অন্ধকার


ঘরের উপরের কড়িকাঠের কাছাকাছি একটা ফুট দুয়েকের খুপরি। এ ঘরে আসা যাওয়ার একমাত্র রাস্তা। আজ বহুবছর একটানা বন্ধ থাকার পরে খুলে গেছে সেটা। সেখান থেকেই লাফিয়ে নিচে নেমে এল মেয়েটা । তার অন্ধকারে ডুবে থাকা শরীর মেঝের উপরে এসে পড়তেই ফাঁকা ঘরের প্রতিটা কোণায় প্রতিধ্বনি শোনা গেল। ঘরটা যেন মহাবিশ্বের কোনো ফাঁকা প্রাণহীন গ্রহ। হাহাকারের মতো শোনাল প্রতিধ্বনিটা । 
ঘরের ঠিক মাঝামাঝি হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এল সে। হাত দিয়ে কিছু যেন খোঁজার চেষ্টা করল । দীর্ঘ, সুঠাম শরীর তার। 
দেওয়াল জুড়ে লম্বা লম্বা কালচে দাগ— পোড়া আগুনের ছাপ। ভালো করে লক্ষ করে বোঝা যায় আগুনের কালো ছোপের মধ্যে কয়েকটা দীর্ঘ সাদা দাগও লেগে আছে দেওয়ালে । যেন নখ দিয়ে কেউ চেরার চেষ্টা করেছে দেওয়ালটা । 
কী হয়েছিল এখানে? 


কিছু একটা খুঁজে নিয়ে হাঁটুর ঠিক সামনে একটা মোমবাতি জ্বালে মেয়েটা। কাঠিটা ছুড়ে ফেলে দেয় দূরে, মোমের শিখাটা কিছুক্ষণ থরথর করে কাঁপার পর আস্তে আস্তে শক্তি পায় তারায়…

শিখায় জ্বলতে থাকে সেটা। এ ঘরে বাতাস কম। যেটুকু আছে তাও কয়েক দশকের পুরনো । আগুন জ্বালানোর তেজ বহুকাল হলো হারিয়েছে তারা । 
শিখার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আচমকাই চোখ বুজে ফেলে মেয়েটা । বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে থাকে । একটা মন্ত্র— ভাষাটা চেনা যায় না। 
নিস্তব্ধ ফাঁকা ঘরের দেওয়ালে সুরের বোল তোলে সেই মন্ত্র। যেন পৃথিবীর গভীরতম কোনো গহ্বরে লুকানো কোনো মন্দির থেকে বহু মানুষের মন্ত্রপাঠের শব্দ ভেসে আসছে । 
মানবসভ্যতার থেকে প্রাচীন, নিষিদ্ধ কোনো মন্ত্র… 
মিনিট খানেক সেইভাবে কেটে যায় । ক্রমে ভারি হয়ে উঠছে ঘরের বাতাস। কোথা থেকে হালকা বাঁশির শব্দ আসছে । 
উলটোদিকের দেওয়ালে মেয়েটার ছায়া স্থির। একটুও কাঁপছে না। একটা ঘন ধোয়া জড় হচ্ছে ঘরের চারপাশে । ক্রমশ ঘরের ঠিক মাঝখানে জমাট বাঁধছে ধোঁয়াটা! একটু একটু করে বড় হচ্ছে । বাঁশির আওয়াজটা আসছে সেই জমাট বাঁধা ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মাঝখান থেকে… সম্মোহনী বাঁশি। ধোঁয়াটা জীবন্ত। 
ধীরে ধীরে মেয়েটাকে ঢেকে ফেলছে ধোঁয়াটা! পা বেয়ে উঠে আসছে বুকে, তারপর গলায়, মাথায়… দেবতার শিরস্ত্রাণের মতো মেয়েটার মাথার পিছনে গোল একটা চক্র তৈরি করেছে ধোঁয়াটা! এখন বাঁশির সুর আরও স্পষ্ট, ভালো করে কান পাতলেই বোঝা যায় কী বলতে চাইছে সুরটা। 
মেয়েটার মুখটুকুনি ছাড়া সমস্তটাই কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে। আরও আরও বেড়ে উঠেছে বাঁশির শব্দ। 
হঠাৎ চোখ খুলল মেয়েটা। সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল মোমবাতিটা । এবার সেই 
বাঁশির আওয়াজের সঙ্গে শোনা যাচ্ছে আর একটা শব্দ… মেয়েটা মৃদু হাসছে… ক্রুর, শয়তানী
হাসি। তার অন্ধকারে ঢাকা মুখটা আর দেখা যাছে না । শুধু দুটো চোখের তারা আলো ছাড়াই যেন জ্বলছে । একটা সাদা জ্যোতি বেরিয়ে আসছে সেখান থেকে । উজ্জ্বল আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ছে ঘরময়… 
সময়ের সীমানা পেরিয়ে, নক্ষত্রের আলোর মতো গোটা মহাকাল ফুটে উঠছে তার চোখের তারায়…


শুন্য


পাঁচিলের ভাঙা ফাটল দিয়ে ভিতরে ঢুকে এল ছেলের দল । এই ফাটলটার আগে অবধি ওরা চারপাশে দেখে শুনে সাবধানে পা চালায় । কেউ দেখে ফেললে নিজেদের মধ্যে গল্প করার অছিলায় না দেখার ভান করে । ফাটলের সামনে এলেই সবার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায় । তখন এদের মধ্যে দু-একজন মাতব্বর আগে ফাটলের ভিতরে উঁকি মেরে দেখে নেয় ভিতর থেকে কেউ লক্ষ করছে কিনা। কেউ নেই দেখলে দ্রুত ইশারা করে সবাইকে ভিতরে আসার ইঙ্গিত দিয়ে দেয় । তারপরেই ছোট দলটার মধ্যে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে যায় । যে যাকে পারে ঠেলাঠেলি করে ঢুকে আসে ভিতরে। এদের মধ্যে মাধব নামে ছেলেটা একটু দুর্বল। তার উপরে কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত আমাশায় ভুগে শরীরটাও চালতার মতো শুকিয়ে গেছে। সেই ঢাকে সবার শেষে । ঢুকে খানিকক্ষণ জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । তারপর বাকিদের ধরতে সজোরে দৌড় মারে । ভিতরে ঢুকে আর গা ঢাকা দিতে হয় না ওদের । জমিদারবাড়ির ভিতরে ওদের উপর নজর রাখার কেউ নেই । 
মাতব্বরদের একজন হল হরে । তার চেহারাটা একটু গাঁট্টাগোট্টা, তাছাড়া সে পড়াশোনাতেও চৌকশ । ভয়ানক স্মৃতিধর । বাকি ছেলেরা যখন তেরোর 
নামতার শেষের দিকে এসেই হোঁচট খায় তখন হরে গড়গড় করে তেইশ এমন কি সাতাশ অবধি বলে যেতে পারে । ফলে বাকি ছেলেপুলেদের তাকে নেতা বলে জ্ঞান করতে খুব একটা সম্মানে লাগে না। আজ হরে ভিতরে ঢুকেই মাটি থেকে একটা লাঠি তুলে নিল। তারপর চারপাশটা একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বলল “আলো পড়ে গেচে, লুকাচুরি জমবে ভালো ।” সামনে দাঁড়ানো জনা চারেক ছেলের মধ্যে থেকে একটা প্রতিবাদের রেশ ওঠে, “না। ওতে তুই বারেবারে জিতে যাস । অন্য কিছু খেলা হবে!” 
হাত তুলে গণ্ডগোলটা থামায় হরে। তারপর আশ্বস্ত করে বলে, “আমার আজ শরীরটা ভাল্লাগছে না। তোরা খেল, আমি দেখি।” 
খানিক গাইগুই হল। শেষে লুকোচুরিই ঠিক হল! এখন মোমের শিখার শেষ প্রান্তের রঙে রেঙে খানিকটা সন্ধে নেমে পড়েছে। মহলের দিকের আলোগুলোও এই ফাঁকে জ্বালিয়ে দিয়েছে কেউ। 
গোটা জমিদারবাড়িটা ঘুমস্ত পাহাড়ের মতো বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে শুয়ে আছে। তার গা থেকে একটু আগেই মরা রোদ নিভতে নিভতে একেবারে বিলীন হয়ে এসেছে । দক্ষিণের অন্দরমহলের ভিতরে কয়েকটা ঘর থেকে হ্যাঁরিকেনের আলো দেখা যাচ্ছে । সেই সঙ্গে একটানা ঝিরি ডেকে চলেছে ঘাস-পাতার আড়াল থেকে। স্যাঁতস্যাঁতে সন্ধ্যার গন্ধ নামছে বাতাসে । কান পাতলে শোনা যায় হালকা বাঁশির মতো হিসহিস আওয়াজ। সাপের আওয়াজ কি? হতেও পারে… 
এই ছেলেরা সাপে ভয় পায় না। ওদের কাছে সন্ধের জমিদারবাড়িটা এক অবাক বিস্ময়ের সন্ধান দেয়। 
সারাদিন দু-পাচজন ট্যুরিস্ট ভিড় করে এখানে । পাঁচটায় সদরের দরজা বন্ধ হলে বাড়ির বাইরের দিকের এই পিছনের অংশটা একেবারে ফাঁকা হয়ে যায়। সেই সুযোগে সবার চোখ এড়িয়ে তার ভিতরেই দৌড়াদৌড়ি করে খেলা করে স্কুলফেরত ছেলেরা । 
ওদের গলার আওয়াজ পেয়ে সদরের দারোয়ান কাশীনাথ একবার দেখতে এসেছিল এদিকটা। এমনিতে জমিদারবাড়ির চত্তরে বিশেষ অনুমতি ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেয়ার নিয়ম নেই কিন্তু কাশীনাথের সঙ্গে একরকম চুক্তি হয়ে গেছে এই বাচ্চাগুলোর । 
এখানে কাছেপিঠে দোকান নেই । রোজ স্কুলের সামনে মনিহারি দোকান থেকে কাশীনাথের জন্যে বিড়ির প্যাকেট এনে দেয় এরা। কাশীনাথও বিড়ি পেয়ে খুশি হয়ে তাদের ঘণ্টাখানেক এখানে থাকার অনুমতি দেয় ।
আজও তাদেরকে দেখে বিশেষ আপত্তি করে না কাশীনাথ । হরে বিড়ির প্যাকেট এগিয়ে দিতে একবার ভারি গলায় বলে, “শীতকাল পল্লি এট্টু জলদি আসতি হয়, অন্দকারে তুমরা খেলা কর, আর কিছু হলে আমার সাক্রিটা যাক?” 
হরে কান দেয় না কথাটায় । কাশীনাথ তার পাশে বসে পড়ে বিড়িতে একটা টান দেয়। তারপর কণ্ঠ নামিয়ে বলে, “মণ্ডলে ভূত আছে, তা জানো?” 
একটা ফুৎকার করে হরে, “ওইসব ছেলে ভুলানো গল্প বলে লাভ নেই দাদু! আমাদের ইস্কুলে বলেছে ভূত বলে কিছু নেই ।” 
কথাটা মেনে নিতে পারে না বৃদ্ধ কাশীনাথ, গুনগুন করে বলে, “নাও যদি থাইকবে তালে আমি কারে দেকলুম?” 
“তুমি আবার কী দেখলে?” অর্ধেক কৌতূহল দেখায় হরে । 
“তা বললি তুমি বিসসেস করবে নে। একটা ম্যায়ছেলে ঘুরি বেরায় একনে। একদিন রাতে থাকলি দেকতি পাবে!” 
বাকি অর্ধেক কৌতূহল জেগে ওঠে হরের । সেই সঙ্গে ভুরু দুটোও কুঁচকে ওঠে। কাশীনাথের দিকে ফিরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সে, এমন সময় অন্য একটা গলা পিছন থেকে শুনে ঘুরে তাকায়। 
অন্দরমহলের বেড়ার থেকে খানিকটা দূরে যেখানে তারা বসেছে তার পিছন দিয়ে প্রাসাদের চাতাল পেরিয়ে দীঘির দিকে যাবার রাস্তা! সেই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ওদের দেখতে পেয়ে আওয়াজ দিয়েছে একটা লোক । কাশীনাথ 
একে চেনে। বাড়ির উত্তরের মহলে কিছু অংশের মেরামতের বন্দোবস্তু করা হয়েছিল। সিনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ইনি এসেছেন। আপাতত উত্তর প্রাসাদের একটা ঘরেই রয়েছেন। 
কাশীনাথকে বিড়ি টানতে দেখে মুচকি হেসে তিনি বললেন, “বা, এখানেও ঘুষ-টুষের কারবার চলে দেখছি ।” 
বিড়িটা মুখ থেকে সরিয়ে একটা অপ্রস্তুত হাসি হাসে কাশীনাথ।! তারপর ব্যাপারটাকে সামলে
বলে, “আপনে ইদিকে সন্দেবেলা কেন আসেন বাবু? সাপের উৎপাত ।” 
“আমার আবার একটু সন্ধের হাওয়াটা না খেলে কাজে মন লাগে না। বিশেষ করে এখানে দীঘিটা দেখার পর থেকে তো আর লোভ সামলাতে পারি না।!” 
“রাইতে এট্টু তাড়াতাড়ি আইসবেন বাবু। কোতায় কি থাকে…” 
“কী আবার থাকবে? ওসব ভূতের গল্প তুমি বাচ্চাদের শুনিও । বরঞ্চ গেটটা ফাঁকা রেখো না। ভিতরে ঢুকে কে কি হাতিয়ে নেবে ।” বলতে বলতে পা চালিয়ে দীঘির দিকে চলে যায় লোকটা । 
দুবলা মাধবকেই প্রথম চোর করা হয়েছে। বাকিরা গিয়ে লুকিয়েছে উত্তরের অন্দরমহলে । দীঘির পাড় বরাবর এগিয়ে যায় মাধব । পিছন থেকে বন্ধুদের ডাক তার কানে একটু একটু করে মিলিয়ে আসে। 
এতক্ষণে আকাশে চাঁদ উঠেছে । দীঘির জলে ছায়া পড়েছে তার । ওপারের গাছগুলোর মাথা বেয়ে আঁধার নেমে আসছে পাড়ে । গা’টা ছমছম করে উঠল মাধবের । অবশ্য আর একটু কাছে আসতেই ভয়টা কেটে গেল। 
দীঘির পাড়েই একটা লোক বসে আছে । দুটো হাত পিছনে ছড়িয়ে দূরের দিকে চেয়ে আছে একটানা । পিছনে পায়ের আওয়াজ পেয়ে একবার ঘুরে তাকাল লোকটা । মাধবকে দেখতে পেয়ে তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকল। 
বাকিদের ভালো জায়গা খুঁজে লুকাতে একটু সময় লাগবে। মাধব খুব একটা আপত্তি না করে এগিয়ে গেল। লোকটা মাধবের পিঠে একটা হাত রেখে বলল, “তোরা যে এখানে খেলতে আসিস, ভয় করে না?” 
মাথা নাড়ে মাধব । মনে মনে এক থেকে চল্লিশ গুনতে শুরু করে। লোকটা একটু অবজ্ঞার হাসি হেসে বলে, “যদি এই জলে পড়ে যাস?” 
“সাঁতার জানি আমি।” গুনতে গুনতেই জবাব দেয় মাধব। 
“সে তো আমিও জানি। তাও ভয় লাগে ।”

“কীসের ভয়?” 
লোকটাকে একটু ভাবুক দেখায়, দূরে অদৃশ্য চাঁদের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বলে, “কি জানি, এই দীঘির পাড়টায় এলেই মনে হয় কে যেন তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তোর মনে হয় না?” 
আবার মাথা নাড়ে মাধব। একটু একটু ভয় যে তার লাগে না তা নয় কিন্তু বাইরের লোকের কাছে সেটা স্বীকার করে ফেললে আরও বেশি করে তার হাবাগোবা বলে বদনাম রটে যাবে। 
লোকটা কিন্তু থামে না, যেন নিজেকেই বলছে, এইভাবে বলে যেতে থাকে, “খালি মনে হয় কেউ যেন জলের দিকে টানছে । এই বুঝি টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলবে দীঘির জলে ।” 
মাধবের গোনা শেষ হয়ে গেছিল, সে আর না দাঁড়িয়ে দৌড় দিল ভাঙা অন্দরমহলের দিকে । নরম ঘাসের উপর দিয়ে তার পায়ের আওয়াজ শোনা গেল বেশ জোরে। ক্রমশ মিলিয়ে এল! 
রাত আর একটু বেড়ে উঠতে জায়গাটা ছেড়ে ছেলের দল একে একে বাড়ি চলে গেল। 
মহীতোষ কিন্তু দীঘির পাড় থেকে উঠল না। আজ যেন তাকে নেশায় পেয়েছে। উঠতে ইচ্ছা করছে না। দূর গাছের ফাঁক দিয়ে হাওয়া এসে মাঝে মাঝেই ঢেউ খেলিয়ে দিচ্ছে জলের উপরে। তাছাড়া কি আশ্চর্য শান্ত জলটা! একটা মাছও কি নেই? 


পিছনে একটা পায়ের আওয়াজ পেয়ে ফিরে
তাকাল মহীতোষ। এখন কে আসতে পারে? দারোয়ান কাশীনাথ? নাকি অন্য কেউ? 
পিছন ফিরে কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না সে। শুধু দমকা হাওয়ার একটা ঝাপটা এসে লাগল মুখে। চুল উড়িয়ে দিল। বহু দূর থেকে গুনগুন করে একটা গান ভেসে আসছে যেন। খুব করুণ সুরে কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে। ভারি চেনা লাগে সুরটা। 
মাথা সামনে ঘুরিয়ে নিয়েছিল মহীতোষ। সঙ্গে সঙ্গে আবার মনে হল কেউ এসে দাঁড়িয়েছে পিছনে। 
পিছনের জমিটা পুরোটাই ঘাসের। তার উপরে কেউ হাঁটলে ঠিক এরকমই শব্দ হবার কথা। কিন্তু কই? কেউ তো নেই ।
 উঠে দাঁড়ায় মহীতোষ । হাতের টর্চটা জ্বেলে একবার পুরো জায়গাটা দেখে নেয় । শুধু যে এই জায়গাটায় জনপ্রাণী নেই তাই নয়, এখানে একবার এসে দাঁড়ালে মনে হয় গোটা পৃথিবীটাই যেন আচমকা ফাঁকা হয়ে গেছে । 
“কে ওখানে?” 
একটা ঝোপ নড়ে উঠতে সেদিকে আলো ফেলে মহীতোষ। চারদিকটা 
ভালো করে দেখে একটা ছোট লাঠি খুঁজে নেয় । তার কাছে আপাতত দামি কিছু নেই । তাও কারও খারাপ উদ্দেশ্য থাকতেই পারে । 
টর্চটটা ঝোপের উপরে ধরে লাঠিটা উঁচিয়ে এগিয়ে যায় মহীতোষ । এখনও নড়ছে ঝোপের
পাতাগুলো । কিছু একটা আছে ওখানে তা নিয়ে সন্দেহ নেই । গুনগুন বাঁশির আওয়াজটা বেড়ে উঠেছে। 
কাঁপা কাঁপা হাতে লাঠিটা দিয়ে ঝোপের একটা ডালকে একপাশে চেপে ধরে মহীতোষ। তারপর এক ঝটকায় সজোরে একটা বাড়ি মারে তার উপরে। নাঃ কিচ্ছু নেই । 
ঝোপের ভিতরে ছেলেদের ফেলে যাওয়া একটা বল চোখে পড়ল । অথচ একটু আগেই কাউকে এখানে হাঁটতে শুনেছে সে । গেল কোথায় তাহলে লোকটা? 
মহীতোষ ভিতু নয় । তাই যদি হত তাহলে এই মুহূর্তেই সে ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রাসাদের দিকে দৌড় দিত । তার বদলে লাঠিটা আরও শক্ত করে ধরে সে জলের দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতরটা হিম হয়ে গেল তার। মনে হল এতক্ষণ যেন জলের ভিতর থেকে মুখ তুলে কেউ তাকিয়ে ছিল তার দিকে। সে ফিরে তাকাতেই মাথা নামিয়ে নিয়েছে। শান্ত জলের সেই জায়গাটায় এখন গোল হয়ে ঢেউ খেলে যাচ্ছে… 
এইবার সত্যিকারের ভয় লাগল মহীতোষের । জলের দিকে এক’পা এক’পা করে এগিয়ে গেল সে। সত্যি কেউ আছে এখানে । শুধু এই জলের ধারে নয়, এই প্রাচীন জমিদারবাড়ির আনাচে কানাচে, বিরাট সিমেন্টের থামে, শ্যাওলা ধরা শ্বেতপাথরের মূরতিগুলোর নিশ্চল চোখে, জীবন্ত কিছু লুকিয়ে আছে সবার চোখের আড়ালে। খুন, ক্ষোভ, প্রতিহিংসা, অত্যাচারের যে গোপন উপাখ্যান —- ইতিহাস তার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে রাখে, আজ যেন তা উজাড় করে দেখাতে এতটুকু আপত্তি নেই তার । 
মাছের ঘাই মারার মতো একটা গোল ঢেউ চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে । দীঘির ঠিক সেই জায়গাটায় একটানা তাকিয়ে থাকল মহীতোষ । তার সমস্ত 
ইন্দ্রিয় এখন একটু বেশি সজাগ হয়ে উঠেছে। 
গোল ঢেউটার উপরে স্থির হয়ে রয়েছে টর্চের
আলো । জলের উপরে ভেসে থাকা কয়েকটা খড়ের টুকরো সদ্য মিলিয়ে যাওয়া জোতের ধান্ধায় এখনও ভেসে চলেছে । 
জলের উপর এসে পড়া তারার আলোর দিকে তাকিয়ে একটা ভাবনা এসে চেপে ধরল মহীতোষকে । আজ যে তারাগুলোকে সে জলের উপরে দেখছে তার বেশিরভাগই আজ মৃত। কোনো একসময় জীবিত ছিল তারা। পৃথিবী থেকে তাদের দূরত্ব এত বেশি যে মানুষের চোখে যতদিনে সেই আলো গিয়ে পৌছায় ততদিনে তারা আলো শেষ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। 
এই জমিদারবাড়িতে আজ থেকে দেড়শ বছর আগে যারা থাকত তাদের কেউ আর বেঁচে নেই । তবু হয়তো তাদের জীবিত সময়ের আলো আজও ইতিহাসের বুক চিরে ঘুরে বেড়ায় এ বাড়ির আনাচে কানাচে… 
এমন কি কিছু আছে? যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় না? এমন কিছু… যা যুগের পর যুগ সময়ের বেড়াজাল পেরিয়ে হিসেব রেখে যায় সমস্ত ভাঙা-গড়ার? 
উত্তরটা একটু পরেই পেল মহীতোষ। 
পরদিন সকালে মহিতোষকে না পেয়ে একটু ঘাবড়ে গেল কাশীনাথ। রোজ সকালে সে এখানেই চা রেখে যায়। আজ বাইরে থেকে কড়া নাড়তে গিয়ে খেয়াল হল দরজা বাইরে থেকেই বন্ধ । মানে মহীতোষ এখনও দীঘির ধার থেকে ফেরেনি। রাতে কি ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি? 
ঘড়িটা একবার দেখে নিয়ে সন্দেহ আরও দৃঢ় হল কাশীনাথের। এত বেলা অবধি দীঘির ধারে শুয়ে থাকলে চোখে আলো পরেই ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার কথা। এখনও তাহলে ফিরল না কেন? 
চাটা রান্নাঘরেই রেখে এসে সিঁড়ি পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল কাশীনাথ। বাইরের চাতালে এখন সকালের রোদ মেলা বসিয়েছে । সেটা পার করে 
খানিকটা ধীর পায়েই সে দীঘির দিকে চলে এল। ঝকঝকে আয়নার মতো দীঘির জল নিস্তরঙ্গ হয়ে শুয়ে আছে। একটা ঢিমে হাওয়া বয়ে চলেছে
ক্রমাগত, 
দীঘির পাড় ফাঁকা। মানুষজনের কোনো চিহ্ন নেই সেখানে। এতক্ষণে মনটা কেমন কুডাক ডেকে উঠল কাশীনাথের। তবে কি সকালে উঠে বাইরে কোথাও গেছেন? কিন্তু দেউড়ির দরজা তো এখনও খোলেনি কাশীনাথ। দরজা বন্ধ থাকলে লোকটা যাবে কোথায়? 
অবশ্য জমিদারবাড়ি নেহাত ছোট নয় । অন্য কোনো মহলে গিয়ে থাকলে… … কাশীনাথ মাথা নাড়ে। মহীতোষ বসুকে সে যতটা চিনেছে তাতে লোকটা সকালে উঠে বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াবার লোক নয় । তাহলে? 
এবারে পিছনে তাকিয়ে কিছু লোকজনকে এদিকে আসতে দেখল কাশীনাথ। এরা এই বাড়িরই ভাড়াটে । সকালে দীঘির ধারে হাঁটতে আসেন। এদের মধ্যেও দেখা গেল না মহীতোষ বসুকে। 
সে আসতে যাচ্ছিল । এমন সময় দীঘির ধারে কিছু একটা জিনিসে চোখ পড়তে সে থমকে দাঁড়াল । দীঘির ঠিক ধারেই জলের ছাঁট লেগে মাটি নরম হয়ে আছে । তার উপরেই কয়েকটা আঁকিবুকি দাগ ফুটে আছে । যেন কাঁপা কাঁপা আঙলের চাপে কিছু লিখে আবার মাটি লেপে দিয়েছে কেউ । তারপর সেই মাটির উপর আবার আঙ্গুল বুলিয়ে আঁকা একটা পাকানো গোল দাগ … মশার ধুপের মতে। 
একটা চিহ্ন। 
লেখাটা থেকে একটু দূরেই একটা পায়ের ছাপ। দীঘির দিকে এগিয়ে গেছে ছাপটা । দীঘির নিটোল জলের উপরে গিয়েই মিলিয়ে গেছে। আর ফিরে আসেনি । 
কাশীনাথ ভালো লেখাপড়া জানে না। তার উপরে মাটি লেপে দেওয়ায় লেখাগুলো আর কিছু দেখা যায় না। বরঞ্চ মশার ধুপের মতো চিহন্টার মানে সে জানে। ছেলেবেলায় এ বাড়ির কোনো একটা জায়গায় এই চিহ্টটা দেখেছে সে। কোন জায়গায় সেটা আর মনে পড়ে না।
কিছু একটা মনে পড়তেই কয়েক পা পিছিয়ে এল কাশীনাথ… তার বৃদ্ধ বুকে একটা ভয়াবহ উত্তেজনার ঢেউ ঝাঁপিয়ে পড়ছে ক্রমাগত… 
‘সকালের রোদে মহীতোষ বসুর আঙ্গলের ছাপে তৈরি চিহ্নটা এখন জ্বলজ্বল করছে— প্রাচীন পৌরাণিক ধারণা অনুসারে যার অর্থ — পুনর্জন্ম।

