বেরোনোর পথ চেনাতে পারে একজনই! আমাদের এখন তার কাছেই যাওয়া উচিত!


 

// ১১ //

 

- " সিট ডাউন, সিট ডাউন!" - ম্যাডাম অগ্রে হ্যারিকেনের আলোটা উস্কে দিলেন। তারপর এডার দিকে তাকিয়ে মুখ কুঁচকে অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে বললেন -" আমি বুঝতে পারছি না তুমি তোমার সঙ্গে এই মেয়েটিকে কেন আনতে গেলে!"


ম্যাডাম অগ্রের বাড়ি খুঁজে পেতে আমাদের বিশেষ অসুবিধা হয়নি। যেমনটা উনি বলেছিলেন, মেইন রোড ধরে হাঁটতে হাটঁতে একসময় রাস্তার ধারেই একটা পুরোনো আমলের কাঠের একতলা বাড়ি দেখা গেল। দরজা ধাক্কা দিতে প্রথমে কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। তারপর বেশ কিছুক্ষণ একটানা দরজা ধাক্কানোর পর আচমকাই ভিতর থেকে এক বৃদ্ধার ভাঙা চোরা কন্ঠস্বর পাওয়া গেল। এর কিছুক্ষণ পর হ্যারিকেন হাতে ম্যাডাম অগ্রে দরজা খুললেন এবং আমাদের দেখা মাত্রই অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ভিতরে ঢুকিয়ে নিলেন। দরজা বন্ধ করার আগে ভালো করে চেয়ে দেখে নিলেন চারপাশটা।


-" এরকম কেন বলছেন? ওর কি দোষ! আমি  ওকে নিয়ে এই শহর থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চাই..."


আমার কথা শেষ করার আগে বৃদ্ধা বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, " ইউ কান্ট ডু ইট! ইটস সিম্পল...ইউ কান্ট ডু ইট!"


বৃদ্ধা এবার একটু শান্ত হলেন। তারপর গলা নামিয়ে ধীরে ধীরে বললেন-" ওর বাবা মাকে না জানিয়ে এভাবে তুমি ওকে এ শহর থেকে নিয়ে যেতে পারো না। ইটস ক্রাইম। এর চেয়ে ভালো হয় তুমি নিজেই এ শহর থেকে পালিয়ে যাও।"


- " কিন্তু এই শহরে থাকলে তো ও বাঁচবে না!"- আমার কথায় ম্যাডাম অগ্রের মুখটা আচমকাই একেবারে কালো হয়ে গেল। এডার দিকে আবারও ঘুরে তাকালেন তিনি।


- " যার কপালে মৃত্যু লেখা আছে তাকে তুমি বাঁচাবে কী করে! যে মুহূর্তে ও এই শহরে জন্মেছে সেই মুহূর্তে ওর কপালে মৃত্যু লেখা হয়ে গেছে। এই শহরে জন্মানো কোনো মেয়ে বেশিদিন বাঁচে না। ন্যানি তাদের বাঁচতে দেয় না!"


-" ন্যানি ন্যানি ন্যানি! হু ইস্ দিস ন্যানি!"- খানিকটা বিরক্ত হয়েই ম্যাডাম অগ্রের চোখে চোখ রাখলাম আমি।


-" কেন সে আমাদের এভাবে তাড়া করছে সর্বক্ষণ। কি চায় সে? হোয়াই শি ওয়ান্টস টু কিল হার? হোয়াই শি ওয়ান্টস টু কিল মি? এই শহরে কী হচ্ছে! ক্যান ইউ প্লিজ টেল মি!"- কথাগুলো বলতে বলতে খেয়াল করলাম ম্যাডাম অগ্রের মুখটা ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে। 


তিনি এবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মনে মনে কি যেন হিসেব কষলেন। তারপর নিজের মনেই বিড়বিড় করে বললেন-" ভোরের আলো ফোটার আগে জঙ্গলে বেরোনো ঠিক হবে না। এখান বাস স্ট্যান্ডে যেতে বেশিক্ষণ লাগবে না। সকাল সাতটা নাগাদ একটা বাস আছে, একদম স্টেশনে যাবে। ওকে, দ্যাট মিনস উই হ্যাভ টাইম ইন আওয়ার হ্যান্ড!"


-" হ্যালো! ম্যাডাম! কোথায় হারিয়ে গেলেন? "- আমার কণ্ঠস্বরে ম্যাডাম অগ্রে চমকে উঠলেন। তারপর থতমত খেয়ে বললেন -" হাতে সময় আছে। ন্যানির গল্পটা আমি তোমাকে বলতেই পারি। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে এই গল্প শোনার পর তোমার এই শহর ছাড়তে খুবই কষ্ট হবার!"


-" কষ্ট হবে আমার! কিন্তু কেন! আমি সিরিয়াসলি আপনার কথার মাথামুন্ডু কিচ্ছু বুঝতে পারছি না!"


-" বুঝবে বুঝবে। ওয়ান্স ইউ উইল নো দ্য স্টোরি, ইউ উইল আন্ডারস্ট্যান্ড এভরিথিং।" 


ম্যাডাম অগ্রের থমথমে মুখ দেখে আমার বুকের ভিতর আবার সেই চাপা অস্বস্তিটা শুরু হল। কি এমন বলবেন এই বৃদ্ধা যে এই ভয়ঙ্কর শহর ছেড়ে যেতে আমার ভয় করবে! কী গল্পই বা লুকিয়ে আছে ন্যানির পিছনে! আমার মাথার ভিতর সমস্তটা জট পাকিয়ে যাওয়ার আগেই এডা কথা বলে উঠল-" প্লিজ গল্পটা বলো। আমিও জানতে চাই ন্যানির গল্প। আমি মমকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু মম কখনও আমায় বলেনি। ড্যাড একবার রাগের মাথায় বলেছিল অবশ্য ন্যানি আমার জন্যই আসে, কিন্তু কেন আসে জিজ্ঞেস করতে আমায় কিছুই বলেনি।"


এডার কথা শুনে বৃদ্ধা আরেকবার নাক কুঁচকোলেন। তারপর এডার দিকে তাকিয়েই বললেন-" ইয়োর ফাদার ওয়াজ রাইট। তুমিই যত নষ্টের গোঁড়া! যখন তুমি হয়েছিলে তখনই তোমার মাকে বলেছিলাম তোমায় গলা টিপে মেরে ফেলতে। তাহলে আজকে এতগুলো মানুষকে মরতে হত না!"


এতটাই হিংস্রভাবে বৃদ্ধা কথাগুলো বললেন যে এডা ভয় পেয়ে আমায় জড়িয়ে ধরল সঙ্গে সঙ্গে। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।


-" প্লিজ আপনি আসল গল্পটা বলবেন? কে এই ন্যানি? কেন সে সবাইকে মারতে চায়? এডারই বা ন্যানির সঙ্গে সম্পর্ক কী!"


আমার প্রশ্ন শেষ হতেই বৃদ্ধা এবার জোরে একটা শ্বাস নিলেন। তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। যেন মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছেন সবটা। তার নিঃস্তব্ধতার সুযোগে খেয়াল করলাম বাইরে এখনও ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। একটানা সেই বৃষ্টির শব্দ শুনলে নিজের অজান্তেই মাথার ভিতর ঝিম ধরে আসে। একসময় প্রয়ান্ধকার ঘরে হ্যারিকেনের আলোকে আরও খানিকটা উস্কে দিয়ে বৃদ্ধা বলতে শুরু করলেন,


-" ন্যানির গল্পটা অনেকদিন পুরোনো। মে বি সাম হান্ড্রেড ইয়ার্স। ব্যাক দেন, মিস্ট শহর খুব সুন্দর জনবহুল একটা ভিলেজ টাউন ছিল। জঙ্গল আর কুয়াশায় ঘেরা এই শহরের মানুষ প্রকৃতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে খেলতে খেলতে রোজ দিন কাটাত। এই শহর ভরে থাকত ফুলের মত নিষ্পাপ বাচ্চাদের খিলখিল হাসিতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সব বাচ্চাই ফুলের মত নিষ্পাপ হয় না।"


বৃদ্ধা থামলেন। তারপর সামনে রাখা গ্লাস থেকে ঢক ঢক করে জল খেয়ে ফের বলতে শুরু করলেন।


-" বিপদ আর দুর্ভাগ্য কখনও বলে কয়ে আসে না। এক্ষেত্রেও তাই হল। এই আনন্দে ভরা প্রাণোচ্ছল মিস্ট শহরের উপর দুর্ভাগ্যের কালো ছায়া ঘনিয়ে এল আচমকাই। এক ঝড় বাদলার রাতে এক অতি সাধারণ কার্পেন্টার প্যাট্রিকের ঘরে জন্ম নিল একটি মেয়ে, ন্যানি। কিন্তু তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তার মা মেরি তাকে দেখে আঁতকে উঠল। হার ডটার লুকড ডিফারেন্ট! শি ওয়াজ নট নর্মাল! 