প্রথম অধ্যায় 


“খুন! সবাই এটাই কেন জিজ্ঞেস করে বলুন তো আগে?” শশাঙ্ক পালিত দাঁতের ফাকে হাসল । তারপর মিনমিন করে নিতান্ত অদরকারি কথার মতো বলল, “যে মৃত্যুগুলো হয়েছে সেগুলোর সবকটাই বলা যায় ন্যাচারাল ডেথ!। আনইউজুয়াল সেরকম কিছু নেই !” 
নীলাদ্রি এতক্ষণ সিঁড়ির নিচের খসে পড়া প্লাস্টারের তাপ্পি দেওয়া কড়িকাঠের দিকেই তাকিয়েছিল । এবার মাথা নামিয়ে বলল, “ডেথ ব্যাপারটইি ন্যাচারাল নয় শশাঙ্কবাবু, সে বিছানায় শুয়ে হোক কিংবা পাহাড় থেকে পড়ে ।” 
শশাঙ্ক আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল । তাকে থামিয়ে দিল সুনন্দা! তুলির ঘুমন্ত মুখটা নিজের এক কাঁধ থেকে অন্য কাঁধে বদলে নিয়ে বলল, “ডেথটা আমাদের কনসার্ন নয়; বাড়ির যা অবস্থা দেখেছি তাতে যে কোনো সময় ছাদ খসে পড়তে পারে । বিশেষ করে বর্ষাকালটা…” 
“অমন দেখে মনে হয় দিদিভাই, এ কি আর আজকের নরম গাঁথনির বাড়ি? খাস জমিদারবাবুর নিজের তদারকিতেই তৈরি…” 
“জমিদারবাবু আর বেঁচে নেই ।” নীলাদ্রি বলে ওঠে, “তাই ছাদ ভাঙলে সেটা তার ঘাড়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই । আমাদেরই প্রাণটা খোয়া যেতে পারে ।” 
একটু থেমে আবার বলল, “শুনেছি সাউথের বিল্ডিংটা একটু পাকাপোক্ত আছে । ওদিকটায় তো দিতে পারতেন?” 
শশাঙ্কর মুখ দেখে মনে হল সে ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হয়েছে কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে চাইছে না। জোর করে আগের হাসিটা হেসে বলল, “ওদিকে এখনও পাইপের জলের ব্যবস্থাটা হয়নি, আপনারা যদি কুয়ো থেকে জল নিয়ে কাজ চালাতে পারেন তাহলে আমাদের অসুবিধা নেই ।” 
নীলাদ্রি আর কিছু বলল না। সুনন্দাও মুখ নামিয়ে নিয়েছে । থাকার জায়গা নিয়ে খুব বেশি
“খুন! সবাই এটাই কেন জিজ্ঞেস করে বলুন তো আগে?” শশাঙ্ক পালিত দাঁতের ফাকে হাসল । তারপর মিনমিন করে নিতান্ত অদরকারি কথার মতো বলল, “যে মৃত্যুগুলো হয়েছে সেগুলোর সবকটাই বলা যায় ন্যাচারাল ডেথ!। আনইউজুয়াল সেরকম কিছু নেই !” 
নীলাদ্রি এতক্ষণ সিঁড়ির নিচের খসে পড়া প্লাস্টারের তাপ্পি দেওয়া কড়িকাঠের দিকেই তাকিয়েছিল । এবার মাথা নামিয়ে বলল, “ডেথ ব্যাপারটইি ন্যাচারাল নয় শশাঙ্কবাবু, সে বিছানায় শুয়ে হোক কিংবা পাহাড় থেকে পড়ে ।” 
শশাঙ্ক আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল । তাকে থামিয়ে দিল সুনন্দা! তুলির ঘুমন্ত মুখটা নিজের এক কাঁধ থেকে অন্য কাঁধে বদলে নিয়ে বলল, “ডেথটা আমাদের কনসার্ন নয়; বাড়ির যা অবস্থা দেখেছি তাতে যে কোনো সময় ছাদ খসে পড়তে পারে । বিশেষ করে বর্ষাকালটা…” 
“অমন দেখে মনে হয় দিদিভাই, এ কি আর আজকের নরম গাঁথনির বাড়ি? খাস জমিদারবাবুর নিজের তদারকিতেই তৈরি…” 
“জমিদারবাবু আর বেঁচে নেই ।” নীলাদ্রি বলে ওঠে, “তাই ছাদ ভাঙলে সেটা তার ঘাড়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই । আমাদেরই প্রাণটা খোয়া যেতে পারে ।” 
একটু থেমে আবার বলল, “শুনেছি সাউথের বিল্ডিংটা একটু পাকাপোক্ত আছে । ওদিকটায় তো দিতে পারতেন?” 
শশাঙ্কর মুখ দেখে মনে হল সে ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হয়েছে কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে চাইছে না। জোর করে আগের হাসিটা হেসে বলল, “ওদিকে এখনও পাইপের জলের ব্যবস্থাটা হয়নি, আপনারা যদি কুয়ো থেকে জল নিয়ে কাজ চালাতে পারেন তাহলে আমাদের অসুবিধা নেই ।” 
নীলাদ্রি আর কিছু বলল না। সুনন্দাও মুখ নামিয়ে নিয়েছে । থাকার জায়গা নিয়ে খুব বেশি
বিলাসিতা করার মতো ক্ষমতা থাকলে কলকাতা ছেড়ে এই গঞ্জে পুরানো জমিদারবাড়িতে ঠাই নিতে হত না। একমাস হল নীলাদ্রির মার্চেন্ট অফিসের চাকরিটা চলে গেছে । সুনন্দা বাড়িতে টিউশনি করত বেশ কয়েকটা। তাছাড়া জমানো টাকাও খানিকটা ছিল। কিন্তু তাতে আর যাই হোক মাসে মাসে বাড়িভাড়া গুনলে চলে না। ফলে বাধ্য হয়ে প্রস্তাবটা গ্রহন করতে হয়েছে। 
প্রস্তাবটাও ভারি অদ্ভুত । সুনন্দাই এক ছাত্রের মায়ের মুখে প্রথম জানতে পারে খবরটা । এক ধনী দম্পতি সপ্তাখানেকের জন্যে জরুরি দরকারে বিদেশ যাচ্ছেন। তাদের একটি বছর দশেকের মেয়ে আছে। ঘটনাচক্রে সেই মেয়েটিকে এক্ষুনি তারা নিয়ে যেতে চাইছেন না। ফলে সাতদিনের জন্যে এমন কাউকে তাদের দরকার যারা মেয়েটির দেখাশোনা করতে পারে। 
তবে নিজের বাড়িতে মেয়েটিকে আনা যাবে না। হুগলী সদর থেকে বেশ খানিক ভিতরে জামালপুর থানার অধীনে একটা ছোট জনপদ আছে— চকদীঘি। সেখানে একটা পুরনো জমিদারবাড়ি সরকারি তত্ত্ববধানে লিজ নিয়েছেন এনারা ।এই একটা সপ্তাহ মেয়েটিকে নিয়ে সেইখানেই থাকতে হবে। মেয়েটির ঠিক মতো দেখাশোনা হচ্ছে কিনা সেটা দেখার জন্যে কয়েকজন লোককে বাড়িতেই রাখা হবে। বাদ বাকি সমস্ত দায়িত্ব তাদের নিজেদের । 
প্রস্তাবটা শুনে প্রথমে কিছুতেই রাজি হতে চায়নি নীলাদ্রি। গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলেছিল, “উঁহু, এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন দু’নম্বরি ব্যাপার আছে। নিজের মেয়েকে কেউ অন্যের কাছে রেখে যায় নাকি? তাও আবার আজকের সময়…” 
“অন্যের কাছে কোথায় রাখছে? বাড়ি ভরতি ওদের লোকজন থাকবে । আমাদের খালি কয়েকদিনের জন্যে মা-বাবার মতো দেখাশোনা করতে হবে! 
ইটস টু ইজি…” 
তাও গাঁইগুই করেছিল নীলাদ্রি, “তারপর
মেয়েটার কিছু গণ্ডগোল হলে? সব দোষ কিন্তু তোমার-আমার ঘাড়ে চাপবে!” 
“ওইটুকু মেয়ের কী হবে? আর আমরা দুটো এতবড় মানুষ একটা দশ বছরের মেয়েকে সামলাতে পারব না!” 
শেষপর্যন্ত কিন্তু যুক্তিতর্ক ধোপে টেকেনি । পকেটে টাকাপয়সা না থাকলে ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলে আলাদা করে কিছু থাকে না । নীলাদ্রিও রাজি হয়েছে শেষ অবধি। সুনন্দা পা বাড়িয়েই ছিল । তুলিকে দেখার পর থেকে দু’জনের যেটুকু কিন্তু-কিন্তু ভাব ছিল সেটাও কেটে গেছিল। 
যোগেন্দ্র নাথ আর অরুণিমা নাথ নিজেরা থাকেন কলকাতার ভবানিপুরে । নিজস্ব তিনতলা বাহুল্যে ভরা বাড়ি । সেখানে গিয়ে ডাইনিঙে বসতে প্রথমে একটু ভয়-ভয় লাগছিল সুনন্দার । এত সাজানো গোছানো বড়লোকের বাড়িতে সে আগে পা রাখেনি কোনোদিন । বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল দোতলাটার দিকে। সেখানে বারান্দার গ্রিলের গা ঘেঁষে উঁকি দিচ্ছে বেগুনি বোগেনভিলিয়ার ঝাঁক! 
মজার কথা হল প্রস্তাবটায় নীলাদ্রি রাজি হওয়ার পর থেকেই সুনন্দার নিজের উৎসাহে ভাটা পড়েছে ।। উলটে একটা অজানা আশঙ্কা এসে চেপে ধরেছে তাকে। মেয়েটা যদি রাজি না হয়? 
এমনিতে সুনন্দা সবার সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি মিশে যেতে পারে। ফলে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় । কিন্তু বাচ্চামানুষের খেয়াল কেই বা বলতে পারে? আচমকা যদি বেঁকে বসে তাহলে এক ধান্ধায় সব বানচাল হয়ে যাবে। 
নাথ-দম্পতী কিন্তু সে আশংকা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন । বলেছিলেন, “তুলির সঙ্গে একবার মিশে দেখুন না, আপনি ওকে নয়, ওই আপনাকে শাসন করবে।” 
“ওকে নিয়ে যাচ্ছেন না কেন?” নীলাদ্রি করেছিল প্রশ্নটা। 
“আসলে ওখানে গিয়ে ওকে দেখাশোনার সময় পাব না আমরা ।”
“সে হলেও, ওখানে তো পয়সা দিয়ে বেবিসিটার রাখা যায় ।” 
“তা যায়, কিন্তু নতুন জায়গায় নতুন লোকের হাতে ওইটুকু মেয়েকে তুলে দিতে ভরসা হয় না।!” 
“এখানেও তো তাই দিচ্ছেন !” হাসতে হাসতেই কথাটা বলেছিল নীলাদ্রি। 
ব্যঙ্গটা গায়ে মাখেননি যোগেন্দ্র নাথ। হাসির রেশ ধরে বলেছিলেন, “আপনারা যা ভাবছেন তা নয়, মেয়ের উপর চব্বিশঘণ্টা নজর রাখার লোকের ও বাড়িতে অভাব নেই গেলেই বুঝতে পারবেন। কিন্তু আমরা চাইছিলাম মা-বাবার ফিগারটা ও যেন মিস না করে। বিশেষ করে আপনাদের…” আচমকাই থেমে যান যোগেনবাবু। 
খানিকক্ষণ নীরবতা, তার পর সুনন্দা প্রশ্ন করেছিল, “ওর কোনো মেডিক্যাল কন্ডিশন…” 
বিমর্ষ মাথা নেড়েছিলেন দম্পতী, “আজ্ঞে হ্যাঁ, ওর একটু শ্বাসকষ্ট আছে । মানে একটু উত্তেজিত হয়ে পড়লে সেটা শুরু হয় । ইনহেলার রাখবেন সঙ্গে। তবে সেটা যত কম ব্যবহার হয় ততই ভালো, বুঝতেই পারছেন এইটুকু মেয়ে…” 
সুনন্দা মাথা নেড়েছিল । মনে মনে একটা বিচ্ছিরী খেয়াল এসে চেপে ধরেছিল ওকে । মন বলছিল মেয়েটা ওদের দেখে রাজি না হলেই হয়তো ভালো হবে । এক্ষুনি দু’জনে মিলে বাড়ি ফিরে যাবে । আর একটু চেষ্টা করলে একটা চাকরি ঠিক জোগাড় করে নিতে পারবে নীলাদ্রি। কি দরকার খামোখা একটা অচেনা অজানা মেয়ের ভার নিয়ে? শেষে যদি মেয়েটার কোনো ক্ষতি হয় সব দোষ ওদের উপরে এসে পড়বে। 
ভাবনাটা এতটা বেড়ে উঠেছিল যে কথাটা নিজে থেকেই বলত সুনন্দা কিন্তু মুখের কথা আটকে যায় তুলিকে দেখে। দশ বছরের তুলনায় বেশখানিকটা ছোট দেখায় তাকে । নরম, গোলগাল চেহারা। গায়ের রঙটা কেমন যেন ফ্যাকাসে ধরনের। ঠোটের দুটো কোণ এতটাই গভীর যে সারাক্ষণই মনে হয় হাসছে । 
সোফায় ওদের উলটোদিকে বসে প্রথমে বেশি
কথা বলতে চায়নি তুলি । হয়তো সদ্য ঘুম থেকে উঠে এসে বসেছিল বলেই । কিন্তু সে পুরনো বাড়িতে 
গিয়ে বাবা-মাকে ছাড়া থাকতে পারবে কিনা জিজ্ঞেস করতে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ‘ জানিয়েছিল । তারপর উঠে এসে বসেছিল সুনন্দার পাশে । মেয়েটার নরম হাতের উপর হাত রেখেছিল সুনন্দা । একবারের জন্যে নিজের বুকের ভিতরটা কেমন মুচড়ে উঠেছিল তার । রিন্টির কথা মনে পড়েছিল না চাইতেই… 
শশাঙ্ক পালিত উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করছিল । ভাঙা কড়িকাঠের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নীলাদ্রি বলল, “না না! বাচ্চামেয়ে আছে সঙ্গে, কুয়ো-টুয়ো রিস্ক হয়ে যাবে, আপনি এদিকটাতেই ব্যবস্থা করুন ।” 
“দুটো ঘর রেডি করা আছে । আপনারা চাইলে এক্ষুনি খুলে দেব !” শশাঙ্ক পিছনের সিঁড়ির দিকে একবার হাত দেখিয়ে বলল কথাটা । 
“দুটো ঘর একটু বাড়াবাড়ি, আমি আর থাকবই কতক্ষণ, ওদের দু’জনের জন্যেই…” 
সুনন্দার চোখের ইশারায় থেমে গেল নীলাদ্রি!। তারপর একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “আপনি বরঞ্চ ওকে ঘরটা দেখিয়ে আনুন, আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসছি ।” 
“এখন আবার কোথায় যাবে, জামাকাপড় ছেড়ে যেও না হয় !” 
“নাঃ, জাস্ট সারাউন্ডিংটা দেখে আসব একটু । এখান থেকে তো কালনা বেশিদূর নয়, শশাঙ্কবাবু?” 
“না না। সামনেই তারকেশ্বর-বর্ধমান রোড পাবেন!” 
“ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফিরছি । তুমি ভালো করে বুঝে নিও !” কথাটা বলে আর সেখানে দাঁড়াল না নীলাদ্রি। 
সুনন্দা একবার তুলির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল সে তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন । তার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে আবার মাথাটা কাঁধে
ফেলে শশাঙ্কর দিকে তাকিয়ে বলল, “চলুন, যাওয়া যাক ।” 
জমিদারবাড়ির পুরনো সিঁড়ি । প্রতিটা ধাপের কোণে ভরাট শ্যাওলা জমেছে সিঁড়ির ঠিক মধ্যিখানে বেশ কয়েকটা ধাপে সিমেন্টের চাঙড় উঠে গেছে। 
দেখে পা ফেলতে হয় । শুধু ভাঙা বলেই নয়, খসে যাওয়া সিমেন্টের ধূলো আলগা হয়ে পড়ে আছে । তার উপরে একবার পা পিছলে গেলেই মাথা উলটে নিচে পড়তে হবে। সুনন্দা সাবধানে উঠতে লাগল। 
বাড়ির এইদিকটা মোটামুটি খালি । ফলে পায়ের আওয়াজ দোতলা অবধি গিয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে । সিঁড়ির ল্যান্ডিয়ে একটা প্রায় মানুষের সমান লম্বা জানালা আছে । রঙিন স্কাইলাইট লাগানো। সেই নকশা ভেদ করে আসা রামধনু রঙের আলো পড়েছে ধুলোঢাকা মেঝের উপরে । 
শশাঙ্ক ল্যান্ডিয়ে এসে একবার পিছন ফিরে বলল, “দিন, ওকে আমি ধরছি।” 
“না, থাক, এইটুকুই তো।” 
“তাতে কি প্রথমবার উঠছেন । দিন না!” 
মাথা নাড়ল সুনন্দা, প্রসঙ্গটা ঘোরানোর জন্যে বলল, “আচ্ছা, শুনেছি একজন নাকি এই সিঁড়ি থেকে পড়েই মারা গেছিলেন ।” 
দাঁতের নিচে একটু হাসল শশাঙ্ক, তারপর বলল, “সেখান থেকেই তো সুনাম রটল।” 
“হঠাৎ সিঁড়ি থেকে পড়ে গেলেন কী করে?” 
“সিঁড়ির অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন । রাতবিরেতে আলো ছাড়া চলাফেরা করলে পড়ে যে যাবে তাতে আর আশ্চর্য কি? তার উপরে তখন আবার ছিল বর্ষাকাল, এমনিতেই মেঝে সব পিছল হয়ে ছিল ।” 
“হুম…” প্রতিধ্বনির আওয়াজটা মন দিয়ে শুনছিল সুনন্দা! নিশ্চয়ই লোকটা যখন পড়ে যাচ্ছিল তখন তার আর্ত চিৎকারটাও এভাবে গোটা সিঁড়ি জুড়ে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল । দোতলায়
এসে পড়েছিল দু’জনেই । সুনন্দা আর কথা বাড়াল না! 
দোতলায় এলে বোঝা যায় বাড়িটা ঠিক কতটা বড় । চৌকো ঘেরা বারান্দা। তার এক-একটা দিক অন্তত বিশ মিটারের কম নয় । প্রতিটা দিকে তিনটে করে ঘর । তার সবকটার দরজা এখন বন্ধ । দেওয়ালের হলদে রং জায়গায় 
জায়গায় চটে গেছে। কোথাও চুন-সুরকি বেরিয়ে পড়েছে । উপরের দিকটা ফাঁকা। বোঝা যায় বর্ষার সময় জল এসে বারান্দাটাকে থৈ থৈ করে দেয়। 
শশাঙ্ক সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বাঁদিকে একটা ঘরের দিকে এগোতে এগোতে বলল, “এই দুটো ঘর নিলেই আপনাদের সুবিধা হবে, বাকিগুলোতে বড্ড ধুলো পড়ে গেছে ।” 
“আপনারা থাকেন কোথায়?” 
আবার সেই আগের বিনীত হাসিটা ফিরিয়ে আনল শশাঙ্ক, চাবিটা দিল সুনন্দার হাতে । 
‘“আমরা একরকম এ বাড়ির কেয়ারটেকার, যখন জমিদার আমল ছিল তখন এই দিকটা ছিল জমিদার বংশের সদস্যদের থাকার জায়গা। আর আমরা যে মহলটায় থাকি সেটা ছিল গেস্ট আর সাহায্যপ্রার্থীদের । ছাদে আসুন, দেখাব আমরা কোথায় থাকি ।” 
বাঁদিকে আরও কিছুদূর গিয়ে দ্বিতীয় ঘর । দরজাটা খোলা ছিল। সেটা হাত দিয়ে ঠেলে ভিতরটা দেখাল শশাঙ্ক । তারপর আর একটা চাবি তার দিকে বাড়িয়ে দিল। একহাতে চাবিটা নিয়ে ভিতরে ঢুকে এল সুনন্দা । 
ভিতরটা সদ্য গোছানো হয়েছে বোঝা যায় । দেওয়ালেও নতুন রং করা হয়েছে। বাইরে থেকে মহলটাকে যতটা ভাঙাচোরা মনে হয় ভিতর দিকটা ততটা নয়। 
ঘরের দু’দিকে দুটো জানলা। আর একটা দিকে জামাকাপড় রাখার মতো ছোট আলনা-। মাঝখান জুড়ে একটা দু’জনের শোয়ার মতো বিছানা। তার উপরে পরিপাটি করে চাদর পাতা আছে । চাদরটা
নতুন নয় । সম্ভবত এতদিন অন্য কোথাও পাতা ছিল সেটা। সুনন্দারা এখানে আসায় নিয়ে এসে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। 
মাথার উপরে তাকিয়ে একটা নতুন পাখা চোখে পড়ল! সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে সেটা চালিয়ে দিল শশাঙ্ক । সুনন্দা ততক্ষণে তুলিকে কোল থেকে নামিয়ে বিছানার উপরে শুইয়ে দিয়েছে । এগিয়ে গিয়ে জানলাটা খুলে দিল সে। 
বাইরে তাকালেই এ প্রাসাদের অন্দরমহলটা চোখে পড়ে। এতদূর থেকে দেখে বড়সড় মনে হয় সেটাকে । এদিককার প্রাসাদের প্রায় অর্ধেক । অনেকটা জুড়ে ছড়ানো । বাইরে বেশ কিছু কাটাঝোপ গজিয়েছে । ঢোকার রাস্তার ঠিক মুখে একটা বেশ বড়সড় কাঠগোলাপের গাছ । এত বড় কাঠগোলাপ আগে দেখেনি সুনন্দা! সে সেদিকে একটা আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, “গাছটা কে লাগিয়েছে বলুন তো?” 
“সনাতনদা।আরও লাগিয়েছিল। আগের বছরের ঝড়ে সব উপড়ে গেছে। তাছাড়া জায়গাটায় সাপখোপ আছে । খুব একটা যায় না কেউ।” 
“সনাতনদা? উনিও এ বাড়িতেই থাকেন?” 
“হেডকুক বলতে পারেন। এ বাড়িতে ঠিক বলা যায় না, দক্ষিণ মহলে থাকেন । সেদিকের অন্দরমহলটা অবশ্য এতটা ভেঙ্গে পড়েনি । ছাদে আসুন, দেখিয়ে দিচ্ছি সব।” 
তুলির দিয়ে তাকায় সুনন্দা । গালের উপর একটা হাত রাখে। সে একটু উশখুশ করে পাশ ফিরে শোয় । তার গোলাপি ফ্রক এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে বিছানার উপরে । সেটা হাত দিয়ে ঠিক করে দেয় সুনন্দা! এখনও গভীর ঘুমে আছন্ন হয়ে আছে মেয়েটা। কাল রাতটা ট্রেনে ভালো করে ঘুম হয়নি। আজ সকাল থেকে একবারও চোখ খোলেনি। 
ঘরের দরজাটা টেনে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল দু’জনে । 
শশাঙ্ক পালিতের বয়স বছর চল্লিশেকের একটু
বেশি আন্দাজ করা যায়। গালে চাপ দাড়ি, গায়ের রং বেশ ফর্সা। সমস্ত মুখের মধ্যে খাড়া নাকটা আলাদা করে চোখে পড়ে। কপালের কাছে একটা বড়সড় জড়ুল আছে। থেকে থেকে কবজির উলটো দিকটা দিয়ে নাকের ডগাটা ঘষে সে। এ বাড়ির বাকি সদস্যরা এখনও আসেনি এদিকে । শশাঙ্কই গিয়ে হুগলী স্টেশান থেকে নিয়ে এসেছে ওদের । 
আরও গোটা কুড়ি সিঁড়ি পেরোলে ছাদ । ছাদে ওঠার মোট দুটো সিঁড়ি আছে । একটা সিমেন্টের, সোজা! আর একটা লোহার পেঁচানো সিঁড়ি । দ্বিতীয় 
ছাদে ওঠার আগেই দু’জায়গায় ভেঙে গিয়ে ফাঁক হয়ে আছে । সেখানটা একটু লাফিয়ে উঠতে হয় । 
সিমেন্টের সিঁড়ির নিচের দিকে লম্বা ঝুলের সার নেমেছে । তার ফাঁকে কিছু পুরানো জিনিসপত্র রাখা আছে। সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে চলে এল সুনন্দা। 
চকদীঘির দত্ত জমিদারবাড়ি সতেরশো শতকের মাঝামাঝি তৈরি। তখন বড়সড় বাড়ির বেশিরভাগ অংশেই শ্বেতপাথরের মেঝের চল ছিল । কিন্তু এতক্ষণে অন্তত এ মহলে শ্বেতপাথর চোখে পড়েনি সুনন্দার । বাইরে মূল প্রাসাদে ঢাকার মুখে যে সদরের সিঁড়ি আছে সেটা প্রস্থে অন্তত মিটার দশেক চওড়া। তবে কোণার দিকে কয়েক জায়গায় ভেঙে গেছে। 
ছাদে উঠে মনটা হালকা হয়ে গেল সুনন্দার । চারপাশে সিমেন্টের ভারি রেলিং দেওয়া ছাদ । সেই সিমেন্টের গাঁথনির মধ্যে’মধ্যে সময়ের কালো ছোপ পড়েছে। রেলিঙের ঠিক উপরেই নানারকম মূরতি বসানো আছে । বেশিরভাগই সিংহ, কোথাও খাপথখালা তলোয়ার, কোথাও বা ঘোড়া। কয়েকটা জায়গায় মূরতি খসে গিয়ে রেলিঙের খাম্বা বেরিয়ে পড়েছে। 
ছাদের মেঝেতে বড় বড় খোপ কাটা। কয়েকটা খোপ হেঁটে পার হয়ে ছাদের একপ্রাপ্তে এসে দাঁড়াল সুনন্দা । কিনারায় এসে না দাঁড়ালে আশপাশের
অন্য কোনো বাড়ি চোখে পড়ে না। শুধু দক্ষিণের প্রাসাদটা চোখে পড়ে। সেদিকে দেখিয়ে শশাঙ্ক বলল, “মোট দুটো প্রাসাদ। একটা উত্তরের, একটা দক্ষিণের । জমিদারবাড়ির নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেকটা প্রাসাদের পিছনের দিকে সেই প্রাসাদের অন্দরমহল । আপনারা থাকবেন উত্তরের প্রাসাদে । আর আমরা থাকব দক্ষিণের অন্দরমহলে । দেখে আসবেন একবার?” 
“না, আজ আর ভালো লাগছে না। তাছাড়া মেয়েটা জেগে গেলে খুঁজবে ।” 
“খোঁজার কিছু নেই । ও আগেও এসেছে আমাদের এখানে । বেশ চৌকশ মেয়ে। আমাদের সবাইকেই প্রায় চেনে ।” 
এতক্ষণ মন দিয়ে উত্তরের ভাঙাচোরা অন্দরমহলের ভিতরের জমাট 
অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিল সুনন্দা । এবার শশাঙ্কের দিকে ফিরে বলল, “মেয়েটাকে নিয়ে ভয় লাগছে, জানেন?” 
“ভয়ের কী আছে? সাতটা দিনের তো ব্যাপার ।” 
“গণ্ডগোল কিছু হওয়ার থাকলে সাতদিনই যথেষ্ট। বিশেষ করে এইটুকু বাচ্চা…” 
“আপনাদের নিজেদের ছেলে মেয়ে…” 
‘ কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল শশাঙ্ক । অর্ধেক বলেই বুঝতে পেরেছে একটু বেশি ব্যক্তিগত হয়ে গেছে প্রশ্নটা। 
তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নরম করে হাসল সুনন্দা । তারপর মাথা দুলিয়ে বলল, “ছিল…” 
শশাঙ্কের অস্বস্তিটা আর একটু বেড়ে উঠল । সে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। প্রসঙ্গটা বদলাতে বলল, “দাদা বলে দিয়েছেন সনাতনদা আর মধুবাবু মাঝে মাঝেই দেখে যাবেন আপনাদের । আমিও আসব যাব ইচ্ছা হলে ।” 
“আপনিও তো এখানেই থাকতে পারতেন !” 
হাতের উলটোদিক দিয়ে কপালের ঘাম মুহল শশাঙ্ক, “আমার আসলে দোকান বাজারের দায়িত্ব । তাছাড়া রান্নবান্নাটাও দেখাশোনা করতে হয়।
বাইরে থেকে লোকজন জমিদারবাড়ি দেখতে আসে। তাদের সামলানোটাও একটা হ্যাঁপা!” 
“আপনাকে থাকতে বললাম তার একটা কারণ আছে জানেন ।!” 
“কী কারণ?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে শশাঙ্ক! 
“এখানে আসার পর থেকে জমিদারবাড়ির ইতিহাসটা জানতে ইচ্ছা করছে আমার। অন্তত কোনো বই-টই যদি পাওয়া যেত, মানে জমিদারবাড়ির তো কিছু না কিছু হিস্ট্রি থাকে…” 
মিহি একটা হাসি খেলে যায় শশাঙ্কের মুখে, “যত ইতিহাস আপনি বইতে পাবেন তার থেকে ঢের বেশি পাবেন মধুবাবুর মুখে । তবে ইতিহাস বলতে তেমন কিছু নেই । 
জমিদার ভূপতি দত্ত ব্রিটিশদের প্যাট্রন ছিলেন । ফলে সেকালেও জমিদারিটা টিকিয়ে রেখেছিলেন । এই বাড়িটাও । তারপরের জেনারেশান থেকে একটু একটু করে শেষ হয়ে যায় জমিদার বংশ। লোকে বলে…”

“কী বলে?” কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে সুনন্দা। 
“একটি, মাথায় কালো কাপড়ে ঢাকা ছায়ামূরতিকে নাকি কয়েক শতাব্দী ধরে দেখা যায়
এখানে। কিসব যেন অভিশাপ আছে ।” খোলা হাসির একটা দাগ ফোটে শশাঙ্কের দাড়ির আড়ালে, “ওসব গল্প পরে মধুবাবু শুনিয়ে দেবেন! আপাতত জেনে রাখুন বছর পঞ্চাশেক আগেই তার বংশের শাখাপ্রশাখা প্রায় গুটিয়ে গেছে । দাপট যা ছিল তাও শেষ হয়ে গেছে অনেক আগে। শেষে নাথ ইন্ডাস্ট্রি সরকারের নির্দেশে এটা দেখাশোনা আর এলটমেন্টের দায়িত্ব পায় !” 
“আর খুনগুলো কবে হয়?” 
আবার হাসির ঝাপটা ছড়িয়ে পড়ে শশাঙ্কের মুখে, “খুনের ব্যাপারটা আপনার মাথাতেও ঘুরছে তার মানে ।” 
সুনন্দা একটু লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে বলে, “আসলে যে বাড়িতে এতগুলো মানুষ আচমকা মারা গেছেন সেখানে থাকতে একটু একটু গা ছমছম করবে বৈকি । বিশেষ করে প্রাচীন জমিদারবাড়ি যখন, তাও ব্যাপারটা যদি ভালো করে জানা থাকে তাহলে আর অতটা ভয় করবে না।” 
মাথা নাড়ায় শশাঙ্ক, তারপর দূরের দিকে তাকিয়ে বলে, “খুন বলুন আর মৃত্যু, সেগুলো ঠিক কবে থেকে শুরু হয় তা কেউ বলতে পারে না। মানে ধরুন ইংরেজ আমলেও যদি হয়ে থাকে তার সাক্ষী দেওয়ার জন্যে কেউ নেই আর।। চাকর-বাকরের মধ্যে কেউ যদি মরে থাকে তাহলে কেউ তার অত হিসেব রেখে যায় না। আমি যদ্দুর জানি সরকার থেকে এর হেরিটেজশিপের নেওয়ার পর মোট চারজন এ বাড়িতে থাকতে থাকতে মারা গেছেন । তবে তার কোনোটাই খুন বলা যায় না! লোকে গুজব রটাতে পারে বড়জোর। সেটা কোনো নতুন কথা নয় ।” 
“প্রথমটা সিঁড়ি থেকে পড়ে?” 
“আজ্ঞে, যে সিঁড়ি দিয়ে এলাম আমরা। নাইন্টীন সিক্সটিফোরে ।” 
“তারপর?” 
“প্রথমটার বারো বছর পর অর্থাৎ সেভেন্টিস-এর মাঝামাঝি দ্বিতীয়টা। দীঘির জলে বডি ভেসে
ওঠে । এর নাম আমি শুনেছিলাম একবার, মহীতোষ বসু। ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে এসেছিল। কোনোভাবে হয়তো রাতে জলের কাছাকাছি গিয়েছিল । দীঘিতে বডি ভেসে ওঠে!” 
“কোন্ দীঘি?” প্রশ্ন করে সুনন্দা! 
আঙুল দিয়ে অন্দরমহলের মাথার পিছনটা দেখিয়ে দেয় শশাঙ্ক। ঝোপঝাড়ে ঢেকে আছে সেখানটা । তবে ভালো করে লক্ষ করলে সেই গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটুখানি জলের রেখা চোখে পড়ে। 
“ওখানে একটা পুকুর আছে মনে হচ্ছে ।” 
“ওটাই দীঘি, এ বাড়ির সামনে আর পিছনে দু’দিকেই জল আছে । আসার সময় সামনে পুকুরপাড় দেখলেন তো?” 
সুনন্দা মাথা নাড়ে। চারদিক খোলা থাকায় বেশ জোরে একটা হাওয়া দিচ্ছে। তাতে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে মুখের উপরে । এই হাওয়াটা যেন তার বহুদিনকার চেনা। ‘ 
সুনন্দার চেহারাটা বেশ মার্জিত । রোগা বা মোটা কোনোটাই বলা যায় না। গায়ের রং ফর্সার দিকে । চোখে একটা রিমলেস চশমা পরে সে।তাকে একবার দেখেই হাইস্কুলের নতুন বহাল হওয়া অংকের দিদিমণি গোছের একটা চেহারার কথা মাথায় আসে । ফিনফিনে গলার আওয়াজ । কথাও বলে থেমে থেমে। 
বাইরে কম্পাউন্ডের উপরে আরও কিছু ফুলের গাছ লাগানো আছে । তার পাশ দিয়ে মাঝে মধ্যেই জমিদারবাড়ির অন্যদিকের বাসিন্দা কিছু লোকজন এদিক থেকে ওদিক চলে যাচ্ছে । কারও কাঁধে গামছা, কারও পরনে। কেউ কেউ দীঘির দিকে যাচ্ছে স্নান করতে । গুনগুন আওয়াজে ভরে আছে জায়গাটা। 
আচমকাই সুনন্দার চোখ চলে গেল উত্তরের অন্দরমহলের দিকে । ভারী আশ্চর্য গঠন মহলটার । ঠিক যেন একটা ছোটোখাটো মন্দির । উপরের দিকটা জুড়ে ছড়ানো একটা গম্বুজ । তার চূড়ায় একখণ্ড লাল তেকোণা কাপড় পতাকার মতো এসে
পড়েছে। পাশে গজিয়ে ওঠা ঝাঁকড়া খেজুর গাছের পাতা এলিয়ে পড়েছে সেই গম্বুজের উপরে । সামনের দিকে মহলের দরজা। সেই দরজার গায়ে চক দিয়ে কেউ নাম লিখে গেছে । দরজাটা অর্ধেক খোলা থাকায় ভিতরের দিকের ঘন অন্ধকার চোখে পড়ে । সম্ভবত ভিতরে কোনো জানলা বা দরজা খোলা নেই । সামনের ঘাসের জায়গাটার উপরে পায়ে চলা রাস্তা নেই । সত্যি জায়গাটা পরিত্যক্ত । 
সিঁড়ির কাছ থেকে পায়ের আওয়াজ পেয়ে এগিয়ে এল দু’জনে । নীলাদ্রি এসে ঢুকল ছাদে । তারপর সুনন্দার দিকে তাকিয়ে বলল, “কি ঘুম ঘুমাচ্ছে গো! ওঠার নাম নেই ।” 
“ক্লান্ত আছে খুব, রাতে তো জেগেই ছিল ।” 
“সে তো বুঝলাম, কিন্তু এভাবে একা রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হলে?” 
“বেশ, এবার থেকে নিয়েই আসব!” 
পকেট থেকে সিগারেট বের করে শশাঙ্কের দিকে এগিয়ে দিল নীলাদ্রি তারপর আবার সুনন্দার দিকে ফিরে বলল, “সব বুঝে-টুঝে নিয়েছ তো? দরকার পড়লেই লোক থাকবে । ভয়ের কিছু নেই।” 
“আপনি থাকবেন না?” জিজ্ঞেস করল শশাঙ্ক । 
“আমার দিন তিনেকের কাজ আছে কলকাতাতে । তাছাড়া কিছু জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে আসতে হবে। ল্যাপটপটা তো রেখেই এসেছি। কিগো, তোমার ভয় করবে নাকি?” 
ভুরু কুঁচকে মুখ বাঁকাল সুনন্দা, “কে যে ভিতু আমার জানা আছে ।” 
“না না ইয়ার্কি নয়” নীলাদ্রি মুখে মেকি ভয় আনার চেষ্টা করে, “এ বাড়িতে চার-চারটে মানুষ চার-চারটে দশকে অস্বাভাবিকভাবে মারা গেছে। তার মধ্যে একটা আবার সুইসাইড ।” 
“তাই নাকি! সুইসাইডও আছে?” অবাক চোখে শশাঙ্কের দিকে তাকাল সুনন্দা। 
“হ্যাঁ, এটাই লেটেস্ট । বছর দশেক আগে । দড়ি থেকে ঝুলছিল । আপনাদের যে রুমটায় আছেন

তার উলটো দিকেরটায় ছিলেন । নলিনী… কি যেন নাম, ঠিক মনে পড়ছে না…” 
“এনাদের কোনো জ্ঞাতির কেউ?” 
“একেবারেই না। সরকার বাহাদুরের লোক, হ্যাঁ, মনে পড়েছে—~- নলিনী ঘোষ। মজার কথা হল এই যে চারজন মারা গেছেন তাদের কেউই এদের বংশের সঙ্গে যুক্ত নয় । হয় বাইরে থেকে আসা অতিথি না হলে ঠিকাদার, ইঞ্জিনিয়ার, এইসব।” 
“বেশ, তিনজনের কথা জানলাম। ফাস্ট, সেকেন্ড আর ফোরথ, বাকি একজন?” 
শশাঙ্ক কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল । নীলাদ্রি বাধা দিল তাকে। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “মরা লোকেদের কথা পরে জানবে না হয়। আপাতত 
নিচে একজন জীবিত বসে আছেন । তার সঙ্গে দেখা করে আসা দরকার।” 
“কে?” 
“জানি না। নাম বলল সনাতন।” 
সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল শশাঙ্ক, “সনাতনদা এসেছেন । আপনারা নিচে আসুন । আলাপ করিয়ে দি। বাকি সব ওঁর থেকেই জানতে পারবেন। ভারী কৰ্মঠ লোক । তবে মাথাটা ইদানীং বুঝি একটু খারাপ হয়েছে ।” 
দোতলার বাইরের বেঞ্চে বসেছিল সনাতন । লোকটাকে দেখে প্রথম দর্শনে বাঙালি বলে মনেই হয় না। মাথা আর গাল ভরতি সাদা দাড়ি। মোটাসোটা শক্ত গড়ন । হাতে রোঁয়া ওঠা লাল তাগা বাঁধা! পরনে একটা পাট করে পড়া খাটো ধুতি আর ফতুয়া। এটুকু বাদ দিলে শৌখিনতার তেমন কোনো চিহ্ন নেই শরীরে । খানিকটা ঝুঁকে থাকেন সবসময় । সুনন্দার মনে হল লোকটার সঙ্গে ছবি বিশ্বাসের মিল আছে কোথাও । 
নীলাদ্রিদের দেখেই দুটো হাত জড়ো করে তুলে ধরল সনাতন। তারপর সেরকম গম্ভীর মুখে একবার সুনন্দার দিকে তাকিয়ে আবার চোখে ফিরিয়ে নিল। বোঝা গেল বেশি কথাবার্তার লোক নয় সনাতন।
“আপনাদের নন-ভেজে আপত্তি নেই তো?” নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল শশাঙ্ক । 
“উঁহু, সেটাই প্রেফার করি বরঞ্চ।” 
“বেশ, তাহলে সনাতনদাকে নিয়ে অভিযোগ থাকবে না। শুধু ঝালটা একটু বেশি হয় । সেটা সহ্য করে নিতে হবে । অনুরোধ করে লাভ হবে না। ওল্ড হ্যাবিটস… হে হে..” 
“আপনারা যা বলবেন তেমনই করে দেব !” ঘরঘরে গলায় কথাগুলো বলে জামার হাতায় ঘাম মুছল সনাতন! 
“আজ রাতে যা খাবেন এখনই বলে দিন। বিকেলের চা-টা আমি আলাদা করে পাঠিয়ে দেব ।” শশাঙ্ক বলল। 
“না না, আজ রাতে আমরা একটু বাইরে বেরিয়ে খাব ঠিক করেছি । কাল 
সকালে তো ও চলে যাবে !” সুনন্দা সনাতনের দিকে তাকাল। 
“চকদিথীতে বাইরে খাবার মতো কিছু পেলে হয় । ঠিক শহর তো আর নয় । যাই হোক, কাল থেকেই শুরু হবে না হয়! আর মধুদা… মধুদা মহলে নেই সনাতনদা?” 
“ছিল তো আসবে একটু পরে ।” আগের মতোই কাটাকাটা উচ্চারণে কথাগুলো বলে সনাতন। তারপর আবার বসে পড়ে বেঞ্চের উপরে। লোকটার চোখের মণি দুটো কি আশ্চর্য রকম স্থির! মনে হয় বুকের ভিতরে রক্তের বদলে খানিকটা বরফ জমাট বেঁধে আছে । 
“যাই, আমি আবার একটু দেখে আসি তেনাকে পাওয়া যায় কিনা। আপনারা জিরিয়ে নিন ।” কথাগুলো বলতে বলতে বাইরের দিকে পা বাড়ায় শশাঙ্ক! 
সনাতনের পাশে বসে পড়ে নীলাদ্রি। খোশগল্প করতে থাকে। 
বারান্দার উপরে খোলা ছাদ দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সনাতন। প্রশ্ন করলে মাঝে মাঝে মুখ খুলে উত্তর দিয়ে আবার চুপ করে যাচ্ছে । সুনন্দা একবার তাকে আপাদমস্তক দেখে
ভিতরের দিকে ঢুকে আসে । ওপাশের ঘরটার চাবি রেখে গেছে শশাঙ্ক । কিন্তু খুলে দিয়ে যায়নি । সেটা একবার খুলতে হবে 
টেবিলের উপর থেকে চাবিটা নিতে গিয়েই থমকে যায় সুনন্দা । এতক্ষণে বিছানার উপরে উঠে বসেছে তুলি । খোলা জানলা দিয়ে উত্তরের অন্দরমহলের দিকে চেয়ে কি যেন দেখছে । 
“তুমি উঠে পড়েছ?” নরম গলায় প্রশ্ন করল সুনন্দা! তারপর এগিয়ে গেল বিছানার দিকে । 
তুলি একবার মুখ ফিরিয়েই আবার জানালার দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। কোনো কারণে একটু চমকে গেছে যেন সে। 
নিচু অস্পষ্ট স্বরে প্রশ্ন করল, “তোমরা আমাকে ডাকছিলে?” 
“আমরা? নাতো ।” অবাক হয়ে যায় সুনন্দা, “আমি তো উপরে ছিলাম! অবশ্য নীলাদ্রি যদি এ ঘরে এসে…” 
“এ ঘর থেকে না।” কথা শেষ হবার আগেই বলে ওঠে তুলি। 
“তাহলে কোথা থেকে?” 
ডানহাতটা তুলে জানলা দিয়ে দূরের ঝোপে ঢাকা পুরনো অন্দরমহলটা দেখিয়ে দেয় তুলি, “কাছে যেতে বলছিল, ওখান থেকে!” 
দু-এক পা এগিয়ে জানালার কাছে সরে আসে সুনন্দা একটা ঠান্ডা ভ্রেত তার বুকের মাঝে পুরানো ভয়টা আবার ফিরিয়ে আনে । 
কাঠগোলাপ গাছটার ফাঁক দিয়ে শতাব্দী প্রাচীন অন্দরমহল মাকড়সার ঝুলে ঢেকে একবুক নিশ্ছিদ্র অন্ধকার নিয়ে পড়ে আছে । তার সামনেটা এখন ফাঁকা…

দ্বিতীয় অধ্যায় 


ট্রেনটা ক্ষেপে উঠেছে আজ। বারবার ভয়ানকভাবে দুলে উঠছে । সুরেনবাবু একবার চোখ খুলে পাশের সিটে বসে থাকা অনিলাদেবীর দিকে তাকালেন । তিনিও ঢুলছেন। সামনের সিটে একটা অল্পবয়সী মেয়ে বসে আছে, মুখ নামিয়ে কিছু একটা বই পড়ছে সে, নামটা চোখে পড়ল না সুরেনবাবুর । গলার দু’পাশ থেকে নেমে আসা একটা সোনালি চেন বুকের উপর লাফিয়ে খেলা করছে ট্রেনের দুলুনিতে । তার পাশে দু’জন প্রৌঢ়! জানালা দিয়ে বাইরের ছুটস্ত অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। 
সুরেনবাবু সব দেখে চোখ বুজতে যাবেন এমন সময় আবার প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে দুলে উঠল ট্রেনটা! তিনি নিজে কোনোরকমে সামলে নিলেন কিন্তু অনিলাদেবী সিট ছেড়ে হুমড়ি থেয়ে গিয়ে পড়লেন সামনে । আর একটু হলেই মাথাটা ঠুকে যাচ্ছিল সামনের ফাঁকা সিটে কিন্তু সেটা ঘটার আগেই সামনের সিটের সেই পড়ুয়া মেয়েটা হাত বাড়িয়ে তার কাঁধের কাছটা ধরে নিয়েছে । একটুর জন্যে রেহাই পেলেন অনিলাদেবী । 
“লাগেনি তো মাসিমা?” মেয়েটা অনিলাদেবীর মাথাটা ছেড়ে দিয়ে 
জিজ্ঞেস করল। 
“একটু ব্যালেন্স রাখতে পারো না? আশ্চর্য মানুষ বটে তুমি!” সুরেনবাবু স্ত্রীকে বেশ জোর গলায় ধমক দিলেন, “সামলাতে না পারলে ট্রেনে ওঠো কেন?” 
“আহা, ওঁর তো বয়স হয়েছে। লেগেছে কিনা দেখুন আগে !” মেয়েটা অনিলাদেবীর পিঠে একটা হাত রেখে তার মুখটা দেখার চেষ্টা করল। 
“সত্যিই তো, আপনি অত রেগে যাচ্ছেন কেন?” পাশ থেকে এক প্রৌঢ় সমর্থন করলেন। 
মেয়েটার থাইয়ের উপরে দুটো হাত রেখে উঠে দাঁড়িয়ে আবার সিটে বসে পড়লেন অনিলাদেবী, তারপর মিনমিনে গলায় বললেন, “আসলে একটু
ট্রেনটা ক্ষেপে উঠেছে আজ। বারবার ভয়ানকভাবে দুলে উঠছে । সুরেনবাবু একবার চোখ খুলে পাশের সিটে বসে থাকা অনিলাদেবীর দিকে তাকালেন । তিনিও ঢুলছেন। সামনের সিটে একটা অল্পবয়সী মেয়ে বসে আছে, মুখ নামিয়ে কিছু একটা বই পড়ছে সে, নামটা চোখে পড়ল না সুরেনবাবুর । গলার দু’পাশ থেকে নেমে আসা একটা সোনালি চেন বুকের উপর লাফিয়ে খেলা করছে ট্রেনের দুলুনিতে । তার পাশে দু’জন প্রৌঢ়! জানালা দিয়ে বাইরের ছুটস্ত অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। 
সুরেনবাবু সব দেখে চোখ বুজতে যাবেন এমন সময় আবার প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে দুলে উঠল ট্রেনটা! তিনি নিজে কোনোরকমে সামলে নিলেন কিন্তু অনিলাদেবী সিট ছেড়ে হুমড়ি থেয়ে গিয়ে পড়লেন সামনে । আর একটু হলেই মাথাটা ঠুকে যাচ্ছিল সামনের ফাঁকা সিটে কিন্তু সেটা ঘটার আগেই সামনের সিটের সেই পড়ুয়া মেয়েটা হাত বাড়িয়ে তার কাঁধের কাছটা ধরে নিয়েছে । একটুর জন্যে রেহাই পেলেন অনিলাদেবী । 
“লাগেনি তো মাসিমা?” মেয়েটা অনিলাদেবীর মাথাটা ছেড়ে দিয়ে 
জিজ্ঞেস করল। 
“একটু ব্যালেন্স রাখতে পারো না? আশ্চর্য মানুষ বটে তুমি!” সুরেনবাবু স্ত্রীকে বেশ জোর গলায় ধমক দিলেন, “সামলাতে না পারলে ট্রেনে ওঠো কেন?” 
“আহা, ওঁর তো বয়স হয়েছে। লেগেছে কিনা দেখুন আগে !” মেয়েটা অনিলাদেবীর পিঠে একটা হাত রেখে তার মুখটা দেখার চেষ্টা করল। 
“সত্যিই তো, আপনি অত রেগে যাচ্ছেন কেন?” পাশ থেকে এক প্রৌঢ় সমর্থন করলেন। 
মেয়েটার থাইয়ের উপরে দুটো হাত রেখে উঠে দাঁড়িয়ে আবার সিটে বসে পড়লেন অনিলাদেবী, তারপর মিনমিনে গলায় বললেন, “আসলে একটু
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হাওড়া আর কতদূর?” 
“সে এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি ।” ঘড়ি দেখে কথাটা বলে সামনের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলেন সুরেনবাবু। মেয়েটার বয়স তার নিজের মেয়ের মতোই । ফ্যাকাসে ফর্সা রং, চোখ দুটো ভারি উজ্জ্বল । গায়ে একটা খয়েরি রঙের সালওয়ার, তার নিচে ডেনিম জিনস! পিঠের মাঝখান অবধি চুল একটা মাত্র ক্লিপ দিয়ে বাঁধা। এক কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ। জামাকাপড় আর হাবভাব দেখে সুরেনবাবুর মনে হল মেয়েটা সম্ভবত বোলপুর স্টেশান থেকে উঠেছে । 
“কদ্দুর যাবে তুমি?” নরম গলায় তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন অনিলাদেবী । 
“এইতো, বর্ধমান নেমে যাব !” মেয়েটা বই থেকে মুখ তুলল । এর ফাঁকে সুরেনবাবু দেখে নিয়েছেন মেয়েটা বাইবেল পড়ছে। আশ্চর্য! এতক্ষণ তো তিনি গল্পের বই ভেবেছিলেন । একটা বছর বাইশের মেয়ে ট্রেনে যেতে যেতে বাইবেল পড়ছে কেন খামোখা? 
“কলেজে পড়ো ওখানে?” আবার প্রশ্ন করেছেন অনিলাদেবী। মেয়েটা এবার মুখ তুলে বইটা রেখে দিল পাশে। হাসি মুখে বলল, “নাঃ, আমার 
এন্সেস্ট্রাল হোম আছে ওখানে, আমি মাঝে সাঝে যাই ।” 
“হ্যাঁ, এখনকার ছেলেমেয়েদের আর দেশের বাড়ির টান নেই…” হাসতে হাসতেই কথাটা বললেন সুরেনবাবু। ‘ 
“আমার দেশের বাড়িটা ঠিক সুবিধের নয় স্যার, মা খুব একটা ঘেঁষতে দেয় না ওখানে ।” 
“সুবিধের নয় কীরকম?” ‘ 
একটা বাঁকা হাসি হেসে মেয়েটা বলে “সেখানে নাকি এখনও রাতবিরেতে কাকে যেন দেখা যায়। খুনটুনও হয়েছে কয়েকটা ।” 
কথাটা শুনে হেসে ওঠেন সুরেনবাবু, “ভূতুড়ে ব্যাপার?”