ওর হাত পা ছিল সাধারণ বাচ্চাদের তুলনায় বেশ লম্বা এবং শরীর অসম্ভব শীর্ন। বুকের কাছটা সামান্য উঁচু মতন। শহরের লোকজন দেখা মাত্রই বলল শি ইস্ আ উইচ। বড় হলে এ শহরের মানুষের ক্ষতি করবে ওই মেয়ে। সো দে শুড কিল হার নাও। আদারওয়াইজ এ শহরের লোকেরা নিজেরাই ওই বেবিকে মেরে ফেলবে।


  কিন্তু যতই হোক, মা-ই তো! মেয়েকে কি আর নিজের হাতে মারতে পারে! শহরের লোক যতই বলুক মেরি কিন্তু নিজের মেয়েকে মারল না। সে প্যাট্রিককে বুঝিয়ে শুনিয়ে শহরের সবার থেকে লুকিয়ে ন্যানিকে নিজের বাড়িতেই রেখে দিল। অন্যদিকে সারা শহরে জানিয়ে দিল সে তার মেয়েকে মেরে ফেলেছে।


বেশ ভালোই চলছিল এভাবে। প্যাট্রিক ন্যানিকে পছন্দ না করলেও, সারা শহরের থেকে লুকিয়ে একটু একটু করে ন্যানিকে বেশ শান্তিতেই বড় করে তুলছিল মেরি। কিন্তু সমস্যা দেখা দিচ্ছিল অন্যদিকে। ন্যানি যতই বড় হচ্ছিল ততই অস্বাভাবিকতা দেখা দিচ্ছিল তার মধ্যে। মাত্র পাঁচ ছ বছর বয়সেই তার উচ্চতা সাধারণ মানুষকে ছাড়িয়ে গেছিল। এবং তার শরীর ছিল অসম্ভব রোগা। হাত পায়ের আঙুল ছিল পেন্সিলের মত সরু আর লম্বা। শুধু তাই নয় ন্যানির মুখটাও ছিল অস্বাভাবিক রকম কঙ্কালসার। সে যখন মেরির সঙ্গে খেলতে খেলতে হাসত তখন মেরিরই মাঝে মাঝে ভয় লেগে যেতে ওই হাসি দেখে। বাট এভরিথিং ওয়াজ পারফেক্ট টিল দেন। কিন্তু বিপদ ঘটল আরেকটু বড় হতেই। 


আরেকটু বড় হতেই বাড়ির মধ্যে বন্দি থাকতে থাকতে ন্যানির দমবন্ধ হয়ে আসতে শুরু করল। তখন তার বয়স বারো কি তেরো! কিন্তু তার উচ্চতা সাধারণ মানুষের থেকেও কয়েক হাত বেশি। সে রোজ জানলা দিয়ে দেখে বাইরে বাচ্চারা খেলা করছে, কিন্তু তার সেখানে যাওয়ার অনুমতি নেই। স্বাভাবিক ভাবেই যে বয়সে বাচ্চাদের জীবন বন্ধুত্বের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে সেই বয়সের ন্যানির কোনো বন্ধু ছিল না। শি ওয়াজ এলোন, ভেরি ভেরি লোনলি..."


-" ঠিক আমার মত!"- বৃদ্ধার কথার মাঝখানেই কথা বলে উঠল এডা। 


-" আমারও তো কোনো বন্ধু নেই। স্কুলে সবাই ছেলে। দে ডোন্ট টক উইথ মি। সেইজন্যই তো আমার স্কুলে যেতে একটুও ভালো লাগে না। বাড়িতেও ড্যাড আমায় পছন্দ করে না। শুধু মম আমার সঙ্গে গল্প করে।"


এডা কিছুক্ষণ থামল। তারপর আচমকা আমার জড়িয়ে ধরে বলল-" কিন্তু এখন আমার একজন বন্ধু আছে। সুইটহার্ট।"


আমি এডার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। ম্যাডাম অগ্রের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- " তারপর?" 


ম্যাডাম আমার আর এডার দিকে তাকিয়ে আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর হতাশ কণ্ঠে বললেন,


-" বলছি, শোনো!"


// ১২ //


-" দিনের পর দিন বাইরে বাচ্চাদের দেখতে দেখতে একলা ন্যানির যন্ত্রনা ক্রমশ বাড়তে লাগল। মনে প্রানে ন্যানি বাইরে বেরিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে উঠতে লাগল। বিশেষ করে বাচ্চা মেয়েদের সঙ্গে। ও তো নিজেও মেয়ে। অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে খেলার জন্য ওর প্রাণ ছটফট করতে লাগল!


কিন্তু মেরির কড়া নজরদারিতে সকালবেলায় তা সম্ভব নয়। ফলে ন্যানি মেরির নজর এড়িয়ে রাতের অন্ধকারে বাড়ির বাইরে বেরোতে শুরু করল। সারা রাত সে মনের সুখে এই জঙ্গল ঘেরা শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়ায় আর কারুর বাড়ির জানলা খোলা দেখলেই সেখানে গিয়ে উঁকি মেরে দেখে তার বয়সী কোনো বাচ্চা মেয়ে আছে কি না! প্রথম প্রথম অবশ্য দেখা পর্যন্তই সবটা সীমাবদ্ধ ছিল কিন্তু ক্রমশই এই সাহসটা পেয়ে বসল ন্যানিকে।


সে এবার রাতের অন্ধকারে জানলা দিয়ে উকি মেরে বাচ্চা মেয়েদের দেখেই ক্ষান্ত হল না, বরং তাদের কয়েকজনকে ঘুম ভাঙিয়ে জিজ্ঞেস ফেলল তারা তার সঙ্গে খেলতে চায় কি না! স্বাভাবিকভাবেই এর ফল হল উল্টো। মাঝরাতে ন্যানিকে ওভাবে দেখে তারা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠতে লাগল। এভাবে বেশ কয়েকবার চলার পর সারা শহর জুড়ে একটা লম্বা মেয়ের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে লাগল যে রাতের অন্ধকারে এসে বাচ্চা মেয়েদের চেরা গলায় বলে - " Wanna play with me!"


এ গল্প মেরির কানেও উঠল। অচিরেই মেরি বুঝতে পারল এই লম্বা মেয়েটি কে! ফলে এবার রাতেও ন্যানির বাইরে বেরোনো বন্ধ হয়ে গেল। আর এরপর থেকেই ন্যানির ভিতর একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে শুরু করল। বাচ্চা মেয়েরা তাকে দেখে যে আঁতকে ওঠে এতেই বড্ড বেশি আঘাত পেয়েছিল সে। তারওপর রাতের বেলায় বাড়ির বাইরে বেরোনোও নিষেধ হয়ে গেল। ফলে বাড়ির ভিতরে বন্দি থাকতে থাকতে এবার ন্যানি ভীষণ রকম ইল টেম্পার্ড হয়ে উঠতে লাগল। কথায় কথায় রেগে যায়। ক্রমশ তার রাগ মাত্রা ছাড়াতে লাগল। একাকীত্ব আর বিষণ্ণতা তার এই ক্রোধের আগুনে আরও ঘি ঢাললো।


একদিন মেরি আচমকাই আবিষ্কার করল ন্যানি নিজের ঘরের দেওয়ালে প্রচন্ড জোরে জোরে পেরেক পুঁতছে হাতুড়ি দিয়ে। মেরি জিজ্ঞেস করতেই সে বলল যারা ন্যানির সঙ্গে খেলতে চায় না তাদের মুখ কল্পনা করে এই দেওয়ালে পেরেক পুঁতছে সে! সেদিন ন্যানির কথাবার্তা, মুখের ভাব ভঙ্গিমা দেখে মেরির নিজের বুকই ঠান্ডা হয়ে গেল। মেরি বুঝতে পারল কত বড় ভুল সে করেছে ন্যানিকে বাঁচিয়ে রেখে। ওর মনে হল ন্যানি সত্যিই সাধারণ কোনো মানুষ নয়। শহরের লোকজনের কথা শুনে ওকে ওর জন্মের সময়েই মেরে দেওয়া উচিত ছিল।"


-" বাট ন্যানি ওয়াস এবসলিউটলি নরম্যাল!"

আমি টেবিল চাপড়ে গর্জে উঠলাম। 


-" ইটস আ কেস অফ মরফ্যান সিনড্রোম। জেনেটিক রোগ। খুব রেয়ার। প্রায় দেখাই যায় না। এই রোগের পেশেন্টরা ছোটবেলা থেকেই অস্বাভাবিক রোগা আর লম্বা হয়। কিছু এক্সট্রিম ক্ষেত্রে অল্প বয়সেই এদের উচ্চতা স্বাভাবিক মানুষদের থেকে অনেকটাই বেড়ে যায়। শুধু হাইট আর শারীরিক আকৃতিটুকু বাদ দিলে এরা একদম নরম্যাল মানুষ। ন্যানিও নর্মালই ছিল। শি ওয়াস নট আ উইচ। দীর্ঘদিন ধরে ওকে এভাবে বন্দি রাখতে রাখতে ওর মধ্যে ঐরকম রাগ তৈরি হয়েছিল। শুধু ও কেন! যেকোনো সাধারণ মানুষেরই তাই হবার কথা!"