“তাই বলতে পারেন!” লাজুক হাসে মেয়েটা। 
“দেখার চেষ্টা করেছি কয়েকবার । তিনি দেখা দেননি । ভৃতপ্রেত কিনা জানি না। তবে কিছু একটা ব্যাপার আছে বাড়িটায় । এতদিনের পুরনো বাড়ি তো । একটু গা ছমছম করবেই। আমি এখনও গেলেই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই।” 
“পুরনো ইতিহাসের দিকে আগ্রহ আছে তার মানে । তা হঠাৎ বাইবেল পড়ছিলে কেন বলতো?” মনের ভিতরে খচখচ করতে থাকা প্রশ্নটা করে ফেললেন সুরেনবাবু, “মানে… আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো ধর্মের দিকে অতটা..” 
“ওই যে ইতিহাসের উপরে আগ্রহ…” 
“তাহলে তো ইতিহাস বই পড়ার কথা !” মজার ছলে কথাটা বললেন সুরেনবাবু। 
‘ বাইরে থেকে ভিতরে মুখ ঘুরিয়ে মেয়েটা বলল, “উঁহু… আমার তো মনে হয় ইতিহাস বইতে শুধু সেটা লেখা হয় যেটা হোমরা-চোমড়ারা মিলে লেখা যায় বলে ঠিক করেন!। আসল খাঁটি ইতিহাস আপনি এই থিওলজির ছাড়া আর কোথাও পাবেন না। এই যেমন ধরুন জেনেসিস, বাইবেলের প্রথম অধ্যায়…” । 
“হ্যাঁ হ্যাঁ জানি… সেই অ্যাডাম আর ইভ… যারা একটা ফল খেয়েছিল বলে 
ভগবান তাদের স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দেন…” 
“উঁহু… ওটা ভুল ধারণা !” মুখ বাড়িয়ে মেয়েটা আবার জানলার বাইল্লে কিছু দেখার চেষ্টা করে, “ফল খাওয়ার জন্যে অ্যাডামকে স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দেননি ভগবান । দিয়েছিলেন অন্য কারণে ।” 
“সেকি! আমি তো তাই জানতাম। যাই হোক, কী কারণে?” খোশ গল্পের মেজাজ জেগে ওঠে সুরেনবাবুর। 
পাশ থেকে বাইবেলটা তুলে নিয়ে একটা বিশেষ পাতা খুলে এগিয়ে দেয় মেয়েটা, “এই যে এইখানটা দেখুন… যে ফলের কথা আপনি বলেছেন তার ঠিক পরেই ভগবানের উক্তি…” 
পকেট থেকে চশমা বের করে চোখে গলিয়ে
নেন সুরেনবাবু, জায়গাটা মন দিয়ে পড়তে থাকেন, — 
Genesis 3-22 And the LORDGod said- ‘The man has now become like one of us— knowing good and evil. He must not be allowed to reach out his hand and take also from the tree of life and eat—- and live forever.’ 
Genesis 3-23 So the LORD God banished him from the Garden of Eden to work the ground from which he had been taken.
চশমা খুলতে খুলতে সুরেনবাবু বললেন, “মানে বলছ নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পর অ্যাডাম যে জ্ঞান লাভ করে সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়েই সে অন্য একটি বিশেষ গাছের ফল খাবে— এই ভয়েই ঈশ্বর তাকে স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দেন?” 
“আর সেই গাছের ফল খেলে একটা বিশেষ ক্ষমতা লাভ করবে অ্যাডাম, সেটা লক্ষ করেছেন?” 
“হ্যাঁ, অমরত্ব ।” বিড়বিড় করেন তিনি। 
“এবার ওর পরের জায়গাটা দেখুন…” 
আবার বইতে মন দেন সুরেনবাবু, 
After he drove the man out— he placed on the east side of the Garden of Eden cherubim and a flaming sword flashing back and forth to guard the way to the tree of life. 
“অর্থাৎ ঈশ্বর সেই ট্রী অফ লাইফের সামনে চেরুবিম রাখলেন এবং একটি জ্বলন্ত তলোয়ার স্থাপন করলেন যেটি ক্রমাগত সামনে পিছনে দুলে চলেছে । চেরুব হলো সিংহ বা মানুষের মতো দেখতে একধরনের জীব, চেরুবিম তার প্লুরাল এবার ভেবে দেখুন একটা গাছকে গোল করে ঘিরে ধরেছে কিছু সিংহ বা মানুষ, তাদের মাঝে একটা দুলন্ত আগুনের তলোয়ার । তারা রক্ষা করছে মানুষের অমর হওয়ার ফলকে ।
আজ থেকে দেড় কি দু’হাজার বছর আগের মানুষকে যেন প্রকারাম্তরে কেউ বলতে চাইছে যে দুটো জিনিস পাপ, কিন্তু ইনেভিটেবল। করলে পাপ হবে, কিন্তু করতেই হবে ! প্রথমটা সেক্স, দ্বিতীয়টা ইম্মরটালিটি । এই দুটোর ক্ষেত্রেই ঈশ্বর চোখ বুজে নেন। একটু ডিপ্লোম্যাটিক পোজিশান মেন্টেন করেন ।” 
“তুমি ঠিক কি বলতে চাইছ?” সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন করেন তিনি। 
এবার একটু চাপা গলায় 0 য়েটা বলে, “আমি বলছি না, আধুনিক ইতিহাসবিদরা বলেন, এই ধর্মগ্রন্থগুলো আসলে ছিল সেকালের রাজাদের নিজের পাপকে স্থলন করিয়ে নেওয়ার একটা উপায় । রাজা অমুক পাপটি করেছেন কিন্তু ধর্মগ্রন্থ বলছে ওটি পাপ নয় । ফলে জনতাও রাজাকে মাফ করে দেবে । এখন কথা হচ্ছে অমরত্বের অস্বেষণকে পাপ পুণ্যের মাঝে এমন কমপ্লিকেটেড পজিশানে রেখে দিয়ে রাজা বা রাজপরিবার কোন পাপ স্মলন করতে চাইছিলেন বলুন তো?” 
“মানে বলছ সেকালের রাজারী…” সুরেনবাবুর কথা শেষ হল না। জানালা দিয়ে কি যেন খেয়াল করে মেয়েটা বলে, “বর্ধমান ঢুকবে মনে হয় । উঠতে হবে আমাকে ।” 
সুরেনবাবু ঘাড় নাড়লেন । মেয়েটার চোখে মুখে একটা আলগা ঝকুঝকে ভাব আছে । তবে সেটা ভালো করে লক্ষ না করলে ঠিক কোথা থেকে আসছে বোঝা যায় না। বইটা ব্যাগে ঢুকিয়ে বাকি জিনিসপত্র গুছিয়ে চারপাশটা দেখে উঠে পড়ে মেয়েটা। তারপর আইল ধরে বাইরে বেরিয়ে আসে। সুরেনবাবু তাকে এগিয়ে দিতে গেটের কাছে এসে দাঁড়ান। 
দরজার একটু বেশি কাছে এগিয়ে গেছে মেয়েটা। অদ্ধকারের বুক চিরে হাওয়ার ঝাপটা এসে তার চুলগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে। ক্লিপটা এখন খুলে ফেলেছে সে। 
বর্ধমান আসতে এখনও মিনিট দশেক দেরি আছে । মেয়েটা সম্ভবত একটু হাওয়া খাওয়ার
জন্যেই এখানে এসে দাঁড়িয়েছে । ট্রেনের দরজার পিছনে রাখা আয়নাটায় মুখ দেখতে দেখতে সে আচমকাই বলে, “রোগটার কোনো চিকিৎসা করিয়েছেন?” 
“কোন্ রোগ?” অবাক চোখে তাকান সুরেনবাবু। 
“ক্লেস্টোম্যানিয়া” মুখে জল দিতে দিতে বলে মেয়েটা, “ট্রেনে ওঠার সময় আমার গলায় একটা চেন ছিল । এখন সেটা নেই । আপনি তখন আপনার স্ত্রীয়ের উপরে অতটা ক্ষেপে গেছিলেন কেন এবার বুঝতে পারছি ।” 
সুরেনবাবুর মাথা বুকের উপর ঝুঁকে এল, সঙ্গে সঙ্গে মুখ তুলে তিনি বললেন, “আপনি এক সেকেণ্ড দাঁড়ান, আসলে এতগুলো লোকের সামনে…” 
‘“দরকার নেই” হাসিমুখে তাকে থামিয়ে দেয় মেয়েটা, “ all that glitters is not gold। ট্রেনেওঠার আগে চল্পিশ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম । আপনার স্ত্রীয়ের সম্মানের দাম তার থেকে বেশি। তবে ভালো করে ডাক্তার দেখিয়ে নেবেন। লজ্জার কিছু নেই ।” 
মেয়েটার মাথায় একটা হাত রাখলেন সুরেনবাবু। বুকের ভিতর থেকে একটা পাথর নেমে গেছে তার। 
ট্রেনটা ঢুকে পড়েছে বর্ধমান স্টেশনে! অন্ধকার স্টেশনের বুক ছোট স্টল আর সাদা আলোর ছটায় ভরে আছে । কাঁধের ব্যাগটা ভালো করে চাপিয়ে হাতের ব্যাগটা মাটিতে রেখে নেমে দাঁড়ালো মেয়েটা। সুরেনবাবুর দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি হাসল। কী মনে পড়তে তিনি গলা তুলে বললেন, 
“এই দেখ, এতক্ষণ কথা হল, তোমার নামটাই জানা হল না“ “পায়েল… পায়েল রায়চৌধুরী !” নামটা বলে আর একবার হেসে দ্রুত পা চালাল মেয়েটা । 
* * * * * * *
“গণ্ডগোলটা কোথায় কিছু বুঝতে পারলে?”
“গগুগোলটা যে আছেই সেটা তুমি ধরে নিচ্ছো কী করে?” 
প্লেট থেকে কাঁটাটা তুলে নিয়ে একবার ঠোটে ঠেকাল সুনন্দা। তারপর কি যেন ভাবতে ভাবতে বলল, “ব্যাপারটা এতই সহজ আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না।” 
“বিশ্বাস করতে। যদি ওই অস্বাভাবিক মৃত্যুগুলোর কথা না জানতে । ওগুলোই তোমার মাথাটা খেয়েছে ।।” 
“আচ্ছা নলিনী ঘোষ লোকটা সুইসাইড করল কেন বলতো?” 
“সেটা আমাকে জানিয়ে তো করেনি।” 
“সুইসাইড নোট লিখে যেতে পারে কিছু! তাতে নিশ্চয়ই কারণ লেখা ছিল। বাট দ্যাটস অ্যাবসারড…” 
“অ্যাবসারডের কী আছেঃ?” 
“নাঃ, লোকটা এখানে ঘুরতে আসেনি ।” সুনন্দা চিন্তিত গলায় বলে, “এসেছিল সরকারি কাজে । মানুষ দরকারি কাজে অন্যের বাড়িতে এসে সুইসাইড় নোটে লিখে সিলিঙে ঝুলে পড়ে এমন কথা আমি আগে শুনিনি !” 
“হতে পারে কোনো খবর পেয়েছিল ফোনে। তাতেই ডিপ্রেসড হয়ে…” 
“সুইসাইড করল?” এবার বেশ জোরে জোরে মাথা নাড়ে সুনন্দা, “একেবারেই গোঁজামিল মেলাতে হচ্ছে উত্তরটা, তারপর ধরো সেই প্রথম লোকটা যে সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা গেছিল, প্রশ্ন হল অত রাতে ওই শ্যাওলা ধরা ভিজে সিঁড়িতে কী করছিল সে? সিঁড়িতে যে শ্যাওলা জমেছে হোপফুলি সে নিজেও জানত !” 
“তুমি অন্তত ওই কাজটি করতে যেও না। যা কাজকর্ম বা ঘোরাঘুরি করার সব দিনের বেলাই মিটিয়ে ফেল। রাতে বাহাদুরি দেখিও না !” কাঁটা চামচ তুলে হুমকি দেয় নীলাদ্রি। 
দু’জনেই খাওয়াতে মন দিল। গোটা চকদীঘিতে এই একটা জায়গাতেই একটু দোকানপাট আছে — নতুনপল্লী । তবে জায়গাটা শহরের মতো ঘিঞ্চি
না। বেশি রাত অবধি খোলাও থাকে না। ছাপোষা কিছু খাবার দাবারের দোকান আছে । তারই একটাতে এসে বসেছিল ওরা । একটু সন্ধের দিক বলে লোকজন তেমন নেই । আর একটু পরেই হয়তো দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। বাইরের দোকানগুলোও একটা একটা করে ঝাঁপ বন্ধ করতে শুরু করেছে। থেকে থেকে সাটার নামানোর আওয়াজ আসছে । 
খাওয়া শেষ করে বিল চাইল নীলাদ্রি। দোকানের ম্যানেজার এতক্ষণ কাউন্টারে বসে ঢুলছিলেন । তিনি আচমকা জেগে উঠে একটা ছোট কাগজে কীসব যেন হিসেব করে বললেন, “ছেষট্টি ।।” 
ম্যনেজারের টেবিলের পাশে রাখা চেয়ারে বসে পড়ল নীলাদ্রি। টেবিলের উপরে একটা ছোটো ফলকে নিজের নাম লিখে রেখেছেন ম্যানেজার—-মাধব চৌধুরী । ড্রয়ারে খানিক খোঁজাখুঁজি চলল — খুচরো নেই । উঁচু গলায় ডাকলেন ম্যানেজার, “কিসনু, এ কিসনু…” 
একটা মাঝবয়সী ছিপছিপে চেহারার ছোকরা এসে দাঁড়াল। সম্ভবত দোকানের রান্নাঘরে কাজ করে । একশো টাকার নোটটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে দিলেন মাধব চৌধুরী, “এটা ভাঙিয়ে নিয়ে আয়। যদুবাবুর দোকান খোলা আছে এখনও । জলদি যা !” তারপর নীলাদ্রিদের দিকে ফিরে বলল “আপনারা একটু বসুন, ও এক্ষুনি চলে আসবে ।” 
“দোকান বন্ধ করতে চললেন, এখনও ক্যাশবাক্সে নোট নেই !” কথাটা বলে একটা সিগারেট ধরাল নীলাদ্রি। 
“আধাঘণ্টা আগেও ছিল, এক্ষুনি মহাজনকে পাওনা মেটালাম, সব শেষ! আপনারা বেশি দূর যাবেন নাতো?” 
“না। কাছেই । জমিদারবাড়ি ।” 
চোখ ফিরিয়ে একবার দু’জনকে দেখে নিল ম্যানেজার । তারপর হালকা হেসে বলল, “ওখানে এসেছেন? সরকারি কাজে, নাকি?”
“না আমাদের মালিক পাঠিয়েছেন। আপনি গেছেন?” 
এবার ম্যানেজার হো হো করে হেসে উঠল । তারপর মৌরির বাটি এগিয়ে দিয়ে বলল, “সে ছেলেবেলায় কতবার গেছি। বাপ-মার চোখের আড়ালে হুড়োহুড়ি করার ওর থেকে ভালো জায়গা আর নেই । তখন সীমানার পাঁচিলে একটা ফাটল ছিল । আমরা তার মধ্যে দিয়ে ঢুকে পড়তাম !” ম্যানেজারের চোখে মুখে স্মৃতি রোমন্থনের বিষণ্নতা খেলে যায় । 
“তারপর?” 
“তারপর আর কি, অতবড় বাড়ি আর আমরা জনা ছয়েক কচি-কাঁচা । সব থেকে মজার ছিল ওখানে লুকোচুরি খেলা। একবার যে চোর হল তার কপাল পুড়ল! তবে…” একটু থেমে ম্যানেজার আবার বললেন, “অনেকদিন আর যাওয়া হয়নি । বিশেষ করে ওঁই দীঘিতে লাশটা ভেসে ওঠার পর থেকে বড্ড কড়াকড়ি হয়ে গেছে, তাছাড়া সাপখাপ…” 
ম্যানেজার কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই কিসনু বলে ছেলেটা এসে পড়েছে। এর আসল নাম হয়ত কৃষ্ণ, অপভ্রংশে বদলে গেছে । দশ আর কুড়ি মিলিয়ে কয়েকটা নোট সে ম্যানেজারের দিকে এগিয়ে দিল।ম্যানেজার তিনটে দশটাকা আর ক্যাশবাক্স থেকে চারটে একটাকার কয়েন বের করে এগিয়ে দিল। নীলাদ্রি কয়েনগুলো নিল না। টাকাগুলো মানিব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, “একদিন আসবেন না হয় । আমরা ব্যবস্থা করে দেব !” 
ম্যানেজার বিনীত মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালো । ওরা দু’জন নতুনপল্লির রাস্তা ছেড়ে বেরিয়ে এল । 
এখানকার রাস্তাঘাট সবই পাকা । তবে যত্নের অভাবে কিছু জায়গায় খয়ে গিয়ে গর্ত হয়ে আছে । রাস্তার ধারে সোডিয়ামের উঁচু ল্যাম্পপোস্ট লাগানো আছে । তার আলোয় উলটোদিক থেকে দুলকি চালে এগিয়ে আসা ছোট 
ভ্যানরিক্সা আর সাইকেল চোখে পড়ে । বাস
এদিকে প্রায় নেই বললেই চলে । রাস্তার দু’পাশে পাতলা হয়ে আসা গাছের সার আর তার ভিতরে গজিয়ে ওঠা দু-একখানা পাকা বাড়ি । একটু ভিতরের দিকে ঢুকতে দরমার ঘরও দেখা যায় আর বছর খানেক পরেই গোটা এলাকা জুড়ে আস্ত শহর নামবে! আপাতত সেই গাছপালা আর ঘরবাড়ির প্যারেড থেকে ঝিঁঝিঁর ডাক ভেসে আসছে । 
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুনন্দা বলল, “লোকটার বয়স কত মনে হল তোমার?” 
“কার? ম্যানেজারের?” 
“হুম।” 
“কত হবে, এই বছর পঞ্চাশেক।“ 
“তাহলে দীঘির ব্যাপারটা যখন ঘটে তখন তার বয়স দশের কাছাকাছি ।” 
“অংক করলে তাই দাঁড়াচ্ছে, কিন্তু কেন বলতো?” 
“ভদ্রলোক এমনিতে বেশ দ্রুত কথা বলেন। কিন্তু লুকোচুরি খেলার কথা যখন বলছিলেন তখন থেমে থেমে বলছিলেন । মানুষ কখন থেমে থেমে কথা বলে?” 
“এতদিন আগের ঘটনা মনে করে করে বলতে কষ্ট হয় হয়তো !” 
“বা এমন কোন ঘটনা যা মনে রাখতে চান না, বা এড়িয়ে যেতে চান। আমরা ছোটোবেলায় পুলিনদের দোতলার ঘরে আলো নিভিয়ে লুকোচুরি খেলতাম। কই গলা কাপল?” 
এবার হেসে ওঠে নীলাদ্রি। তারপর সুনন্দার কাঁধে একটা হাত রেখে বলে, “তুমি দেখচি একেবারে গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছো । সেটা একদিক থেকে ভালো । এখানে টিভি নেই যখন… ও, একটা কথা তো তোমায় বলাই হয়নি। বললে আরও উত্তেজিত হয়ে পড়বে!” 
“কী কথা?” নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে সুনন্দা। 
“মোড় থেকে বাঁদিকে গেলে তো জমিদারবাড়ি, সেদিকটা ছেড়ে একটু এগিয়ে ডানদিকে
ঘণ্টাখানেক হেঁটে গেলে কি পড়বে জানো?” 
“কী?” 
“সেমেটারি । সেই সঙ্গে লাগোয়া প্রাচীন ক্যাথোলিক চার্চ ।” 
“তাহলে গ্রেভইয়ার্ড বল !” 
“মানে?” 
“মানে যেখানে শুধু কবরস্থান থাকে তাকে বলে সেমেটারি, আর চার্চের লাগোয়া হলে গ্রেভইয়ার্ড । দুটো একদম আলাদা জিনিস।” 
“ওঃ, আমি ভাবলাম তুমি এক্সাইটেড হবে, উলটে জ্ঞান দিচ্ছো ।” 
সিগারেট ফেলে মুখ বাঁকাল নীলাদ্রি। 
সুনন্দা কি যেন ভাবতে ভাবতে বলল, “কবরস্থানটা কোনো বড় কথা না। আমার মাথায় বারবার উত্তরের অন্দরমহলটা ফিরে আসছে, জানো? আচ্ছা . তুলিকে ওখান থেকে কে ডাকল বলতো?” 
“যে কেউ হতে পারে । তাছাড়া বাচ্চা মেয়ে, নিজের খেয়ালে ভুল শুনেও থাকতে পারে । আবার এও হতে পারে আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে ।” 
আর কিছু বলল না সুনন্দা। মিনিট কুড়ি হাঁটার পর বাড়ির সামনে পুকুরপাড়ে পৌছে গেল দু’জনে । আগে এদিকটা ছিল দেউড়ি । পাঁচিলের গায়ে লাগোয়া বড় সদর দরজা । এখানে সিংহ দরজা ছিল একসময় । এখন সেসব ভেঙে পড়ায় কলান্সিবেল গেট লাগানো হয়েছে। তার সামনে সারাক্ষণ সিকিউরিটি গার্ড বসে থাকে । বাইরের লোকের প্রাসাদে ঢাকা বিকেল ছ’টা নাগাদ বন্ধ হয়ে যায়। 
সুনন্দা আর নীলাদ্রিকে দেখে মাড়োয়ারি গার্ড দরজা খুলে দিল। ওরা ভিতরে ঢুকে এল। 
বাইরের কম্পাউন্ডে দাঁড়ালে দুটো প্রাসাদই পুরোপুরি চোখে পড়ে। পাশাপাশি দুটো অট্টালিকার মতো দাঁড়িয়ে । তবে ফ্লোরগুলোকে বাইরে থেকে দেখা যায় না। আকাশছোয়া লম্বা লম্বা থামগুলো পথ আটকে দাঁড়ায় ।
থাম যেখানে শেষ হয়েছে তার উপরেই ছাদের পাঁচিল । পাঁচিলের ঠিক উপরেই গোল চাঁদটাকে চোখে পড়ছে । মাঝে মাঝে সোনালি মেঘের চাদরে 
ঢাকা পড়ে যাচ্ছে সেটা । পরক্ষণেই খানিক দূর ভেসে গিয়ে আবার দেখা দিচ্ছে। 
থামের ভিতরে এখন তিনটে মশাল জ্বলছে । এটা হয়তো বাড়ির ট্রাডিশান; গার্ডই সন্ধে হলে জ্বালিয়ে দিয়ে আসে মশালগুলো। 
সেই আলোর দিকে তাকিয়ে একটু থমকে দাঁড়ায় দু’জনে, সুনন্দা অস্ফুট ‘স্বরে বলে, “এরকম কখনও ভাবিনি, জানো?’ 
“কী ভাবোনি?” 
“পরশু অবধি ভাড়া বাড়িতে থাকতাম । ভাবতাম কবে নিজেদের বড়সড় কিছু একটা হবে। আর আজ প্রায় রাজবাড়ি ।” 
“এটাও একরকম ভাড়াবাড়িই বলতে পার। মেয়েটা যতদিন থাকবে ততদিন !” 
“সেটাও কি ভেবেছিলে কোনোদিন?”
 নীলাদ্রি উত্তর দেয় না। বাড়ির আশপাশটা ভালো করে দেখতে থাকে সে। তারপর খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে ঘাসের জমির উপরে বসে পড়ে বলে, “ধরে নাও আমি হলাম জমিদার ভূপতি দত্ত!” 
“যিনি ব্রিটিশদের চামচা ছিলেন ।” ফুট কাটে সুনন্দা! 
“সে যাই হোক, এই হল আমার প্রাসাদ, আর তুমি হলে…” 
কথাটা বলতে গিয়ে আটকে যায় নীলাদ্রি। ভুরু কুঁচকে বলে, “সনাতন বলছিল এই দত্তবাবুর স্ত্রী নাকি অল্পবয়সে মারা জান। ছেলেপুলে হয়নি কিছু! দত্তবাবু তো স্ত্রী-বিয়োগের পর তুরম্ভ আবার বিয়ের পিড়িতে বসেন। এই নতুন বিয়েতে তার একটি ফুটফুটে ছেলে হয়… কন্দর্প দত্ত !” 
“ফুটফুটে কি না জানলে কী করে?” 
“আহা, জমিদারবাড়ির ছেলে সে কি আর খ্যাদাপেঁচা হবে?” 
“ব্যাস…” হাত তুলে কিছু একটা বলতে
যাচ্ছিল সুনন্দা। এমন সময় বাগানের একপাশ থেকে একটা পায়ের আওয়াজ শুনে চমকে উঠল। 
সকালের রোদ বাড়ির উপরে পড়লে বিরাট থামগুলোর ছায়া বাড়ির দেওয়ালের উপরে লম্বা লম্বা নকশা এঁকে যায় । রাত হলে বাড়ির চাতালে 
মশাল জ্বলে বলে ছায়া পড়ে ঠিক উলটোদিকে । সূর্যের সঙ্গে মশালের আলোর এই ছায়াযুদ্ধ চলতে থাকে সারাদিন। এখন বাগানের উপর এসে পড়া ছায়াগুলোর মাঝে একটা মাঝবয়সী তরুণীর ছায়া পড়েছে । দু’জনে চোখ তুলে তাকাতেই মূরতি এগিয়ে এল । একটা বছর পাঁচিশের মেয়ে । দুটো হাত জড়ো করে কপালের কাছে ঠেকিয়ে বলল, “আমি মালতী, মধুবাবু পাঠালেন।”

“পাঠালেন! কেন বলতো?” 
তেমনই আধো গলায় মালতী বলল, “তুলিদিদির যদি দরকারে লাগে তাই । রাতের দিকটা থাকব আমি। দিনে মধুবাবু থাকবেন!”
নীলাদ্রি নিচু গলায় বলল, “দরকার-টরকার বাজে কথা, মধুবাবু বুঝেছেন রাতে গল্পগুজব করার লোক দরকার তোমার ।” 
তারপর সামনে ঘুরে বলল, “বেশ মালতী, উপরে চল!” 
ঘাটের সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে উঠে এল তিনজনে। সিঁড়ির কাছে আলোটা একটু বেশি জোরালো করে রাখা আছে । সকালের মতো সেই পায়ের 
আওয়াজটা কানে যেতেই আবার একটা বিষণ্নভাব চেপে ধরল সুনন্দাকে ভালো করে শুনলে মনে হয় যেন আওয়াজটা পায়ের না। দোতলা থেকে অনেক মানুষের গুনগুন কথা বলার আওয়াজ আসছে । দূর থেকে আসছে বলে একসঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে শোনা যাচ্ছে না কথাগুলো । 
“তুমিও কি এ বাড়িতেই থাকো?” মালতীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল সুনন্দা। 
“না দিদি, আমার বাবা থাকে। আমি আর মা বাদামতলায় ঘর নিয়ে থাকি দিনটা এখানে থাকি, রাতে বাড়ি চলে যাই ।” 
“তোমার বাবার নাম কী?” 
“সনাতন কবিরাজ!” 
‘ও, সনাতনদার মেয়ে তুমি ।” নীলাদ্রি বলল কথাটা, তারপর একদম উপরের ধাপে পা রেখে বলল, “তোমরাও এখানে থাক না কেন?” 
মালতী শাড়ির আঁচলটা একবার মুখে বুলিয়ে নিয়ে বলল, “থাকতে দিলে তা…” 
আর কিছু বলল না ওরা । বুঝল মালতীর বাপ-মায়ে কিছু একটা গণ্ডগোল আছে । সনাতনই তার মেয়ে-বৌকে এখানে থাকতে দেয় না। এ নিয়ে আর প্রশ্ন করা উচিত হবে না। 
বারান্দাটা ঘুরে এদিকের ঘরে ঢুকে এল তিনজনে । আপাতত ঘরের বিছানার উপরে তুলি আর মধুবাবু বসে আছেন । মাঝে একটা দাবার বোর্ড রাখা। তুলি দাবা খেলতে ভালোবাসে । এখানে আসার আগে তাই একটা বোর্ড কিনেই
এনেছে সুনন্দা! সে নিজেও খেলতে পারবে মাঝে মাঝে। আর কিছু তো তেমন করার নেই । 
ঘরে ঢুকেই জলের বোতলগুলো তুলে নিল মালতী ! সেগুলো প্রায় খালি হয়ে এসেছে । সেই সঙ্গে অ্যাসট্রেটা । সেটা ভরতি হয়ে এসেছে। বাইরে গিয়ে ফেলে আসা দরকার । 
“তুমি তো বেশ পাকা খেলোয়াড় হয়েছ দিদি!” হাসতে হাসতে তুলির 
মাথায় একটা হাত রাখলেন মধুবাবু। তার রাজা এতক্ষণে সাদা গজের প্যাচে পড়ে নড়াচড়ার শক্তি হারিয়েছে, “কে শিখিয়েছে বল তো?” 
“কেউ না। আমি নিজে শিখেছি।” 
“নিজে শিখে মধু মোক্তারকে তিনবারে দু’বার হারিয়ে দিলে? যাঃ সত্যি করে বল কে শিখিয়েছে।” 
“ওমা, বলছি তো রে বাবা নিজে নিজে খেলি। বাপি তো সময়ই পায় না! আর মা পারেই না।!” 
সুনন্দা এগিয়ে গিয়ে মধুবাবুর পাশে বসে পড়ে বলে, “বেশ, মিস গ্র্যান্ডমাস্টার, আমাকে একবার হারিয়ে দেখাও দেখি।” 
“তুমি পার খেলতে?” তুলির চোখমুখ খুশিতে ভরে ওঠে । সে দ্রুত হাতে দাবার বোর্ড সাজাতে থাকে । 
মধুবাবু একটু পেছনে সরে এসে নিচু গলায় বলেন, “ভারী মজার মেয়ে। বাবা-মাকে ছেড়ে এতদূরে দিব্যি অচেনা লোকেদের সঙ্গে মিলে গেল।!” 
“আপনার তো অচেনা না। আগেও তো এসেছে এখানে ।” সুনন্দা বোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বলে! 
“সে আর ক’বার । সবমিলে হয়তো বার চারেক । তার মধ্যে দু’বার এত ছোটবেলায় যে মনে থাকার কথা নয় ।” 
“হুম…” কয়েক সেকেন্ড থেমে কি যেন ভেবে নেয় সুনন্দা। তারপর আরও চাপা স্বরে বলে, “আপনি, মালতী, সনাতনদা আর শশাঙ্কদা ছাড়া আর যারা এখানে থাকে তাদের মধ্যে কে কে চেনে
তুলিকে?” 
“আর কারও তো চেনার কথা না। মালতীর সঙ্গেও ওর খুব একটা আলাপ নেই !” 
“আপনারা কেউ আজ বিকেলের দিকে অন্দরমহলের দরজার কাছটায় গিয়ে ওকে ডাকাডাকি করছিলেন?” 
“না তো!” অবাক হয়ে যান মধুবাবু, “দিনের বেলাতেই সাপের ভয়ে কেউ যেতে চায় না।” 
একটু থেমে পরের কথাগুলো বলে সুনন্দা, “তাহলে আপনারা ছাড়াও এখানে আরও কেউ আছে যে তুলিকে চেনে এবং সে সাপের ভয় পায় না।” 
“কে?” 
”জানি না।” মাথা নেড়ে সুনন্দা বলে। 
এতক্ষণে তুলি দাবার বোর্ড সাজিয়ে ফেলেছে । সে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করে, “তুমি সাদা নেবে না কালো?” 
“কালো। তাহলে আগে তুমি চাল দেবে।” 
দু’জনে খেলায় মেতে ওঠে। নীলাদ্রি ওদের দিকে একবার দেখে নিয়ে বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে আসে। তারপর গলা তুলে ভিতরে ডাক দেয়, “আসুন মধুবাবু, আমরা পাশের ঘরটা ঘুরে আসি ।” 
মধুবাবুর চেহারাটা বেশ সাদামাটা । মাঝবয়সী অফিসযাত্রীদের মতো সারাক্ষণ হাফ শার্ট আর ছিটের প্যান্ট পরে থাকেন। মাথা জোড়া চকচকে টাক । কাঠের বাক্সের মতো চৌকো মুখ। বয়স বছর ষাটেকের খানিক নিচে, কিন্তু এই বয়সেও ভিতরে ভিতরে বেশ শক্তি ধরেন বোঝা যায় । 
মধুবাবু বাইরে আসতে তার দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিল নীলাদ্রি তারপর ঘরের দরজায় একটা ঠেলা দিতে দিতে বলল, “বাচ্চাকাচ্চার সামনে 
সিগারেট খেতে খারাপ লাগে। বুঝলেন তো? তাই এ ঘরে…” “হ্যাঁ…আজকাল তো আর এসবের তেমন চল নেই । উলটে বাচ্চারাই খাচ্ছে বড়দের সামনে । আমাদের ছোটবেলায় আমরা
ভাবতেই পারতাম না ।” 
লাইটার দিয়ে নিজেরটা জ্বালিয়ে মধুবাবুরটার মুখে সেটা ঠেকাতে ঠেকাতে নীলাদ্রি বলে, “আপনি ছোটোবেলা থেকেই আছেন এখানে?” 
“না না।” মাথা নাড়েন মধুবাবু, “আমাকে নাথ স্যার রেখেছেন। আগে ওঁর ফ্যাক্টরিতে কাজ করতাম । এখন এই জমিদারবাড়ি দেখাশোনা করি । তাও নয় নয় করে বছর কুড়ি হয়ে গেল!” 
লাইটারটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে জানলার সামনে এসে দাঁড়ায় দু’জনে। দুটো ধোঁয়ার রেখা জানালা বেয়ে হাত বাড়াতে থাকে বাইরে। 
“আপনার নিজের বাড়ি কোথায়?” 
“বারুইপুর । ওখানেই বৌ-বাচ্চা থাকে !” 
“তাদের ছেড়ে এতদূরে থাকতে খারাপ লাগে না?” 
ফিকফিক করে হাসলেন মধুবাবু, বললেন, “লাগলেই কি আর উপায় আছে? আপনিও তো…” 
কথাটা শেষ করলেন না মধুবাবু। 
“আমিও কি?” মুখ থেকে সিগারেট সরিয়ে জিজ্ঞেস করল নীলাদ্রি। 
“না, মানে আপনিও তো থাকছেন এখানে ।” 
“ওঃ…” 
নীলাদ্রি বুঝতে পারল আরও কিছু বলতে চাইছিল লোকটা। কিন্তু কি? সে যে নিতান্ত টাকার দায়ে পড়েই প্রস্তাবটায় রাজি হয়েছে সেটা কি জানে লোকটা? কিন্তু কীভাবে? নাকি অন্য কিছু বলার চেষ্টা করছিল? যাই হোক, আর তাকে দিয়ে মুখ খোলানো যাবে না। জানালা থেকে সরে এসে ঘরের চারিদিকে তাকাল নীলাদ্রি। 
আগের ঘরটার থেকে এটার তেমন কোনো পার্থক্য নেই । শুধু এ ঘরের জানালায় নেট লাগানো হয়েছে নতুন! ক্ষীণ হয়ে আসা গদ্ধে বোঝা যায় নতুন রঙও করা হয়েছে হয়তে। 
“বাকি ঘরগুলোর চাবি কার কাছে থাকে?” 
“আমার কাছে।” সিগারেটে একটা বড়সড় টান দিয়ে বলেন মধুবাবু, “কাল দেখাব আপনাদের !”
“কাল আমি থাকব না। ওকে দেখাতে পারেন! ওর এসব দিকে যথেষ্ট আগ্রহ আছে ।” 
“এসব দিকে বলতে?” 
“মানে এসব পুরনো ঘরটর । তার উপরে একটা সুইসাইড হয়ে গেছে আবার।” 
“সে তো আমার চোখের সামনেই। আমিই উদ্ধার করেছিলেম বডিটা । 
সিলিং থেকে কাপড় বেঁধে ঝুলছিল । উউফ্ সে কি দৃশ্য!” 
“কোনো সুইসাইড নোট পাননি?” 
“উঁহু নাথিং। আশ্চর্যের কথা হল লোকটা সেদিন রাতেই সরকারি দফতরে ফোন করে মাইনে ঢুকছে না বলে তাগাদা দিয়েছিল । যে লোক রাতে আত্মহত্যা করবে, সে সন্ধেবেলা মাইনের জন্যে কেন ফোন করবে!” 
“তাহলে আত্মহত্যা নয় বলছেন?” 
“তাঁই বা কী করে বলি? দরজা জানলা ভিতর থেকে তালা দিয়ে বন্ধ। আমি আর মতীন গভীর রাত অবধি দরজায় বাইরে সিংহ দরজার কাছে বসেছিলাম ।” 
“মতীন কে? সিকিউরিটি গার্ড?” 
“হ্যাঁ, তখন ছিল। এখন সে আর নেই ।” 
দু’পা এগিয়ে এসে বিছানার উপর বসে পড়ে নীলাদ্রি। তারপর সিগারেটে একটা মোক্ষম টান দিয়ে বলে, “এই দত্তদের কোনো উত্তর-পুরুষ থাকে না এখানে?” 
“উত্তর-পুরুষ বলতে যা বোঝায় তা ঠিক নয় । তবে ওই লতায় পাতায় জ্যাতিরা এখনও কেউ কেউ টিকে আছেন। আমাদের সঙ্গে থাকেন মোহনদা। মানে ক্ষেত্রমোহন সেন। আর অনাদি রায়চৌধুরী বলেও একজন আছেন! তবে তিনি এদিকে প্রায় আসেননি বললেই চলে । তবে তার মেয়ে আসে কালে ভদ্রে – পায়েল। ভারি ভালো মেয়ে ।আজ রাতেই আসার কথা আছে শুনেছি ।।” 
“ব্যাপারটা অদ্ভুত। জমিদারি মানে তার লতায়-পাতায় অনেকদূর জ্ঞাতিগোষ্ঠি থাকে । তাদের
থেকে মাত্র দুটো পরিবার পড়ে আছে? বাকিরা কি উবে গেল নাকি?” 
“দু’টো – আমরা জানি। বাকিরা হয়তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এসব পুরানো বাড়ি নিয়ে তাদের আর আগ্রহ নেই । তবে একবার এক ভদ্রলোক এসেছিলেন।” 
“কীরকম ভদ্রলোক?” 
“খুব একটা ভক্তি হয় না তাকে দেখে। ছাপোষা মধ্যবিত্ত টাইপের । বলেছিল তার ঠাকুরদার বাবাকে নাকি বাড়ির ওয়ারিশন করে গেছিলেন তৎকালীন জমিদারবাবু।” 
“মানে?” 
“মানে সোজা কথায় বলে গেছিলেন যদি আমার কোনো উত্তরপুরুষ সন্তান না রেখে মারা যায় তাহলে অমুক ব্যক্তি, অমুক কাল অবধি সম্পত্তির দেখাশোনা করবেন । সেই ব্যক্তি নাকি ওই ভদ্রলোকের ঠাকুরদা, ফলত এই মুহূর্তে ওয়ারিশন তিনি নিজে ।” 
“ইন্টারেস্টিং। তা এমনি এমনি দাবি করেছিলেন নাকি কিছু কাগজপত্র ছিল?” 
“কাগজ কিছু একটা দেখানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু আমরা অতটা পাত্তা দিইনি। এত বড় সম্পত্তি দেখাশোনার মোহে যে কেউ ওরকম কাগজ নিয়ে হাজির হতে পারে । বলে গেছিলেন উকিল-টুকিল নিয়ে নাকি আবার আসবেন !” 
“তারপরে আর আসেননি?” 
“উঁহু… সেখান থেকেই আরও পরিষ্কার করে বোঝা গেল লোকটা ফ্রড !” 
“বটে… নামটা মনে আছে?” 
গালে একটা হাত রেখে ভাবার চেষ্টা করেন মধুবাবু । তারপর থেমে থেমে বলেন, “তাও বছর দশেক আগের কথা । নাম যতদূর মনে পড়ছে শশিভূষণ সরকার । বড়বাজারে মশলাপাতির দোকান ছিল। আমার সঙ্গেই কথা বলেছিলেন তো, তাই এটুকু মনে আছে !” 
“বছর দশেক আগে? মানে শেষ আত্মহত্যাটা হওয়ার সময়ে প্রায় !” মনে মনে বলে নীলাদ্রি।
সিগারেট এতক্ষণে ছোট হয়ে এসেছে । ঘর থেকে বেরিয়ে এল দু’জনেই । ঘেরা বারান্দা দিয়ে হাঁটতে লাগল । এখান থেকে নিচের ঠাকুরদালানটা দেখা যায়। সেখানে এখন ভাঙা যন্ত্রপাতি পড়ে আছে । কিছু পুরানো কাঠের 
আলমারির পাল্লা, ঝুলে ভরা একটা সাইকেল । পুরনো তোষক । হাতের সিগারেটটা তার উপরে ছুড়ে ফেলে দিল নীলাদ্রি। ভাঙাচোরা আসবাবের ফাঁকে মুহূর্তে মিলিয়ে গেল সেটা। 
এগিয়ে গিয়ে একটা দরজার উপরে হাত রাখল! কাঠের শক্ত দরজা। তার উপরে ছেনি দিয়ে কেটে নকশা করা। বাইরে তালা লাগানো। তাও ঠেলা দিলে একটুখানি ফাঁক হয়ে ভিতরটা দেখা যায় । এখন বাইরে চাঁদের আলো আছে বলে হালকা উদ্ভাসিত হয়ে আছে ভিতরটা । দেওয়ালের গায়ে বড়সড় কয়েকটা খোপ কাটা। দেখে মনে হয় পুরানো বাতিদান । আগে এখানে আলো রাখা হত! এখন আর দরকার পড়ে । 
“আপনি এত কী ভাবছেন বলুন তো?” নীলাদ্রিকে চুপ করে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেছেন মধুবাবু । নীলাদ্রি মাথা নামিয়ে কপালের ভাজগুলো কমিয়ে এনে বলে, “আপনি যে নামটা বললেন সেটা আগে কোনোভাবে শুনেছি আমি।” 
“কোন নাম? সেই ফ্রড শশিভূষণ সরকার?” 
“আজ্ঞে হ্যাঁ । কিন্তু কোথায় শুনেছি মনে পড়ছে না।” 
“কমন নাম। না শোনার কিছু নেই ।” 
নীলাদ্রি আর কিছু বলল না। বহুদূর থেকে রেলের শব্দ ভেসে আসছে । সামনে গাছপালার মাথায় হাওয়া লেগে শনশন করে আওয়াজ উঠছে একটা। 
তুলি আর সুনন্দা এতক্ষণে খেলার মাঝামাঝি এগিয়ে গেছে। সুনন্দার ইতিমধ্যে দুটো নৌকা আর মন্ত্রী খোয়া গেছে । সাদা সৈন্য কালো রাজাকে প্রায় কোণঠাসা করে দিয়েছে । মালতী একপাশে বসে খেলা দেখছে। তার ঠোটের কোণে ঝুলছে একটা সরু হাসি।
এবারের চালটা দিয়ে একটু সময় নিচ্ছে তুলি। তার মাথার চুলগুলো বারবার মুখের সামনে এসে পড়ে বিরক্ত করছে । সুনন্দা সেগুলো একবার ঠিক করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তুলি হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে। এই 
মুহূর্তে শত্রুপক্ষের সাহায্য নেবে না সে। 
সুনন্দা একবার মালতীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা, এখানে দেখার জায়গা কি আছে গো? কাল ভাবছি তুলিকে নিয়ে যাব!” 
“দেখার জায়গা এই জমিদারবাড়িই, কাল না হয় ওদিকের প্রাসাদটা দেখে এসা ।” 
“উঁহু,” মাথা নাড়ে সুনন্দা, “সে পড়ে হবে খন! শুনছিলাম কাছেই নাকি একটা কবরস্থান আছে ।” 
“তা আছে, কিন্তু কবরস্থান একটা দেখার জায়গা হল?” 
“কেন?” মুচকি হাসল সুনন্দা, “আমার তো বেশ লাগে।” 
“রক্ষে করো। কি না কি উঠে আসবে। তার উপরে আবার সব সাহেব !।” 
কথাগুলো বলতে গিয়ে মালতী নিজেও হেসে ফেলে । ঝকঝকে দাঁতগুলো টিউবের আলোতেও ঝকমকিয়ে ওঠে। 
“তুমি দেখছি ভারী ভীতু…” কথাটা শেষ করে না সুনন্দা । তুলি এতক্ষণে একটা চাল দিয়ে ফেলছে। সেদিকে তাকিয়ে মন দিয়ে পরের চাল ভাবতে থাকে সে। 
ধীর পায়ে ঘরে ঢাকে নীলাদ্রি। তারপর আবার চেয়ারের উপরে বসে! জানালার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে থাকে। গজ এগিয়ে দেয় সুনন্দা, “উনি চলে গেলেন?” 
“হ্যাঁ…” অন্যমনস্কভাবে উত্তর দেয় নীলাদ্রি। খেলা আরও খানিকদূর এগায় । এর মাঝে উঠে একবার বাথরুমে যায় তূলি । যাবার আগে শাসিয়ে যায়, তার অনুপস্থিতিতে বোর্ডের একটাও ঘুটি এদিক থেকে ওদিক হলেই সে বুঝতে পারবে। অমনি সে খেলা ভণ্ডুল করে দিয়ে নিজে জিতে
যাবে! 
সে চলে যেতে নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হয় সুনন্দা । চুল ঠিক করতে করতে বলে, “তুমি কি কিছু ভাবছ?” 
“একটা ব্যাপার কিছুতেই মাথায় আসছে না!” 
“কী ব্যাপার?” 
বাথরুম করে মালতীর সঙ্গে ফিরে আসে তুলি। আবার গিয়ে বসে দাবার বোর্ডের সামনে! 
“একটা নাম। আগে শুনেছি । কিন্তু মনে পড়ছে না কোথায় শুনেছি !” 
“কী নাম?” 
“শশিভূষণ সরকার । বড়বাজারে মশলার দোকান ছিল ।” 
সুনন্দার চোখে একটা ঝিলিক দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায় । ফিরে এসে চাল দিয়েছে তুলি । সে অধৈর্য্য হয়ে ওঠে । সুনন্দা চাল দিতে দিতে বলে, “আরে দাঁড়া বাবা, অত তাড়াহুড়ো করলে হয়?” 
কোনোরকমে একটা চাল দিয়ে বলে, “আমরা বাজার করতে গেছিলাম কিন্তু কিছু একটা গণ্ডগোলে বড়বাজার বন্ধ ছিল । আমার ফোনটা কোথায় গেল?” 
ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে গুগলে নামটা দিয়ে সার্চ করে সুনন্দা। একটা অন্যমনস্ক চাল দেয় আরেকবার । 
খবরটা স্ক্রিন জুড়ে ফুটে উঠতেই সেটা নীলাদ্রির দিকে এগিয়ে দেয় সুনন্দা! তারপর বলে, “শশিভূষণ সরকারের বড়বাজারে দোকান ছিল । তার মৃত্যুতেই একদিন গণ্ডগোল হয়েছিল ওখানে । বছর দশেক আগে। আমরা মনে হয় তখনই গেছিলাম বড়বাজারে কিছু কেনাকাটি করতে!” ফোনটা বিছানার উপর রেখে দেয় সুনন্দা । রিমলেস চশমাটা শাড়ির আঁচলে মুছে নেয়। 
“মারা গেছে? মানে এখান থেকে ফেরার পরপরই ।” বিড়বিড় করে নীলাদ্রি, কি মনে পড়তে আচমকা বলে, “সে তো কতলোক মরছে । তাতে বন্ধ ছিল কেন?” 
প্রশ্নটা শুনে ফোনটা তুলে নিয়ে আটিকেলটা
আর একটু পড়ে সুনন্দা, বলে, “উঁহু, মৃত্যু না। ভদ্রলোক রাতে দোকানেই ঘুমাতেন। সেদিন সকালে দোকানের ভিতর ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায় । পুলিশে বলছিল সুইসাইড… কিন্তু ওখানকার লোকজন বলছিল … খুন।” 
উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে নীলাদ্রি। 
“চেকমেট !” রাজার সামনে মন্ত্রী এগিয়ে দিয়ে বলে ওঠে তুলি ।

 তৃতীয় অধ্যায় 


পুকুরের ধার দিয়ে অনেকক্ষণ পায়চারি করছিল পায়েল । মাঝে মাঝেই পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে নিচ্ছে। প্রায় সাড়ে ন’টা বেজেছে । 
পুকুরের পাড়ে দাঁড়ালে ঝাঁকড়া গাছের মাথা থেকে পাতা উড়ে আসে গায়ে । পায়েলের সালওয়ারের উপরেও এসে পড়েছিল কয়েকটা । সেগুলোকে তুলে ফেলে দিল সে । কাঁধের ঝুলন্ত ব্যাগের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে একটা রুমাল বের করে আনল । তারপর সেটা পাখার মতো নাড়তে লাগল মুখের সামনে। একটু ছায়ায় এসে দাঁড়াল। 
পায়েলের চেহারাটা বেশ ধারালো। সবে চব্বিশে পা দিয়েছে । ছিপছিপে পাতলা গড়ন । সাধারণ মেয়েদের থেকে একটু বেশি লম্বা । গায়ের রং যতটা না ফৰ্সা তার থেকে বেশি রক্তাল্পতা আর লো ব্লাড প্রেশারে ভুগে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে । কাল রাতেই বোলপুর থেকে বর্ধমান হয়ে হগলী ফিরেছে সে। রাতেই সুনন্দার সঙ্গে প্রাথমিক আলাপটা সেরে এসেছে । আজ সকালে দু’জনের গ্রেভইয়ার্ড দেখতে যাবার কথা । কিন্তু সুনন্দা এখনও এসে পৌছায়নি । 
খানিক পরে জমিদারবাড়ির সদর দরজায় দেখা গেল সুনন্দাকে । সেই সঙ্গে তুলিকেও । তার একটা হাত ধরে আছে সুনন্দা। 
দূর থেকে পায়েলকে দেখতে পেয়ে একবার হাত তুলে ইশারা করল সে। তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে এল সেই দিকে। 
আজকের রোদটা বেশ চড়া। তাতে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মাথা ধরে যায়। শরীর শুকিয়ে আসে। 
“অনেকক্ষণ এসেছ?” কাছে এসেই প্রশ্নটা ছুড়ে দেয় I । 
“মিনিট দশেক হবে । হেঁটে যাবে?” 
“এই রোদে! রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে তা…” 
একটুখানি হাসল পায়েল। তারপর তুলির দিকে তাকিয়ে বলল, ““রানিমা কি কোলে বসতে রাজি
হবেন?” 
“একটুও না।” মাথা দুলিয়ে বলে তুলি। 
“তাহলে বাঁদিক দিয়ে চল, ছায়া পড়ে আছে ।” 
রাস্তার বাঁদিকে সরে আসে তিনজনে । তারপর হাঁটতে থাকে । এখান থেকে (গ্রেভইয়ার্ডটা বেশিদূরে না। মিনিট কুড়ি বড়জোর । তুলিকে একদম ধারে রাখে সুনন্দা । সে নিজে মাঝখানে আর পায়েল রাস্তা ঘেঁষে হাঁটতে থাকে । 
“তুমি একা এলে! বাবা মা কেউ এলেন না!” সুনন্দা জিজ্ঞেস করে পায়েলের দিকে তাকিয়ে । 
“বাবা আসতে চায় না খুব একটা এখানে । একটু পাঞ্জাবী পরা আঁতেল গোছের লোক । জমিদারি-টোমিদারি এড়িয়েই চলে । আর মায়ের একা এতদূর আসার ইচ্ছা নেই ।” 
“তোমার আগ্রহ আছে?” 
পায়েল হাসে । হাসলে বেশ মিষ্টি দেখায় তাকে । সাদা ঝকঝকে দাঁতগুলো সরু ঠোটের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় একঝলক। তারপর বলে, “আমার সব পুরনো জিনিসপত্রতেই আগ্রহ । তবে এখানে আগে খুব একটা আসা হয়নি।” 
“কেন?” 
“এসে কী করব? লোকজন যাদের চিনি তারা হয় আমার বাবার বয়সী নাহলে এতটাই গম্ভীর যে কথা বলতেও ভয় লাগে !” 
“তোমাকেও তো বেশ গম্তীর মনে হয় । কাল তো তাই মনে হচ্ছিল!” 
“আমাকে যা মনে হয় আমি আদৌ তা নই । ক’দিন যেতে দাও । বুঝবে!” অর্থপূর্ণ হাসি হেসে চুলে একটা ক্লিপ লাগায় পায়েল। 
“আমি আইসক্রিম খাব !” রাস্তার ধারে একটা আইসক্রিমের গাড়ি দেখে আবদার করে তুলি । সুনন্দা তাকে আইসক্রিম কিনে দেয়। তারপর আবার হাঁটতে থাকে সামনে। ‘ 
কালকে রাতের ঘটনাটা মনে পড়ে তার । ব্যাপারটা নীলাদ্রিকেও ভাবিয়ে তুলেছে । এতক্ষণ ভাবনাগুলো মনের মধ্যে ছটফট করছিল । এবার সে হাঁটতে হাঁটতে বলে, “আমার যা মনে হয়
তোমাদের বংশে কিছু একটা 
গোলমাল আছে ।” 
“গোলমাল বলতে?” পায়েল জিজ্ঞেস করে । 
“মানে তোমাদের কোনো পূর্বপুরুষের অবর্তমানে শশিভূষণ সরকার বলে এক ভদ্রলোকের জমিদারির সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব পাবার কথা ছিল। ভদ্রলোক কাগজপত্র নিয়ে এসেওছিলেন কিন্তু তারপরেই কেউ খুন করে তাকে ।” 
পায়েল ব্যাপারটা একবার ভেবে নিয়ে বলে, “মানে বলছো যাতে তিনি দায়িত্ব না পান তার জন্যেই তাকে সরিয়ে দিয়েছে কেউ?” 
“সেটা হতে পারে। তবে তার থেকেও বড় কথা হল সেই খুনটা হয়েছে ঠিক সেইভাবে যেভাবে এই বাড়ির শেষ খুনটা… আই মিন আত্মহত্যাটা হয়েছে ।” 
“কীভাবে?” 
“বন্ধ ঘরের মধ্যে । মানে জানলা দরজা সব ভিতর থেকে ছিটকানি দিয়ে বন্ধ! সকালবেলা লোকে দরজা ভেঙে দেখে সিলিং থেকে ঝুলছে ।” 
“তাহলে খুন বলছ কী করে? আত্মহত্যাই তো মনে হচ্ছে ।” 
সুনন্দার বাঁকা কপালের রেখাগুলো এবার নরম হয়ে আসে, “‘আমি বলছি মানেই তো আর হয়ে যাবে না। তবে এখানে আসার পর থেকে মনটা সারাক্ষণ খারাপ হয়ে থাকে আমার !” 
“কেন?” 
“কি জানি, এতদিন আগে এত লোক এখানে থাকত। এখন তারা আর কেউ বেঁচে নেই । কত হাসিকান্না, মৃত্যু, হিংসা- প্রতিহিংসার ঝড় বয়ে গেছে। সেসব আজ আর কোথাও লেখা নেই !” কথাটা বলেই হাওয়ায় একবার হাত চালিয়ে সে বলল, “ছাড়ো এসব। বোলপুরে তুমি কী পড়ো বলতো?” 
“ইংলিশ অনার্স ।” 
“তা কলকাতার বাড়ি ছেড়ে ,এতদূরে!” : 
“আর বলো কেন, সেই টুটাফুটা গল্প । বাবার
ইচ্ছা ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি। আমার কম্প্যারাটিভ লিটারেচার ভালো লাগত । তাই নিলাম একরকম জোর 
করেই । তারপর দেখলাম বাড়িতে থাকলে ওই এক জিনিস নিয়ে বকবক শুনিয়ে মাথা হেজিয়ে দেবে। তাই ভাবলাম দূরে গিয়েই থাকি ।” 
“এখন হঠাৎ এলে যে…” 
“কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছিল একবার ঘুরে আসি । তাছাড়া…” 
পায়েলের কথা শেষ হল না । দু’জনেই থেমে গেল । রাস্তাটা একটা বাঁক (ঘোরার পরে অনেকটা খালি জায়গা দেখা যাচ্ছে। সেখান থেকে সোজা তাকালে একটা লোহার আর্চ চোখে পড়ে। তার ঠিক পাশেই বড়বড় হরফে (লেখা— চকদীঘি ব্যাপটিস্ট চার্চ অ্যাণ্ড গ্রেভইয়ার্ড । লেখাটার গায়ে এখন লতাপাতা গজিয়েছে । সেই লতার ঝাক নেমে এসেছে দু’পাশের পাঁচিলের উপরে। এখানে এখনও যে ক’টি খ্রিস্টান পরিবার আছে তারাই যত্ন নেন চার্চটার । দু’জনে এগিয়ে গেল সেইদিকে । 
গেটের মুখটায় একজন মাঝবয়সী লোক বসেছিলেন । ইনি সম্ভবত স্থানীয় লোক । চার্চের দেখাশোনা করেন । সুনন্দা একটু এগিয়ে তার সামনে গিয়ে দীড়িয়ে বলল, “একটু ভিতরে যাওয়া যাবে?” 
“কোথা থেকে আসছেন আপনারা?” লোকটা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল! 
“আমরা জমিদারবাড়িতে এসেছি। আর ও…” 
“ওকে চিনি ।” পায়েলের দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল লোকটা। পায়েল নিজেও অবাক হয়ে গেছিল। সে আগে কখনও গ্রেভইয়ার্ডে আসেনি। তাহলে লোকটা ওকে চিনল কী করে? 
যাই হোক, লোকটা আর কথা না বাড়িয়ে ভিতরটা দেখিয়ে দিল।! ওরা দু’জনে ভিতরে ঢুকে এল। 
গেট পেরিয়ে ঢুকলে প্রথমেই চার্চের বড়সড় বিল্ডিংটা দেখা যায় । এখন তার উপরে দুপুরের
রোদ এসে পড়েছে । লাল রঙের ক্যাথোলিক চার্চ । চূড়ার ঠিক নিচে একটা কাচের প্লেটে যিশুর প্রতিকৃতি । তার নিচে গোল, রোমান নিউমারেল লেখা ঘড়ি । সামনে খানিকটা ঘাসের জমি । বড়সড় চেহারার দরজাটা খোলা ! তার ভিতরে তাকালে প্রেয়ার রুমের কয়েকটা বেঞ্চ চোখে পড়ে! চার্চের 
পিছনের দিকে ছোটখাটো কয়েকটা স্তম্ভ । সেখান থেকেই গ্রেভইয়ার্ড শুরু। 
চারপাশে তাকিয়ে আর কাউকে কিন্তু চোখে পড়ল না। ভিতরে হয়তো লোক থাকতে পারে । কিন্তু বাইরে থেকে তাদের দেখতে পাবার কথা নয় । দু’জনে চার্চটাকে পাশ কাটিয়ে সমাধিক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যায় । 
সমাধির দিকটায় গাছপালা একটু বেশি। বাইরে থেকে দেখলে পাতলা জঙ্গল বলে মনে হয় । মাটিতে শুকনো ডালপালা বিছিয়ে রয়েছে। ওদের পায়ের চাপে মড়মড় করে আওয়াজ উঠছে তাতে । ঠিক যেন মনে হয় পিছন পিছন হেঁটে আসছে কেউ। মাঝে মাঝে চমকে ফিরে তাকাচ্ছে দু’জনে । 
কিছু সমাধির উপরে বেদি করা আছে । উঁচু বেদির সমস্ত গা জুড়ে শ্যাওলার ছোপ পড়েছে । কিছু জায়গায় আবার শ্বেতপাথরের গা খসে গিয়ে একটুখানি ফাঁক হয়ে আছে । তার ভিতরটা অন্ধকার । অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হয় ভিতর থেকে কেউ চেয়ে আছে যেন। 
দেখতে দেখতে হাঁটতে থাকে দু’জনে। বিশেষ করে কিছু দেখার নেই । তবে সমাধির উপরে শ্বেতপাথরের ফলকে মৃত ব্যক্তির নাম, জন্মতারিখ, কবে মারা গেছেন ও তার সম্পর্কে দু-একটা কথা খোদাই করা আছে ইংরাজিতে । সেগুলোর উপর চোখ রাখল ওরা! বেশিরভাগ ফলকই অস্পষ্ট। কয়েকটা আবার আশপাশের গাছের শিকড়ের জন্যে নিচের দিক থেকে ভাঙতে শুরু করেছে । 
ফলকের উপর লেখা শালগুলো দেখতে দেখতে হাঁটছিল পায়েল। এবার সে থেমে গেল, তারপর আসতে আসতে বলল, “একটা জিনিস লক্ষ্য
করছি ।” 
“কী বলতো?” সুনন্দা তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল! 
“মোটামুটি সত্তর শতাংশ লোক এখানে সতেরোশো নব্বই থেকে আঠেরোশো পাঁচ— এই পনেরো বছরের মধ্যে মারা গেছে, এবং তাদের আবার সিংহভাগের বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে ।” 
“নতুন গরমের দেশে এসে ক্লাইমেটটা সহ্য করতে পারেনি । রোগটোগ হয়েছিল হয়তো !” 
তুলির আইসক্রিম এতক্ষণে শেষ হয়েছে । সে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সৌধগুলোর দিকে । এর আগে কোনো করবরস্থানে আসেনি সে। এতক্ষণে সুনন্দার হাত ছেড়ে সে পায়েলের দিকে সরে এসেছে । 
আচমকা একটা এপিটাফ চোখে পড়তে থমকে গেল সুনন্দা। তারপর সেটার উপরে ঝুঁকে পড়ে বলল, “দেখ, এখানে ওয়াও লেখা আছে । মানুষ মরে গেছে তাও এত খুশি হয়েছে কেন?” 
পায়েল একবার সেদিকে তাকিয়ে হাসল, তারপর বলল, “ওটা আসলে একটা এব্রিভিয়েশান! উডমেন অফ দ্য ওয়ার্ল্ড, একটা ইন্সিওরেন্স কোম্পানি; কেউ মারা গেলে এরা সাধারণত মৃতের পরিবারকে মোটা টাকা দিয়ে সাহায্য করত। এমনকি এপিটাফটা পর্যন্ত এরা নিজেরা বানিয়ে দিত । শর্ত শুধু ওই একটাই । এপিটাফের উপরে ওদের লোগো খোদাই করতে দিতে হবে !” 
“মজার ব্যাপার তো!” খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সুনন্দা, “এখানেও অ্যাডভেটাইজমেন্ট!” 
“হ্যাঁ, ইন্সিওরেন্সের বিজ্ঞাপন মরা লোকের থেকে ভালো আর কে করতে পারে?” 
মূল রাস্তা ছেড়ে আর একটু ভিতরের দিকে ঢুকে আসে ওরা। এখানে আরও কিছু ছড়ানো ছিটানো বেদি চোখে পড়ছে । কোথাও বা বেশ বড়সড় বেদি বানিয়ে একটা গোটা পরিবারকে কবর দেওয়া হয়েছে। দুই ভাইয়ের কবর চোখে পড়ল। একজন
মারা গেছে আঠেরোশো ছয়ে, আর একজন আঠেরোশো আটে । 
পায়েল একটু ভুরু কুচকে বলল, ‘“দেখ, প্রথম কবরটা দেওয়ার সময় যেন লোকগুলো জানত পরের ভাইকেও কবর দিতে হবে। পাশে খানিকটা জায়গা ফাঁকা রেখেছিল।” 
“আগে থেকে জানল কী করে?” 
“হয়তো রোগে ভুগছিল।” ক্লান্ত গলায় জবাব দিল পায়েল। 
এবারে একেবারের শেষের দিকে এসে পড়েছিল ওরা । এদিকটা প্রায় ফাঁকা 
হয়ে এসেছে । দু-একটা সমাধি এখানেও আছে বটে তবে গভীর গাছপালা এসে ঢেকে দিয়েছে তাদেরকে। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় একটা মসোলিয়াম । অর্থাৎ ছোট্ট ঘর। বাইরে থেকে লোহার চেন দিয়ে তালা লাগানো আছে । 
“এটা কী বলতো?” কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করল সুনন্দা! 
“মৃতের ঘর বলতে পারো । যদি ভিতরে সমাধি থাকে তাহলে বলা হবে মসোলিয়াম আর মৃতদেহ ছাড়া শুধু স্মৃতির উদ্দেশ্যে যদি হয় তাহলে সেনোটাফ। তবে আয়তন দেখে তো মসোলিয়ামই মনে হচ্ছে। এসো তো দেখি।” 
ঘরগুলো দেখে বেশ আগ্রহ পেয়েছিল তুলি । সে হাত ছাড়িয়ে ইচ্ছামতো এদিক-ওদিক ছুটতে থাকে । একটা মাঝারি সাইজের মসোলিয়ামে চোখে আটকেছে তার । 
দু’জনে ঝোপঝাড় ভেঙে এগিয়ে যায় শ্বেতপাথরের উপর সিমেন্টের আবরণ দেওয়া ঘরটার দিকে । তুলি যেদিকে গেছে সেখানে একটা সমাধিকক্ষ দেখা যাচ্ছে। আয়তনে প্রায় একটা কুড়েঘরের মতো হবে । তবে দরজাটা 
বেশ জমাকালো। বাইরে স্বাভাবিকের থেকে বেশ বড় এপিটাফে কিছু একটা খোদাঁই করা ছিল । আপাতত তার বেশিরভাগটাই ভেঙে পড়ে বেশ খানিকটা ইটের গাঁথনি বেরিয়ে পড়েছে । 
কাছে গিয়ে ভালো করে সেটার উপরে চোখে
রেখে, হাত দিয়ে খানিকটা শ্যাওলা সরিয়ে পায়েল বলল, ‘“একটা নাম দেখা যাচ্ছে, মসক্রপ। তবে সেটা মনে হয় ফ্যামিলি নেম। মসোলিয়ামের ভিতরে এক পরিবারের সবাইকে সমাধি দেওয়া হত। তবে…” 
“তবে কী?” মনের ইচ্ছা সত্বেও সামনে এগোতে পারে না সুনন্দা! তুলির হাতটা ধরা আছে তার হাতে । মেয়েটাকে নিয়ে ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না। জায়গাটা বেশ ভাঙাচোরা। ঝোপঝাড়ের আড়ালে সাপখোপ থাকতে পারে । 
“চিহ্নগুলো একটু গোলমেলে লাগছে।” 
“কীসের চিহ্ন?” 
“জেনারেলি এইসব সমাধির গায়ে কিছু চিহ্ন আঁকা হয় । সমাধির ভিতরে 
যে বা যারা শুয়ে আছে তাদের সম্পর্কে কিছু বোঝানোর জন্যে । যেমন মিলিটারি বা আর্মির কেউ মারা গেলে তার কবরে ঈগল আঁকা হত। কোনো শিশু মারা গেলে আঁকা হত ভেড়া । এখানে যেটা আঁকা আছে তার মানে আমি জানি না !” 
“কী আঁকা আছে !” 
“একটা গোলের ভিতরে ছোট একটা চেয়ার । তাছাড়া একটা পদ্ম । এটার মানেটা জানতাম। সম্ভবত মহাকাশ… তবে এটুকু বুঝছি এগুলো আঁকা হয়েছে আগেরগুলোর থেকে বেশ দেরিতে ।” 
সুনন্দা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল । কিন্তু তার আগেই তার হাত ছাড়িয়ে দৌড় দিল তুলি । দৌড়ে তাকে ধরতে গেল সুনন্দা কিন্তু পারল না। প্রায় লাফাতে লাফাতে ঝোপঝাড় মাড়িয়ে মসোলিয়ামের সামনে এসে দাঁড়াল! জায়গাটা দেখে ভারি অবাক হয়েছে সে। ছোট ছোট হাতগুলো একবার রাখল সিমেন্টের উপরে। তারপর দৌড়ে চলে গেল পিছনে। যেন ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল গোটা সৌধটা। 
এতক্ষণে ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সুনন্দা। প্রথমেই লোহার চেনগুলো চোখে পড়ল! চেন দুটো যেখানে এসে মিলেছে সেখানে এখন একটা
মোটাসোটা তালা ঝুলছে । একবার দেখেই বোঝা যায় বহুবছর খোলা হয়নি সেটা। দরজাটাও সিমেন্টের । তালাটা খোলা থাকলেও দরজাটা টেনে খোলা খুব একটা সহজ হবে না।
“তুলি… পিছনে যেও না… এসো এদিকে ।” গলা তুলে ডেকে উঠল সুনন্দা। ওদিক থেকে কোনো সাড়া এল না। সুনন্দা তাকে ডাকতে যাচ্ছিল এমন সময় কবজিতে টান পড়তে থেমে গেল সে। 
পায়েল একহাতে টেনে ধরেছে তার হাতটা । ফিসফিসে গলায় বলল, “একটা মেয়ে । বাচ্চা মেয়ে । চেয়ারটার মানে এবার বুঝতে পারছি ।” 
পায়েলের দৃষ্টি লক্ষ্য করে পাথরের ফলকের দিকে তাকিয়ে সুনন্দা দেখল হাত দিয়ে আরও খানিকটা শ্যাওলা সরাতে ফলকের আর একটু বেরিয়ে পড়েছে বাইরে । তার উপরে কিছু একটা লেখা আছে। একটা নাম — এলিজাবেথ এম মসক্রপ। তার পাশেই জন্ম আর মৃত্যুর তারিখ — ১৭৯৯-১৮০৪ । 
“মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মারা গেছে ।” বিড়বিড় করে বলল সুনন্দা। 
ফলকের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সুনন্দার দিকে তাকাল পায়েল! একটা মিহি হাসি খেলে গেল তার মুখে। গলাটা নিচে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
 “একবার ডেকে দেখবে নাকি? সাড়া দেয় কিনা?” 
“মানে?” অবিশ্বাসের গলায় জিজ্ঞেস করে সুনন্দা। 
“মানে ধর এই সিমেন্টের নিচেই সে শুয়ে আছে। ডেকে দেখব? ওপাশ থেকে কেউ সাড়া দেয় কিনা?” 
“তুমি পাগল হয়েছ?” 
সুনন্দার কথায় কান দেয় না পায়েল। সে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে মসোলিয়ামের সামনে । সিমেন্টের উপরে দুটো হাত রাখে। তারপর মাথাটা পিছনের দিকে ফিরিয়ে বলে, “কেমন দেখতে ছিল বলতো? ধর গায়ের রং ফরৰ্সা। টুকটুকে লাল ঠোট । সোনালি চুল । হাইট… আমি এভাবে হাঁটু গেড়ে থাকলে তার মুখটা আমার মুখের সামনে থাকবে…” 
“পাগলামি ছাড়ো পায়েল। কেউ দেখলে কি ভাববে?” 
“বেথ… বেথ শুনতে পাচ্ছ আমার কথা?” সিমেন্টের সৌধের একদম কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কথাগুলো বলে পায়েল । পুরনো সিমেন্টের খসা ধূলোয় তার 
হাতের উপরটা ভরে গেছে। ঝুঁকে থাকা গাছের থেকে টুপটাপ পাতা খসে পড়ছে চারিদিকে । একটু আগে কাছেই কোথাও একটা দাঁড়কাক ডাকছিল।; এখন সে চুপ করে আছে। 
পায়েলকে ডাকতে গিয়ে আচমকা একটা ধান্ধা লাগল সুনন্দার । মনে হল আজ থেকে প্রায় দু’শো বছর আগে ফিরে গেলে এই গ্রেভইয়ার্ডটাকে একদম অন্যরকম দেখাত । অনেকগুলো সৌধ হয়নি তখনও । চারপাশটা আর একটু ফাঁকা । গাছগুলো গজিয়ে ওঠেনি । এই ফলকটা সদ্য খোদাই করা হয়েছে। ফ্লকের সামনে বসে কাঁদছেন এক মহিলা। সদ্য মেয়ে মারা গেছে তার। এবার ফলকের উপর নাম খোদাই করা হচ্ছে , ঠং ঠং ঠং — সাদা পাথরের উপরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে হাতুড়ির আওয়াজ । 
কতগুলো লোক মিলে ছোট স্ট্রেচারে করে নিয়ে
এল একটা সাদা পাশবালিশের মতো কাপড়ে জড়ানো মৃতদেহ । কীভাবে মারা গেল সে? এইটুকু বয়সে? মারা যাওয়ার আগে কী ভাবছিল? 
“বেথ…” পায়েলের কণ্ঠস্বর এখনও শোনা যাচ্ছে। আকুল কণ্ঠে ডেকে চলেছে সে। যেন সত্যি আর একটু পরেই কিছু একটা শোনা যাবে। একটা হাসির আওয়াজ… অথবা কান্না… অথবা… 
হাওয়া দিতে শুরু করেছে জোরে । লম্বা খয়েরি গাছগুলো আর একটু জোরে মাথা দোলাচ্ছে এখন। আর একটু বেশি করে পাতা পড়ছে । কাকটা আবার ডাকতে শুরু করেছে। আগের মতো নয় । খানিকটা অন্য সুরে । শুধু ডাক নয়, এবার যেন দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বলতে চাইছে সে। 
খিলখিল করে একটা হাসির আওয়াজ । ভিতর থেকে না। ওপাশ থেকে শোনা গেছে। পিছিয়ে এল সুনন্দা। মসোলিয়ামের পিছন থেকে হাসছে তুলি। মাটটি থেকে উঠে পড়ে দ্রুত পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল সুনন্দা। আর গিয়েই সে থমকে গেল। সিমেন্টের গায়ে কান রেখে দাঁড়িয়ে কি যেন শোনার চেষ্টা করছে তুলি । তার মুখে হাসির চিহ্ন নেই । একটু আগে হাসছিল হয়তো । সুনন্দা উঠে পিছনে আসতে আসতে সে থেমে গেছে 
“নিষেধ করলে শোন না কেন বলতো?” কড়া গলায় ধমক দিল সুনন্দা। 
তুলি মুখ তুলে তাকাল না। শুধু ঠোঁটের উপরে আঙ্গুল রেখে চুপ করতে বলল সুনন্দাকে। দেওয়ালের ভিতরের কিছু যেন মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করছে সে। 
“ওখানে কান দিয়ে আছ এবার কানের ভিতরে পোকা ঢুকে যাবে !” দ্রুত মেয়েটার দিকে এগিয়ে এল সুনন্দা, “সরে এসো ।!” 
“কেউ কথা বলছে !” নিচু স্বরে বলল তুলি। 
“অনেক হয়েছে । চলে এসো এবার ।” তুলির হাত ধরে টানল সুনন্দা। 
“কান রাখো। শুনতে পাবে !” তুলির মিহি গলায় আত্মবিশ্বাসের ছাপ। সে ইয়ার্কি করছে না। মিথ্যে বলছে না। কিছু একটা ছিল তার মুখের
ভয়ার্ত রেখাগুলোতে, সুনন্দা রেগে গেলেও উপেক্ষা করতে পারল না। সিমেন্টের গা থেকে ধুলো সরিয়ে একটু মসৃণ করে তার উপরে সাবধানে কান রাখল সে নিজে । 
শনশন করে ভিতরের হাওয়ার আওয়াজ । দু’হাতে কান চেপে ধরলে যেমন শব্দ হয় । অনেকটা সেইরকম । আর কিছুতো… 
মুহূর্তে সুনন্দার বুকের ভিতর হিমেল স্রোত বইতে থাকে। সেই শনশন হাওয়ার শব্দের ভিতরে আরও একটা ক্ষীণ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । যেন মাটির গভীরতম অংশ থেকে অস্পষ্ট কতগুলো শব্দ ভেসে আসছে । প্রায় শোনা যায় না,তাও এটুকু বোঝা যায় সেটা মানুষের গলার আওয়াজ । বাতাসের শব্দ নয় । তুলির একটা হাত এতক্ষণ ধরা ছিল তার হাতে । এবার সেটা খসে পড়ল। মুখ থেকে আতংকের মৃদু একটা শব্দ বেরিয়ে এল । কান সরিয়ে নিল সে। 
পায়েল এসে দাঁড়িয়েছিল তুলির পাশে। সুনন্দা তাকে বলতে যাচ্ছিল কথাটা, পায়েল তার আগেই থামিয়ে দিয়ে বলল, “জানি । আমিও শুনেছি।” 
“আপনারা কি কিছু খুঁজছেন?” একটু দূর থেকে ভেসে আসা প্রশ্নটা শুনে ফিরে তাকাল দু’জনে । খানিকদূরে যেখানে সমাধিক্ষেত্রের সীমানাটা শেষ হচ্ছে সেখানে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছেন । উপর থেকে নিচ অবধি একটা সাদা আলখল্লা। জামাকাপড় দেখে বোঝা যায় ইনিই সম্ভবত চার্চের ফাদার । তবে বয়স বছর তিরিশেকের বেশি হবে না!ভুরু কুঁচকে তিনজনের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। 
একটু অপ্রস্তুতে পড়ে গেল সুনন্দা । তারা যে কাজটা করছিল সেটা অপরাধ কিছু না হলেও মোটেই অভিপ্রেত নয় । সে হাত দিয়ে একবার মুখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আসলে একটু কৌতূহল হল আর কি…” 
ফাদার কিন্তু রাগলেন না। বরঞ্চ মুখটা নামিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে এললেন, ‘“চলে আসুন ।” 
তুলির হাত ধরে বেরিয়ে এল সুনন্দা। পায়েল
তাদের পিছনে। কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে জল বের করে একবার খেল সে। থাই-এর কাছে থাবড়ে হাতের ধুলোটা ঝেড়ে নিল। 
“নতুন এসেছেন এখানে?” মিহি গলায় জিজ্ঞেস করলেন ফাদার । 
“হ্যাঁ। রাজবাড়িতে আছি ।” 
“ও।” আর কিছু না বলে পিছন ফিরে হাঁটতে লাগলেন ফাদার । কিছু বুঝতে না পেরে তাকে অনুসরণ করল বাকি তিনজন । এখান থেকে চার্চটা সামনেই । নিজেদের মধ্যে আর কোনো কথা হল না। চার্চের সামনে এসে একবার ওদের দিকে তাকালেন ফাদার । তারপর চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে বললেন, “চলুন, ভিতরে গিয়ে বসি। তারপর কথা হবে!” 
কথা যে কি তা পায়েল ভেবে পেল না। লোকটার এতক্ষণে অসন্তুষ্ট হওয়ার কথা। দু’কথা শুনিয়ে দিলেও প্রতিবাদ করার কিছু নেই ! 
প্রার্থনা ঘরের ভিতরে গিয়ে বসে শরীরটা বেশ ঠান্ডা লাগল ওদের । এতক্ষণের জমাট গরমটা এখানে নেই । চারদিকে পাথরের উঁচু দেওয়াল। হলঘর জুড়ে লম্বা লম্বা বেঞ্চ পাতা আছে । একদম সামনে ছোট একটা বেদি । তার অনেকটা উপরে ক্রস থেকে যিশু ঝুলছেন । তিনতলার সমান উঁচু সিলিং জুড়ে অনেকগুলো পেন্টিং লাগানো । শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মাথাটাও ঠান্ডা হয়ে এল পায়েলের । সে বেঞ্চের একপাশে বসেছে। মাঝে তুলি তার পাশে সুনন্দা! উলটোদিকের বেঞ্চটায় এসে বসলেন ফাদার । একটা হাত তুলির মাথায় রেখে অল্প হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “নাম কী তোমার?” 
“ঋত্বিকা নাথ।” 
“বেশ। আর এই দু’জন?” 
প্রথমে পায়েলের দিকে তাকাল তুলি, “এটা আমার দিদি…” সুনন্দার দিকে তাকিয়ে এক সেকেন্ড কি যেন ভেবে নিল সে, “এটাও আমার দিদি ।” 
তুলির দিক থেকে চোখ সরিয়ে সুনন্দার দিকে
তাকালেন ফাদার, “এবার বলুন, কী জানতে চান আপনারা ।” 
পায়েল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল । সুনন্দা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আসলে ওই মেয়েটা এত কম বয়সে মারা গেছে । ঠিক কী হয়েছিল জানতে ইচ্ছা করছিল ।” 
এতক্ষণে একটা খোলা হাসি ফুটে উঠল ফাদারের মুখে, “ওঃ এই কথা! তা এখন আর কেউ বলতে পারে না। একটা সময় হয়তো কিছু রেকর্ড রাখা হত । আমার দাদুর আমল থেকেই তার আর পাত্তা নেই ।” 
“আচ্ছা গেটের বাইরে যিনি ছিলেন তিনি আমাকে চিনলেন কেমন করে বলুন তো? আমি তো আগে আসিনি এখানে।” পায়েল জিজ্ঞেস করে । 
“আপনি কি জমিদারবাড়ির এন্সেস্টারদের কেউ?” 
অবিশ্বাসের সঙ্গে মাথা নাড়ে পায়েল, “হ্যাঁ। কিন্তু আপনিও…” 
আবার সেই নরম হাসিটা ছড়িয়ে যায় ফাদারের মুখে, “আপনার পূর্বপুরুষদের মধ্যে একজন হলেন সহদেব দত্তের বোন লীলাবতী। তিনি একসময় প্রচুর টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন চার্চকে । প্রতিদানস্বরূপ চার্চের পক্ষ থেকে কাউকে দিয়ে তার একটা প্রতিকৃতি এঁকে উপহার দেওয়া হয় । কিন্তু কেন জানি না সেটা নিতে চাননি তিনি। ফলে চার্চের জিম্মাতেই এখনও পড়ে আছে সেই প্রতিকৃতি । আমরা মাঝে মধ্যে পরিষ্কার করাই সেটা, সংরক্ষণ করি। তো আপনাকে অবিকল সেই লীলাবতী দেবীর মতো দেখতে ।” 
“ঊনি আমার ঠাকুমার ঠাকুমার ঠাকুমা সম্ভবত ।” 
“ব্যাস। তাহলে মিলে গেল হিসেব !” বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসলেন ফাদার । 
“একবার সেটা দেখাবেন আমাকে? মানে…” 
“মানে কৌতূহল হচ্ছে, তাই তো?” 
মাথা নাড়ল পায়েল। ফাদার তুলির গালটা
একবার টিপে দিয়ে উঠে পড়ে বললেন, “আসুন আমার সঙ্গে ।” তারপর প্রেয়ার রুমটা পেরিয়ে এগিয়ে গেলেন দোতলার সিঁড়িটার দিকে। 
পায়েল তুলির কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, “এতক্ষণ আমরা যে জায়গাটায় ছিলাম তাকে বলে নেভ। আর ঢুকার মুখে যে ফাঁকা জায়গাটা ছিল তাকে বলে নারথাক্স । মনে থাকবে?” 
তুলি মাথা নেড়ে বলল, “ওখানে কী হয়?” 
“চার্চে ঢোকার আগে একজন আরেকজনের সঙ্গে গল্প করে ওখানে দাঁড়িয়ে । আর ওইখানটা দেখছ, একটা ছোট ঘর ।” 
তুলি মুখ তুলে দেখে । যিশুর ক্রস যেখানে আছে সেখান থেকে একটু দূরে ‘একটা পোডিয়াম । পোডিয়ামের পাশেই একটা পিয়ানো রাখা আছে। তার পিছনে একটা ছোট ঘর চোখে পড়ছে। যদিও মাটি থেকে বেশ কিছুটা উপরে ঘরটা । 
“ওটাকে বলে স্যাংচুয়ারি।” 
“ওখানে কী হয়?” 
“পরে বলব। এখন এসো ।” 
সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসে চারজনে। উঠেই দু’দিকে দু’টো ছোট ছোট স্টোররুম! চার্চের পুরানো জিনিসপত্র এখানেই সংরক্ষণ করা হয় । চাবি দিয়ে প্রথম স্টোররুমের দরজাটা খুলে ফেললেন ফাদার । 
নানারকম পুরনো জিনিসে ভরতি হয়ে আছে ঘরটা । কোনো জানালা নেই । ফলে দরজা খুলতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এল সবার। 
ঘরের ভিতরে ঢুকে এলেন ফাদার। সামনে কয়েকটা কাঠের লগ পড়েছিল। সেগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে ফেললেন । একটা চ্যালিশ, গোটা কতক পুরনো উইতে খাওয়া বই সরিয়ে কাপড়ে ঢাকা বড়সড় কিছু একটা বের করে আনলেন । পাশেই ঝুলতে থাকা একটা কাপড় দিয়ে ধুলো ঝেড়ে নিলেন।! সুনন্দা বিড়বিড় করে বলল, “বেশ সংরক্ষণ করে দেখছি।” 
পায়েল কিছু বলল না। কোনো একটা কারণে তার ভুরু দুটো আশ্চর্যরকম
কুঁচকে এক মনে কিছু একটা ভেবে চলেছে সে। উত্তর পাচ্ছে না। 
কাপড়টা সরিয়ে ভিতরের ফ্রেমটা বের করে আনলেন ফাদার। এখানে আলো খানিকটা কম! ছবিটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। প্যাসেজের কাছে বড় জানালা দিয়ে রোদের ফালি আসছে । কয়েকপা এগিয়ে সেদিকটায় চলে এলেন তিনি । তারপর একটা স্ট্যান্ড টেনে এনে তার উপরে রাখলেন ছবিটা । 
ছবিটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল ওরা দু’জনে । যেন কেউ রংতুলিতে পায়েলকে আঁকার চেষ্টা করেছে। একই চোখ, নাক, এমনকি মাথার চুলটা পর্যন্ত একইভাবে আঁচড়ানো । শুধু চেহারায় ছবির মানুষটা একটু স্থূল । একটা ছোট টেবিলের উপরে হাত রেখে বসে আছেন বছর বাইশেকের এক মহিলা । 
একটু এগিয়ে গিয়ে ছবিটা ভালো করে দেখে পায়েল । গোটা ছবিটা জুড়ে কি যেন খুঁজতে থাকে সে । বিড়বিড় করে বলে, “টেবিলটা বেশ উঁচু.. মহিলার হাত রাখতে অসুবিধা হচ্ছে । কিছু একটা গণ্ডগোল আছে ছবিটায় সুনন্দাদি…” 
সুনন্দা হাঁ করে তাকিয়েছিল সেদিকে । পায়েলের কপালের কপালের ভাঁজটা আরও একটু গভীর হয়ে উঠেছে । সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ছবিটার কাছে । হাঁটু গেড়ে সেটার সামনে বসে পড়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছু যেন দেখার চেষ্টা করল। ছবি নয় যেন আয়না। পায়েলের মুখেরই ছায়া পড়েছে । 
কয়েক মিনিট পরে উঠে এল পায়েল। এতক্ষণে ছায়ায় ঢেকে গেছে তার মুখ সুনন্দা অবাক গলায় প্রশ্ন করল, “তোমার কী হয়েছে বলতো? এটা দেখে তো খুশি হওয়ার কথা ।” 
মাথা নাড়ে পায়েল। একবার আড় চোখে ফাদারের দিকে দেখে নেয় সে। বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। 
“আমি বুঝতে পারছি কেন লীলাবতী দত্ত ছবিটা নেননি ।”
“সেকি! দেখেই বুঝতে পারছ! কেন?” 
“কারণ ছবিটা তার নয়।” 
“তাহলে কার?” 
“এলিজাবেথ মসক্রপ…” বিড়বিড় করে বলে ওঠে পায়েল।