আমার কথা শুনে ম্যাডাম অগ্রে মুখটা কুঁচকে গেল। নিজের মনে বিড়বিড় করে কিসব যেন বলল সে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে উঠল-" ইউ আর রং ইয়াং গার্ল। শি ওয়াজ আ উইচ। আ ব্যাডলাক। ও আমাদের শহরটাকে অভিশাপের পাঁকে ডুবিয়ে গেছে!"


-" হোয়াট নেক্সট! এরপর কী হল?"- এডা এইবার প্রশ্ন করল।


-" হোয়াট নেক্সট? এরপরের কাহিনী হাড় হিম করে দেওয়া। দিনের পর দিন নিজের ঘরের দেয়ালে পেরেক পুঁততে পুততে ন্যানি ক্রমশ হিংস্র থেকে হিংস্রতর হয়ে উঠল। এক রাতে প্যাট্রিক তাকে বাঁধা দিতে এলে প্রচন্ড ক্রোধে সে হাতুড়ির বাড়িতে প্যাট্রিককেই নৃশংসভাবে খুন করে। তারপর এতদিন ধরে যে মা তাকে একটু একটু করে বড় করেছে সেই মাকেও খুন করে ওই হাতুড়ির আঘাতেই। তারপর সেই রাতেই বাড়ির থেকে পালিয়ে লুকিয়ে পড়ে জঙ্গলের মধ্যে। পরের দিন সকালে বাচ্চারা স্কুলে যাওয়ার পথে বের হলে আচমকাই সে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে হাতুড়ি হাতে নিয়ে তাদের আক্রমণ করে বসে। তার হাতুড়ির নৃশংস আঘাতে প্রাণ হারায় ছয়টি নিষ্পাপ বাচ্চা।


কিন্তু এই কাণ্ডের পর শহরের লোকজনের হাতে ধরা পড়ে যায় সে। স্বাভাবিকভাবেই প্রচন্ড মারধর করা হয় ন্যানিকে। প্রহারের মুখে পড়ে ন্যানি আচমকাই বাচ্চাদের মত মা মা বলে চিৎকার করতে থাকে। তখন শহরের লোক বোঝে ন্যানি আদৌ বড় কেউ নয়, ন্যানি আসলে বাচ্চা। পরে তাকে জিজ্ঞেস করতে সে যখন তার মা আর বাবার নাম বলে তখন সারা শহরের মানুষ আঁতকে ওঠে! 


 এ তো সেই উইচ! যাকে জন্মের সময়েই মেরে ফেলার কথা ছিল। মেরি একে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছে! শহরে এ কথা ছড়িয়ে যেতেই হৈ হৈ পড়ে যায়। ঠিক হয় এই শয়তান মেয়েকে জীবন্ত কবর দেওয়া হবে মাটির তলায়। জন্মের সময়েই যা করা উচিৎ ছিল সেটাই এবার করবে শহরবাসী!


এরপর ন্যানিকে হাত পা বেঁধে জঙ্গলের মাঝে এক ঝড় বাদলার রাতে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়। কবর দেওয়ার সময়েও ন্যানি হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল সে শুধু বন্ধু ছাড়া আর কিচ্ছু চায়নি। যদিও তার কথা কেউ শোনে নি। জীবন্তই কবর দেওয়া হয়েছিল তাকে। শুধু  তার মুখে মাটি ফেলার আগে ন্যানি কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে উঠেছিল,


 -" The game is on buddy

  wanna play with me!"


বৃদ্ধা থামেন। এতটা বলতে বলতে উনি হাঁপিয়ে উঠেছেন। ঢকঢক করে আবার একবার জল খেয়ে বলেন,

-" এরপর থেকেই এই শহরে ন্যানির কার্স নেমে আসে। মৃত্যুর পর ন্যানি পরিণত হয় এমন এক ডেমনিক সত্ত্বায় যার হাত থেকে কারুর মুক্তি নেই। একের পর এক বাচ্চা মেয়েদের সে রাতের অন্ধকারে এসে নিয়ে যেতে থাকে। একসময় এই শহরে যখন একটাও বাচ্চা মেয়ে অবশিষ্ট থাকে না তখন সে প্রতিজ্ঞা করে এই শহরে যখনই কোনো বাচ্চা মেয়ে জন্মাবে তাকে সে চার বছরের পর নিজের খেলার সঙ্গী করার জন্য নিয়ে যাবে। শুধু তাই নয় এ শহরে জন্মানো কোনো বাচ্চা মেয়েকে এ শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সঙ্গে সঙ্গেই তার মৃত্যু ঘটবে। 


এই অভিশাপের পরেই শহরের লোকজন নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। তাদের সঙ্গে ন্যানির একটা ডিল হয়। এই শহরে কোনো বাচ্চা মেয়ে জন্মালে তার চার বছর বয়স থেকে পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত ন্যানিকে প্রত্যেক বছর একটি মেয়ে খেলার সঙ্গী হিসেবে দিতে হবে। তবে এই শহরের কোনো মেয়ে হলে চলবে না। সেই মেয়েটিকে হতে হবে এই শহরের বাইরের কেউ। সেই মেয়েটিকে থেকে এনে এই শহরে সাতদিন রাখতে হবে। তারপর ন্যানি তাকে তার বন্ধু বানাবে। বদলে সেই বাচ্চা মেয়েটিকে সে ছেড়ে দেবে। যদি কোনো বছর এই নিয়ম ভাঙে ন্যানি সেই বাচ্চা মেয়েটিকে নিয়ে চলে যাবে।


 এবার বুঝলে তোমাকে এখানে কেন নিয়ে আসা হয়েছে!"- ম্যাডাম অগ্রে আমার দিকে এবার স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন।


-" এর মানে হয় আমি বাঁচবো নয়তো এডা! তাইতো?"- কথাগুলো বলতে বলতেই খেয়াল করলাম বুকের ভেতরটা একটা অব্যক্ত যন্ত্রনায় মুচড়ে উঠল। 


ম্যাডাম অগ্রে কিছু বলতেই যাবেন তার আগেই হ্যারিকেনের আলোটা দপ করে নিভে গেল। আর পরক্ষণেই খেয়াল করলাম ম্যাডাম অগ্রের পিছনে ফুটে উঠেছে একটা দীর্ঘ নারীমূর্তি। তাকে দেখা মাত্রই আমার বুকটা ঠান্ডা হয়ে গেল। খেয়াল করলাম প্রচন্ড আতঙ্কে এডাও আমার হাতটা খামচে ধরল। আমি কিছু বলতেই যাবো তার আগেই একটা হাতুড়ি হাওয়ার বেগে এসে লাগল ম্যাডাম অগ্রের মাথার পিছনে! 


-" আআ"- একটা চাপা আর্তনাদ। ম্যাডাম অগ্রের মাথাটা ধপ করে পড়ে গেল টেবিলের ওপর। আর তারপরেই অন্ধকার ঘরের ভিতর একটা চেরা গলা ফিসফিস করে উঠল-


" The game is on buddy! 

 Wanna play with me?"



// ১৩ //


-" রান এডা...রান!"- ম্যাডাম অগ্রের নিথর শরীরটার দিকে তাকিয়েই আমি প্রচন্ড আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম। 


এডা আমার কথা শুনে তৎক্ষণাৎ চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল দরজার দিকে। আমিও তার পিছন পিছন দৌড়ালাম সেই দিকেই। কিন্তু অন্ধকার ঘরের ভিতর দৌড়াতে গিয়ে কাঠের কিছুতে একটা ধাক্কা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লাম মাটিতে। 


-" সুইটহার্ট!"- দরজাটার সামনে দাঁড়িয়েই ছোট্ট এডা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল!