চতুর্থ অধ্যায় 


“কিন্তু তা কী করে হয়?” বিছানার একপ্রান্তে বসে অধৈর্য হয়ে প্রশ্নটা ছুড়ে দেয় সুনন্দা । চার্চ থেকে ফেরার পর থেকেই একটা ছটফটানি খেলা করছে তার শরীরে । তুলিকে এতক্ষণে স্নান করাতে নিয়ে গেছে মালতী। পায়েলের ব্যাগটা বিছানার মাঝখানে পড়ে আছে । সে নিজে বসে আছে মেঝেতে। খাটের পায়াতে হেলান দিয়ে । 
প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে থাকে পায়েল, তারপর বলে, “আমি জানি না। বাট অল দ্যা ইমপ্লিকেশানস আর দেয়ার!” 
‘“কী করে বলছ তুমি?” পকেট থেকে নিজের মোবাইলটা বের করে আনে পায়েল। ফেরার সময় সেই পেন্টিংটার একটা ছবি তুলে এনেছে সে। সেটা এগিয়ে দেয় সুনন্দার দিকে, “ভালো করে দেখ। তাহলেই বুঝতে পারবে!” 
আগেই ছবিটা ভালো করে দেখেছে সুনন্দা। কিন্তু আলাদা করে কিছু চোখে পড়েনি । ছবির একমাত্র আশ্চর্যের ব্যাপার হল মহিলাকে অবিকল পায়েলের মতো দেখতে। তাও আর একবার চোখ বুলিয়ে-ঘাড় নাড়ে সুনন্দা, “না, আমি তো কিছু পাচ্ছি না।” 
মেঝে থেকে উঠে এসে তার পাশে বসে পায়েল । তারপর ছবির একটা বিশেষ জায়গায় পিঞ্চ করে জুম করে । 
যে টেবিলটার উপরে হাত দিয়ে বসে আছে মহিলা সেই টেবিলের সার্ফেসের ঠিক নিচেই একটা ড্রয়ার রাখা আছে । এতক্ষণে সুনন্দার চোখে পড়ল সেই ড্রয়ারের ডালার ঠিক উপরে ছোট করে কিছু নম্বর লেখা আছে! সেই সঙ্গে একটা চিহ্ন । চিহ্নটা চিনতে পারল সুনন্দা। এলিজাবেথ মসক্রপের সমাধির উপরে ঠিক এই চিহ্নটাই ছিল । বড়সড় চেহারার একটা পদ্মফুল। 
“কিন্তু তার মানেই এটা ওই মেয়েটা…” 
“নম্বরগুলো চিনলে না?” 
“নম্বর…” চিহ্ন ছেড়ে এবার নম্বরের দিকে চোখ
রাখে সুনন্দা! ভালো করে 
তাকাতেই সেগুলো চিনতে পারে সে । হ্যাঁ, শুধু মাঝে একটা দাগ নেই বলে এতক্ষণ চোখ এড়িয়ে গেছিল। ১৭৯৯১৮০৪। এলিজাবেথ মসক্রপের জীবনকাল ১৭৯৯-১৮০৪। 
“কিন্তু এতেও তো পরিষ্কার হয় না কিছু।! কেউ লিখে দিতেই পারে ।” 
এবার ফোনটা হাতে নিয়ে উঠে পড়ে পায়েল। ঘরের ভিতর পায়চারি করতে করতে বলে, “আমারই ভুল । মসোলিয়ামের সামনে একটা ব্যাপার গুলিয়ে ফেলেছিলাম !” 
“কী ব্যাপার?” 
“প্রাচীন বাইবেলের রীতি অনুযায়ী পদ্মফুল মহাকাশের চিহ্ন বটে । কিন্তু সব ধরনের পদ্ম নয় !” 
“তাহলে কীরকম পদ্ম?” 
“পদ্মের পাপড়ি যদি বন্ধ থাকে তাহলে বোঝায় শক্তি! খোলা ফুলে যদি আটটা পাপড়ি দেখা যায় তাহলে মহাকাশ । বৌদ্ধ রীতি অনুযায়ী পদ্ম হল পবিত্রতা । মানুষের আদর্শ জীবনের মতো । তার পা ডুবে থাকবে পাঁকে, কিন্তু মন থাকবে নির্মল। আর পদ্মের যদি তিনটে পাপড়ি দেখা যায় তাহলে তার মানে হল…” 
“কী ?” 
“রেসারেকশান কিংবা পুনর্জন্ম ।!” 
“ধ্যাত্।” সুনন্দার মুখ দিয়ে একটা বিরক্তির আওয়াজ বেরিয়ে আসে, “অন্য সব কিছু বিশ্বাস করে নেওয়া যায় কিন্তু এই পুনর্জন্ম একটু বাড়াবাড়ি।” 
“তুমি শান্তি দেবীর কথা শুনেছ?” 
“সেটা কে?” 
“নব্বই বছর আগের একটা ঘটনা, বলা যায় একটা মানুষ। তিনি যে রিসারেক্টেড ছিলেন সেটার অকাট্য প্রমাণ আছে ।” 
“কীরকম?” 
বিছানার উপরে পিঠ এলিয়ে শুয়ে পড়ে পায়েল । তারপর একটা বড়সড়
শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে — “শান্তি দেবী জন্মেছিলেন উনিশশো ছাব্বিশ নাগাদ । দিল্লীর এক গ্রামে। তো মেয়ের যখন চার বছর বয়স তখন সে এক অদ্ভুত দাবি করে বসল — তার আসল বাড়ি নাকি মথুরায় । সেখানে ‘তার ঘরদোর সংসার এমনকি স্বামীও আছে । 
দিল্লি থেকে মথুরার দূরত্ব প্রায় দেড়শ কিলোমিটার এবং চার বছর বয়সে শান্তি দেবী দিল্লি ছেড়ে কোথাও যাননি । যাই হোক, ওইটুকু বয়সের বাচ্চা মেয়ে এমন নানা দাবিই করে থাকে । ফলে মা বাবা অতটা গুরুত্ব দেননি। 
আসল গোলমালটা শুরু হল একটা ঘটনা থেকে । একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে শান্তিদেবীকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না।! শেষমেশ পুলিশ যখন তার খোঁজ পেল তখন সে সবে মথুরা যাবে বলে ট্রেন ধরছে । 
সে যাত্রা বকাবকি করে বাড়ি নিয়ে আসা গেল কিন্তু মেয়েকে কিছুতেই আটকানো যায় না, সে ক্রমাগত বলে চলেছে তার স্বামীর নাম কেশবনাথ এবং একটি পুত্র সন্তান জন্ম দেবার মাত্র দশদিন পরে নাকি তার মৃত্যু হয়েছিল । বাড়িতে মা বাবা পাত্তা না দিতে স্কুলে গিয়েও এইসব বলাবলি শুরু করল । এমনকি মথুরার ভাষায় সে কথা অবধি বলতে পারত। 
শেষ পর্যন্ত স্কুলের হেডস্যারের নজরে পড়ে ব্যাপারটা এবং তিনি নিজে মথুরাতে চিঠি লিখে খোঁজ খবর নিয়ে দেখেন সেখানে সত্যি কেশবনাথ বলে এক ভদ্রলোক থাকেন। ন’বছর আগে তার স্ত্রী লুগড়ি দেবী সন্তান জন্ম দেবার দশদিন পরে মারা গেছেন। 
চিঠির জবাব পেয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গে কেশবনাথকে দিল্লি আসতে বলেন! ইচ্ছা করে শান্তিদেবীকে বলা হয় যে কেশবনাথ নিজে পারেননি বলে ভাইকে পাঠিয়েছেন । কিন্তু আশ্চর্যের কথা শান্তিদেবী কেশবনাথকে চিনে ফেলেন। 
এরপর তাকে মথুরা নিয়ে যাওয়া হয় এবং
পরিবারের বাকি সদস্যদেরও মুখ দেখে নাম বলে দেন শান্তিদেবী, এমনকি স্বর্গগত ঠাকুমা পর্যন্ত । লুগড়ি দেবী মৃত্যুর আগে স্বামীকে দিয়ে বেশ কিছু প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন । সেগুলো কেশবনাথ পালন করেননি বলে তাকে ধমক পর্যন্ত দেন। অথচ সেগুলো 
কারা জানার কথাই নয়। 
সেযুগে ব্যাপারটা ভাইরাল হয় । এমন কি মহাত্ম গান্ধী এই ঘটনার তদস্তের জন্যে কমিশন তৈরি করে দেন । তবে বুঝতেই পারছ ভারতের রাজনীতিতে তখন টালমাটাল সময় । ফলে এই তদন্ত আর বেশিদূর এগোয়নি । 
শান্তিদেবী মারা যান উনিশশো সাতাশিতে । একষট্টি বছরের জীবনে তিনি বিয়ে করেননি । এর মধ্যে আরও বেশ কয়েকবার কমিশন বসে, জিজ্ঞাসাবাদ হয় কিন্তু এ রহস্য অন্ধকারেই ঢেকে থাকে ।” 
“অবাক কাণ্ড তে !” বিস্ময়ে এতক্ষণের প্রসঙ্গটা কিছুক্ষণের জন্যে মুছে গেল সুনন্দার মাথা থেকে । 
“পুনর্জন্ম সত্যি না মিথ সেটা পরের কথা, কিন্তু আমার মনে হয় না আর্টিস্ট এখানে পুনর্জন্ম বোঝাতে চেয়েছেন ।” 
“কেন?” 
“ছবিটা জমিদার পরিবারকে উপহার হিসেবে দেওয়ার কথা ছিল । তখনকার দিনে পুনর্জন্ম কোনো লজ্জার কথা ছিল না। ফলে সে কথাটা ছবির মধ্যে কৌশলে লুকিয়ে রাখার দরকার ছিল না। আর্টিস্ট পরবর্তী প্রজন্মকে কিছু একটা বলতে চেয়েছেন ঠিকই । কিন্তু সেটা গোপন কিছু। গসিপ না।” 
“মানে বলছ ওটা মেটাফোর? কিন্তু পুনর্জন্ম মানে আর কী হতে পারে?” 
“সেটাই ভেবে পাচ্ছি না ।” পায়চারি থামিয়ে বলল পায়েল। চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে তার চোখে মুখে । বিছানায় পড়ে থাকা ব্যাগটা তুলে নিয়ে কিছু একটা বের করতে গিয়েও থেমে গেল।
একটা লাজুক হাসি হেসে বলল, “বলছি, একটা কথা বলব কিছু মনে করবে না?” 
“খাও । শুধু তুলি থাকলে খেও না। ওর হাঁপানি আছে ।” 
ব্যাগ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা ধরালো পায়েল । তারপর আবার মাটিতে বসে পড়ে বলল, “সব ব্যাপারটা কেমন যেন গুলিয়ে গেছে মনে হচ্ছে । মাথাটা একটু পরিষ্কার করা দরকার ।” 
মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়ে আবার কি যেন দেখতে দেখতে সুনন্দা বলল, 
“তোমার কথা ঠিক ধরলেও একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না।” 
“একটা ব্যাপার! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। যাই হোক, বল কি ব্যাপার?” 
“এলিজাবেথ মসক্রপকে আমরা কল্পনা করেছিলাম যেরকম, এই মহিলা (মোটেই তার ধারে কাছে না। গায়ের রঙ ফর্সা বলা যায় কিন্তু সাহেব তো নয় বোঝাই যাচ্ছে… আর?” 
“আর কী?” 
“যদি ধরেই নি ইনিই সেই এলিজাবেথ। তাহলে ওই সমাধির ভিতরে কে শুয়ে আছে?” 
“সেটা বোঝার একটাই উপায় আছে ।” ধোঁয়ার একটা বড়সড় রিং ছেড়ে বলল পায়েল। 
“কী উপায়?” 
“ওই মসোলিয়ামের ভিতরটা একবার খুলে দেখা ।” 
“পাগলঃ এমনিতেই ফাদার দেখে ফেলে কী ভাবছেন কে জানে?” 
“আচ্ছা তুমি কোনোদিন প্রেয়ার শুনেছ? মানে রবিবার যেটা হয়?” 
“না। তবে চার্চে আগেও গেছি ।” 
“কাল তো রবিবার । চলো ঘুরে আসি ।” 
“বাবা! তুমি এত ধার্মিক জানতাম না তে ।” 
“উঁহু, পিয়ানোটা বেশ লেগেছে আমার । ওটা শুনতে ইচ্ছা করছে ।” 
“চলা তাহলে । আমার তো কাজ নেই । তুলিও
বাড়িতে বসে বোর হয় !” 
পায়েল আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই দরজার কাছে মধুবাবুকে চোখে পড়ল । তাড়াহুড়ো করে সিগারেটটা বিছানার নিচে ছুড়ে ফেলল পায়েল। তবে বিছানার উপরে সিগারেটের প্যাকেটটার কথা খেয়াল ছিল না তার। সুনন্দা সেটার উপরে একটা বালিশ ছুড়ে ফেলে তার উপর আধশোয়া হয়ে শুয়ে পড়ে বলল, “এইতো মধুবাবু, আপনার কথাই হচ্ছিল ।” 
“আমার কথা !” একটু অবাক হলেন মানুষটা, “আমাকে শশাঙ্ক পাঠাল! 
ও বাজারে যাচ্ছে আপনাদের কিছু কেনাকাটা আছে কিনা জিজ্ঞেস করল !” 
“না না, ওসব না। অন্য কারণে দরকার।” 
“বেশ। একটু দাঁড়ান ।” কথাটা বলে বারান্দায় গিয়ে দূরের দিকে হাত দেখিয়ে কি যেন বলে দিলেন মধুবাবু। তারপর আবার ফিরে এসে দরজার কাছেই মেঝের উপরে বসে পড়লেন । সুনন্দা এতক্ষণে সিগারেটের প্যাকেট সরিয়ে রেখেছে। সেও বিছানা থেকে মেঝের উপরে নেমে এল। 
“এবার বলুন কী বলবেন!” দেওয়ালে পিঠ রেখে বললেন মধুবাবু। 
“শশাঙ্কদা বলছিলেন এ বাড়ির ইতিহাস নাকি অনেকটা জানেন আপনি। সেটাই জানতে ইচ্ছে করছে আর কি !” 
“ইতিহাস বলতে ওই যতটুকু এদের মুখে শুনেছি আর কি। আমার আসলে কলেজে হিস্ট্রিটা সাবজেক্ট ছিল, তাই…” হাতদুটো পায়ের উপরে রাখলেন মধুবাবু। পরনে এখনও সেই একই ইউনিফর্ম। ছিটের প্যান্ট আর হাফ শার্ট । 
“সেটুকুই বল না !” পায়েল বলে উঠল। 
“বাবা!” একটু অবাক হলেন মধুবাবু, “তোমার আবার এদিকে আগ্রহ হল কবে থেকে? আগে তো যতবার বলতে গেছি কানই দাওনি ।” 
“এবার একটু বড় হয়েছি না।” 
মধুবাবু হেসে উঠলেন । তারপর হাত দিয়ে
পায়ের উপরে আলগা চাপড় মারতে মারতে বললেন, “আমি যা জানি সেটা বলতে পারি কিন্তু তার আগে একটু ইতিহাস জানতে হবে। বাংলার জমিদারীর ইতিহাস । বেশি না, অল্প ।” 
দু’জনের কেউ আর কিছু বলল না। তবে মধুবাবু বুঝলেন কারও অসম্মতি নেই । তিনি আর একটু আরাম করে হেলান দিয়ে বলতে শুরু করলেন। 
“বাংলার জমিদার বলতে মোটামুটি দু’রকমের । ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানী লাভের আগের আর পরের। ১৭৬৫ তে দেওয়ানী লাভের পর আগের নবাব আমলের বেশিরভাগ জমিদারী নিলাম হয়ে যায়। তাদের আর কোনো হদিস পাওয়া যায় না। 
এই জমিদাররা কৃষি-অর্থনীতির একটা স্তম্ভ ছিল নবাবী আমলে। তারা 
লোপ পেতে সেই জায়গাটা ফাঁকা হয়ে যায় । কোম্পানি প্রথমে পাঁচশালা বন্দোবস্ত চালু করে । ফলস্বরূপ কৃষকরা ভয়ানক আর্থিক সংকটে পড়ে। 
উপায় নেই দেখে লর্ড কর্নওয়ালিস পাঁচশালার বদলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করেন। এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে আগের নিলাম হওয়া কিছু জমিদারী এবং ইংরেজ সরকারের তাবেদারি করে পাওয়া কিছু জায়গা জিরেত জমা করে করে নতুন কিছু বাঙালী ধনী লোকের উদ্ভব হয় । এদের উপর কোম্পানি ভার দেয় খাজনা আদায়ের । এদেরকে বলা হত গাতিদার । বলা বাহুল্য খাজনায় কারচুপি, চাষিদের শোষণ আর কোম্পানির প্যায়দারি করে এরা ফুলে ফেঁপে উঠে নব্য জমিদারে পরিণত হয়। 
এইসব নব্য জমিদার আর কোম্পানির অসহ্য অত্যাচার ও অর্থনৈতিক (শোষণের ফলে ১৭৭০ নাগাদ বাংলায় মন্বন্তর দেখা দেয় । _ 
দত্তদের ঠিক কোন পূর্বপুরুয কোথাকার নিলামে এই জমিদারবাড়ি কিনেছিলেন তা আজ আর জানা সম্ভব নয় । তবে এটুকু ধারণা করা যায় কিনেছিলেন ওই ১৭৭০/১৭৭২ নাগাদ। তর্কের
খাতিরে ধরে নাও সেই গাতিদারের নাম অজ্ঞাত দত্ত। এবং তার মেজো ছেলে হল আমাদের এই ভূপতি দত্ত। 
“মেজোছেলে বলতে? তার আরও ভাইবোন ছিল?” 
“আমি যতদূর শুনেছি ভৃপতি দত্তরা মোট চার ভাইবোন ছিল। তাদের মধ্যে তিনজনের নাম জানা যায় । বড়জনের নাম জানা না যাওয়ার কারণ তিনি অতি অল্পবয়সে মারা যান। আমার ধারণা কুড়ির আগে ।” 
“কীভাবে মারা যান?” গল্প শুনতে শুনতে প্রশ্ন করে পায়েল। 
“শোনা যায় তিনি নাকি কোম্পানিকে কর দিতে অস্বীকার করেন। সরাসরি সংঘর্ষেও নাকি গেছিলেন। ফলে পরিবারের কেউই তাকে সরিয়ে দেয় !” 
“সেকি! কেন?” 
“ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে এক ভাই রাগালে গোটা গাতিদারিই হাতছাড়া হতে পারে । অগত্যা…” 
“সাংঘাতিক ।” বিড়বিড় করে বলে সুনন্দা। 
“ফলে তার কোনো কীরতিকাহিনির কথা বংশের ইতিহাসে লেখা নেই । ইতিহাসের এই এক লেখা। যারা তাবেদারি করল তাদের নাম জিইয়ে রেখেছে এতকাল। 
যাক গে, বড় ভাই মারা যাবার পর ভূপতি ছিল নেক্সট টু কিন । ফলে তারপর সে-ই জমিদারীর দায়িত্ব পায়, বিয়ে করে । বিয়ের অল্প কিছুদিনের পরে স্ত্রী মারা যায়। তার কিছুদিন পরে আবার বিয়ে করেন ভূপতি। ভূপতির ছেলেপিলের কথায় পরে আসছি । 
এর পরের ভাই হল নৃপতিপ্রসাদ দত্ত! এনার কোনো ছেলেপুলে হয়নি। একটি ছেলেকে দত্তক নিয়েছিলেন বলে শোনা যায় । সে ছেলের নামটি ছিল খাসা— চাণক্য। জমিদারবাড়ির সেই সময়ের দেওয়ান ছিলেন দিনু রায় বলে জনৈক ব্যক্তি । চাণক্যের সঙ্গে দেওয়ান দিনু রায়ের মেয়ের প্রেম
হয় । সে প্রেম পরিণতি পায় কিনা জানি না। কিন্তু মেয়েটিকে একদিন সকালে দীঘির ধারে মৃত এবং সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় পাওয়া যায় । কে বা কারা এ কাজটি করে তা আর জানা যায় না। এই নিয়ে কিছু জল ঘোলা হয় কিন্তু খুনি ধরা পড়ে না। 
এছাড়া আর এক বোন ছিল এদের—সন্ধ্যারানি । যিনি সম্পর্কে আমাদের পায়েল রায়চৌধুরীর ঠাকুমার ঠাকুমার ঠাকুমার মা হেঁহেঁ, … তার বিয়ে কার সঙ্গে হয়েছিল আমি জানতাম কিন্তু এই মুহূর্তে আর মনে পড়ছে না। 
ভূপতির দ্বিতীয় পক্ষের একটি ছেলে হয় । কন্দর্প দত্ত ! এই কন্দর্প দত্তকে নিয়ে একটা বড়সড় গণ্ডগোল আছে!” 
‘কীরকম গণ্ডগোল?” 
একটু ইতস্তত করেন মধুবাবু । খানিক চূপ করে থেকে বলেন, “এ কথাটা যে আমি বলেছি সেটা বাইরে কাউকে বলবেন না। বাকি কথাগুলো বলতেই পারেন। কিন্তু এটা না।” 
“বেশ, আমরা মুখে কুলুপ আঁটছি।” 
দেওয়াল থেকে পিঠ তুলে বাকি কথাগুলো বলতে শুরু করলেন মধুবাবু, “লোকে বলে ছেলেটি নাকি প্রকৃতিস্থ ছিল না । মানে জন্মের সময় থেকেই কিছু একটা গোলমাল ছিল তার মাথায় । তখন এখানের চারিদিকে জঙ্গল! বেশিরভাগ সময় নাকি সে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত । কখনও পুকুর ধারে গিয়ে চুপ করে বসে থাকত । জমিদার বাড়ির ছেলের এইসব আচরণ মোটেই সাধারণ ব্যাপার ছিল না। 
ঠিক এইসময়ে একদিন বাড়িতে ডাকাত পড়ে। মাঝরাতে আচমকাই দা, কাটারি, খড়গ নিয়ে জনা বিশেক লোক সদর দরজা খুলে ঢুকে পড়ে । ভূপতি দত্তের জমিদারীর ঠাটবাট তখনও ছিল । ঠাকুর দালানে একপাল লেঠেলের দল তখন ঘুমাচ্ছিল । তাদেরকে ঘুমের মধ্যেই কুপিয়ে খুন করে ডাকাতরা । প্রাসাদে লুটপাট করে তারা উত্তরের অন্দরমহলের দিকে ছুটে যায় । কন্দর্প রাতের দিকটা দীঘির ধারেই ঘোরাফেরা করত!
তাকে দেখতে পেয়ে ডাকাতরা ‘তার দিকেই ছুটে যায় । ভূপতি তখন জানেন মৃত্যু আসন্ন । ইস্টদেবতার নাম জপ করতে থাকেন তিনি । বাড়িময় কান্নার রোল পড়ে যায় । সেই সব ছাপিয়ে শোনা যায় ডাকাতদলের উল্লাস । কিন্তু সেখানেই শেষ…” 
কথা বলতে বলতে থেমে যান মধুবাবু। গলা শুকিয়ে গেছে তার । সুনন্দা অধৈর্য হয়ে বলে, “শেষ মানে? তারপর কী হল?” 
“তারপর কী হল সেটা বলা ভারি মুশকিল। তবে ডাকাতদের চিৎকার আচমকা থেমে যেতে বাড়ির লোকজন ছুটে এসে দেখেন ডাকাতরা গায়েব এবং দীঘির একপাশে অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে কন্দর্প। সঙ্গে সঙ্গে দীঘিতে লোক নেমে তাদের বেশিরভাগের মৃতদেহ উদ্ধার করে। দু-একজনের তখনও হুঁশ ছিল ! 
“ডাকাতদের ঠিক কী হয়েছিল তা জানা যায় না। কন্দর্প তেমন শক্তিধর নয় যে কুড়িজন মানুষকে একাই ঘায়েল করে ফেলবে। ডাকাতদের মধ্যে একজন নাকি পরদিন সকাল অবধি কোনোরকমে টিকে ছিল! সে বারবার একটি নারীমূরতির কথা বলছিল ।” 
“নারীমূরতি!” 
“আজ্ঞে হ্যাঁ । তেমনই শুনেছি। তার মাথা থেকে পা অবধি নাকি অন্ধকারে ঢেকেছিল । মাথায় ঘোমটার মতো কুয়াশার কাপড়। তার মুখের দিকে তাকালে শুধু চোখের তারা দুটো দেখা যায় । অন্ধকারের মধ্যে দুটো উজ্জ্বল জ্বলন্ত চোখ। সেই সাথে নাকি বাঁশির আওয়াজ শুনেছিল কেউ কেউ। তবে ডাকাতরা নেশা-ভাঙ করত । খুব একটা স্বাভাবিক অবস্থায় থাকত না। মরার আগে অস্পষ্ট জবানবন্দী, তার উপরে সেটা আবার দু’শো বছরেরও বেশি লোকমুখে ঘুরেছে ।। ফলে বিশ্বাস করতেই হবে এমন কোনো মানে নেই ।”

“মাথায় কুয়াশার ঘোমটা ব্যাপারটা সম্ভবত হ্যাঁলুসিনেশান”, পায়েল বলে, “বাকিটা মেনে নিতে আপত্তি নেই । অনেক লোকেই নাকি মরার আগে মৃত্যুকে দেখতে পায় । এও অনেকটা সেরকম… মেটাফরিকাল ইভিল…” 
“না পায়েল” ঘাড় নাড়ে সুনন্দা। “মাথায় কুয়াশার ঘোমটার ব্যাপারটা শয়তানের চিহ্ন নয়, বরঞ্চ উলটোটা । যিশুখৃস্টের মাথায় কাঁটার মুকুট ছিল । হিন্দু মিথোলজি অনুযায়ী সমস্ত দেবতার মাথার চারপাশেই একটা বলয় থাকে ।। সেই বলয়টাই আসলে তার মহত্ব বা শক্তি নির্দেশ করে । গঙ্গার কথা জানো তুমি?” 
পায়েল ঘাড় নাড়ে, মধুবাবু হেসে বলেন, “ও আর জানবে কী করে। ঠাকুমা-দিদিমা না থাকলে ওসব গল্প বলবে কে?” 
সুনন্দা বলে, “গঙ্গানদী আগে মর্তে নয়, স্বর্গে বইত । ব্রহ্মা সেখানে বন্দি করে রেখেছিলেন তাকে
। শেষে একদিন তিনি গঙ্গাকে মুক্তি দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেন। আকাশ বেয়ে এঁকে বেঁকে গঙ্গানদী সাপের মতো নেমে আসতে লাগল পৃথিবীর দিকে । কিন্তু মুশকিল হল সে নদীর তেজ তখন এত বেশি যে সে পৃথিবীতে যেই মুহূর্তে আছড়ে পড়বে তখনই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এই সংকট থেকে পৃথিবীকে বাঁচান শিব । তিনি গোটা গঙ্গানদীটাকে তার জটায় ধারণ করেন। তারপর জটার একটা গিট খুলে দেন আর সেখান থেকে সরু শান্তধারায় গঙ্গা নেমে আসে। অর্থাৎ গঙ্গার সমস্ত শক্তি জমা থাকে শিবের জটায়… তেমনই আমাদের এই নারীমূরতির শক্তিও কুয়াশার মতোই তাকে ঘিরে থাকত।” 
“আর সেই শক্তিতেই কুড়িজনের ডাকাত দলকে ডুবিয়ে মারে সে?” সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন করে পায়েল। 
“এছাড়া আর কোনও ব্যাখ্যাও তো নেই !” সুনন্দা মাটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল!। 
“আরও একটা জিনিসের ব্যাখ্যা নেই ।” পায়েলের মুখ এবার উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। 
মধুবাবু হাসলেন। কিছু একটা কথা এক্ষুনি বলতে যাচ্ছিলেন তিনি। পায়েল ধরে ফেলায় থেমে গেলেন। 
“ডাকাতরা চোর নয় যে চুপিচুপি লুট করতে আসবে। কেউ কেউ আগে থেকে জানিয়ে আসত। আসার আগে চিৎকার করে বাড়ির লোককে জাগিয়ে দিত । মারপিট হত। সেদিন লেঠেলদেরকে খুন করে ওরা। তাও ঘুমের মধ্যে । পাশের লোক খুন হলেই আরেক জনের ঘুম ভেঙে যাওয়ার কথা! অর্থাৎ লেঠেলদের আগে থেকেই বেহুঁশ করে রাখা হয়েছিল । ইট 
ওয়াস এন ইনসাইড জব । আর মোডাস অপারেন্ডি দেখে এদের ডাকাত নয়, এসাসিনেটার মনে হয়।” 
“ইয়েস। গুপ্তঘাতক ।” পায়ের উপরে জোরে থাবড়া মারলেন মধুবাবু, “আর ইনসাইড জবটি
কে করেছিলেন বলতে পারবে?” 
এক মুহূর্ত সময় নেয় পায়েল, পরক্ষণেই উত্তরটা বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে, “নায়েব দিনু রায়।” 
“পারফেক্ট। তিনি স্বাভাবিকভাবেই ভেবেছিলেন চাণক্য দত্তের জীবন থেকে তার মেয়েকে সরাতে তাকে জমিদারবাড়ির কেউই খুন করেছে। ফলে প্রতিশোধ নেবার জন্যেই গুপ্তঘাতক নিয়োগ করেছিলেন তিনি । ব্যাপারটা জানাজানি হবার পরেই দিনু রায় পালিয়ে যান। তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।” 
একবার আড়মোড়া ভাঙলেন মধুবাবু । বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমারও একবার কলকাতা গেলে হত। এখানের কাজে আটকে গেলাম!” কথাটা বলে কি মনে পড়তে বললেন, “ওঃ, ওদিকের বাকিদের সঙ্গে আপনার আলাপই করানো হয়নি। আসুন না একবার ।” 
সুনন্দার মুখে এতক্ষণের ছায়াটা মুছে গেল, ‘“হ্যাঁ, স্নান করে যাচ্ছি সবাই মিলে।” 
“বেশ, আমিও তবে উঠি।” 
মাটি থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন মধুবাবু। তাকে পিছন থেকে একবার ডেকে উঠল পায়েল, “আচ্ছা শুনুন না !” 
“হ্যাঁ বলুন।” ঘুরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মধুবাবু। 
“মসক্রপ নামের সঙ্গে এ বংশের কোনো সম্পর্ক আছে?” 
মধুবাবুর ভুরু দু’টো কুঁচকে এল। কি যেন ভেবে তিনি বললেন, “জমিদারী আমলে এ বাড়িতে সাহেবদের যাওয়া আসা ছিল সে তো জানা কথা। কিন্তু ও নাম তে শুনিনি। কেন বল তো?” 
“না এমনি।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ নামিয়ে নিল পায়েল। মধুবাবু সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। 
“মসক্রপকে নিয়ে খুব ভাবনায় পড়েছ দেখছি ।” হাসিমুখে কথাটা বলে সুনন্দা। তারপর মেঝে থেকে উঠে ঘরের জানালার গিয়ে দাঁড়ায় ।
“কিছুতেই হিসেব মিলছে না, বুঝলে? কোথায় যেন গিয়ে সব ঘোঁট পাকিয়ে যাচ্ছে। ধরে নিলাম আশেপাশের কোনো সাহেব কলোনিতে পাঁচ বছরের মেয়ে এলিজাবেথ মসক্রপ মারা গেল। তাকে কবর দেওয়া হল সমাধিতে । তার বহুবছর পরে লীলাবতী দেবীকে ছবি উপহার দিল চার্চ । কিন্তু ছবির মধ্যে দিয়ে পুনর্জন্মের কথা বোঝাতে চাইল কেউ। কে?… আচ্ছা… একটা কথা এতক্ষণ ভেবে দেখিনি জানো?” 
“কী কথা?” 
“সেকালের আর্টিস্টরা সাধারণত মডেলকে দেখে ছবি আঁকত। ধর পুনর্জন্মের কথা যে লোকটা জানত সে কোনোভাবে জানতে পারে যে লীলাবতীর ছবি আঁকা হবে এবং কোনো একটা নির্দিষ্ট টেবিলের উপরে হাত রেখে বিশেষ একটা পোজে ছবি আঁকাবেন । তিনি কোনো এক ফাঁকে আগে থাকতে টেবিলের উপরে এই চিহ্নগুলো এঁকে দেন। আর্টিস্ট ছবি আঁকার সময় প্রায় সবকিছুর সঙ্গে টেবিলের লেখাগুলোকেও কপি করেন। কপি নাও করতে পারতেন। সেটুকু চান্স নিতেই হত লোকটাকে । ছবি আঁকার পর তিনি দেখলেন ছবিতে সংখ্যা আর সংকেতগুলো রয়েছে । ব্যস… কাজ শেষ…” 
গালে হাত দিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় লাগল সুনন্দার । এই সম্ভাবনাটার কথা এতক্ষণ সে নিজেও ভেবে দেখেনি । 
“এবং সেটা যদি হয় তাহলে সে টেবিল এখনও এ বাড়িতে থাকতে পারে ।” 
“না থাকার সম্ভবনাই বেশি।” 
“তা ঠিক। তবে সেটা পেলে আশা করি কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর পাব!” 
“কী করে?” 
“টেবিলের সংকেতগুলো ড্রয়ারের উপরে আঁকা হয়েছিল । হয়তো ড্রয়ারের ভিতরে রাখা ছিল কিছু । নাহলে খামোখা পুনর্জন্মের সংকেত এঁকে তো কোনো লাভ দেখতে পাচ্ছি না।!” 
“আগে টেবিলটা তো পাও তারপর তার
ড্রয়ার।” 
সুটকেস থেকে জামাকাপড় বের করছিল সুনন্দা । মালতী তুলিকে নিয়ে ঘরে এসে ঢুকল । ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে গলায় পাউডার মাখতে লাগল তুলি। সুনন্দা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পায়েল মালতীকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা এ বাড়ির পুরনো ফার্নিচার কী হল বলতো?” 
মালতী তুলির চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, “কিছু একতলার দালানে পড়ে আছে । আর কিছু ওদিকের ঘরে রেখেছে ।” 
“দালানে টেবিল টাইপের আছে কিছু? বেশ বড়সড়, কালো রঙের?” 
একটা হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠল মালতীর মুখে, “থাকলেও সে আর এদ্দিনে ব্যবহার করা যাবে না। ভেজে বারোমাস। কাঠ পচে ঝুরো হয়ে গেছে।” 
“হুম!” 
মাটি থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে এল পায়েল। আকাশটা এতক্ষণে একটু কালো করে এসেছে । বিকেলের দিকে হয়তো কালবৈশাখী আসবে। আর একটা সিগারেট ধরাল সে। এখানে আসার এই একটা সুবিধে। ইচ্ছেমতো সিগারেট খাওয়া যায়। 
বারান্দায় দাঁড়ালে নিচের দিকটা পরিষ্কার চোখে পরে । সেখানে স্তুপ করে ফেলা আছে পুরনো কাঠের জিনিসপত্র । দেখতে দেখতে একটু আগের সেই সিমেন্টের ভিতর থেকে আসা আওয়াজটার কথা মনে পড়ল তার । সত্যি কি কারও গলার আওয়াজ ছিল সেটা? নাকি উত্তেজনার বসে হাওয়ার শব্দকেই মানুষের গলা বলে ভুল করেছিল? 
আরও অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর নেই । কে সেই আপাদমস্তক ঢাকা নারীমূরতি? এলিজাবেথ মসক্রপের কফিনে কে শুয়ে আছে? কে সেকথা জানতে পারল? কাকে জানাতে চাইল? শশিভূষণ সরকারকে কে খুন করল? করলই বা কীভাবে? 
সমস্ত ব্যাপারটা একটা অসম্ভব কঠিন ধাঁধার মতো । পায়েলের মন বলল এই সব ঘটনার পিছনে
একটা সুতো আছে । একটাই সুতো । সেই সুতো ধরে হাঁটতে থাকলে একটাই জায়গায় পৌছানো যাবে । 
সেই সুতোটাকেই নিজের বুকে আগলে রেখেছে ইতিহাস । কিছুতেই দেখাতে চাইছে না । হয়তো একটা ঘটনা, অথবা একটা চরিত্র । তাকে আবিস্কার করতে পারলেই দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠবে সব কিছু! 
বারান্দা ধরে বাকি ঘরগুলোর সামনে ঘুরতে লাগল পায়েল। পুরনো কাঠের দরজাগুলোর বহু জায়গা উইতে ফৌপরা করে দিয়েছে। দু’শো বছরের ইতিহাসের সাক্ষী এই দরজাগুলো । কত মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি সময়ের বিবরণ লেখা আছে এদের খাতায়। 
একটা দরজার ফাঁকে চোখ রাখল পায়েল! পুরনো আলনা চোখে পড়ল! আলনার পিছনেই জানালা । সে জানালা এখন বন্ধ । দরজার ফাঁকে মুখ রেখে নিজের নাম ধরে ডাকল সে — 
“পায়েল…” 
কয়েকবার প্রতিধ্বনি শোনা গেল। তারপর মিলিয়ে গেল নামটা। মনে মনে একটু হেসে পাশের দরজায় সরে এল।! আবার দরজার ফাঁকে চোখ রাখল। আগের ঘরটার সঙ্গে এটার তেমন কোনো পার্থক্য নেই । শুধু আলনাটা নেই এখানে। 
পাশের আরেকটা দরজায় চোখ রাখতে গিয়ে একটু থমকে গেল পায়েল! এ দরজাটা সে চেনে । বছর চারেক আগেই এ ঘরে গলায় দড়ি দিয়েছিলেন এক গেস্ট। তার বডিটা ঝুলছিল সিলিঙ থেকে। 
মালতী এতক্ষণে পায়েলের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। এই ঘরটা সে এড়িয়েই চলে । এখন পায়েলকে ভিতরে চোখ রাখতে দেখে তার বুকটাও কেঁপে উঠল। 
“কী করছ গো দিদি, কোনো মানে হয়?” 
দরজার উপর দুটো হাত রেখে পাল্লার ফাঁকে চোখ রাখল পায়েল। প্রথমেই 
চোখ গেল উপরের দিকে। সিলিঙটা ফাঁকা।
নিচে তাকাতেই এক ঝটকায় পায়েলের পা কেঁপে গেল। 
এ ঘরের জানালার সামনেও আলনা নেই । তার বদলে আছে একটা সেগুন কাঠের বড় টেবিল। এ টেবিলটা পায়েল চেনে। 
মুহূর্তে পিছন ফিরে মালতীর দিকে তাকাল সে । একটু থমকে দাঁড়িয়ে ছিল মালতী। পায়েল গলার উত্তেজনাটা চেপে রেখে বলল, ‘“এ ঘরের চাবি কার কাছে থাকে?” 
“মধুদা।” 
“একটু নিয়ে এসো তো, তাড়াতাড়ি ।” 
মিনিট দশেক পরে চাবি নিয়ে ফিরে এল মালতী । পায়েল এতক্ষণ ছটফট করছিল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ।। এক ঝটকায় চাবিটা নিয়েই সে খুলে ফেলল তালাটা । 
কোনোদিকে না তাকিয়ে গিয়ে দাঁড়াল টেবিলটার সামনে । তার হাবভাবে অবাক হয়ে গেল মালতী। সেও ঝুঁকে পড়ল। 
চিনতে ভুল হয়নি পায়েলের । ড্রয়ারের উপরে সেই চেনা সংখ্যাগুলো। হাতের মোবাইলটার ছবিটা খুলে মিলিয়ে নিল । এই সেই টেবিল। কোনো ভুল নেই । 
পায়েলের হাত কাপছিল । একবার ড্রয়ারটা ধরে জোরে টান দিল সে। ড্রয়ার খুলল না! দীর্ঘদিনের অব্যবহারে আটকে গেছে । 
“ছাড়, আমি দেখছি।” পায়েলকে সরিয়ে মালতী এবার হাতলটা ধরে টান দিল । ভারি কাঠের ভিতর থেকে একটা যন্ত্রণাময় শব্দ বেরিয়ে এল । সময় সহজে তার রহস্য খুলতে দিতে চায় না। 
একটা হাত ড্রয়ারের পাশে রেখে আবার টান দিল মালতী । এবার একটু খানি ফাঁক হল সেটা। আধ ইঞ্চি সেই ফাঁকের মধ্যে দিয়ে ভিতরের খানিকটা অন্ধকার চোখে পড়ল । … 
“ড্রয়ারের উপরের দিকে শক্ত কিছু একটা আটকে আছে । তাই খোলা 
যাচ্ছে না।” হাঁপাতে হাঁপাতে নিজের মনেই বলে
পায়েল । 
“কী আছে গো ভিতরে?” তার উদ্বিপ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে মালতী। 
“একটা রহস্যের চাবি!” 
কথাটা বলে গায়ের সমস্ত জোর একত্র করে টান দিল পায়েল। তীব্র ঘর্ষণের একটা আওয়াজ করে খুলে গেল ড্রয়ারটা। পায়েল আর মালতী দু’জনেই ঝুঁকে পড়ল তার উপরে । 
একটা পুরনো জং লাগা আয়না শোয়ানো আছে ড্রয়ারের ভিতরে । হাত দিয়ে তুলে সেটা সরিয়ে ফেলল পায়েল। তারপর আবার তাকাল ড্রয়ারের দিকে। 
ড্রয়ার ফাঁকা। 
“পেলে কিছু?” মালতী ব্যাগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল। 
পায়েলের ঠোঁটের কোণে একটা চেরা হাসি খেলে যায়, “পেয়েছি।”