তার পরক্ষণেই আমি খেয়াল আমার শরীরটা আবারও ঠিক আগের দিনের মতই ধীরে ধীরে প্রায় পালকের মত হালকা হয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার ঘরের মধ্যেই আমি ক্রমশ ভেসে উঠছি শূন্যে! ঠিক এই সময়ে ঘরের ডানদিকের একটি জানলা দড়াম করে খুলে গেল। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম বাইরে আচমকাই প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ওইটুকু খোলা জানলা দিয়ে যেন ঝুপ করে ঘরের ভিতর ঢুকে আসতে চাইছে মধ্যরাতের অন্ধকার জঙ্গল। প্রচন্ড বৃষ্টি আর মাঝে মধ্যেই বিদ্যুতের চোখ রাঙানিতে যেন ভীত সন্ত্রস্ত বাচ্চাটির মত আতঙ্কে ঠকঠক করে কাঁপছে সে।


-" আআআআ!"- আচমকাই আমার দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করতে লাগল এডা। ওর চোখে মুখে ক্রমশ জমাট বেঁধে আছে আতঙ্কের কালো মেঘ। দরজার হাতল ধরে দাঁড়িয়েই ঠকঠক করে কাঁপছে সও। একসময় আমার পিছনে কি একটা দেখে ওর চিৎকার আচমকাই বন্ধ হয়ে গেল। ঠিক পাথরের মত স্থির হয়ে ও তাকিয়ে রইল আমার দিকেই। 


আর তার ঠিক পরের মুহূর্তেই আমি আমার ঘাড়ের কাছটায় একটা ঠান্ডা আঙুলের স্পর্শ পেলাম। উহু, সাধারণ আঙুল না...অত্যন্ত লম্বা আর পেন্সিলের মত সরু একটা আঙুল। প্রথম একটা আঙ্গুল, তারপর একে একে দুটো, তিনটে...করতে করতে মত দশটা বরফের মত ঠান্ডা সরু সরু আঙ্গুল আমার গলার দুদিকে চেপে বসল। তারপর ধীরে ধীরে আমার ঘাড় বেয়ে সাপের মত এঁকে বেঁকে ক্রমশ পেঁচিয়ে ধরতে লাগল আমার গলাটাকে।


শূন্যে ভাসতে ভাসতেই এবার আমার নিঃশ্বাসটা প্রায় বন্ধ হয়ে এল। তারমধ্যেই কোনরকমে এডার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলাম-" রান এডা...রাআআন...আমার কথা ভেবো না...প্লিজ পালিয়ে যাও এখান থেকে...রাআআআন!"


এইবার প্রায় উন্মাদের এত জোরে চিৎকার করে উঠলাম যে মনে হল গলার ভিতর স্বরনালীটাই বুঝি ছিড়ে ফালাফালা হয়ে গেল। এডা দরজায় দাঁড়িয়ে এতক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। ওর মুখ বিবর্ণ, ফ্যাকাসে। এবার আমার চিৎকার ও যেন ভূত দেখার মত শুনে চমকে উঠল। সারা শরীরটা ওর থরথর করে কেঁপে উঠল। কয়েক সেকেন্ড আমার চোখের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল সে। যেন বলতে চাইল,


-" তোমাকে এইভাবে ফেলে আমি কি করে চলে যাবো সুইটহার্ট!"


 তারপর একসময় কাঁপা কাঁপা হাতে দরজাটা খুলে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ছুট লাগাল বাইরের দিকে। 


আর সঙ্গে সঙ্গেই আমার মুখের উপর দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। আর তার পরক্ষনেই আমার শূন্যে ভাসমান দেহটা ছিটকে গিয়ে পড়ল দরজার সামনে। কাঠের মেঝেতে এইবার প্রচন্ড জোরে মুখ থুবড়ে পড়লাম। কয়েক সেকেন্ড পরেই টের পেলাম নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে।


এইবার বাইরে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। আর সেই আলোতে পিছনে ফিরতেই আমার চোখের সামনে ঝলসে উঠল একটা দীর্ঘ নারীমূর্তি। আমার মনে হল আমার সামনে গাঢ় অন্ধকার ইজেলে ঠিক যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে এল দীর্ঘ অতিপ্রাকৃত অবয়ব। ন্যানি!


 আমার দিকে তাকিয়েই সেই দীর্ঘ নারী মূর্তি এবার চেরা গলায় ফিসফিসিয়ে উঠল,


- " Only one day left ! 

  wanna play with me?"


কথাগুলো শোনামাত্রই আমার মাথার ভিতর বিদ্যুৎ খেলে গেল! কানের সামনে ক্যাসেটের মত বেজে উঠল ম্যাডাম অগ্রের কথাগুলো! অন্য শহর থেকে আসা কোনো মেয়েকে এই শহরে ঠিক সাত দিন থাকার পর ন্যানি তাকে বন্ধু বানায়! কিন্তু আমার তো এই শহরে এখনও সাত দিন হয়নি...তার মানে এক্ষুণি এই মুহূর্তে ন্যানি আমায় মারবে না! তার মানে এখনও আমার পালানোর সুযোগ আছে! ঠিক এই কারণেই সেইদিন রাতেও ন্যানি হাতের সামনে পেয়েও আমাকে মারেনি। শি ওয়াজ জাস্ট প্লেয়িং উইথ মি!


আমার কানের সামনে এবার স্লো মোশনে বেজে উঠল ন্যানির কথাদুটো...দা গেম ইস্ অন বাডি! ওয়ানা প্লে উইথ মি! সো দিস ইস হার ফাকিং গেম! মানুষকে এই ভয় দেখানোটাই আসলে ন্যানির খেলা! কাউকে বন্ধু বানানোর আগে তার সঙ্গে ও এই ভয় দেখানোর খেলাটাই খেলে! যেটা ও এখনও এই মুহূর্তেও আমার সঙ্গে খেলে চলেছে।


কথাগুলো ভাবামাত্রই বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত বল পেলাম। মেঝের থেকে এইবার লাফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তারপর একবারও পিছনে না তাকিয়ে প্রাণপণে ছুটলাম দরজার দিকে। একবারের চেষ্টাতেই দরজাটা খুলে গেল। ঘরের থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। 


পিছন ফিরে বৃষ্টির মধ্যে দৌড়োতেই যাবো হঠাৎ আমার পা দুটো মাটির মধ্যে বরফের মত জমে গেল। আমি দেখলাম আমার সামনে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়েই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ছোট্ট এডা। আর তার পিছনে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে....


-" হোয়াট দা ফাক! মৌসুমী! তুমি! বাট হাউ!"- মৌসুমী আমার দিকে তাকিয়ে এবার একটা ঠান্ডা হাসি হাসলো। ও কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমার পিছনের দিকে আঙুল তুলে এডা চিৎকার করে উঠল-" ড্যাডি নোওওও...!"


আমি কিছু বুঝে উঠবার আগেই আমার মাথার পিছনে রডের মত কিছু একটা দিয়ে সজোরে আঘাত অনুভব করলাম। পরক্ষণেই টের পেলাম আমার শরীরটা লতানে গাছের মত মাটিতে এলিয়ে পড়েছে। আমার মাথার ওপর বৃষ্টিস্নাত অরণ্যের আচ্ছাদন ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। সেই ঝাপসা হয়ে আসা দৃষ্টিতে দুটো মুখ আমার মাথার উপর ঝুকে পড়ল এবার। এরিক ও মৌসুমী। ওদের মুখে ধূর্ত শৃগালের হাসি।


 চোখের সামনে সবটা অন্ধকার হয়ে যাওয়ার আগে টের পেলাম একটা বাচ্চা মেয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদছে। আমার কপালে একে দিচ্ছে উষ্ণ চুম্বন। রিনরিন করে আমার কানে ভেসে আসছে তার অতি ক্ষীণ কন্ঠস্বর....


-" সু...ই...ট...হা...র্ট!"


// ১৪ //


-" আমার প্রথম মেয়ে অ্যানাকে যখন ন্যানি নিয়ে গেল, তখন মা হিসেবে ঠিক করেছিলাম আর কখনো সন্তান হলে মেয়ে নেব না। অ্যানা আমার খুব আদরের ছিল খুব ভালোবাসার। অনেক কষ্টের পর আমার প্রথম সন্তান। এরিক ছেলে চেয়েছিল, আমি কিন্তু প্রথম থেকেই মেয়েই চেয়েছিলাম। আসলে তখনও জানতাম না এই শহরের অন্ধকার অতীতের কথা। আমার কিন্তু ছেলের থেকে মেয়েই বেশি পছন্দ, সেই শুরু থেকেই!"


মৌসুমী থামল। ওর মুখ একদমই ভাবলেশহীন। আমার সামনের চেয়ারটাতে বসে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওর পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে এরিক। ওদের পিছনে বেডরুমের দরজা থেকে উঁকি মারছে রণ। 


আমার হাত পা চেয়ারের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা। আমিও ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে আছি মৌসুমীর দিকে। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই মাথাটা এমন ধরে আছে সামান্য কথা বলার শক্তিটুকু জোগাড় করতে পারছি না। মৌসুমী এবার ডাইনিং এর খোলা জানলা দিয়ে বাইরের জঙ্গলের দিকে তাকাল।


-" এরপর দ্বিতীবার যখন প্রেগনেন্ট হলাম তখন সত্যি বলতে প্রচন্ড আতঙ্কে ছিলাম।"- মৌসুমীর কণ্ঠে চমকে উঠে ফের ওর কথায় মনোনিবেশ করলাম।


-" জানো তখন রোজ ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতাম। যদি ছেলে না হয়ে মেয়ে হয়! তাহলে কী হবে! রোজ একটা দমবন্ধ করা ভাব। মেয়ের হওয়ার কথা ভাবলেই অ্যানার মৃত্যুর কথাটা মনে পড়ে যায় আর বুকের ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে আসে। শেষে যখন রণ হল, তখন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। 


কিন্তু এর ঠিক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার প্রেগনেন্ট হলাম। এবারেও বুক দুরুদুরু। তবে মনে একটু কনফিডেন্স ছিল যে আগেরবার ছেলে হয়েছে যখন এবারেও ছেলেই হবে। কিন্তু ভগবানের ইচ্ছা অন্য। এবার আমার মেয়ে হল। এডা। বিশ্বাস করো সকলে জন্মের সময়েই বলেছিল ওকে মেরে ফেলতে। একটা মেয়ে বাঁচিয়ে রেখে কী লাভ? সেই তো বাবা মায়ের ঘাড়ে বোঝা! ওকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কতকিছুই না করতে হবে। তারপরেও কি ওকে আটকে রাখতে পারবে? হয়তো শেষমেশ আমাদের ছেড়ে চলেই যাবে!