পঞ্চম অধ্যায়


“আসুন মিস সান্যাল। আলাপ করিয়ে দি, ইনি হলেন ক্ষেত্রমোহন সেন! আর ওঁর শ্রী গিরিজা । আর অতীন… তাকে দেখচি না…”
 একটা কৃত্রিম হাসি মুখে ঝুলিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে আসে সুনন্দা। তুলি একটু আগেই এসে ঢুকেছে। সে ছাড়া ঘরে পঞ্চম ব্যক্তি যিনি উপস্থিত আছেন তিনি শশাঙ্ক পালিত। ক্ষেত্রমোহন সেন এই জমিদারবাড়ির আর এক আবাসিক । এখানে আছেন তাও বছর দশেক হতে চলল । এনার কোনো এক পূর্বপুরুষ সহদেব দত্ত এবং লীলাবতী দত্তের আমলে এবাড়ির নায়েব ছিলেন! পরে সেই নায়েবের সাথেই জমিদারবাড়ির কারও বিয়ে হয়। ফলে একরকমভাবে
 ইনিও এই দত্তবংশেরই রক্ত বহন করছেন। সে প্রজন্ম শেষ হতে আর নায়েব রাখা হয়নি এ বাড়িতে । জমিদারী তখন থেকেই পড়ে আসতে শুরু করে । 
গিরিজা বলে মহিলাটিকে এখনও দেখতে পায়নি সুনন্দা । বিছানার উপরে একটা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন তিনি । সুনন্দা তার দিকে তাকিয়ে একবার নমস্কার করেছিল । মহিলা কুতকুতে চোখে তাকে আপাদমস্তক জরিপ করে আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন । এর মধ্যেই সুনন্দা বুঝেছে সে এখানে আসায় যেকোনো কারণেই হোক খুশি হননি গিরিজা সেন। 
“আমার স্ত্রী আসলে একটু অসুস্থ !” গিরিজার দিকে একবার তাকিয়ে সামাল দেবার চেষ্টা করলেন ক্ষেত্রমোহন, “লোকজনের সঙ্গে তেমন একটা মিশতে চায় না। অতীন… ও অতীন… একবার এদিকে শোন্ বাবা!” 
অতীন যার নাম সে ভিতরের ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল । সম্ভবত ক্ষেত্রমোহন-এর ছেলে । এর চেহারাটা খাপছাড়া রকম পরিপাটি । মাথার চুল মেপে বাঁদিকে সিতে করে সাজানো । এমনভাবে আজকালকার ছেলেমেয়েরা আর চুল 
“দিয়েছিলাম ।” কাটা কাটা উত্তর । 
“তিরিশ এমজি তো?” 
“হ্যাঁ। মেপে দিয়েছি।” 
“বেশ করেছিস । আজ রাতে আর দিতে হবে না।”
 ঘাড় নেড়ে আবার ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল অতীন। ক্ষেত্রমোহন সুনন্দার দিকে চেয়ে বলল, “চলুন আমরা বাইরে গিয়ে কথা বলি । ও আবার বেশি আওয়াজ পছন্দ করে না!”
 “হ্যাঁ সেই ভালো ।” কথাটা বলে বাইরের দিকে পা বাড়াল শশাঙ্ক 
আজ সকালেই দক্ষিণের প্রাসাদটা দেখে এসেছে সুনন্দা। আলাদা করে কিছ
 চোখে পড়েনি । উত্তরের প্রাসাদের সঙ্গে এর তেমন একটা কিছু পার্থক্য নেই1 দূ-একটা ঘরে লোকজন আছে । তারা কে, জমিদারবাড়ির সঙ্গে কীসের সম্পর্ক (সেসব আর জিজ্ঞেস করেনি সুনন্দা। লোকগুলো এগিয়ে এসে আলাপ করার মতো নয় । দুটো প্রাসাদের মাঝে মিটার খানেকের একটা রাস্তা রাখা হয়েছে।! (সেখান দিয়ে পিছনে অন্দরমহল আর দীঘির দিকে যাওয়া যায় । উত্তরের অন্দরমহল আর তার আশেপাশের ঝোপঝাড়ে ছেয়ে যাওয়া জায়গাটাকে একটা কাঠের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। সেই বেড়ার বাইরে থেকে ভিতরে চোখ রেখে একটা ফুট পাঁচেক লম্বা খরিশের খোলস দেখতে পেয়েছে সুনন্দা । দেখেই বুকের ভিতরটা আটকে উঠেছে তার । সরু শুকনো ডালপালার ‘আড়ালেই কোথাও এখনও লুকিয়ে আছে হয়তো সাপটা । ইচ্ছা হলে বেড়ার ঘরাক দিয়ে বাইরেও বেরিয়ে আসতে পারে সে। 
মনটা সেদিক থেকে ফেরায় সুনন্দা, কিছু আঁচড়ায় না। পরনে একটা হাফ প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি। বয়সে চোদ্দ কি পনেরোর বেশি হবে না। ঘরের বাইরে এসে সে সটান বাপের মুখের দিকে চেয়ে দাঁড়াল। 
“মাকে সকালের ট্যাবলেট দিয়েছিলি?”
একটা বলছেন ক্ষেত্রমোহন, “আমার বৌয়ের ব্যবহারে কিছু মনে করবেন না প্লিজ । আসলে আমার এখানে থাকাটা ওর পছন্দ নয়।” 
“পছন্দ নয় কেন?” সুনন্দা আগ্রহ দেখানোর চেষ্টা করে । 
ক্ষেত্রমোহন ভুরু দুটো কপালের বেশ খানিকটা নিচ অবধি নামিয়ে আনেন, ‘“আসলে আমি একটু ভ্যাগাবন্ড টাইপের ছিলাম । সংসার-টংসার নিয়ে অত মাথা ব্যথা ছিল না। বিয়ে করি বেশ দামড়া বয়সে । দোকানে হেল্পারের কাজ করেছি, ড্রাইভারি করেছি এমনকি খাবার-দাবারের দোকানও দিয়েছি কিছুদিন । বিয়ের পর থেকে গিরিজার শখ ছিল নিজেদের একটা ফ্ল্যাট কিনে কলকাতায় থাকা। সে আর হল কই? এখন ভরসা বলতে একমাত্র ওই ছেলে । বাপের পয়সা নেই, কিন্তু অতীন বেশ ব্রাইট স্টুডেন্ট !” 
প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এসে মাঝের রাস্তাটা দিয়ে হাটতে লাগল তিনজনে ! তুলি আপাতত মালতীর সঙ্গে ফুল দেখছে ।। এখানে এসে থেকে একবারও মা-বাবার কথা বলেনি মেয়েটা।! আজ সকালেই যোগেন্দ্র নাথ ফোন করেছিলেন।! তুলির খবর নিচ্ছিলেন। সুনন্দার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা সেটাও জিজ্ঞেস 
করলেন । সুনন্দা জানিয়ে দিয়েছে বেশ ভালোই আছে সে। আর তুলির মতো মিশুকে ভালো মেয়েও আর হয় না। কাল আর আজ একবারও শরীর খারাপ করেনি । শুধু মাঝে মধ্যে একদম কথা শুনতে চায় না। 
অন্দরমহলের সীমানা পেরিয়ে আবার একটুখানি ঝোপঝাড় পড়ে। সেটার দিকে এগোতেই একটা কুয়ো চোখে পড়ল সুনন্দার। তবে এর উপরে গাছপালা গজিয়ে গেছে। চারপাশেও পুরু ঘাসের আস্তরণ । সম্ভবত আর ব্যবহার হয় না সেটা । সেদিকে আঙল দেখিয়ে সুনন্দা জিজ্ঞেস করল, “এটা কি শুকনো?” 
শশাংকই উত্তর দিল, “তা আজ বহুকাল হল এরকমই পড়ে আছে । আমাদের ব্যবহারের
কুয়োটা সামনের দিকে।” 
সুনন্দা মনে মনে একটা সময় কল্পনা করার চেষ্টা করল। চারপাশের ঘাসগুলো হয়তো ছিল না তখন। সিমেন্টের চাতালটা ভেঙে পড়েনি । ওপাশের অন্দরমহলের ঝকঝকে গম্বুজে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ত। বাইরের ঘরে বসে গড়গড়া টানতেন ভূপতি দত্ত । তাজা তামাকের গন্ধে ভরে থাকত চারপাশটা । বাড়ির মেয়ে-বৌ এসে কুয়ো থেকে বালতি নামিয়ে জল তুলত । গমগম করত জায়গাটা। 
কুয়োর পাশটা এখন আগাছায় ভরে গেছে । একটা সিমেন্টের স্ল্যাব দিয়ে ঢাকা আছে সেটা। স্ল্যাব আর কুয়োর মুখের মাঝে যেটুকু ফাঁক ছিল সেটা ঢেকে গেছে শ্যাওলার আস্তরণে । 
ঝোপটা পেরিয়ে আসতেই বিশাল চোখ জুড়ানো দীঘিটা দেখতে পেল সুনন্দা। জমিদারবাড়ির গোটা পিছন দিকটা ছাড়িয়ে আরও বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেছে সেটা। ওপারে তাকালে ছোটখাটো কয়েকটা কুড়ে ঘর চোখে পড়ে । 
দীঘির জলে এখন পড়ন্ত বিকেলের রোদ পড়ে এসেছে। একটু আগের খেয়ালটা আবার ফিরে এল সুনন্দার মাথায় । কুড়িজন গুপ্তঘাতকের শরীর ভেসে উঠেছে দীঘির জলে । আর ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সেইখানে অসহায় মুখে দাঁড়িয়ে আছে কন্দর্প দত্ত… আর সেই নারীমূরতি। 
খোলা জলের উপরে দিয়ে হাওয়া বয়ে এসে সুনন্দার খোলা চুল উড়িয়ে দিচ্ছিল । সেগুলো বাঁধতে বাঁধতে সে বলল, “এ বাড়িতে একসময় ডাকাত পড়েছিল শুনেছি ।” 
শশাংক হাসল, “মধুবাবু বলেছেন তো? আরে লোকটার ওই এক দোষ!। ধাকে পাবে ধরে ধরে ইতিহাস শোনাবে।” 
“দোষ কেন? আমরাই তো জানতে চেয়েছিলাম । ছোটোখাটো একটা মার্ডার মিস্ট্রি বলা যায়।” 
“সেইসঙ্গে রিভেঞ্জ ড্রামা!” ক্ষেত্রমোহন বলে উঠলেন, “দিনু রায়ের ব্যাপারটা শুনেছেন তো?” 
মাথা নাড়ে সুনন্দা! তারপর দীঘির ধার ঘেঁষে
হাঁটতে শুরু করে, “মার্ডার মিস্ট্রি বললেন বলে মনে পড়ল, সে মিস্ট্রি কিন্তু এখনও সলভ্ড হয়নি ।” 
“কেন?” অবাক হল শশাঙ্ক । 
“দিনু রায়ের মেয়েটাকে কে খুন করেছিল সেটা এখনও জানা যায়নি । মানে দিনু রায় সন্দেহ করেছিলেন যে জমিদারবাড়ির থেকেই কেউ, কিন্তু তারপর তো আর কিছু জানা গেল না।!” 
শশাংক কিছু বলতে যাচ্ছিল, ক্ষেত্রমোহন তার আগেই বললেন, “সন্দেহ খুব একটা অমূলক ছিল না মনে হয় । সে আমলে জমিদাররা অত পুলিশ টুলিশের ধার ধারত না। জমিদারবাবুর মেয়েটাকে পছন্দ হয়নি, চাণক্য ঝোলাঝুলি করছে । ব্যাস! একটা মেয়েকে তুলে এনে খুন করতে কতক্ষণ লাগে?” 
“সেসব ঠিকই আছে, কিন্তু মেয়েটাকে বিবস্ত্র অবস্থায় পাওয়া গেছিল, আর লাশ গুম করাটাও ভৃপতি বা নৃপতি দত্তের কাছে বড় ব্যাপার ছিল না। যার উপরে আমার রাগ তাকে খুন করে নিজের বাড়ির দরজায় তার লাশ বেঁধে রাখব কেন আমি? উঁহু… লাশের বিবরণ শুনে মনে হচ্ছে কেউ যেন জোর গলায় বলতে চেয়েছে, দেখ একটা খুন হয়েছে । বুঝতেই পারছ কে খুন করেছে…।” 
“তাহলে আপনি বলছেন ভূপতি দত্তকে ফীসানো হয়েছিল?” শশাঙ্ক 
জিজ্ঞেস করল। 
“কাকে ফাঁসানো হয়েছে বলা মুশকিল। তবে দিনু রায়ের আগেও জমিদারবাড়ির চরম শত্রু ছিল কেউ সেটা বোঝা যাচ্ছে ।” 
“সেটাও অস্বাভাবিক না। জমিদারদের বন্ধুর থেকে শত্রুই বেশি থাকত।” 
বেশ খানিকক্ষণ কোনো কথা বলল না কেউ । দীঘির জল পাথরে বাধানো পাড়ে এসে লেগে ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ আসছে । দু-একটা মাছ জলের উপর মুখ বাড়িয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে কি যেন দেখেই আবার তির বেগে ডুব দিচ্ছে ভিতরে । এতক্ষণ কিছু একটা ভাবছিল সুনন্দা।
মুখ ফিরিয়ে বলল, “আচ্ছা এই ডাকাতিটা ঠিক কোন সময় নাগাদ হয়েছিল বলুন তো?” 
“আপনি তো রীতিমতো গোয়েন্দার মতো প্রশ্ন করছেন !” কথাটা বলে কৌতুকে হেসে উঠলেন ক্ষেত্রমোহন। একটা লজ্জার রেশ ছড়িয়ে পড়ুল সুনন্দার মুখে, “আসলে এখানে তেমন কিছু করার নেই তো, রান্নাবান্নাও সনাতনদা করে দেন। ফলে এইসব নিয়েই ভাবি সারাদিন।” 
“বেশ, তো ভাবুন না। আমি আপনাকে একটা টাইমলাইন দিয়ে দিচ্ছি । ভাবতে সুবিধা হবে। সালগুলো যদিও একেবারেই আন্দাজে… তাও…” 
শশাঙ্ক বুক পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে সুনন্দার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “সকালের ফর্দর পিছন দিকটা ফাঁকা আছে । লিখে নিন ইচ্ছা হলে ।” 
পেন সমেত কাগজটা হাতে নিয়ে দীঘির পাড়েই বসে পড়ল সুনন্দা। ক্ষেত্রমোহন বসলেন তার পাশে । শশাংক একটু দূরে ঘাসের উপরেই দাঁড়িয়ে হাওয়া খেতে লাগল। 
খানিকটা হিসেব করে নিয়ে বলতে শুরু করলেন ক্ষেত্রমোহন — 
“এই বাড়িটা কবে তৈরি তা আন্দাজেও বলা সম্ভব না। তবে ভৃপতি দত্তের বাবা এটা ব্রিটিশ সরকারের থেকে লিখিয়ে নেন সম্ভবত ১৭৭০ নাগাদ । এবং তার পর থেকেই থাকতে শুরু করেন । তার বড় ছেলের নাম জানা যায় না। ধরে নিন তিনি জন্মেছিলেন সত্তরের আশেপাশেই !” 
সাদা কাগজে ছোট ছোট করে লেখে সুনন্দা— আননোন; ১৭৭০ । 
“তার পাঁচবছর পর অর্থাৎ ১৭৭৫-এ ভূপতি, ১৭৮০ তে সন্ধ্যারানি ও ছোট ছেলে নৃপতি ১৭৮৫ নাগাদ। আবার বলছি সংখ্যাগুলো আন্দাজে আর দুই ভাইবোনের মধ্যে পাঁচবছরের ফাঁক রেখে।” 
মাথা নাড়ে সুনন্দা । সত্যিকারের সাল তারিখ এখন আর পাওয়া সম্ভব নয় । 
“বড় ছেলে যার নাম জানা যায় না সে মারা যায় কম বয়সে । ধরে নিন ১৭৯০ এর কাছাকাছি ।
ভূপতি জমিদারী সামলাতে সামলাতে প্রথমবার বিয়ে করেন একটু তাড়াতাড়ি, ধরা যাক ১৮০৩ । প্রথম স্ত্রী মারা যান একবছরের মধ্যে। তারপর আবার বিয়ে করেন ১৮০৪-এ ধরে নিন । কন্দর্পের জন্ম তাহলে দাঁড়াচ্ছে ১৮০৫-এর কাছাকাছি। 
ভূপতির বোন সন্ধ্যারানির বিয়ে হয় কম বয়সে ১৮০২-১৮০৩ এর মধ্যে। হয়তো দু’বছর পর তার প্রথম সন্তান হয়— লীলাবতী, তার গায়ে গায়েই সহদেব।” 
হাত দেখিয়ে ক্ষেত্রমোহনকে একটু থামতে বলল সুনন্দা । মানে লীলাবতী জন্মাচ্ছে ১৮০৫ এর কাছাকাছি । ঠিক যে বছর মারা যায় মসক্রপ নামের সেই মেয়েটি । কাগজের উপরে কী যেন লিখল সুনন্দা । ভুরু দু’টো আশ্চর্য রকম কুচকে আছে তার। প্রায় মিনিট খানেক পর শব্দ ফুটল মুখে, “তারপর?” 
নৃপতির বিয়ে হচ্ছে তাহলে ১৮১০ । তার ছেলেমেয়ে হয়নি বলে দত্তক নেন তিনি চাণক্যকে । চাণক্যর জন্ম তাহলে ধরে নিন আঠেরোশো দশের আশেপাশে । তার প্রেমে পড়ার মতো বয়স হতে আরও বছর কুড়ি নিয়ে নিন— ১৮৩০ । এই হল আপনার প্রশ্নের উত্তর— জমিদারবাড়িতে ডাকাতি ঘটে ১৮৩০ । তখন ভূপতির বয়স ৫৫, সন্ধারানি ৫০, নৃপতি ৪৫, কন্দর্প ২৫, লীলাবতী ও সহদেব প্রায় ২৫ 
পিছন থেকে এবার সামনের দিকে সরে আসে শশাঙ্ক ! পাড়ের উপরে উবু হয়ে বসে পড়ে বলে, “কিছু বুঝলেনাঃ” 
সুনন্দার মুখ থেকে চিন্তার মেঘ কেটে যায়, “বোঝার আর কি আছে । আমার আসলে কৌতূহল হচ্ছিল একটু !” নারীমূরতির কথা ইচ্ছা করেই 
চেপে গেল সে। 
“আপনার কৌতূহল কোথা থেকে হচ্ছে সেটা কিন্তু আমি জানি। সেদিন যেভাবে মৃত্যুগুলোর কথা জিজ্ঞেস করছিলেন…” 
“তার সঙ্গে এইসব জমিদারী ইতিহাসের সম্পর্ক
আছে বলছেন?” 
কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করে সুনন্দা। 
“মে বি অর মে নট বি। কে বলতে পারে এই বাড়ির কোনো গোপন কুঠুরিতে হয়তো শুভ অশুভ এমন কিছু আছে যা এর আগেও মানুষ খুন করেছে।” গলায় রহস্য আনার চেষ্টা করে শশাঙ্ক। 
“তা বলতে পারব না।! তবে আমার একটা কথা মনে হচ্ছে এখানে আসার পর থেকে।” 
“কী কথা?” দু’জনে প্রায় একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল। 
পাড়ের উপরেই উঠে দাঁড়ায় সুনন্দা। তারপর দীঘির জলের উপর চোখ নিবদ্ধ রেখে বলে, “খুনের কথা জানি না। তবে মনে হয় এই দীর্ঘ আড়াইশো বছরের সাক্ষী হয়ে আছে কেউ। এই এত কান্না, শোক, মৃত্যু, উৎসব, যন্ত্রণা— কেউ দেওয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। কালের প্রবাহে বয়ে যাওয়া দুই শতাব্দীর গোপন ইতিহাস ধরা আছে তার চোখের তারায় আজও আগের মতোই দেখে চলেছে সে। এখনও..” 
বিরাট প্রাসাদগুলোর দিকে ফিরে কিছু একটা কথা বলতে যাচ্ছিল সুনন্দা। কিন্তু সে থেমে যায় । প্রাসাদের দিক থেকে মালতীকে দৌড়ে আসতে দেখা যায়। তার হাবেভাবে একটা অদম্য উত্তেজনা খেলা করছে । এক মুহূর্তের জন্যে সুনন্দার বুক কেঁপে ওঠে । দ্রুত পায়ে সে দীঘির পাড় ফেলে এগিয়ে যায় 
প্রায় দৌড়ে কাছাকাছি চলে আসে মালতী। সুনন্দার দিকে তাকিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘“তুলিদিদির শরীর খারাপ করেছে । শ্বাস আটকে যাচ্ছে, শিগগির চলুন।” 
আর কোনো কথা শোনার জন্যে দাঁড়ায় না সুনন্দা। দ্রুত পায়ে দৌড় দেয় দক্ষিণের অন্দরমহলের দিকে। একটু আগে সেখানেই শশাঙ্কর ঘরে 
গিয়েছিল তুলি । ভিতরে মধুবাবু আর সনাতন ছিল । তার মধ্যেই কি হয়েছে তুলির? ভাবতেই সুনন্দার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। …
শশাঙ্কের ঘরের দরজায় গিয়ে দু-তিনজন অচেনা লোককে চোখে পড়ল! এরাও হয়তো এই মহলেই থাকেন। কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে শুনে দৌড়ে এসেছেন। 
সবাইকে সরিয়ে বিছানার উপর ঝুঁকে পড়ল সুনন্দা! একটা বালিশের উপরে শুয়ে আছে তুলি। তার চোখ দুটো এখন খোলা। বুকটা মৃদু ওঠা-নামা করছে । বালিশের ঠিক পাশেই পড়ে আছে ইনহেলারটা। সারাক্ষণ সেটা তুলির পকেটেই থাকে ।
সুনন্দাকে আসতে দেখে তার দিকে একবার মুখ ফেরাল তুলি। তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি ফুটল না। গোটা মুখ লাল রঙে ভরে গেছে। একটু একটু করে যেন ফ্যাকাসে হচ্ছে চামড়াটা। 
“এখন ঠিক লাগছে মা?” তুলির কপালে একটা হাত রেখে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল সুনন্দা। 
কয়েক সেকেণ্ড পরে উপরে নিচে মাথা নাড়াল তুলি। তারপর আবার মুখ ফিরিয়ে বা পাশের জানালাটার দিকে তাকা 
“ভাগ্যিস ঘরে খুরাম ছিল !” মাটির উপরে বসে থাকা একটা মাঝবয়সী ছেলের দিকে চেয়ে বলল
মালতী। 
ছেলেটা হালকা মাথা নাড়াল, “আমি তো পে… হিসি করতে গেছিলাম বাইরে… এসে দেখি…” 
সুনন্দা লক্ষ করল ছেলেটার বয়স বেশ কম। সম্ভবত এ বাড়ির কোনো শরীকের ছেলেপুলে হবে । সে খুরামের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এসে কী দেখলে?” 
খুরাম ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল, “দেখি দিদি খুব হাত পা ছুড়ছে। আর শ্বাস নিতে পারছে না।” 
মুখ ঘুরিয়ে নিল সুনন্দা । তারপর আবার তুলির কানের কাছে মুখ এনে বলল, “কী হয়েছিল তুলি? ভয় পেয়েছিলে?” 
এই মুহূর্তে তুলি যেন অনেকটা পালটে গেছে । তার চোখ মুখ আশ্চর্যরকম স্থির, ঠোট দুটো শুধু কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝে। সেই রকম কাঁপাকীপা ঠোটেই আলতো করে উচ্চারণ করেছিল সে, “একজন এসেছিল । চলে গেছে ।” 
“কে এসেছিলঃ?” উদ্বিপ্ন গলায় প্রশ্ন করে সুনন্দা। 
“একটা মেয়ে। মুখ দেখতে পাইনি। মুখ ঢাকা ছিল ।” 
“কী বলছিল সে?” 
এ প্রশ্নের আর উত্তর দেয় না তুলি। 
সুনন্দা খুরামের দিকে তাকাতে সে অর্থবহ মাথা নাড়ায় । 
সুনন্দা তাকিয়ে দেখে শশাঙ্ক আর ক্ষেত্রমোহন এসে দাঁড়িয়েছে দরজায় । তাদের ভিতরে আসতে ইশারা করে তুলির মাথায় আর একবার হাত রেখে বাইরে বেরিয়ে আসে সুনন্দা। 
পায়েলকে এতক্ষণে চোখে পড়ে তার। স্নান খাওয়া সেরে উত্তরের প্রাসাদের দিক থেকে এদিকে আসছে সে। সুনন্দাকে দেখে একটু থমকে দীড়ায় । তারপর অন্দরমূহলের দিকে একবার উঁকি মেরে দেখে বলে, “কি হয়েছে গো? এত লোক কেন?” 
“তুলির শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল !” মুখ নামিয়ে বলে সুনন্দা! 
“শ্বাসকষ্ট! এমনি, এমনি?” অবাক হয়ে
জিজ্ঞেস করে পায়েল। 
“নাঃ, কেউ এসেছিল ওর ঘরে ।” 
“সে আসতেই পারে, তার জন্যে শ্বাসকষ্ট হবে কেন?” 
‘‘একটি মেয়ে… তার মুখ কাপড়ে ঢাকা ছিল । খুরাম ঘরে ঢুকে দেখতে পায়নি তাকে 
তীক্ষ্ন চোখে সুনন্দার দিকে তাকায় পায়েল, “কাপড়ে মুখ ঢাকা মেয়ে…! এটা তো…” 
“জানি” পায়েলের কথা শেষ হওয়ার আগেই তাকে থামিয়ে দেয় সুনন্দা, ‘এল আমরা এখানে আসার পরেই তুলিকে কেউ ডেকেছিল । উত্তরের অন্দরমহলের দিক থেকে । আমার মনে হয় দু’জন একই !” 
“দিস ইস টারনিং টু স্পুকি। ভুতের গল্প মনে হচ্ছে।” 
সুনন্দা এতক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল । এবার সে পায়েলের চোখে চোখ রেখে বলল, “ভৃত হোক বা অন্য কিছু। আমি তাকে ছেড়ে দেব না।! আজ ওর কিছু একটা হয়ে গেলে…” আচমকাই সুনন্দার চোয়াল শক্ত হয়ে ঢঠেছে । মুখের শিরাগুলোয় রং ধরতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে । সেটা দেখে এক মুহূর্তের জন্যে ভয় লাগে পায়েলের। দ্রুত সুনন্দার একটা হাত ধরে ফেলে সে বলে, “তুমি একটু শান্ত হও । এরকমও তো হতে পারে যে ও ভুল দেখেছে, বা ঘুমের ঘোরে দেখেছে । হাজার হোক ও একটা বাচ্চা মেয়ে।” 
“হ্যাঁ। বাচ্চা, একদম রিন্টির মতো ।” আগের মতো শক্ত গলাতেই কথাটা এলল সুনন্দা। 
“রিন্টি কে?” নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল পায়েল। 
“আমার মেয়ে । বেঁচে নেই !” 
“ওঃ সরি… আসলে…” 
“জাস্ট শাট আপ!” 
এতক্ষণে সুনন্দার গলার কঠিন ভাব মুছে গিয়ে একটা চাপা কান্নার রেশ 
ফুটে ওঠে, “আট বছর বয়স ছিল রিন্টির । বাবার হাত ধরে সকালের বাজার করতে গেছিল।
তখনও ভালো করে ভোরের আলো ফোটেনি । রাস্তার উলটোদিক দিক থেকে এসে একটা গাড়ি ধাক্কা মারে ওদের । নীলাদ্রি একট দূরে ছিটকে পড়ে । রিন্টিকে চাপা দিয়ে চলে যায় গাড়িটা।” 
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু থামে সুনন্দা। একফোঁটা জল তার চোখ থেকে গড়িয়ে গালের উপরে নেমেছিল । আঁচলের একটা প্রান্ত ধরে সেটা মুছে নিয়ে মুখ তুলে তাকায় । 
পায়েল এতক্ষণ ধরেই ছিল তার হাতটা । এবারে হাতটা কাঁধে রেখে বলে, “তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি, জানো?” 
“কী কথা?” ধরা গলায় জিজ্ঞেস করে সুনন্দা। 
“টেবিলটা খুঁজে পেয়েছি আমি।” 
“মানে সেই ছবির টেবিলটা!” পলকের মধ্যে সুনন্দার গলায় একটু আগের উত্তেজনাটা ফিরে আসে । 
“ইয়েস, দ্যাট টেবিল । যে ঘরে নলিনী ঘোষ সুইসাইড করেছিল সেখানেই রাখা ছিল ।” 
“ড্রয়ারটা ছিল?” 
“ছিল। কিন্তু তার ভিতরে একটা আয়না ছাড়া কিছু ছিল না।” 
“আয়না! কীরকম আয়না?” 
“সেটা বড় কথা না। আশ্চর্যের ব্যাপার হল অনেক টানাটানির পরেও ড্রয়ারের পুরোটা খোপ থেকে খুলে বেরিয়ে আসছিল না!” 
“তে? তাতে কী হল?” 
“তাতে হল এই যে আমি বুঝতে পারলাম ড্রয়ারের উপরের কাঠে এমন একটা কিছু আটকান আছে যেটা ড্রয়ারের শেষ প্রান্তটাকে খুলে বেরিয়ে আসতে বাধা দিচ্ছে । আয়নাটা আর একবার ওখানে চিত করে রাখতেই ড্রয়ারের উপরের দিকের কাঠটা দেখতে পেলাম।” 
“কী ছিল সেখানে?” 
“ইয়েস। কী ছিল ওখানে ।” 
পকেট থেকে একটা পুরনো মরচে ধরা বড়সড় চাবি বের করে দেখাল প।য়েল । তারপর চারপাশটা একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বলল,
“একবার এদিকে এসো তো।” 
‘“কোথায়?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল সুনন্দা! 
“ওই কুয়োটার কাছে।” 
“কিন্তু কেন?” 
সুনন্দার কোনো কথা আর শুনল না পায়েল। দ্রুত পায়ে এগোতে লাগল কুয়োর দিকে। সুনন্দা বুঝল তাকে আর বাধা দিয়ে লাভ নেই । ভারি জেদি মেয়েটা। যেটা একবার মাথায় চাপল তো সেই নিয়েই মেতে থাকবে । 
কাছে পৌঁছাতে সুনন্দা বুঝল কুয়োটা সে আগে যতটা ভেবেছিল তার তুলনায় বেশ খানিকটা ছোট । মাটির উপরে একটা মানুষের কোমর সমান উঁচু সেটা! সাবধানে পা ফেলে কাছে যেতে হয় । দু’জনের পায়েই চটি । সাপ না হোক পোকামাকড় কামড়ে দিলেও রক্ষা থাকবে না! 
কুয়োটার সামনে পৌঁছে সেটাকে আর একবার ঘুরে ফিরে দেখল পায়েল । তারপর একবার স্ল্যাবটার উপরে হাত রেখে পিছন ফিরে বলল, “এটাকে সরিয়ে ফেলতে হবে !”

“কী হবে তাতে?” এবার বেশ বিরক্ত হয় সুনন্দা । মেয়েটা যেন বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছে ।
“আহা, শোনোই না আমার কথা ।” পায়েল কাতর আবেদন জানানোর চেষ্টা করল। 
“যতক্ষণ না বলছ চাবিটা কীসের ততক্ষণ কিচ্ছু শুনব না।!” 
এক পলকে পায়েলের ঠোটে একটা শয়তানী হাসি খেলে গেল, “বেশ, সব বলব, কিন্তু তার আগে তোমাকে একটা পাজেলের উত্তর দিতে হবে !” 
“আর ভালো লাগে না… যাক গে, বল কী পাজেল!” 
“পাজেলটা এই স্ল্যাবের নিচে। হাত লাগাও !” 
অগত্যা হাত লাগাল সুনন্দা!। স্ল্যাবটা ভীষণ ভারি । সেটা তুলে সরানো দূরের কথা ঠেলে খানিকটা ফাঁক করতেই কালঘাম ছুটে গেল দু’জনের। মাঝে কয়েকবার থেমে দম নিল সুনন্দা । পায়েলের কিন্তু ধৈর্যে ঘাটতি নেই । মহামূল্য কিছু রত্ন রাখা আছে যেন স্ল্যাবের নিচে । সরালেই সব জ্বলজ্বল করে উঠবে। 
শেষে ইঞ্চি পাঁচেক ফাঁক হতে সূর্যের আলো সেই অন্ধকারের ভিতরে গিয়ে পড়ল। সেই ফাঁকের ভিতর দিয়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করল পায়েল। তারপর একপাশে সরে এসে নাটকীয় ভঙ্গীতে বলতে লাগল — 
“উনিশশো বিরানব্বই সাল। স্থান এই জমিদারবাড়ি । একটা বছর তিরিশের লোক । হাইট এই ধর তোমার কি আমার মতোই হবে! একদিন সকালে তার ডেডবডি আবিষ্কার করা গেল এই কুয়োর ভিতরে । উপর থেকে পড়ে ঘাড় ভেঙে মারা গেছে সে । কুয়োর পাঁচিলে রাখা ছিল একটা মদের বোতল আর একটা প্লাস। ভদ্রলোককে শেষ দেখা গেছিল আগের দিন বিকেলে। একটা ব্যাগ নিয়ে দীঘির দিকে যাচ্ছিলেন তিনি । কী মনে হয়? কীভাবে পড়ে গেল লোকটা?” 
সুনন্দা একটুও না ভেবে বলল, “এত খুব সহজ । মদ খেয়ে মাথার ঠিক ছিল না। কুয়োর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল । তেমন উঁচু তো নয়, নিচে পড়ে
গেছে ।” 
“কিন্তু কেন? লোকটা যদি জানে কুয়োটা পরিত্যক্ত তাহলে কাছে এসে দাঁড়াবে কেন?” 
“কেন?” 
“তুমি কেন এসে দাঁড়ালে?” 
“তুমি ডাকলে বলে !” কথাটা বলেই মাথা নাড়ে সুনন্দা, “না পায়েল। জোর করে ব্যাপারটাকে খুন বলতে চাইছ । তবে একটা জিনিস আমার মাথায় ঢুকছে না।” 
পায়েল কপালের ঘাম মুছে ব্যাগের ভিতর থেকে জলের বোতলটা বের করে এগিয়ে দিল সুনন্দার দিকে, “জল খাও । যা হাওয়া দিচ্ছে, আমারও গলা শুকিয়ে গেছে।” 
বোতলটা হাতে গিয়ে এক ঢাক জল গলায় ঢালল সুনন্দা সত্যি একটু আগের দৌড়াদৌড়িতে গলা শুকিয়ে গেছে তার। 
দ্বিতীয় ঢাক ঢালতে যাবার আগেই থেমে গেল সুনন্দা। একটা আতঙ্ক মিশ্রিত চিৎকার শোনা গেছে। বোতলটা তার হাতে দিয়ে কুয়োর স্ল্যাবের ফাঁকে চোখ রেখেছিল পায়েল । তার গলা থেকেই বেরিয়ে এসেছে আওয়াজটা । এক ঝটকায় চোখে সরিয়ে নিল সে — “নিচে কিছু একটা আছে ।” 
“কী আছে?” সুনন্দার বুকটাও দুরুদুরু করতে শুরু করেছে । 
“জানি না ।” খানিকটা পিছিয়ে এল পায়েল। সুনন্দা মনে জোর এনে কুয়োর ফাঁকের কাছাকাছি চোখটা নিয়ে গেল। হাতের বোতলটা পাঁচিলের উপরে রেখে অন্ধকারের ভিতরটা দেখার চেষ্টা করল । না সূর্যের আলোর ছটা ভিতরের লতাগুল্ম খানিকটা আলোকিত করে রেখেছে । সেখানে তাকিয়ে স্থির নীরবতা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। 
মুখ ফিরিয়ে পায়েলের দিকে তাকাল সুনন্দা! অবাক হয়ে গেল। মেয়েটা হাসছে । একটু আগে ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিল কিন্তু এখন তার রেশ মাত্র নেই তার মুখে। বরঞ্চ তার বদলে একটা পরিতৃপ্তির হাসি।
“কী হল? কিছু নেই তাতে…” হতবাক গলায় বলল সুনন্দ 
“তুমি বোতলটা খেয়াল কর। কোথায় রেখেছ?” 
বোতলটা এখনও পাঁচিলের উপরে রাখা আছে । একটু আগেই ভিতরটা দেখার সময় সেটা ওখানে রেখেছিল সুনন্দা। 
পায়েল আগের মতোই হাসতে হাসতে বলল, “যে লোক কুয়োর ধারে দাঁড়িয়ে মদ খাচ্ছে সে যদি পা পিছলে পড়ে যায় তাহলে তার হাতে ধরা গ্লাসও নিচে গিয়ে পড়বে। প্লাস পাঁচিলের উপরে কিন্তু লোকটা নিচে মানেই লোকটা পা হড়কে পড়েনি । বরঞ্চ নিচে কিছু একটা চোখে পড়েছিল তার । সেটা দেখতে গিয়েই পা হড়কে যায় বা কেউ ঠেলা মারে পিছন থেকে । আমি সিওর না। তবে এক্ষেত্রে শুধু মদ যে দায়ি নয় সেটা জানি ।” 
সুনন্দার মুখ থেকে বিস্ময়ের ভাবটা এখনও কাটেনি। সে কাটা কাটা উচ্চারণে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু নিচে কী দেখেছিল বল তো?” 
“যাই দেখুক না কেন, সেটা আর এখানে নেই ।” 
কুয়োটা ছেড়ে আবার প্রাসাদের দিকে হাঁটতে লাগল দু’জনে । একটু আগের মেঘটা এতক্ষণে নিকষ কালো হয়ে এসেছে । দূরে নারকেল আর তালগাছের মাথাগুলোতে ছাই রঙের খেলা শুরু হয়েছে । তিরতির করে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে একটা। 
“আজ রাতটা মালতীকে বলবে তুলির কাছে থাকতে?” 
“কেন? আমি থাকব না নাকি?” 
“প্লিজ। আমি একা পারব না। বিশ্বাস করো, আমার ভীষণ ভূতের ভয় !” 
“কী পারবে না?” কথাটা জিজ্ঞেস করে থেমে গেল সুনন্দা, পায়েলের দুটো কাঁধ ধরে বেশ জোর গলায় বলল, “এই মেয়ে, খুলে বল তো কী হয়েছে? আর চাবিটাই বা কীসের?” 
“মেটাফোরিকালি বলতে গেলে রহস্যের । আর আক্ষরিকভাবে বলতে গেলে একটা দরজার ।”
“কোন দরজার?” 
“এলিজাবেথ মসক্রপের সমাধির । এন্ড উই আর ব্রেকিং দ্যাট টুনাইট!” 
 * * * * * * * * * *
সন্ধ্যের দিকে আচমকা মেঘ ঘন হয়ে এল! মালতী তড়িঘড়ি গিয়ে রাতের রান্নার জন্যে পেঁয়াজ কাটতে বসেছিল । জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একবার আকাশটা দেখে নিয়েই বটি ছেড়ে উঠে পড়ল সে । লাল চাদর গায়ের উপর টেনেছে আকাশটা । একটু পরেই ঝড় শুরু হবে। শনশন করে হাওয়া দিচ্ছে । দোতলার জানালাগুলো বন্ধ করতে ছুটল মালতী । 
আজ সন্ধে থেকে তুলিকে সে নিজের কাছেই রেখেছে । সুনন্দা আর পায়েল ঘরের ভিতর ঢুকে কি নিয়ে যেন আলচনা শুরু করেছে । রাতে নাকি সবাইকে না জানিয়ে কোথায় একটা যাবে । তুলি থাকবে মালতীর কাছে। এই এক সমস্যা তার। কেউ জোর করলে সে কিছুতেই না বলতে পারে না। 
এতক্ষণ তুলি বাইরের বারান্দাতে খেলছিল । তাকে আর খেলতে দেওয়া চলবে না । বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লাগার ধাত আছে মেয়েটার । মালতী ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল বারান্দাটা খালি । তুলি নেই সেখানে। 
“তুলি… এই তুলি…” জোর গলায় তুলিকে ডাকল মালতী । ঝড়ের হাওয়া এতক্ষণে বেড়ে উঠছে। সেটাই বয়ে নিয়ে গেল ডাকটাকে । কারও সাড়া পাওয়া গেল না। 
“কোথায় গেল আবার… উফফ্” শাড়িটা কোমরে গুঁজে দু’হাতে দূরে আসা ধুলো থেকে চোখ আড়াল করে সিঁড়ির দিকে এগোলো মালতী। মেয়েটা কি তবে নিচে নেমে গেছে? 
কয়েকটা সিঁড়ি নিচে নেমে থেমে গেল মালতী। ঝড়ের মধ্যে আর একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। উপর থেকে আসছে, ছাদের দিক থেকে । কান্নার আওয়াজ — তুলির কান্নার আওয়াজ । 
দ্রুত সেদিকে ছুটল মালতী । উপরের সিঁড়ির
কাছে পৌঁছে অবাক হল সে। এই সিঁড়ি থেকে নয়, ছাদে ওঠার আর একটা বাঁকানো লোহার সিঁড়ি আছে সেখান থেকে আসছে আওয়াজটা । তবে কি সেটা দিয়ে ছাদে উঠতে গেছিল তুলি? 
লোহার ভাঙা সিঁড়িটার নিচে আসতেই তুলিকে দেখতে পেল মালতী। ভাঙা 
জায়গাটা দিয়ে নিচে পড়ে আছে মেয়েটা । আপাতত তার কান্নার শব্দ ফিকে হয়ে এসেছে । এক হাতে নিজের হাঁটুর উপরে হাত বুলাচ্ছে সে। অল্প চিরে গিয়ে রক্ত পড়ছে সেখান থেকে ।মালতী দৌড়ে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নেয়। 
“কী করছিলে এখানে?” একটা হাত হাঁটুর নিচে রেখে প্রশ্ন করে মালতী । কাটাটা খুব একটা বেশি নয় । তবে মেয়েটা মাথায় আঘাত পেয়েছে নিশ্চয়ই । 
“জামাটা…” চোখের জল মুছতে মুহতে বলে তুলি । 
লোহার সিঁড়িটা যেখানে ছাদের দরজায় গিয়ে মিশেছে সেখানে তাকিয়ে একটু অবাক হয় মালতী । সত্যি একটা জামা আটকে আছে দরজার মাথায়। হয়তো দুপুরে শুকোতে দেওয়া হয়েছিল । কোনো ভাবে ঝড়ে উড়ে এসে আটকেছে দরজার মাথায় । জামাটা নিতেই ছাদের দিকে যাচ্ছিল তুলি । সিঁড়িটা যে মাঝপথে গিয়ে ভেঙে গেছে সেটা সে আগে অন্ধকারে দেখতে পায়নি । ফলে সিঁড়ির ভাঙা ধাপটায় পা রাখতে গিয়ে নিচে এসে পড়েছে । 
“তোমাকে জামাটা কে আনতে বলেছে? বদমাইশ মেয়ে… আমাকে ডাকতে পারোনি?” মৃদু তিরস্কারের গলায় বলে মালতী । 
“ডাকতে গেলে তো জামাটা ও নিয়ে নিত !” 
“কে নিয়ে নিত?” দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করে মালতী। 
তুলি আর কিছু উত্তর দেয় না। মালতী এক মুহূর্তের জন্যে ছাদের দরজার দিকে তাকায়। অনেকক্ষণ আগে মূল সিঁড়ি দিয়ে ছাদে ওঠার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে । এই লোহার সিঁড়ি দিয়ে এ
বাড়ির কেউ ছাদে ওঠে না। তবে এদিকের দরজাটা কোনো কারণে খোলাই আছে দেখল । খোলা দরজার দিকে তাকাতেই মালতীর হৃৎপিণ্ড এক সেকেন্ডের জন্যে থেমে যায়। একটা ছায়া— অল্প টিমটিমে আলোতেও বেশ বোঝা যায় কেউ একটা সরে গেল ছাদের দরজা থেকে । এতক্ষণ যেন ওখানে দাঁড়িয়েই লুকিয়ে নজর রেখেছিল ওদের উপরে । 
“কে ওখানে?” 
কেউ সাড়া দেয় না। ঝড়ের শনশন শব্দের তেজ আরও বেড়ে ওঠে । তুলিকে নিয়ে সুনন্দার ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে মালতী।

ষষ্ঠ অধ্যায়


সন্ধেবেলার দিকটায় ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নেমেছিল । রাত দশটা পার হতে সেটা একটু থেমেছে । তবে এখনও একবারে বিদায় নেয়নি । আকাশে চাঁদ এখনও দেখা যাচ্ছে না। বরঞ্চ লালচে আভা ছড়িয়ে আছে আকাশ জুড়ে। জলের ছোয়া পেয়ে কাঁটাঝোপের ভিতর থেকে একটানা ব্যাঙের ডাক ভেসে আসছে । সেই সঙ্গে মিটমিট করে জ্বলছে জোনাকি। জমিদারবাড়ির থাম, দেওয়াল আর ছাদ রাতের বুকে শুয়ে আছে জোনাকির আলো মেখে। সব কিছু আশ্চর্যরকম নিস্তব্ধ । গোটা এস্টেটটা গভীর ক্লান্তির ঘুমে ঢলে পড়েছে । 
হঠাৎ জমিদারবাড়ির দিক থেকে ভেসে আসা একটা শব্দে এই নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে গেল। চাতালের মাঝে জমে থাকা জলের উপর পায়ের আওয়াজ । একটা নয় দুটো ।
 হঠাৎ জমিদারবাড়ির দিক থেকে ভেসে আসা একটা শব্দে এই নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে গেল। চাতালের মাঝে জমে থাকা জলের উপর পায়ের আওয়াজ । একটা নয় দুটো । 
অন্ধকারের মধ্যে একটা নারীমূরতিকে দেখা গেল। তার মাথা থেকে পা অবধি কাপড়ে ঢাকা । সন্তর্পণে মাথা থেকে ঢাকাটা সরিয়ে ফেলল সে। চোখের মণি দুটো সাদা হয়ে জ্বলছে । না মণি নয়, জ্যোৎস্না এসে পড়েছে তার রিমলেশ চশমার কাচে । সেই আলোই প্রতিফলিত হচ্ছে । পিছন ফিরে সে বলে, “আজ কি না হলেই নয়? কাদার উপরে আছাড় খেলে আর রক্ষে থাকবে না।” 
এবারে পিছন থেকে আর একটি নারীমূরতিকে দেখা গেল। একটা জ্বলন্ত সিগারেট ধরা আছে তার ঠোটে। সেই আলোতেই মুখের একটুখানি অংশ চোখে পড়ছে । ধীর পায়ে জল পাড়িয়ে এগিয়ে এল সে, “আজ বৃষ্টি হওয়ায় একটু ঠান্ডা পড়েছে । সহজে লোকের ঘুম ভাঙবে। দিস ইজ আইডিয়াল ।” 
“আর জামাকাপড়ে কাদা লাগলে কাল তুমি পরিষ্কার করবে !”
“বেশ করে দেব । চল এখন। এই জায়গাটা সেফ না।” 
আর আপত্তি করে না সুনন্দা। দেখে শুনে পা 
চালায় । মনটা মোটেই ভালো নেই তার । একে সারাদিন ধকল গেছে, তার উপরে এই রাতবিরেতে অচেন জায়গায় চোরের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে কবর খুঁড়ে বের করা। এসব করতে হবে জানলে সে এ বাড়িতে থাকতেই আসত না। নীলাদ্রিকে এসব কথা জানানো হয়নি । জানালে লাভের থেকে ঝামেলা হবে বেশি । পরশুর আগে সে ফিরছে না। ফিরলে একেবারে সামনা-সামনি না হয় বলা। 
পায়েল আজ রাতের আগে দেখা দেয়নি । নিজের ঘরে গিয়ে নাকি পড়াশোনায় মন দিয়েছিল । অন্যবার এখানে এসে নিরিবিলিতে তার পড়াশোনা ভালো হয় । এবার কিছুই হয়নি । 
আজ তুলির সঙ্গে দাবা খেলতে খেলতে অনেকগুলো নতুন ভাবনা খোঁচা দিচ্ছিল সুনন্দার মাথায় । বেশ কয়েকটা নতুন সম্ভাবনা । এমনও তো হতে পারে যে চারটে লোক এ বাড়িতে মারা গেছে তাদের মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে । আপাত দৃষ্টিতে দেখলে অবশ্য সেটা থাকার কথা নয়, কারণ চারজন চার রকমভাবে চার জায়গায় মারা গেছে । প্রথমজন যখন মরেছে তখন শেষ জনের জন্মই হয়নি । সমস্ত ঘটনাটা একেবারে শুনলে মনে হয় আড়াল থেকে যেন একজন মানুষই কলকাঠি নাড়ছেন । কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে সেই লোকটার বয়সও অন্তত আশি-পাঁচাশির কম হওয়ার কথা হয় । তেমন বৃদ্ধ কেউ তো এ বাড়িতে নেই । তাহলে কে? 
“আরে, দেখে চলো । পড়বে তো ।” 
এইসব ভাবতে ভাবতে অসাবধানে একটা গর্তে পা রেখে হাচট খেয়ে টলে গেছিল সুনন্দা। পায়েল হাত বাড়িয়ে খপ করে ধরে নিল তাকে । 
সামনেই সিকিউরিটি গার্ডের ঘর । তার পাশেই সদর দরজা । তার উপরে এখন একটা বড় তালা ঝুলছে । সেটার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে সুনন্দা বলল, “ওই চাবি তো জোগাড় করেছ । এটার কী হবে?” 
পায়েলকে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চিন্তিত দেখাল। তারপর সেইরকম ভাবুক মুখেই বলল,
“একটাই প্ল্যান মাথায় আছে ।” 
“কী প্ল্যান?” 
“উঁহু, আমার না, তোমার মাথায় । ক্লিপটা দাও তে ।” 
“ক্লিপ!” মুহূর্তে অবাক ভাবটা কমে যায় সুনন্দার, “বুঝেছি। ওইটা কেঁকিয়েই চাবি বানিয়ে তালা খুলবে?” 
“হ্যাঁ, দাও তাড়াতাড়ি । আর লক্ষ রাখো ভোঁদড়টার ঘুম যেন না ভাঙে ।” 
“আর ভেঙে গেলে?” 
“ভাঙবে না। এমনি কি আর বৃষ্টির দিনে বের হয়েছি?” 
অগত্যা মাথা থেকে একটা ক্লিপ খুলে পায়েলের হাতে দিল সুনন্দা। বেশ থানিকটা চুল মাথার উপর থেকে কানের পাশে চলে এল তাতে। সে সাবধানে এগিয়ে এসে গার্ডটার মুখটা একবার ভালো করে দেখল। ঘড়ঘড় করে নাক ডাকার শব্দ আসছে । মুখটা হাঁ করে ঘুমাচ্ছে লোকটা! হাতের পাশেই একটা বড়সড় লাঠি পড়ে আছে। 
ওদিকে পায়েল ক্লিপটাকে বাঁকিয়ে-চুরিয়ে তালার ভিতরে ঢুকিয়ে কসরত শুরু করেছে । দরজার ঠিক উপরেই একটা নীলচে কম পাওয়ারের আলো জ্বলছে। তাতে ভালো করে তালাটা দেখতে পাচ্ছে না সে। 
“তোমার মোবাইলে টর্চ নেই?” সুনন্দা ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল। 
“আছে, কিন্তু সাইলেন্ট করা নেই । লক খুলতে গেলে আওয়াজ হবে জোরে । ভোঁদড় উঠে পড়বে ।” 
আর কিছু না বলে চশমাটা ভালো করে চোখের উপরে বসিয়ে নিল সুনন্দা। এবারে মেয়েটা হতাশ হয়ে ফিরে গেলেই ভালো। 
ক্লিপটা মুঠো করে ধরে উঠে পড়ল পায়েল । চারপাশে তাকিয়ে কিছু একটা আলো খুঁজতে লাগল। চোখে পড়ল থামের ভিতরে জ্বলতে থাকা মশালটা। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে আংটা থেকে সেটা খুলে নিল পায়েল। তার শিখাটা ঠান্ডা
হাওয়ার ঝাপটায় কেঁপে কেঁপে উঠছে । আগের মতোই সাবধানে ফিরে এসে সেটা সুনন্দার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এটা দেখাও এদিকে । আর গার্ডের দিকটা আড়াল করে দাঁড়াও । ওর মুখে যেন আলো না পড়ে ।” 
“একটা টর্চ আনতে পারলে না?” বিরক্ত হয়ে বলে সুনন্দা। 
“টর্চ আমার কাছে নেই । মধুদার কাছে ছিল কিন্তু চাইতে গেলে কিছু 
একটা সন্দেহ করবে।।” 
“আমাকে আগে বলতে পারতে মোমবাতি ছিল আমার কাছে?” 
পায়েল দাঁত দিয়ে ক্লিপ কামড়াতে কামড়াতে বলে, “বছর পয়তিরিশের মহিলা। মাঝরাতে মোমবাতি হাতে পুরনো কবরস্থানে ঘোরাঘুরি করছে । তোমার প্রোফাইলটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াত বুঝতে পারছ?” 
“সব তোমার পাল্লায় পড়ে ।” 
“অন দ্যা কন্ট্রারি তুমি আমাকে কবরস্থানে নিয়ে গেছিলে । আমি আগে যাইনি ।” 
“আমি কবরস্থানে যেতে বলেছিলাম, তালা খুলে একেবারের সমাধির ভিতরে ঢুকতে বলিনি ।” 
খুট করে একটা শব্দ করে খুলে যায় তালাটা। পায়েল সেটা আংটা থেকে সরাতে সরাতে বলে, “সেটা যে করতে বলেছে তার নামটাই জানতে ইচ্ছা করছে খুব।” 
মশালটা আবার আংটায় রেখে গেটে তালাটা আলতো করে ঝুলিয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে দু’জনে । সুনন্দা পা চালাতে চালাতে বলে, “তা বিদ্যেটা শিখলে কোথা থেকে?” 
“কোন বিদ্যে? তালা খোলা?” 
“হ্যাঁ।” 
“ইউটিউব দেখে ।” 
“তাহলে এই চাবিটা এত কষ্ট করে জোগাড় করার কী ছিল?” 
“মসোলিয়ামের সামনে যেটা ঝুলছে সেটা মামুলি তালা নয় । শতাব্দী প্রাচীন প্যাডলক ।
সেটা খুলে ফেলা চুলের ক্লিপ দিয়ে সম্ভব নয় । তাছাড়া…” 
“তাছাড়া কী?” 
“চাবিটা শুধু তালাটা খোলার জন্যে না। এটা সম্ভবত একটা সংকেত। আমাদের চাবিটা দিয়ে বলতে চাওয়া হয়েছে যে মসোলিয়ামটা খুললে কিছু একটা পাওয়া যাবে। 
দু’জনে বেশ কিছুদূর হেঁটে আসে। রাস্তার পাশের লাইটপোস্টগুলো তেমন জোরালো নয় । সরু ফুটপাথ আলোছায়ায় ঢেকে আছে । রাস্তা দিয়ে দ্রুত গাড়ি ছুটে গেলেও দুটি নারীমূরতিকে দেখতে পাবার কথা নয় । হাঁটতে আরামই লাগে সুনন্দার । পথ বেশ নরম। কদিন গরম পড়ার পড়ে আজ রাতের ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লেগে জুড়িয়ে দিচ্ছে শরীরটা । 
আবার হোঁচট খেতে যাচ্ছিল সুনন্দা । পায়েল তার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “তুমি আজ এত কী ভাবছ বল তো?” 
“ভাবছি এই চারজনের আগেও হয়তো এ বাড়িতে অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে” 
“মধুবাবু সেদিন একটা কথা চেপে গেছিলেন আমাদের কাছে । হয়তো একটু বেশি ভায়োলেন্ট বলেই আমাদের মন ভারাক্রান্ত করতে চাননি ।!” 
“কী কথা?” 
“ভূপতি দত্ত বিছানায় শুয়ে মারা যাননি! ভূপতির শেষ বয়সে টিবি হয়! তাতেই মৃত্যু হয় তার । ফলে জমিদারী দেখাশোনার দায়িত্ব এসে পড়ে নৃপতির ঘাড়ে । তিনি খুব একটা সুবিধের লোক ছিলেন না। খাজনার জন্যে লুটপাট, জেনোসাইড এসবের জন্যে কৃষকরা এমনিতেই ক্ষেপে ছিল । শেষে একদিন মাঝরাতে একদল গ্রামবাসী চড়াও হয়ে তার স্ত্রীকে ধর্ষণ ও নৃপতি দত্তকে, সাদা বাংলায় যাকে বলে জবাই করে । জবাই বোঝো?” 
মাথা নাড়ে সুনন্দা, তারপর বলে, “ছুরি দিয়ে কুপিয়ে খুন?” 
“উঁহু, সে তো তাংক্ষণিক ব্যাপার । জবাই করা হয় অনেকটা ধীরে সুস্থে। হয় বাঁধা থাকে, নাহলে
কেউ হাত চেপে ধরে, কেউ পা চেপে ধরে । তারপর একজন ছুরি বা চপার নিয়ে এসে একটু একটু করে কাটে । সোজা কথায় জবাইয়ের একটা বিল্ড-আপ আছে ।” 
“মানুষ কত নৃশংস ছিল তখন!” থমথমে গলায় বলে সুনন্দা। 
“ভূপতির জেনারেশানকে যতটা ব্যাকডেটেড ভাবছ ততটা নয় । ভূপতি দত্ত রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা দ্বারকানাথের কনটেম্পোরারি। আর আমাদের কন্দর্প দত্ত 
যদি আর একটু দক্ষিণে জন্মাতেন তাহলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে চা খাবার একটা সুযোগ ছিল তার!” 
“তুমি এত কিছু জানলে কী করে? ইউটিউব দেখে?” 
“আজ সন্ধ্যেয় পড়ছিলাম এসব!” 
“ও হরি!ইংরাজি পড়ার নাম করে আসলে এইসব পড়ছিলে তার মানে?” 
“ভাষাও তো ইতিহাসেরই একটা অংশ!” 
খানিক দূর হেঁটে এসে চার্চের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল দু’জনে । এখানে একটা দরজা আছে বটে তবে তালা নেই । চার্চের দরজায় তালা ঝোলানো বেআইনি । পায়েল ফিসফিস করে বলল, “ডাক্তার, ডোম আর ভগবান এদের অফিস বন্ধ করার জো নেই । কার যে কখন দরকার পড়ে ।” 
“অফিসে লোক থাকলেই মুশকিল !” 
নেই বলেই তো মনে হচ্ছে । অন্তত এত রাতে ‘লোক’ থাকাটা অফচান্স। তাও ধরা পড়ে গেলে কিছু একটা বাহানা রেডি রেখো ।” 
“রাত-বিরেতে লোকের কবর খুঁড়তে আসার কোনো বাহানা হয় না পায়েল। এসাইলাম থেকে কী করে পালালাম সেটার একটা গল্প শোনাতে হতে পারে বরং।” 
“তাই শুনিও না হয় ।” কথাটা বলে দরজাটা একটু ফাঁক করে ভিতরের দিকে পা বাড়ায় পায়েল । ক্যাঁচ করে দরজা খোলার আওয়াজ হয় একটা ।
পায়েল নিচু হয়ে ভালো করে চারপাশটা একবার দেখে নেয় । না কাউকে চোখে পড়ছে না। চার্চের কম্পাউন্ডের সামনেটায় একটা টিউব জ্বালানো আছে । তাতে আলোকিত হয়ে উঠেছে চার্চের সামনেটা । এতদূর আসার প্রশ্নই ওঠে না। 
সুনন্দাও ঢুকে আসে পায়েলের সঙ্গে সঙ্গে । এতক্ষণে মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ বেরিয়ে এসেছে । সেদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে পায়েল বলল, “আজ ফুলমুন দেখছি। ভালোই হল!” 
“এবার তো মোবাইল জ্বালাতে পারবে। ফুলমুনের কী দরকার?” 
“উঁহু, আলোর জন্যে নয়। পূর্ণিমা রাতে ওয়্যার-উলফরা শিকার ধরতে বেরোয়। কিন্তু ঈশ্বরের এলাকা বলে তারা চার্চের ভিতর ঢুকতে পারে না! ‘আমরা চার্চের আশেপাশে আছি মানে বিপদ নেই !” 
“যত্তসব, কাজ নেই আর খেয়েদেয়ে…” মুখ বেঁকায় সুনন্দা । 
ছপছপ করে কাদার উপরে পায়ের আওয়াজ হচ্ছে । একটু দূরে ফণীমনসার ঝোপ থেকে ঝিঁঝিঁ ডেকে চলেছে একটানা। কয়েক ফোটা জল এসে পড়ল সুনন্দার গায়ে । গায়ের রেনকোটটা ভালো করে জড়িয়ে নিল সে। এই বিরাট কবরস্থানে বৃষ্টি এলে দাঁড়িয়ে যেতে সমস্যা হবে না কিন্তু তেমন বৃষ্টি হলে এদিকটায় জল দাঁড়িয়ে যেতে পারে । বাড়ি ফেরাটা মুশকিল হবে। কেন যে পায়েলের পাল্লায় পড়ল… 
চার্চটাকে পাশ কাটিয়ে জমির উপর দিয়ে এগিয়ে এল দু’জনে । এদিকটায় আলো অপেক্ষাকৃত কম! সামান্য আলোর হেরফেরে কবরস্থানের চেহারা কতটা পালটে যেতে পারে সেটা না দেখলে বিশ্বাস করতে পারত না সুনন্দা! 
মোবাইলের আলোটা জ্বেলে সেটা নিচু করে ধরে সমাধিগুলোকে পাশে ফলে কবরস্থানের শেষের দিকে হেঁটে গেল ওরা । মাটিতে দেখেশুনে পা ফেলতে হচ্ছে । একে জায়গাটা কাদায় পিছল হয়ে আছে তার উপরে মাটিতে পড়ে থাকা
ডালপালা যে কোনো সময় পায়ের উপর আঁচড় কাটতে পারে । চাঁদ আর মোবাইলের সাদা স্তিমিত আলোই একমাত্র ভরসা । 
বেশ কসরত করে মসক্রপ পরিবারের মসোলিয়ামের সামনে আসতে আধঘণ্টা লেগে গেল ওদের। রেডিয়াম ডায়ালের ঘড়িতে সময় দেখল পায়েল । রাত সাড়ে এগারোটা হয়েছে সবে। এর মধ্যেই গোটা এলাকাটা মরার মতো ঘুমে ডুবে গেছে । 
এক’পা এক’পা করে কাদার উপরে পা দিয়ে মসোলিয়ামের দরজার সামনে চলে এল পায়েল। একটু ইতস্তত করে সুনন্দাও পা বাড়াল। 
ছোট গ্রানাইটের ঘরটাও যেন গোটা চকদীঘি গ্রামের মতোই ঘুমিয়ে আছে। শুধু তার ঘুমটা একটু দীর্ঘ। অন্তত দু’শো বছর ধরে ঘুমের আড়ালে কিছু 
একটা রহস্য লুকিয়ে রেখেছে সে। 
“ভয় লাগছে নাকি?” সুনন্দার দিকে তাকিয়ে সরু গলায় জিজ্ঞেস করে পায়েল। 
“হু, তবে ভুতের না। কেউ দেখে ফেললে ঝামেলা হবে সেই ভয় !” 
পকেট থেকে চাবিটা বের করে পায়েল । সেই সঙ্গে একটা সাঁড়াশির মতো দেখতে যন্ত্র। সুনন্দা অবাক হয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে বলে, “ওটা কী হবে?” 
“মসোলিয়াম সাধারণত সিল করে দেওয়া হত। সেটা হাত দিয়ে খোলা যাবে বলে তো মনে হয় না। আলোটা ধরো তো দেখি।” 
সুনন্দা আবার আলোটা জ্বেলে তালাটার উপরে ধরে। চারপাশটা আর একবার দেখে নেয় । যদিও আলোটা জোরালো নয় আর চার্চের এদিকটায় কোনো জানালা নেই । তাও কেউ দূর থেকে তাকালে দেখতে পাবে আলোটা। 
মোটা চেনগুলোর সঙ্গে জড়ানো আছে তালাটা । যেন দু’টো মানুষেরই হাত মসোলিয়ামের দু’পাশ থেকে বেরিয়ে এসে ঘিরে রাখতে চাইছে দরজাটাকে ।
তালার ভিতরে চাবি ঢুকিয়ে কিছুক্ষণ খুটখুট করল পায়েল । তালা এত সহজে খোলার নয় । হঠাৎ সুনন্দার মনে হয় তাদের ঠিক পিছনেই যেন কেউ এসে দাঁড়িয়েছে । গাছের ডালপালার উপরে পায়ের আওয়াজ হতেই সে ফিরে তাকালো ! আলোটা ঘুরে গেল সেদিকে । 
নাঃ নেই । আগের মতোই খাঁখাঁ করছে কবরস্থানটা । দূরে চার্চের আলোটা আর দেখা যাচ্ছে না এখানে থেকে । একটু দূরে পাশের সমাধির পিলারটা এখনও আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে ঠায়। তাহলে কার পায়ের আওয়াজ শুনলো এক্ষুনি? মনের ভুল? 
আলোটা ঘুরে যেতে একটু বিরক্ত হল পায়েল, “আরে কী হল? প্রায় কায়দা করেই ফেলেছি।” 
আরও মিনিট তিনেকের চেষ্টার পরে বেশ জোর করে ঘড়াং করে একটা আওয়াজ করে খুলে গেল তালাটা। পায়েল হাত দিয়ে টেনে চেনগুলো দু’পাশে সরিয়ে দিতে দরজাটা চোখে পড়ল! যেখানে চেনগুলো ঝুলে ছিল তার চারপাশে বেশিরভাগটা ধুলো আর শ্যাওলায় ঢেকে গেছে। তার নিচে আবার এলিজাবেথ মসক্রপের নামটা লেখা। পায়েল কিছুক্ষণ ভুরু কুচকে সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “একলা মানুষের জন্যে মসোলিয়াম বানানো হয় না। মেয়েটার বাবা মা
কীভাবে মারা গেল কে জানে ।” 
তালাটা যেখানে ঝুলছিল তার ঠিক নিচেই একটা লোহার কড়া লাগানো। দরজার দুটো পাল্লাকে একসঙ্গে ধরে রেখেছে সেটা । হাতের যন্ত্রটা বের করে সেটার নিচে একবার ধরল পায়েল। তারপর একটা বড়সড় নিশ্বাস নিয়ে চাপ দিল তাতে। কোনো নড়চড় হল না। জং ধরে শক্ত হয়ে এঁটে গেছে সেটা! 
সুনন্দা একটু নিচু স্বরে বলল, “পায়েল, পরে একদিন আসা যাবে না হয়। আজ ফিরে চল!” 
“তুমি এত বেকুবের মতো ভয় পাচ্ছ কেন বলতো?” পায়েল আংটায় চাপ ! 
দিতে দিতে দম ধরা গলায় বলল! 
“কি জানি, মন বলছে যা হচ্ছে তাতে কারও ভালো হবে না। এতদিন আগের একটা ব্যাপার । সেটা নিয়ে আমরা নাই বা টানা ইেচড়া করলাম। সেই সময় যা ঘটেছিল তাতে যেই দায়ি থাক না কেন সে আজ বেঁচে নেই।” 
“আর শশিভূষণ সরকার? তার খুনটা তাহলে হল কী করে?” 
“খুন যে হয়েছে সেটা আমাদের ধারণা। এমনও হতে পারে ভদ্রলোক সত্যি 
সুইসাইড করেছিলেন । আমরা অকারণেই অন্ধকারে টিল ছুড়ছি ।” 
“মানে তুমিও স্বীকার করছ আমাদের চারপাশে এমন একটা কিছু আছে যেটা অন্ধকার । এই জমিদারবাড়িকে জড়িয়ে কিছু একটা লুকিয়ে রাখা আছে । সেটা যদি থাকতে পারে টিল ছুড়তে অসুবিধা কোথায়?” 
সুনন্দা আর কিছু না বলে একটু পিছিয়ে দাঁড়াল । একটা ইেচকা টানে আংটাটা তুলে আনল পায়েল। তারপর একটা পায়ে ভর দিয়ে আর একটা পা সামনে রেখে দু’হাতে ঠেলা দিল শ্বেতপাথরের ফলক করা দরজাটায় । সুনন্দা এসে হাত লাগালো । 
খানিক ঠেলাঠেলির পর একদিকের পাল্লাটা আড় হয়ে খুলে গেল। বাইরে থেকে মোবাইলটা
দিয়ে ভিতরে আলো ফেলল সুনন্দা । প্রথমটা প্রায় কিছুই দেখা গেল না। তারপর একটু একটু করে ভিতরের খানিকটা পরিষ্কার হল তাদের চোখের সামনে । 
ভিতরের সব জায়গাটা মিলিয়ে তিন স্কোয়ার মিটারের মতো একটা ঘর । তার সমস্তটাই শ্বেতপাথরে বাধানো । মাকড়সার ঝুল উপর থেকে নিচ অবধি মশারির মতো ছেয়ে রয়েছে। ভিতরে একসঙ্গে দু’জনের বেশি মানুষের দাঁড়াবার জায়গা নেই । 
মুখ বাড়িয়ে একবার ভিতরটা দেখে নিয়ে পাল্লাটা পেরিয়ে এল পায়েল। 
সুনন্দার হাত থেকে আলোটা নিয়ে সেটা মেঝের দিকে ফেলল। পুরু ধুলোর আস্তরণে ঢেকে আছে মেঝেটা । 
দু’খারে মেঝে যেখানে শেষ হচ্ছে সেখান থেকে কফিন ঢোকানোর জন্যে ছোট ছোট থাক করা আছে । মোট তিনটে থাক । দুটো বাঁদিকের দেওয়ালে একটা ডানদিকের দেওয়ালে । থাকগুলো শেষ হতেই দু’দিকের দেওয়ালে তিনটে করে মোট ছ’টা খুপরি করা আছে । পায়েলের হাতের আলো গিয়ে পড়তে দেখা গেল সেই খুপরির ভিতরে কতগুলো দলা পাকানো নষ্ট হয়ে যাওয়া হাত-পা ভাঙা পুতুল। 
“এগুলো সম্ভবত এলিজাবেথ মসক্রপের খেলনা। বাচ্চা মরে গেলে তার 
প্রিয় খেলনাগুলো রেখে দেওয়া হত মসোলিয়ামের ভিতরে । পিরামিডের ইনফ্লুয়েনস বলতে পারো ।” 
পুতুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতরটা ছ্যাত করে উঠল সুনন্দার। একসময় একটা বছর পাঁচেকের বাচ্চামেয়ের খেলার সাথী ছিল সেগুলো। কয়েকশো বছর ধরে ওভাবেই পড়ে আছে অন্ধকারে । কেউ খেলে না তাদের নিয়ে। এলোমেলো চুল, স্থির ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে আছে সুনন্দার দিকে! 
উবু হয়ে নিচের একটা থাকের সামনে বসে
পড়ল পায়েল । তারপর গলাটা অনেকখানি নিচে নামিয়ে বলল, “এগুলো হল ক্রিপ্ট । এর ভেতরে ঢোকানো হয় কফিনগুলো । আজীবন ধরে এই ক্রিপ্টের মধ্যেই থেকে যায় তারা !” 
“তার মানে এখানে তিনটে মৃতদেহ আছে?” 
“উঁহু, তার মানে মসক্রপ পরিবারের মোট সদস্য তিনজন । বাবা মা আর একটি মেয়ে ।” 
“কিন্তু মেয়ে মসক্রপ তা…” 
“আপাতত ধরে নাও পুনর্জন্ম হয়েছে অ্যাজ লীলাবতী দত্ত । আমার গ্রেট গ্যান্ড মাদারের গ্রেট গ্যান্ড মাদারের উত্তরজন্ম আমার সামনে । ইটস গেটিং স্পুকি।” 
কথাটা বলে একটু হাসল পায়েল। তারপর আলোটা একবার ঘোরালো চারিদিকে । দরজার ঠিক উলটোদিকে একটা মিটার দুয়েকের দেওয়াল। দু’পাশে ক্রিপ্ট থাকায় তার অল্প খানিকটা চোখে পড়ে । সেখানে শ্বেতপাথরের উপরে রঙিন পাথরের কাজ করা আছে । সেদিকে এগিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ চোখ মেলে কিছু খোঁজার চেষ্টা করে । শেষে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, “ক্রিশ্চানদের রীতি অনুযায়ী যেখানে একটা বাচ্চামেয়ের সমাধি আছে সেখানে বিশেষ কিছু সিমবল্ থাকার কথা। ভেড়া, ক্রস, হার্ট কিন্তু তার বদলে এখানে যা দেখতে পাচ্ছি সেগুলো খুব একটা সুবিধের নয় !” 
“কী দেখতে পাচ্ছ?” 
দেওয়ালের দিকটায় সরে আসে সুনন্দা। তার নিঃশ্বাস পড়ছে এখন পায়েলের কাঁধে। 
দেওয়ালের ঠিক মাঝ বরাবর একটা বড় গোল করা। তার ভিতরেই খোদাই করা আছে চিহ্নগুলো । কয়েকটা পাখির মুখ, গুল্ম লতা ভালো করে তাকিয়ে একটা চিহ্ন দেখে একটু অবাক হল সুনন্দা। বিড়বিড় করে বলল, “একটা ড্রাগনও আছে দেখছি।” 
পরক্ষণেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “চল, এবার ফেরা যাক।” 
“ফিরব!” বিস্ময়মাখা গলায় বলল পায়েল,
“এখনও তো আসল কাজই করা হয়নি ।” 
“কী কাজ?” 
আর উত্তর না দিয়ে মাটির উপরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল পায়েল। তারপর আবার আলোটা সামনে ধরে ক্রিপ্টগুলোর উপরে কিছু একটা খুঁজতে লাগল। 
“কী খুঁজছ বলতো তুমি?” ‘ 
“একটা চিহ্ন । বাইরে যেটা ছিল । লোটাস উইথ থ্রি পেটালস ।” 
কথাটা বলেই হাতের আলোটা একটা ডানদিকের ক্রিপ্টটার একদম নিচের দিকে নিয়ে গেল সে। তার মুখে একটা হাসির রেখা খেলে গেল। 
“অ্যাণ্ড হিয়ার ইট ইজ ।” 
সুনন্দাও মাটির উপরে বসে পড়ে দেখল ক্রিপ্টের গায়ে সত্যি খোদাই করা আছে চিহ্নটা! একটা ছোট গোলের ভিতরে একটা তিন পাপড়ির পদ্ম । 
“খুলতে হবে এটা!” 
“কী খুলবে?” অবিশ্বাসের গলায় জিজ্ঞেস করে সুনন্দা। 
“কী আবার, এই ক্রিপ্টটা । এর জন্যেই এত ঝামেলা করে এখানে আসা !” 
“তুমি কি খেপেছ? আর কিছু না মানো অন্তত মৃত মানুষের প্রতি একটু তো সম্মান দেখাও।” 
“এর ভিতরে কোনো মৃত মানুষ নেই সুনন্দাদি । ভিতরে যা আছে সেটাকে রক্ষা করার জন্যেই কেউ বানিয়েছিল এই ক্রিস্টটা ।” 
“যদি থাকে? তাহলে কী হবে?” 
“অন্তত গ্রেভ ডিগিং-র জন্যে তোমাকে পৈতে ছিঁড়ে অভিশাপ দেবে না।!” 
রাগ মাথায় উঠে গেল সুনন্দার, সে হিসহিসে স্বরে বলল, “সমস্ত ব্যাপারটা তোমার কাছে মজার? তাই না? দেখ, এসব তোমাদের বংশের ব্যাপার তুমি বুঝবে। আমাকে একটা বাচ্চামেয়ের দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার বেশি কিছুতে জড়াতে চাই না আমি ।”
“বেশ, জড়িও না। আমি তো জোর করিনি তোমাকে ।” 
শান্ত গলায় কথাটা বলে আবার ক্রিপ্টের দিকে মন দিল পায়েল। সুনন্দা কী করবে বুঝতে পারল না। এই অবস্থায় পায়েলকে এখানে ফেলে ফিরতে ভয় করছে তার । একটু আগে যেভাবে জোর গলাতে কথাটা বলেছে তাতে খানিকটা ভয় তার নিজেরও লাগছে । কয়েক সেকেন্ড সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে একটুখানি বাইরের দিকে সরে এল সুনন্দা। মুখে বলল, “বেশ, তোমার যা করার আছে করে নাও ! একসঙ্গেই ফিরব !” 
আর কোনো উত্তর পাওয়া গেল না।! মসোলিয়ামের ভিতরটা ঘুপচি। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে শ্বাস আটকে আসে। একটু আগের লোহার যন্ত্রটা নিয়ে চাড় দিয়ে ক্রিপ্টের শ্বেতপাথরের আবরণটা সরিয়ে ফেলে পায়েল! ভিতরে কোনো নাম লেখা নেই । একটা ভ্যাপসা গন্ধ এসে লাগে তার নাকে । সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে আসে সে। 
একেই নিঃশ্বাসের অসুবিধা তার উপরে বিশ্রী গন্ধ । কপালের জমা ঘাম রূমাল দিয়ে মুছে নেয় । বড় কয়েকটা নিশ্বাস নেয় । একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে সুনন্দা!মাঝে মাঝে পায়চারি করছে । তার শরীর জুড়ে একটা ছটফটানি ভাব। পায়েল তার থেকে অনেকটা শান্ত । 
কিছুক্ষণ পরে ঘড়িতে সময় দেখে আবার ভিতরে ঢুকে আসে পায়েল। গদ্ধটা এতক্ষণে একটুখানি কমে এসেছে। আবরণটা সরিয়ে রাখা আছে একপাশে । 
আবার মেঝের উপরে বসে পড়ে সে। আলোটা ভিতরের দিকে ফেলে দেখতে পায় কফিনটা। তার গায়ে কোনো হাতল নেই । সাবধানে সেটাকে চেপে ধরে একটু একটু করে টেনে বাইরে আনে পায়েল। ধুলোর উপর দিয়ে 
ঘসঘস করে আওয়াজ হয় একটা । কফিনটা খুব একটা ভারী নয় । ভিতরে তেমন কিছু নেই তা বোঝা যায় । মৃতদেহও যদি রাখা হয়ে থাকে এত বছর পরে তার আর ওজন থাকার কথা নয়।
একটা ক্ষীণ যন্ত্রণা শুরু হয়েছে পায়েলের মাথায় । যেন বহু দূর থেকে কেউ বাঁশি বাজাতে শুরু করেছে । বাজিয়েই চলেছে একটানা। সুরের মধ্যে কিছু কথা লুকিয়ে আছে যেন। কেউ কি কিছু বলতে চায়? 
মাথায় একবার হাত রেখে যন্ত্রণাটা কোথায় বোঝার চেষ্টা করে পায়েল। মনে হয় আর একটু পরেই সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে । ইচ্ছা করে গলা তুলে একবার সুনন্দাকে ডাকতে কিন্তু পরমুহূর্তেই সংবরণ করে নিজেকে । 
কফিনের ডালাটা একটা আংটায় আটকানো ছিল । সেটায় জং ধরে গেছে । হাতের যন্ত্রটা সেখানে গলিয়ে জোরে চাপ দেয় পায়েল। সেটা খোলে না। চড়চড় করে একটা আওয়াজ শোনা যায় শুধু । অদম্য জেদ পায়েলের ক্লান্ত শিরায় আচমকাই অমানুষিক শক্তি এনে দেয় । আবার আংটায় জোরে চাপ দেয় সে। এবার অন্য একটা আওয়াজ! জং ধরা হুকটা খুলে গেছে । সেটা 
ভেঙে নিচে পরে যায় । ডান হাত দিয়ে ডালাটা ধরে সেটা খুলে ফেলে । আলোটা এখনও পড়েনি কফিনের ভিতরে । কিছু দেখা যায় না সেখানে । 
মোবাইলটা তূলে ধরে কফিনের ভিতরে আলো ফেলে পায়েল। সঙ্গে সঙ্গে সে চমকে ওঠে। 
না। তার আন্দাজ মেলেনি । কফিনের ভিতরে শোয়ানো আছে একটা শেষ হয়ে প্রায় মিলিয়ে
আসা ফুট চারেক হাড়ের কাঠামো। 
যেহেতু সেটা কফিনের মধ্যে ছিল তাই মানুষ বলে ধরে নেওয়া যায় তাকে! তবে আকৃতি দেখে এও বোঝা যায় সেটা পূর্ণবয়স্ক মানুষের না। কোনো বাচ্চার । একটা খুলি, মাটিতে নুয়ে পড়া পাঁজরা আর হাঁটু অবধি পা!। 
পায়েলের মাথার যন্ত্রণাটা এখন তীব্রভাবে বেড়ে উঠেছে। আর দূরে নয়, খুব কাছ থেকেই যেন কেউ ডাকছে তাকে । মসোলিয়ামের ভিতরের অন্ধকার চিরে ক্রমে ফুটে উঠছে একটা লাল আলো। মিলিয়ে যাচ্ছে পরক্ষণেই । 
কোমর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাটিতে পড়ে যাবার আগেই কফিনের ভিতরে আর একটা জিনিস চোখে পড়ে পায়েলের। তার মুখ দিয়ে একটা চিৎকার বেরিয়ে আসে। প্রাণপণে শব্দ করে সুনন্দাকে ডাকতে চায় সে। 
চিৎকারটা শুনেই সুনন্দার শরীরে একটা শিহরণ খেলে যায়! সে প্রায় এক নিঃশ্বাসে দৌড়ে এসে দাঁড়ায় ছোট ঘরটার ভিতরে । 
পুতুলগুলো যেন ভয়ার্ত চোখে এখন চেয়ে আছে মাটির দিকে । সেদিকে 
তাকিয়েই পায়েলকে মেঝের উপরে পড়ে থাকতে দেখল সুনন্দা। সামনেই পড়ে থাকা কফিনটার ডালা খোলা। সুনন্দার নার্ভগুলো শিথিল হয়ে আসছিল। তাও কোনোরকমে কফিনের ভিতরে চোখ দেয় সে। 
বাচ্চার দেহাবশেষটা চোখে পড়ে । সেই সঙ্গে অন্য জিনিসটাও । নিচু হয়ে কীপা-কাঁপা হাতে সেটা তুলে নিয়ে আলোর কাছে ধরে সুনন্দা। একটা খাতা! খুব সম্ভবত একটা ডায়েরি। 
সাবধানে দু-একটা পাতা উলটেই বুঝতে পারে সুনন্দা। পুতুলের সঙ্গে সঙ্গে এটাকেও কবর দেওয়া হয়েছিল মৃত মেয়েটার সঙ্গে । তবে আলাদা করে নয়! কফিনের ভিতর, মালকিনের সঙ্গেই-এলিজাবেথ মসক্রপের ডায়েরি।