এরিকও বলেছিল ঝামেলা তখনই মিটিয়ে ফেলতে। কিন্তু আমি পারিনি। বিশ্বাস করো আমি পারিনি। আমি তো মা। আমার কাছে ছেলেও যা মেয়েও তা। কি করে আমার নিজের হাতের ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েটাকে জ্যান্ত মাটির তলায় কবর দিয়ে দেব বলো তো? কোনো মা কি তা পারে?"


"কোনো মা কি তা পারে?" কথাগুলো আমার কানে এসে আঁচড় কাটতে লাগল। আমার মাথার মধ্যে ক্রমশ ফুটে উঠতে লাগল আরেক হতভাগ্য মায়ের কথা। মেরি। সেও তো নিজের হাতে নিজের সন্তানকে মারতে পারেনি। সেও এই সমাজের বিরুদ্ধে গিয়েই বাঁচিয়ে রেখেছিল ন্যানিকে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই খেয়াল করলাম রণের পাশ থেকে এইবার উকি মারছে আরেকটা মুখ। এডা।


-" এডাকে বাঁচিয়ে তো রাখলাম। কিন্তু যত ও বড় হতে লাগল বুকের ভিতর ভয় দানা বাঁধতে। এই বুঝি আমার মেয়ে আমার থেকে চিরকালের মত দূরে চলে গেল। অ্যানার বেলায় দুবারের বেশি পারিনি তবে এবারে আমি ঠিক করলাম পারতেই হবে। এডাকে বাঁচিয়ে রাখতে যা করতে হয় তাই করব। প্রথমে এরিক রাজি হয়নি। আমরা তো সাধারণ মানুষ ছিলাম। ঠান্ডা মাথায় মানুষ মারা কি আমাদের কাজ! 


 অ্যানার বেলাতেও করেছিলাম দু তিনবার তবে সেসব কোনো কিছুই প্ল্যানড ছিল না। কিন্তু এবার এডার বেলায় বুঝলাম প্ল্যান কষে একটু একটু করে এগোতে হবে। ফলে আমরা অনেক ভেবে শেষমেশ এই প্ল্যান বানালাম। প্রতি বছর আমি অসুস্থ হবে, আমায় দেখতে একটি করে নার্স আসবে দীর্ঘকালীন চুক্তিতে। কিন্তু সে আর কখনও ফিরবে না। কিছু রিস্ক অবশ্যই ছিল, কয়েকজনকে নার্সকে খুজতে বাড়ির লোকও এসেছিল। একবার পুলিশও এসেছিল। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। আমাদের খেলা কেউই ধরতে পারেনি।


 ফলে একে একে এমিলি, ফ্লোরিয়া...এবং ওদের মত আরো ছজন নির্দোষ মেয়ে এই শহরে এসে হারিয়ে গেছে। বিশ্বাস করো আমরা তাদের মারিনি। আমরা শুধু তাদের ন্যানির কাছে পৌঁছে দিয়েছি আমার মেয়ের জীবনের পরিবর্তে। বাকি এই অভিশপ্ত শহরই তাদের গিলে খেয়েছে।"


আমার দিকে তাকিয়েই এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মৌসুমী। ওর পিছন থেকে ওর কাঁধে এবার হাত রাখল এরিক। 


-" চিন্তা করো না ডার্লিং...আর তিনটে বছর...একবার এডার পনেরো বছর হয়ে যাক, তারপরেই আমরা এর থেকে মুক্তি পেয়ে যাবো। আর আমাদের এভাবে মানুষ শিকার করতে হবে না।"


এরিকের কথাগুলো আমার কানে ঢুকছিল না। আমি স্থির দৃষ্টিতে চেয়েছিলাম দরজা দিয়ে উকি মারা এডার দিকে। ওর মুখটা অসম্ভব শুকনো দেখাচ্ছে। আমার দিকে ও চেয়ে আছে বটে কিন্তু ওর মুখে একবিন্দু হাসি নেই! আনন্দ তো নেই-ই। যেন কোন গভীর চিন্তার চোরাবালিতে ও তলিয়ে গেছে।


-" সো টু ডে ইস্ দা লাস্ট ডে অফ ইয়োর লাইফ। পারলে আমাদের ক্ষমা করবেন!"


এরিকের কথায় এবার চমকে উঠলাম। পরক্ষণেই ওর দিকে তাকাতেই দেখি ও একদম আমার হাতের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর হাতের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম। ওর হাতে একটা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ধরা। আমার দিকে তাকিয়ে এবার মৃদু হাসল ও। তারপর ইনজেকশনটা পুশ করে দিল আমার হাতে।


আমি ঠোঁট কামড়ালাম। কিন্তু লাফালাফি করলাম না। কেন জানি না এখন আমার আর লাফালাফি করতে ইচ্ছা করছে না। ছটফট করতেও ইচ্ছা করছে না। যে শহর থেকে পালানোর কথা মনে করলেই চোখের সামনে ভেসে উঠছে এডার মুখ। কানের সামনে ভেসে উঠছে এডার ডাক...


- " সু...ই...ট...হা...র্ট!"


 ইনজেকশন নেওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বুঝলাম আমার চোখ জুড়িয়ে আসছে। মাথাটা ভার ভার ঠেকছে। চারিদিকে সমস্ত ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। একসময় সবটা অন্ধকার হয়ে এল।


চোখ বুজলাম। একটা হাত আমার মাথায় এসে পড়ল। তারপর ধীরে ধীরে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। জ্ঞান হারানোর আগে স্পষ্ট শুনলাম একটা মহিলা কন্ঠস্বর আর্দ্র কণ্ঠে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে,


-" সরি ঐশী এডাকে বাঁচাতে এ ছাড়া আমার কাছে আর কোনো অপশন নেই! তুমি মা হলে বুঝতে। আমার আর কিছু করার নেই।  নাথিং!"


// ১৫ //


মুখের ওপর টিপটিপ করে একটানা তরল কিছু একটা পড়ছে। প্রথম কিছুক্ষণ ঘুমের ঘোরে ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি, পরে তন্দ্রাভাবটা কেটে যেতেই ধড়ফড় উঠে বসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না! আমার হাত, পা সারা শরীর যেন নাগপাশে আবদ্ধ। হাজার ছটফট করেও কোনোই লাভ হল না, এক চুলও নড়তে পারলাম না।


চোখের পাতাটা যেন পাথরের মত ভারী হয়ে আছে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু খুলতে পারলাম না। ঠিক মনে হল আঠা দিয়ে চোখের পাতা দুটো কেউ জুড়ে দিয়েছে। আর সেটা কখনোই খোলা সম্ভব হবে না। নিশ্চয়ই ইনজেকশনে খুব কড়া কোনো সিডেটিভ ছিল। নইলে এমনটা হওয়ার কথা নয়।


হঠাৎই একটা বাচ্চা মেয়ের কান্নার আওয়াজ কানে ভেসে এল। এইবার নিজেকে শান্ত করলাম। তার চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বোঝার চেষ্টা করলাম আমার চারপাশে কি ঘটে চলেছে। আর ঠিক তখনই ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। বৃষ্টি পড়ছে। আমার মুখের ওপর ঝিরঝির করে এক টানা বৃষ্টি পড়ছে। একটু কান পাতলেই সেই একটানা বৃষ্টির শব্দ স্পষ্ট শোনা যায়। 


তারমানে... তার মানে আমি এখন বাড়িতে নেই...তাহলে কোথায়! জঙ্গলে? কথাগুলো ভাবমাত্রই বুকের ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে গেল। আমি জঙ্গলে শুয়ে আছি! এখন নিশ্চয়ই গভীর রাত হবে। এই রাতে আমি মাঝ জঙ্গলে হাত পা বাঁধা অবস্থায় শুয়ে আছি। আমার মাথার ওপর কালো আকাশ একটানা ঝরিয়ে চলেছে জল। আমার বুকের ভিতর হৃৎস্পন্দন ক্রমশ বাড়ছে। আমি চোখটা আবার খোলার চেষ্টা করলাম। এইবার চোখটা একটু হালকা হালকা লাগছে। কিন্তু তাও খুলছে না। 


-" প্লিজ! প্লিজ ডোন্ট কিল হার...প্লিজ মম...প্লিজ!"- আবারও বৃষ্টি ছাপিয়ে সেই মেয়েলি কন্ঠস্বরটা ভেসে উঠল। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই আমার ঠোঁটদুটো নড়ে উঠল নিজের অজান্তেই। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম আমার হাত পা বাধা থাকলেও, আমার মুখে আর কোনো কাপড় বাধা নেই। আমার মুখ থেকে দিব্যি এবার একটা শব্দ বেরিয়ে এল,

-" এডা!"


এরপর আরও কিছুক্ষণ নিঃস্তব্ধ। তারপর একটা চেনা পুরুষ কন্ঠস্বর পাওয়া গেল।


-" জ্ঞান ফিরে এসেছে। ডোজটা একটু বেশি হয়ে গেছিল। নইলে এতক্ষণ ঘুমায় না। যাইহোক আর বেশি দেরি হবে না। নাও শি উইল কাম!"


"নাও শি উইল কাম" কথাগুলো শোনার পরই প্রায় কেঁপে উঠলাম আমি। কে জানে কি হল, প্রচন্ড আতঙ্কে এইবার চোখের দুটো পাতা অনায়াসে খুলে গেল। আর সেটা খুলতেই মনে হল এর চেয়ে চোখের পাতাদুটো আজন্মকাল বন্ধ করে রাখাই ভালো ছিল!


চোখ খুলতেই আমি দেখলাম আমার মাথার ওপর ঝুকে আমার দিকে জুলুজুলু দৃষ্টিতে একভাবে তাকিয়ে

মধ্যরাতের জঙ্গল। আমার মাথার ওপর ধোঁয়ার আস্তরণের মত ঘন কুয়াশার চাদর। সেই চাদর ভেদ করে টুপটাপ বৃষ্টি ঝরে পড়ছে আমার মুখের ওপর। পরক্ষণেই মাথাটা ঘুরিয়ে দুই পাশে তাকাতেই আঁতকে উঠলাম। সেই কবরখানা! জঙ্গলের মধ্যে সেই নিশুতি কবরখানা যেখানে এডার সঙ্গে এসেছিলাম আমি। আমাকে এখন সেখানে এনেই শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। 


আমার মাথার চারপাশে মাটির ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি পাথরের স্মারক। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে এসব দেখছি, আচমকাই আমার বুকের ওপর এইবার একটা বাচ্চা মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পরক্ষণেই আমি দেখলাম এডা আমায় জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদছে। আর কাঁদতে কাঁদতে বলছে,

-" প্লিজ মম, সুইটহার্টকে ছেড়ে দাও...প্লিইইইজ...শি ইস্ মাই অনলি ফ্রেন্ড!"


আমি এবার এডার মুখের দিকে তাকালাম। ও ছলছল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল-" তুমি ন্যানির ফ্রেন্ড হয়ে গেলে আমার সঙ্গে কে খেলবে সুইটহার্ট! আমার তো আর কোনো বন্ধু নেই!"


আমি এবার ওর দিকে তাকিয়েই মৃদু হাসলাম। ওর নিষ্পাপ মুখটা দেখে বুকের ভেতরটা কেমন যেন মুচড়ে উঠল আমার। আহা রে! জন্মের সেই প্রথম দিন থেকে এই নিষ্পাপ শিশুটার মাথার ওপর শকুনের মত ঘুর পাক খাচ্ছে মৃত্যু! কিন্তু কেন? কী ওর দোষ! শুধু ছেলে না হয়ে, একটা মেয়ে বলেই ও এটা ডিসার্ভ করে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বুকের ভিতর একটা অব্যক্ত বেদনা দলা পাকিয়ে উঠল। খুব ক্ষীণ কণ্ঠে এডাকে বললাম,


-" কাঁদে না এডা! তোমার সুইটহার্ট তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবে না। উই আর ফ্রেন্ডস রাইট..."


আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখলাম মৌসুমী এসে এডাকে টানাটানি শুরু করেছে। কিন্তু এডা কিছুতেই আমাকে ছাড়বে না। একসময় মৌসুমী বিরক্ত হয়ে ধমকে উঠল-" লিভ হার এডা! ডোন্ট ডু সাচ স্টুপিড থিংস। এটা প্রথমবার নয় যখন তুমি সবটা দেখছ।" - তারপর একটু থেমে বিরক্ত মুখে বলল- " তুমি এখানে না থাকলে হবে না তাই, নইলে তোমাকে এখানে কখনও আনতাম না..."


মৌসুমী নিজের কথাগুলো শেষও করতে পারেনি তার আগেই হঠাৎ এরিক চেঁচিয়ে উঠল-" মৌসুমী! তোমার পিছনে...রান!"


এরিকের কথায় মৌসুমী আর এডা দুজনেই এবার ঝড়ের গতিতে পিছনে ফিরে তাকাল। তারপর কি একটা দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে গেল। আমি টের পেলাম প্রচন্ড ভয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরে রাখা এডার হাতদুটো ঠকঠক করে কাঁপছে। ওর হাতের মুঠো আলগা হচ্ছে একটু একটু করে। এরপর ঠিক কয়েক সেকেন্ড, তারপরই একটা প্রচন্ড ঝটকা...খেয়াল করলাম মৌসুমী একরকম মেয়ে খামচে ধরে টেনে আলাদা করল আমার থেকে। তারপর চোখের নিমেষে পাগলের মত ছুট লাগাল আমার থেকে দূরে।


আর তারপরেই আমার চোখের সামনে ফুটে উঠল দৃশ্যটা। সেই দৃশ্যটা যেটা দেখে মৌসুমীর বুকও ঠান্ডা হয়ে গেছিল। আমি দেখলাম আমার থেকে কিছু হাত দূরেই গাঢ় অন্ধকারের পশম গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা দীর্ঘ নারী অবয়ব। তার শরীর মরা গাছের মত শুকনো। বুকের কাছটা অস্বাভাবিক উঁচু। 


ঠিক সেই সময়ে আকাশে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই আরও একবার আমার চোখের সামনে ঝলসে উঠল তার মুখটা। হয়তো এটাই শেষবার। কিন্তু প্রতিবারের মত এবারেও সেই অস্বাভাবিক কঙ্কালসার মুখটার দিকে তাকিয়ে আমার নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল। বুঝতে পারলাম এই হাত পা বাঁধা অবস্থাতেও সারা শরীর আমার মৃগী রোগীর মত ঠকঠক করে কাঁপছে।


ন্যানির মুখটা আজ যেন আরও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। ওর মুখে সেই অস্বাভাবিক হাসি আজ যেন আরও চওড়া হয়ে উঠেছে। তবে আজকের ওর মুখের হাসিটা কিন্তু আগের দিনগুলোর চেয়ে আলাদা। কারণ আজকে ন্যানির হাসির মধ্যে যোগ হয়েছে একটা অদ্ভুত ঘেন্না আর নৃশংসতা। আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে ওকে যখন এই মাটিতেই জীবন্ত কবর দেওয়া হচ্ছিল, তখনও বোধহয় শেষবার ওর মুখে এরকমই হাসি ফুটে উঠেছিল। মানুষের প্রতি ঘেন্নায় আর ক্রোধে!


আমার দিকে তাকিয়ে ন্যানির চোখদুটো যেন চকচক করছে। প্রায় ধূর্ত শিকারীর মত পা টিপে টিপে এক পা এক পা করে ও এগিয়ে আসতে লাগল আমার দিকেই।


এরমধ্যেই আচমকা একটা পুরুষ কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম।


-" দি ডিল ইস্ ডান ন্যানি। আমরা তোমাকে তোমার খেলার সঙ্গী দিয়ে দিলাম এ বছরের জন্য, রিচুয়াল অনুযায়ী খেলার সঙ্গী দেওয়ার সময় আমার মেয়ে এডাও এখানে প্রেজেন্ট আছে। আমরা আমাদের প্রমিস রাখলাম। এবার তোমার পালা। এ বছরের জন্য আমার মেয়ে এডার তুমি কোনো ক্ষতি করতে পারবে না!"


এরিকের কন্ঠস্বর শুনে ন্যানি এবার চোখ তুলে তার দিকে তাকাল, তারপর ঘাড় ঠান্ডা একটা হাসি হাসল। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই পিছন থেকে ভেসে এরিকের কাঁপা কাঁপা কন্ঠস্বর, 

-" ওকে ওকে, আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি। মৌসুমী লেটস গো। এডা চলো!"


এরিকের কথা শেষ হওয়ার আগেই শোনা গেল এডার তীক্ষ্ণ চিৎকার ও হাউ হাউ করে কান্নার স্বর। এডা কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করছে-" প্লিজ লিভ হার, লিভ হাআআআর!"


-" এরিক প্লিজ ওকে ধরে নিয়ে চলো এখান থেকে। ও পাগল হয়ে গেছে। আমি ওকে সামলাতে পারছি না।" এবার স্পষ্ট মৌসুমী চিৎকার শুনতে পেলাম। ওর কন্ঠস্বর একইসঙ্গে আতঙ্কিত ও ভীত সন্ত্রস্ত।


এর পর বেশ কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির আওয়াজ...এডা পাগলের মত ছটফট করছে আমার কাছে আসার জন্য...ওর তীক্ষ্ণ চিৎকারে এই অন্ধকার কুয়াশামাখা জঙ্গলও যেন শিউরে শিউরে উঠছে! তারপর আচমকাই একসময়ে ওর কন্ঠস্বর ক্রমশ কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। দূর...আরও দূর...এডার চিৎকার আরও ক্ষীণ ক্ষীণ হতে হতে একসময় মিলিয়ে গেল বাতাসে।


আর তারপরেই সমস্ত জঙ্গল জুড়ে আবার নেমে এল সেই ভয়ঙ্কর নিঃস্তব্ধতা। ঝিরঝির বৃষ্টিও কখন যেন থেমে গেছে। তার বদলে জঙ্গলের শরীর জুড়ে এখন মাকড়সার মত জাল বিস্তার করছে ঘন কুয়াশা। সমস্ত পৃথিবীটাকেই যেন বোবায় ধরেছে। কোথাও কোনো হাওয়া নেই, একটা গাছের পাতাও নড়ছে না। দূর দূরান্ত পর্যন্ত একটা সামান্য কোনো শব্দও নেই। ভাবা যায়! একটা অসহ্য নিঃস্তব্ধতায় আমার নিঃশ্বাস যেন ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসছে! 


আমি বোধহয় মরে যাচ্ছি একটু একটু করে। আর মরে যেতে যেতেই দেখছি ন্যানি এবার এগোতে এগোতে একদম আমার পায়ের সামনে মুখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তারপর ওর লম্বা গলাটা ঝুঁকিয়ে দিচ্ছে আমার মুখের উপর। আস্তে আস্তে ওর মুখটা নেমে আসছে আমার মুখের কাছে। একসময় ঠিক আমার মুখের ওপর এসে ওর মুখটা স্থির হয়ে গেল।


তারপর আমার দিকে তাকিয়েই ওর মুখে ফুটে উঠল সেই ভয়ঙ্কর অ্যাবনরমাল হাসিটা। চেরা কণ্ঠে ও ফিসফিস করে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

-" The time is up buddy

  wanna play with me?"


এরপরের মুহূর্তেই ওর ডান হাতটা ক্রমশ উঠে এল আমার ঠিক মাথার ওপর। ওর সরু সরু আঙুলগুলো আরও চেপে বসল হাতুড়ির হাতলে । আমি আর পারলাম না। যেভাবে শুরু হয়েছিল এই খেলা, সেভাবেই শেষ হোক না হয়। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। তারপর নিশ্চিত মৃত্যুর অপেক্ষায় মনে মনে গুনতে শুরু করলাম এক দুই তিন...


মনে মনে গুনতে গুনতেই আমার চেতনার পর্দায় একের পর এক ঝড়ের গতিতে ফুটে উঠতে লাগল আমার জীবনের সব কাছের মানুষগুলোর ছবি...মা, বাবা, দিদি,আমার প্রেমিক....তারপর একসময় সবার শেষে মনের পর্দাতেই ফুটে উঠল ছোট্ট এডার হাসি মুখটা! চোখ বন্ধ করেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। 


হে ঈশ্বর! এডা ভালো থাকুক! এডা সুখে থাকুক! তুমি দেখো...


-" আই ওয়ানা প্লে উইথ ইউ!"- আমার চিন্তার জাল ছিন্ন করে হঠাৎই একটা মেয়েলি কন্ঠ আছড়ে পড়ল সমস্ত অরণ্যের বুকে। চমকে উঠে চোখ খুলতেই সমস্ত শরীরটা যেন ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল আমার।


এডা! আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েই প্রচন্ড জোরে জোরে হাঁফাচ্ছে ও! এডা...এডা কী করছে এখানে! হোয়াট দ্য ফাক শি ইস্ ডুইং হেয়ার! 


-" আই ওয়ানা প্লে উইথ ইউ ন্যানি। জাস্ট লিভ হার!"


ছলছল চোখে এডার কথাগুলো শুনতে শুনতে প্রথমটা আমার মাথার ভিতর কোনো বোধ বুদ্ধি যেন কাজ করল না। তার পরক্ষণেই আমি পাগলের মত চেঁচিয়ে উঠলাম,

- " নো এডা নো... ডোন্ট ডু দিস!"


আমার চিৎকার শেষ হওয়ার আগেই দেখলাম এডার পিছন থেকে প্রায় উদ্ভ্রান্তের মত ছুটতে ছুটতে আসছে এরিক আর মৌসুমী! কিন্তু অদ্ভুতভাবে ওরা কেউই এডার কাছাকাছিও আসতে পারল না তার আগেই কোন এক অলীক শক্তিবলে ওদের শরীর দুটো আচমকা মাটির থেকে শূন্যে উঠে স্থির হয়ে গেল।


এরপর আমি ঠিক যেটা ভয় পেয়েছিলাম, সেটাই হল। ন্যানি আমায় ছেড়ে ক্রমশ এক পা এক পা করে এগিয়ে যেতে লাগল এডার দিকে। কিন্তু কি অদ্ভুত! এইবার ন্যানিকে দেখে এডার মুখে একটুও ভয় ফুটে উঠল না। বরং ওর মুখে ফুটে উঠল একটা স্নিগ্ধ হাসি,


-" আমি তোমার সঙ্গে খেলতে চাই ন্যানি।"- এডার ঠোঁটদুটো নড়ে উঠল। এডার গলাটা ভেজা ভেজা শোনাচ্ছে। ও বলছে,


-" আমি কিন্তু জোর করে তোমার সঙ্গে খেলতে চাই না। ভয় পেয়েও খেলতে চাই না। আই জাস্ট ওয়ান্ট টু বি ইয়োর ফ্রেন্ড ন্যানি। আমি জানি একলা থাকতে কেমন লাগে। আমি জানি কোনো বন্ধু না থাকলে কতটা কষ্ট হয়। সেই ছোটবেলা থেকে এই শহরে আমারও কোনো বন্ধু নেই জানো। কিন্তু কদিন আগেই একজন আমার বন্ধু হয়েছে। শি...সুইটহার্ট!"


এডা আমার দিকে আঙুল তুলে দেখাল। ওর কন্ঠস্বর এখন অদ্ভুত পরিণত শোনাচ্ছে। 

-" সুইটহার্ট আমার প্রথম বন্ধু। আমি চাই না আমার জন্য আমার একমাত্র বন্ধু মারা যাক। প্লিজ মেক মি ইয়োর ফ্রেন্ড!"


-" এডাআআ!"- পিছন থেকে এবার প্রচন্ড চিৎকার ভেসে এল মৌসুমীর। শূন্যে ভাসমান অবস্থাতেই পাগলের মত হাউ হাউ করে কাঁদছে ও। কাঁদতে কাঁদতেই বলছে-" এডা! ডোন্ট ডু দিস এডা... তোকে ছাড়া তোর মা বাঁচবে কী করে! প্লিজ ডোন্ট ডু দিস!"


-" সরি মম আই হ্যাভ টু দিস।"- এডা মৌসুমীর দিকে তাকিয়ে এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। 

-" আমি জানতাম না তোমরা আমাকে এতটা ভালোবাসো মম। আমি তো ভাবতাম ড্যাড আমাকে ভালোইবাসে না!"


-" মিথ্যে! আই লাভ ইউ এডা!"- শূন্যে ভাসমান অবস্থাতেই চিৎকার করে উঠল  এরিক। -" আমি তোমায় আমার প্রাণের চেয়েও ভালোবাসি। বিলিভ মি। যেই মুহূর্ত থেকে তোমায় কোলে নিয়েছি সেই মুহূর্ত থেকে একজন বাবা হিসেবে চেষ্টা করেছি কিভাবে তোমায় বাঁচিয়ে রাখবো। আই ডিড এভরিথিং টু সেভ ইউ মাই লিটল এঞ্জেল। প্লিজ ডোন্ট ডু দিস। ফিরে এসো আমাদের কাছে।"


-" আই নো ড্যাড। এখন আমি সবটা জানি তোমরা আমায় কতটা ভালোবাসতে। আমি প্রাউড আমি তোমাদের মত বাবা মা পেয়েছি। বাট আই মাস্ট গো। আমার জন্য অনেকগুলো মানুষ মারা গেছে। তোমরা আমায় কখনও বলোনি যে আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তোমরা ওদের মেরে ফেলছ। আজ যদি আমি বেঁচেও যাই আমার জন্য সুইটহার্ট মরে যাবে। এরপরেও আরও তিনজন মরবে। দ্যাটস নট রাইট। তুমিই তো শিখিয়েছিলে না মম জেনে বুঝে কারুর ক্ষতি করতে নেই। নাও ডোন্ট আস্ক মি টু ডু দ্যাট!"


এডা এবার ন্যানির দিকে ফিরে তাকায়। ধীর পায়ে হাসতে হাসতে এগিয়ে যায় তার দিকে। তারপর তার দিকে হাত বাড়িয়ে হাসতে হাসতে বলে ওঠে-" উই উইল বি ফ্রেন্ড ন্যানি। বাট তোমাকে প্রমিস করতে হবে এই কার্স এখানেই শেষ হয়ে যাবে। আর তুমি কোনো মেয়েকে তোমার ফ্রেন্ড বানাবে না। আর কোনোদিন এখানে কেউ মেয়ে জন্মালে ভয় পাবে না। আতঙ্কিত হবে না। মেয়েদের অভিশাপ বলে ভাববে না। উইল ইউ বি মাই ফ্রেন্ড?"


সেই দীর্ঘ নারীমূর্তি এইবার স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল এডার দিকে। তারপর এমন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল যার জন্য আমি কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমি অবাক হয়ে দেখলাম ন্যানির হাত থেকে হাতুড়ি খানা মাটিতে পড়ে গেল। যেন এতদিনের রাগ, বিষণ্ণতা আর একাকীত্ব এক লহমায় ঝেড়ে ফেলল সে। তারপর ধীরে ধীরে কাঁপা কাঁপা হাতে তার সরু সরু আঙুলগুলো বাড়িয়ে দিল এডার দিকে।


এডা হাসতে হাসতেই সেই আঙুল গুলো চেপে ধরল। তারপরের মুহূর্তেই আমার দিকে তাকিয়ে বলল-" গুড বাই সুইটহার্ট! ভালো থেকো। মনে আছে তুমি বলেছিলে ভালো মানুষেরা মরে গেলে আকাশের স্টার হয়ে যায়? আমিও স্টার হয়ে যাবো। আই উইল মিস ইউ আ লট!"


-" এডাআআ!"- আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলাম। চোখের সামনে সিনেমার দৃশ্যের মত একের পর এক ভেসে উঠতে লাগল এডার সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তের স্মৃতি। সেই প্রথম দিন ওর আমার ঘরে এসে বিছানায় বসা, সেই একসঙ্গে কত গল্প করা, একসঙ্গে জঙ্গলে বেড়াতে যাওয়া...এই কদিনেই আরও কত স্মৃতি...সব যেন একের পর উড়ে উড়ে এসে আমার চোখে ঝাপটা মারতে লাগল। আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না। শুধু এডার দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম।


-" নাও আই মাস্ট গো!"- এডা এবার ন্যানির একদম সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর ন্যানির হাত ধরে মৌসুমীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল-" ওই গানটা গাও না মম, যেটা দিদিকে ঘুম পাড়ানোর জন্য গাইতে। আই এম অলসো গোয়িং টু স্লিপ নাও। ফরেভার। প্লিজ গাও না.."


-" নাআআআ..."- মৌসুমী আরও জোরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল পাগলের মত।


-" ওকে। তাহলে আমিই গাইছি। কিন্তু আমায় মাঝপথে এবার থামবে না... কেমন?"


এই বলেই এডা আরও শক্ত করে চেপে ধরল ন্যানিকে। আমার ঝাপসা হয়ে আসা চোখে আমি খেয়াল করলাম আমার চোখের সামনেই ন্যানি আর এডার শরীরটা আস্তে আস্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। এডা চলে যাচ্ছে। আমাকে ছেড়ে, ওর মাকে ছেড়ে, এই শহর এই দুনিয়া ছেড়ে অনেক অনেক দূরে। শুধু যাওয়ার সময় মুছে দিয়ে যাচ্ছে এই শহরের অন্ধকার অতীতকে। ও ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে সমগ্র মনুষ্যত্বের কালিমাকে। এডা ক্রমশ আবছা থেকে আরও আবছা হয়ে যাচ্ছে। শুধু এই অরণ্যের চারদিক থেকে ভেসে আসছে ওর মিষ্টি গলায় গান,

-" যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,

আমি বাইব না...

আমি বাইবো না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে...


চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,

মিটিয়ে দেব গো,   

মিটিয়ে দেব লেনা দেনা,

বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে--

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

 তারার পানে চেয়ে চেয়ে

 নাইবা আমায় ডাকলে।

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে..."

   

একসময় ন্যানির সঙ্গে এডার শরীরটাও সম্পূর্ন রূপে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। এরিক আর মৌসুমীর শরীরটাও নেমে এল মাটির ওপর। আমাদের তিনজনের চোখের জলই শুকিয়ে গেছে। আমরা তিনজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি মাথার ওপরে।  সেখানে জঙ্গলের মাথায় ঘন কুয়াশার জাল ক্রমশ একটু একটু করে কেটে যাচ্ছে। তার বদলে অন্ধকার অরণ্যের বুক চিরে নেমে আসছে স্বচ্ছতোয়া আলো। ভোর হচ্ছে। আর এই নতুন ভোরে সমগ্র অরণ্যের হৃদয় জুড়ে বাজছে এডার করুণ কন্ঠস্বর...


" তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।

সকল খেলায়...

সকল খেলায় করবে

খেলা এই আমি-- আহা,

নতুন নামে ডাকবে মোরে,   

বাঁধবে নতুন বাহু-ডোরে,

আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।


 তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

 তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে,

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে...."


// উপসংহার // 


বেশ কয়েক বছর পর...


-" এরপর কি হল মাম্মা?"


-" এরপর! এরপর ন্যানি আর ছোট্ট এডা হ্যাপি হ্যাপি মিস্ট শহরে থেকে গেল। ওদের আর কেউ ভয় করে না। ওরা আর কাউকে ভয়ও দেখায় না। বরং ওরা এখন এঞ্জেল হয়ে চুপিচুপি সমস্ত বাচ্চাদের প্রটেক্ট করে। আর যে সমস্ত বাচ্চারা একলা থাকে তাদের সঙ্গে গিয়ে খেলা করে!"


-" রিয়েলি!"


-" সত্যি!"- আমি চোখ টিপলাম। তারপর বললাম,

-" অনেকে বলে মিস্ট শহরের জঙ্গলে এখনও নাকি একটা লম্বা আর একটা ছোট্ট মেয়েকে মাঝে মাঝেই খেলতে দেখা যায়। কোনো বাচ্চা জঙ্গলে পথ হারিয়ে গেলে ওরা পথও দেখিয়ে দেয়।"


-" ওয়াও! আই লাভ দিস স্টোরি। দি স্টোরি অফ টল গার্ল এন্ড দ্য লিটল এঞ্জেল!"


-" এই নিয়ে কতবার গল্পটা বললাম তোমায়! নাও এবার ঘুমিয়ে পড়ো।"-


 আমার ছোট্ট মেয়ের কপালে চুমো একে দিলাম। 


-" এটা কি সত্যি গল্প মা? এমন শহর আছে?"


আমি যেন একটু থামলাম। তারপর বললাম,

-" আছে আছে আছে।"


-" ওয়াও...আমি ওই শহরে যাবো। ন্যানি আর এডার সঙ্গে খেলা করতে। ইয়েএএ..."


আমার পুচকি মেয়েটা আমার কোল থেকে লাফিয়ে উঠে হাত দুটো দুদিকে মেলে ধরে ঘরের মধ্যে মনের আনন্দে ঘুরতে লাগল। আমি একটু রেগে বললাম,

-" অনেক হয়েছে এডা! এবার ঘুমাও!"


কি চমকে গেলেন? হ্যাঁ আমার মেয়ের নামও এডাই রেখেছি। ওই শহর ছেড়ে আসার আজ এতগুলো বছর পরেও এডাকে এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারিনি। সর্বক্ষন ওর সেই হাসি মাখা মুখটা আমার চোখের সামনে ভাসে। আর কি আশ্চর্য জানেন আমার মেয়েকেও না অবিকল এডার মতোই দেখতে হয়েছে। আমি জানি আপনারা কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু আমি মনে মনে নিশ্চিতভাবে জানি আমার এডা তার সুইট হার্টের কাছে ঠিক ফিরে এসেছে।

 

ওই দেখুন। শুনতে পাচ্ছেন? আমার এগারো বছরের পুঁচকে এডা নিজের মনে খেলতে খেলতেই আমায় এবার ডাক দিচ্ছে,


-" সুইটহার্ট! 

the game is on buddy! 

wanna play with me?"

Post a Comment

0 Comments