সপ্তম অধ্যায় 

সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙতে বিছানার উপরে উঠে বসল তুলি । কি সুন্দর সকাল! সে তাকাল জানালার দিকে। চমৎকার রোদ আসছে । মেঝের উপরে আলোছায়ার নকশা এঁকেছে রোদটা । তুলির মনে হল রোদটা যদি আর একটু বড় হত তাহলে ওর উপরে পা রেখে দিব্যি চু-কিতকিত খেলা যেত, রোদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বিছানার উপর তাকাল তুলি । একটু অবাক হল সে। কাল রাতে মালতীদিদির কাছে শুয়েছিল । আজ সকালে কীভাবে জানি নতুনদিদি শুয়ে পড়েছে পাশে। আরে! এই বিছানাতেই তো রাতে শোয়নি । মাঝরাতে কি তবে কেউ কোলে করে নিয়ে এল তাকে? নাঃ তুলির কোলে উঠতে একেবারে ভালো করে না । বাচ্চামেয়ের কোলে ওঠে ।
 সুনন্দা পাশ ফিরে ঘুমিয়েছিল । তার মুখের দিকে আর একবার দেখে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে আসে তুলি। একবার জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় । মনটা নেচে ওঠে তার । কয়েকটা পাতি হাঁস মানুষে চলা পথ দিয়ে দুলে দুলে হেঁটে দীঘির দিকে রওনা দিয়েছে । কাল রাতের বৃষ্টিতে সমস্ত মাটি কাদায় ভরে গেছে। সেই মাটি পায়ে লেগে যাচ্ছে তাদের, বিরক্ত হয়ে হাঁসগুলো প্যাকপ্যাক করে ডেকে উঠছে বারবার । ভারী মজার ব্যাপার । 
সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তুলির মনে হয় খুব খিদে পেয়েছে। নতুনদিদি যেভাবে ঘুমোচ্ছে তাতে এখন তাকে ঘুম থেকে তুলতে ইচ্ছা করল না তার। বরঞ্চ মালতীদিদিকে খুঁজে বের করতে হবে কোথাও থেকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলটা একবার আঁচড়ে নিয়ে বারান্দায় চলে এল সে। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে সাবধানে চাতাল পেরোল। দক্ষিণের প্রাসাদে একতলায় রান্নাঘর । কাদা ডিঙিয়ে সেদিকে চলে এল । কাল একবার উঁচু তাকে রাখা বিস্কুটের ডিবে দেখেছিল । সেইটা খেতেই এখন লোভ হয়েছে । 
রান্নাঘরের দরজা খোলার আগেই কীসের যেন
একটা গন্ধ এল নাকে । এ গন্ধটা আগে সে পায়নি কোনোদিন। রান্নাঘরের ঢাকার আগেই মধুবাবুকে 
চোখে পড়ল। তিনিও ঘুমচোখে এদিকেই আসছেন । তুলিকে দেখে তিনি একবার ভুরু নাচালেন । তুলি একগাল হেসে রান্নাঘরের দরজা খুলে ফেলল— এত সকালে বাচ্চা মেয়েটাকে এখানে দেখবেন ভাবতেই পারেননি মধুবাবু! ভোরবেলার চা-টা এখনও দিয়ে গেল না মালতী ।সকালে উঠে বেশ খানিকটা বিরক্তই হয়েছিলেন । কিছুক্ষণ মালতীকে খুঁজলেন তারপর সনাতনকে । শেষে কাউকেই না পেয়ে নিজে বেরিয়ে এলেন চায়ের জল বসাবেন বলে ! সারাক্ষণের ইউনিফর্মটা গায়ে গলানো হয়নি । শুধু একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি চাপালেন গায়ে । তুলিকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে তিনি একবার ভুরু নাচালেন — আজ মালতীর শরীরটা ভালো নেই । সে যে কালরাতে বাড়ি না ফিরে উত্তর মহলে থেকে গিয়েছিল সেটা সনাতন জানে । খানিকটা রাগ করেছে বাবা সেটা মুখ দেখে বুঝেছে মালতী । মাঝরাতে পায়েল আর সুনন্দা ফিরতে ঘুমন্ত তুলিকে সুনন্দার কাছে দিয়ে সুনন্দার পাশের ঘরেই শুয়ে পড়েছিল সে। তখন ঘুম ভেঙে যাওয়ায় সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরি হয়েছে । তার উপরে বাইরে একটু একটু ঠান্ডা পড়েছে যেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে পড়ল মালতী। কে জানে বকা শুনতে হবে হয়তো মধুবাবুর কাছে — সনাতন যে ঘরে শোয় তার ছাদ থেকে বৃষ্টি হলে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে। ফলে কাল রাতে নিজের ঘরে শুতে পারেনি সনাতন । শশাঙ্ক নিজেই এসে ডেকে নিয়ে গেছিল তাকে ।অনেকদিন পর কাল রাতে এ বাড়িতে থাকতে একেবারেই ইচ্ছা করেনি সনাতনের। নিজের বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছা করছিল । কাল রাত থেকেই মনটা কুডাক ডাকছে । কে জানে? এমনটা তো খুব একটা হয় না তার!! আজ তাহলে কী হল? শুয়ে শুয়ে এইসব ভেবেই উঠে পড়ে সনাতন — সকালের দিকে একবার ঘুম ভেঙেছিল শশাঙ্কের । আড়চোখ একবার সময় দেখল সে। সনাতনদার বিছানা খালি । পাশ ফিরে
আবার ঘুমিয়ে পড়ল সে— ক্ষেত্রমোহন বিছানা ছেড়ে উঠে এসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন একবার । গিরিজা এখনও শুয়েই আছে বিছানায় । ঘুমোচ্ছে । ঘুমাক, যতক্ষণ চোখ বুজে থাকে ততক্ষণই শান্তি । কবে যে আপদ ঘাড় থেকে নামবে 
আশপাশ দেখেও ছেলেকে দেখতে পেলেন না ক্ষেত্রমোহন। সাতসকালে গেল কোথায়? অতীনকে খুঁজতে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি — 
দরজা খুলেই ছিটকে বেরিয়ে এল তুলি । তার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা ভয়ার্ত আর্তনাদ। দু’হাতে মুখ ঢেকে মাটির উপরেই পড়ে গেল সে। একটু ঘাবড়ে গেছিলেন মধুবাবু। দ্রুতপায়ে এগিয়ে এলেন তিনি, মাটি থেকে তোলার চেষ্টা করলেন, “কী হয়েছে মা?” 
তুলি কিন্তু উঠল না। সে একটু একটু করে পিছোতে শুরু করেছে । তার চোখ থেকে আহত পশুর মতো যন্ত্রণা ঝরে পড়ছে, “ভি… ভিতরে… ও মাগো…” ডুকরে কেঁদে উঠল তুলি । তারপর উঠে দাঁড়িয়েই দৌড় দিল বাইরে । 
কৌতূহল হতে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন মধুবাবু। এতটা ভয় পেল কেন মেয়েটা? কিছু কি দেখেছে ভিতরে? আরশোলা জাতীয় কিছু? দরজাটা আড় করে খোলাই ছিল । এবার ঠেলা দিয়ে সেটা খুলে ফেললেন মধুবাবু। সঙ্গে সঙ্গে একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গের ঝটকা তার পা দুটো কাঁপিয়ে দিল। কোনোরকমে নিজেকে সামলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি । 
ঘরের ভিতর কাল রাতের এঁটো বাসনকোসনের মধ্যে মাথা গুঁজে পড়ে আছে একটা লাশ । মাথাটা থেতলে দিয়েছে কেউ । মুখটা আর চেনা যায় না। কোমর অবধি ঢেকে আছে টকটকে লাল রক্তে । জামাকাপড় আর চেহারা দেখে চেনা যায় লাশটা কার । ক্ষেত্রমোহনের ছেলে — অতীন।

**********
জমিদারবাড়ির সামনে যখন পুলিশের জিপটা থামল তখন বেলা প্রায় দশটা।একটু আগেই জামালপুর থানার পুলিশ এসে দেখে গেছে জায়গাটা! পোস্টমর্টেমের জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বডি । প্রবীণ ইন্সপেক্টার কেশব শর্মা দুটো হাত পিছনে রেখে ভালো করে দেখতে লাগলেন বাড়িটা। পিছনে একজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে ছিল, তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ছেলেটার বয়স কত বললে?” 
“চোদ্দ কি পনেরো ।” কনস্টেবল তৎক্ষণাৎ জবাব দেয় । 
“ও, আর মার্ডারটা কীভাবে হয়েছে বললে।” 
“মাথা থেঁতলে দিয়েছে কেউ । ব্লাজন কেস স্যার।” 
“দিনদিন মানুষ শালা কেমন যেন শুয়োরের বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে। যাই হোক, চলো ।” 
কনস্টেবল আর শর্মা ভিতরে ঢুকে এলেন। আরও দু-একজন কনস্টেবল ও ডাক্তারকে চোখে পড়ল । সঙ্গে বাড়ির কয়েকজন লোককেও ! শর্মাকে দেখে মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন । ভিতরের ঘর থেকে চিৎকার চেঁচামিচি কানে আসছে । সেই সঙ্গে কান্নার আওয়াজও । শর্মা হাতটা একবার বুকের কাছে জড়ো করে বললেন, “কেশব শর্মা সি.আই.” 
কনস্টেবলের সঙ্গে ঘরের দিকে এগিয়ে যান শর্মা। এতক্ষণে সেটা সিল করে দিয়েছে পুলিশ ।
শর্মাকে দেখে বাকি দু’জন কনস্টেবল সরে দাঁড়ালেন। দরজার উপরের হলুদ ফিতে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে এলেন শর্মা। 
বডিটা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এতক্ষণে! মেঝের উপরে রক্তের দাগ অবশ্য এখনও চোখে পড়ে। সেখানে গিয়ে একটু থমকে দাঁড়ালেন শর্মা তারপর মাটির উপরে উবু হয়ে বসে চকে আঁকা বডির অবস্থানটা দেখার চেষ্টা করলেন ! 
“স্ট্রেঞ্জ!” ভুরু দুটো কুঁচকে উঠল তার 
“কী হয়েছে স্যার?” কনস্টেবল জিজ্ঞেস করল । 
“সামওয়ান ব্যশড হিজ হেড । বাট দেয়ার ইজ নো সাইন অফ স্টাগল ।” রান্নাঘরের র‍্যাকের উপর রাখা থালা-বাসনগুলো দেখালেন তিনি, “বাসনগুলোও পরিপাটি করে সাজানো। বাইরে পায়ের দাগ দেখলে? দু-একটা আছে তবে সেগুলো বড়ি ডিস্কভার হওয়ার তুরন্ত পরে যারা বাইরে থেকে এসেছিল তাদের । স্পিকিং অফ হুইচ, তারা কারা?” 
“সেটা আমি ঠিক জানি না স্যার ।” কনস্টেবলটি মাথা নামিয়ে নেয় । মধুবাবু দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেন । ইন্সপেক্টার তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “খুনটা প্রথম দেখে কে?” 
“তুলি । আমিও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকি । ও রক্ত দেখেই ছুটে পালিয়ে যায়। আমি দেখে চিৎকার করে বাকিদের জানাই।” 
“সবার আগে কে আসে?” 
“মালতী, তারপর সনাতন!” 
“ততক্ষণ আপনি ডেডবডির সঙ্গেই ছিলেন?” 
“না…” একটু ইতস্তত করেন মধুবাবু, … মানে ঘরের বাইরে ছিলাম। অত রক্ত… ওইটুকু ছেলে…” 
“পুলিশে কে খবর দেয়?” 
“শশাঙ্ক । আসলে ওই এসব ব্যাপার দেখাশোনা করে ।” 
“কীসব ব্যাপার? কেউ মরে গেলে পুলিশে খবর দেওয়া?” 
“অ্যা? না না। মানে ব্যাঙ্ক, থানা এসব জায়গায়
ওই যায় সাধারণত ।” 
“তাকে একটু পাঠিয়ে দিন। এই ছেলেটা রাতে কার সঙ্গে ছিল?” 
“ওর বাবার সঙ্গেই তো শোয় যতদূর জানি ।” 
“বেশ। তার কন্ডিশান কেমন? একটু কথা বলা যাবে?” 
মাথায় একবার হাত বোলান মধুবাবু, “ব্যাটাছেলে তো, হয়তো বলতে পারবেন । তবে ছেলেটার মা খুব ভেঙে পড়েছে ।” 
“দ্যাটস ভেরি ন্যাচারাল !” 
ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ইন্সপেক্টার । তিনজনে পা বাড়ালেন সিঁড়ির দিকে । প্রাসাদের অন্য বাসিন্দারা বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে । পুলিশ দেখে অবশ্য পরপর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে জানালাগুলো । শর্মার গায়ে ইউনিফর্ম নেই । তবে তার চেহারায় এমন একটা ভারিক্কি ভাব আছে যে আশেপাশে কনস্টেবল পরিবৃত হয়ে রীতিমতো গমগমে পরিবেশ সৃষ্টি করে । 
“বডি নিয়ে প্রোভিশানালি কিছু বলেছে ফরেন্সিক?” পাশে হাঁটতে থাকা কনস্টেবলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন শর্মা। 
“মাল্টিপেল উন্ডস। সবই ফ্রন্টে । সম্ভবত মাথার চুল ধরে বারবার দেওয়ালে ঠুকেছে ।” 
“সেটাই আমি ভাবছিলাম, কিন্তু একটা ছোট প্রবলেম হচ্ছে !” 
“কীরকম প্রবলেম স্যার?” 
“মুঠো করে চুল ধরে যদি বারবার দেওয়ালে ঠুকতে থাকে তাহলে কিছু চূল মাথা থেকে উপড়ে হাতে চলে আসার কথা। অর্থাৎ যেখানে ঠোকা হয়েছে মাথাটা সেখানে ঘরের মেঝেতে কয়েকটা চুল পাওয়া যাবেই । কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা এবসেন্ট । অবশ্য বাচ্ছাছেলের চুল একটু বেশি শক্ত হয়…” 
কথাগুলো বলতে বলতেই ক্ষেত্রমোহনের ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরেন মধুবাবু। পরদা সরিয়ে ভিতরে ঢুকে যান । কিছুক্ষণ কারও সঙ্গে কথা বলে বাইরে বেরিয়ে এসে চোখের ইশারায় ভিতরে ডেকে নেন শর্মাকে । ঘরের ভিতরে বাইরে কিছু লোকজন বসে শান্ত্বনা দিচ্ছিলেন ক্ষেত্রমোহনকে ।
তারা একে একে বাইরে বেরিয়ে যান। শর্মা কনস্টেবলদের বাইরে বসতে বলে ভিতরে ঢুকে যান। 
ভিতরটা এখন মোটামুটি শান্ত । গিরিজাকে খানিকক্ষণ আগেই ঘর থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে । ক্ষেত্রমোহনকে চোখে পড়ল ঘরের ঠিক মাঝে বিছানার উপরে বসে আছেন মাথা নিচু করে । চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। 
শর্মার কাছে অবশ্য এসব নতুন কিছু নয় । তিনি একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “এসময়ে কথা বলতে পারবেন না জানি। আমি জানি 
একটু ফলো আপ করেই চলে যাব।” 
উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়লেন ক্ষেত্রমোহন । এখনও মুখ তুলে তাকাননি তিনি । গলার কাছে অনেকক্ষণ ধরে রক্ত খাচ্ছে একটা মশা। সেদিকে খেয়াল পড়ছে না তার। 
“আপনার ছেলে… আই মিন অতীন । কাল আপনার কাছেই শুয়েছিল?” 
আবার মাথা নাড়লেন ক্ষেত্রমোহন । তার কাঁধ ঝুঁকে পড়েছে । নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে খুব ধীরে ধীরে। 
“সকালে কখন ঘুম ভাঙে আপনার?” 
“সাড়ে সাতটায় ।” ঘরঘরে গলায় জবাব দেন ক্ষেত্রমোহন। 
“তার মাঝে একবারও ঘুম ভাঙেনি ।” 
উপরে নিচে মাথা নাড়েন ক্ষেত্রমোহন । সদর্থক । একটু নড়েচড়ে বসলেন শর্মা, “সময় দেখেছিলেন?” 
“দরকার হয় না। আমি বাথরুম করতে উঠি একবার সাড়ে চারটেয় ।” 
“তখন ছেলেকে দেখতে পেয়েছিলেন?” 
“শুয়ে ছিল আমার পাশে । তখনও যদি একবার জানতাম…” ক্ষেত্রমোহনের গলা বুজে আসে। চোখ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে নিচে । পরমুহূর্তে সেটা মুছে নেন তিনি। 
শর্মা বিড়বিড় করে বললেন, “তার মানে খুন দিনের বেলা হয়েছে । রাতের অন্ধকারে নয় ।” তারপর মধুবাবুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন,
‘“বডি কখন দেখতে পান আপনারা?” 
মধুবাবু একটু ভেবে বললেন, “ওই পৌনে আটটা ধরুন !” 
“রক্ত যতদূর গড়িয়েছে তাতে অন্তত ঘণ্টাখানেক পড়ে ছিল বড়ি । মানে খুনটা হয়েছে প্রায় সাড়ে ছটা থেকে সাতটার মধ্যে।” 
আবার একবার গলা খাঁকারি দিয়ে শর্মা বললেন, “অত সকালে অতীন রান্নাঘরে কেন গিয়েছিল বলতে পারবেন?” 
দু’পাশে মাথা নাড়লেন ক্ষেত্রমোহন । বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীর মুখ করে বসে 
থাকলেন শর্মা। তারপর উঠে পড়ে বললেন, “ছেলেটা যে বিছানায় শুয়েছিল সেখানটা একটু দেখতে হবে আমাকে।” 
“হ্যাঁ। আমি দেখাচ্ছি। এই ভিতরের ঘরটা !” বলে মধুবাবু উঠে পড়লেন। তারপর দ্রুত পায়ে ভিতরের ঘরের দিকে এগোতে এগোতে বললেন, “ও আর ওর বাবা এখানেই শোয়… মানে শুত !” 
পরদা সরানোই ছিল । ভিতরে ঢুকে এলেন শর্মা! বিছানাটা এখন ফাঁকা পড়ে আছে । চাদরটা দেখে বোঝা যায় রাতে দুটো মানুষ শুয়েছিল তার উপরে । 
বারান্দার দিকে জানলাটা খোলা আছে সেদিকে একবার উঁকি দিলেন শর্মা। উলটো দিকের প্যাসেজটা চোখে পড়ছে ।। এখন সেখানটা ফাঁকা। 
তিনি আবার বিছানার কাছে ফিরে এলেন । নিচু হয়ে বসে পড়লেন মেঝেতে । বিছানার নীচটা দেখার চেষ্টা করলেন। সেখানে চোখ রাখতেই কয়েকটা দোমড়ানো ছোট কাগজ চোখে পড়ল তার । ছোট, দলা পাকানো কাগজ । মাটির উপরে শুয়ে পড়ে সেটা বের করে আনলেন তিনি। 
কাগজগুলো দেখে বোঝা যায় কেউ কিছু লেখার পর দলা পাকিয়ে ফেলে দিয়েছে । সম্ভবত যা লিখেছিল সেটা পছন্দ হয়নি । … 
হাতের চাপে কাগজটা সোজা করে নিলেন শর্মা। মন দিয়ে লেখাগুলো লক্ষ করলেন তিনি। কাঁপা কাঁপা হাতে কয়েকটা শব্দ লেখা আছে তাতে। শব্দগুলো পড়ে অবাক হয়ে গেলেন
ইন্সপেক্টার— তার চোখের তারায় ।” 
সব ক’টা কাগজে একই শব্দ একই ভাবে লেখা আছে । একটা বছর বারোর ছেলে খামোখা এই তিনটে শব্দ বারবার লিখে ছিড়ে ফেলবে কেন? অবশ্য এমনও হতে পারে এ ঘরের অন্য কেউ লিখে ফেলে দিয়েছে । 
তিনি মাটি থেকে উঠে পড়লেন । তারপর ঘরটা আর একবার খতিয়ে দেখে বেরিয়ে এলেন । মধুবাবু ক্ষেত্রমোহনের কাধে একটা হাত রেখে বললেন, “এখানে আর একা একা বসে থাকবেন না। চলুন, বাইরে সবাই আছে ।” 
“আমার ভালো লাগছে না। কে আমার ছেলেটার এমন করল বলুন তো, ওইটুকু বয়স । এত কষ্ট দিয়ে…” 
গলা ধরে এল ক্ষেত্রমোহনের । মধুবাবুকে হাতের ইশারায় এখানে থাকতে বলে ক্ষেত্রমোহনের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন শর্মা। বাড়িটা গুঞ্জনে ভরে আছে । প্রাসাদের দিক থেকে খাসনবীশকে হেঁটে আসতে দেখলেন শর্মা। মুকেশ খাসনবীশ জামালপুর থানায় নতুন সাবইন্সপেসক্টারে বদলি হয়েছে বছর তিনেক হল। যদিও জুনিয়ার অফিসার তাও ঝকঝকে স্মার্ট চেহারার জন্যে এর মধ্যেই নাম কামিয়ে ফেলেছে । শর্মাও স্নেহ করেন তাকে। 
শর্মাকে দেখে এগিয়ে এল মুকেশ । তারপর গম্ভীর গমগমে গলায় জিজ্ঞেস করল, “আপনাকেও এখানে ঠেলেছে?” 
“সকালে মেয়েকে আঁকার স্কুলে দিতে গেছিলাম, জান? ফোন করে বলল একটা ব্রুটাল মার্ডার হয়ে গেছে। শালা কোন দেশে আছি ।” 
“তা যা বলেছেন, এখানে কোনো লিড পেলেন?” শর্মা আগেও লক্ষ করেছেন খাসনবীশ ডিউটিতে থাকলে অন্য কথা বিশেষ বলতে চায় না। এ স্বভাবটা ভালো লাগে শর্মার । 
“লিড তো পরের কথা। একটা জিনিস ভেবে তো কুল পাচ্ছি না হে…” 
“মোটিভ?” 
“এক্সাক্টলি । মোটিভ । বারো বছরের একটা
ছেলেকে নৃশংসভাবে মারা হল কিন্তু তার এপারেন্টলি কোনো কারণ নেই !” 
খাসনবীশ একটু ভেবে বলল, “এসব ক্ষেত্রে দেখেছি একটা কমন মোটিভ থাকে । এলিমিনেটিং দ্য আই উইটনেস !” 
“মানে ছেলেটা কিছু একটা ক্রাইম দেখে ফেলেছিল বলছ?” 
“হতে পারে ।” 
“কিন্তু তেমন কোনো ক্রাইম এ বাড়িতে তো হয়েছে বলে শুনিনি ।” 
“হয়েছিল । তবে বছর দশেক আগে। একটা প্রিজিউমড সুইসাইড । তবে সেটারও কোনো মোটিভ ছিল না !” 
“উঁহু…” একটু ভেবে মাথা দোলান শর্মা, “ধরে নিলাম সে ক্রাইমটা এ ছোকরা কোনোভাবে দেখে ফেলেছিল । তাহলে দশবছর পরে তাকে খুন করার 
দরকার পড়বে কেন? আর এ ছেলের যা বয়স তাতে ব্ল্যাকমেইলের থিওরিও লাগাতে পারবে না।” 
“তা জানি না তবে মোডাস অপারেন্ডি দেখে মনে হচ্ছে এ খুনি যেই হোক না কেন, দিস ইজ নট হিজ ব্রেকিং!” 
“মানে আগেও খুন করেছে বলছো?” 
সিঁড়ি ধরে একতলায় নামতে থাকে দু’জনে। খাসনবীশ আড় হয়ে নামতে নামতে বলে, “ব্যাপারটা কমপ্লিকেটেড । এ বাড়ির এক মহিলা এক ইরিলেভেন্ট কিন্তু ইন্টারেস্টিং তথ্য দিয়েছেন । তিনি বলছেন বছর খানেক ‘আগে শশিভূষণ সরকার নামে এক ভদ্রলোক এ বাড়িতে কিছু কাগজপত্র নিয়ে সম্পত্তি দেখাশোনার দাবি জানাতে আসেন । পয়েন্ট টু বি নোটেড, লোকটা সম্পত্তির দাবি জানাতে আসেনি, দিন কতক পরে তিনিও সাস্পিসিয়াসলি সুইসাইড করেন।” 
“বাবা! এ তো সুইসাইডের লাইন লেগে গেছে । শুধু আজকের ব্যাপারটা হোমিসাইড । আচ্ছা এ বাড়িতে মোট কত লোক থাকে?” 
“প্রায় জনা তিরিশেক । তবে তাদের বেশিরভাগই পিছনের বিল্ডিংয়ে । কিছু শরীক
আছে । কিছু অস্থায়ী বাসিন্দা আছে । জ্ঞাতিগোষ্ঠি আর কি !” 
“তার মধ্যে যে কেউ খুন করে থাকতে পারে…” 
একতলায় নেমে এসেছিল দু’জনে । দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে খাসনবীশ বলে, “দ্যাট উড বি হাইলি এবসারড । কাল রাতে বৃষ্টি পড়ে চারিদিক কাদা হয়ে গেছিল । পিছনের দিক থেকে কেউ যদি এ বিল্ডিংয়ে আসে তাহলে মাটিতে তার পায়ের ছাপ পড়বে । মজার কথা হল খুনের ধারে পাশে কোনো পায়ের ছাপ নেই।” 
“মানে খুন এই বিল্ডিংয়ের ভিতরেই কেউ করেছে ।” 
“পাশের বিল্ডিং-এ কয়েকজন গেস্ট আছে । তাদের যাওয়া-আসার জন্যেও একটা প্যাসেজ আছে।” 
“মানে আমাদের সাসপেক্ট এসে দাঁড়াচ্ছে প্রায় জনা দশেক । পোস্টমর্টেম 
রিপোর্ট কখন আসছে ।” 
“হাই প্রায়োরিটি দিয়েছিলাম । এতক্ষণে তো এসে যাওয়ার কথা!” 
বাইরে বেরিয়ে দু’জনে একতলার একটা ঘরের কাছে এসে দাঁড়ালেন। আগের থেকে এখন ভিড় খানিকটা কমেছে । ভিতরের ঘর থেকে কান্নার শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। ঘরের ভিতরে একবার উঁকি দিলেন শর্মা! মাঝে যিনি বসে আছেন তাকে দেখে বোঝা যায় তিনি ছেলেটির মা। মহিলার মুখের দিকে তাকানো যায় না। পাশ থেকে কয়েকজন ধরে আছে তাকে । মাঝে মাঝেই কীদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন তিনি । 
“উনি ঠিক আছেন তো?” পাশে বসে থাকা একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন শর্মা। মেয়েটি মাথা নেড়ে দিল । শর্মা উঠে এসে তাদের দিকে পিছন ফিরে খাসনবীশকে বললেন, “একে এখন ইন্টারোগেট করা ইনহিউম্যান হবে। এক কাজ কর, যে বাচ্চা মেয়েটি বডিটা দেখেছে তাকে ডেকে দিতে বল!” 
মিনিট দশেকের মধ্যে তুলি এসে বসল দোতলার ঘরে । তাকে যারা নিয়ে এসেছিল তাদের
হাতের ইশারায় বাইরে দাঁড়াতে বললেন শর্মা। 
তুলির চোখ-মুখ থেকে এখনও আতংকের দাগ মোছেনি । কিছু বলতে গেলেই বারবার ঠোট কেঁপে উঠছে তার। কচি মুখটা যেন এক ধাক্কায় অনেকটা বয়স বাড়িয়ে ফেলেছে । 
তার কাধে একটা হাত রেখে অভয় দিলেন শর্মা, “তুমি না সাহসী মেয়ে । ভেঙে পড়লে চলবে?” 
কিছু বলল না তুলি। কোলের উপর পড়ে থাকা একটা হাতের উপরে আর একটা হাত রেখে মাথা নিচু করে বসে থাকল। 
“কাল রাতে কোথায় শুয়েছিলে তুমি?” 
প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে একটু থমকালো তুলি, তারপর একবার I গিলে বলল, “আগে দোতলায় মালতীদিদির কাছে । তারপর নতুনদিদির কাছে।” 
চোখ,তুলে একবার খাসনবীশের দিকে তাকালেন শর্মা। তারপর আবার 
মুখ নামিয়ে নরম গলায় বললেন, “মালতীদিদির কাছ থেকে কে নিয়ে এসেছিল তোমায়?” 
“জানি না। আমি তো ঘুমিয়ে ছিলাম ।” 
জিভ কাটলেন শর্মা, “তাও ঠিক, তাও ঠিক। বোকার মতো প্রশ্ন করছি। আচ্ছা সকালে তুমি কী করতে যাচ্ছিলে রান্নাঘরে?” 
‘“আমার খিদে পেয়েছিল । বিস্কুট খেতে যাচ্ছিলাম ।” 
“ঘরে ঢোকার আগে কিছু দেখেছিলে?” 
মাথা নাড়ে তুলি, তারপর বলে, “মধুকাকা আসছিলেন রান্নঘরে। আমি ভয় পেয়ে যাই খুব!” 
“তা তো পাবেই । আচ্ছা রাতে কোনো আওয়াজ শুনেছিলে তুমি? কাউকে দেখেছিলে?” 
মাথা নাড়ে তুলি। 
“আচ্ছা তুমি এসো এবার । ভয়ের কিছু নেই । একা একদম থাকবে না। বুঝেছ?” 
মাথা দুলিয়ে তুলি ঘর থেকে বেরিয়ে যায় । শর্মা উঠে পড়ে খাসনবীশের দিকে তাকিয়ে বলেন, “রাতে মেয়েটাকে সরানো হয়েছিল ঘর থেকে। কিছু কারণ বুঝতে পারছ?”
“মালতী নামের মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলেই বোঝা যাবে!” 
দু’জনে ঘর থেকে বেরিয়ে এল । বারান্দায় এসে রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন শর্মা। কি যেন ভাবতে ভাবতে বললেন, “আচ্ছা, তোমার প্রাইমারিলি কী মনে হয়? খুনি নারী না পুরুষ?” 
“দুটোই হতে পারে । তবে যেভাবে বারবার মাথাটা ঠোকা হয়েছে তাতে রীতিমতো শক্ত হাতের কাজ মনে হচ্ছে ।” 
“প্লাস কোনো স্টাগলের চিহ্ন নেই । যেন ছেলেটা কিছু বোঝার আগেই তার মাথাটা খুনির হাতে চলে গেছে ।” 
“অথবা খুনি ছেলেটার কাছের কেউ । যার কাছ থেকে বিপদের আশঙ্কা 
একেবারেই করেনি সে।” 
“রাতে কেউ শব্দ শুনেছে কিছু?” 
“উঁহু…নাথিং”। 
শর্মা একটা হাত বুকের কাছে তুলে এনে আঙুল ফাটাতে থাকেন। অনেকগুলো প্রশ্ন উত্তরের অভাবে মাঝসমুদ্রে ভাসছে। তবে সব কিছু ছাপিয়ে যেটা বেশি করে ফুটে উঠছে সেটা হল মোটিভ । অন্তত সেটুকু যদি পাওয়া যেত তাহলেও এগোনোর একটা রাস্তা থাকত । আপাতত সব পথ বন্ধ। 
পকেট থেকে কাগজটা বের করে আবার তার উপরে চোখ রাখলেন তিনি। খাসনবীশ সেটার উপর ঝুঁকে পড়ে ভুরু কুচকে জিজ্ঞেস করল, “এগুলো কোথায় পেলেন?” 
“ছেলেটার ঘরে । ডায়েরির পাতা ছিড়ে এইসব লিখছিল কাল রাতে ।” 
“কাল রাতে কী করে বুঝলেন?” 
“রোজ বিকেলে ঝাঁট দেওয়া হয় । আশা করা যায় কাল রাতেই কোনো সময় এইসব লিখেছে সে । কিন্তু প্রশ্ন হল একটা বাচ্চা ছেলে হঠাৎ এই তিনটে শব্দ লিখতে যাবে কেন?” 
“তার চোখের তারায়…” কথাগুলো উচ্চারণ করে একবার থেমে যায় খাসনবীশ। একটু দূরে শশাঙ্ককে হেঁটে আসতে দেখা যায় । দু’জনে
এগিয়ে যায় তার দিকে । 
শশাঙ্ককে আগেই জেরা করেছে খাসনবীশ। সে পুলিশ দু’জনের কাছে এসে একটু ইতস্তত করে বলে, “একটা কথা আপনাদের আগে বলা হয়নি । আমি একটু ভয় পেয়েছিলাম স্যার, মাফ করবেন !” 
“কী কথা বলুন তো?” নিরুৎসাহিত গলায় জিজ্ঞেস করেন শর্মা! তিনি জানেন যে কথা শশাঙ্ক বলতে চলেছে তাতে ঘটনার মোড় ঘুরে যেতে পারে। তাও বেশি উৎসাহ দেখালে সে ঘাবড়ে গিয়ে আবার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। 
“আসলে তেমন কিছু না। এ ঘটনার সঙ্গে কোনো যোগ নেই হয়তো 
তাও মনে হল বলা উচিৎ।” 
“নিশ্চিন্তে বলুন।” খাসনবীশ বলল পাশ থেকে। 
মাথা ঘুরিয়ে একবার চারপাশটা দেখে নিয়ে শশাঙ্ক বলল, “কাল ভোরের দিকে কেউ আমার দরজায় টোকা দিচ্ছিল ।” 
“মানে!” চেষ্টা করেও উত্তেজনাটা চাপা দিতে পারলেন না শর্মা, “কখন?” 
“তা বলতে পারব না। তবে বার দুয়েক দিয়েছিল । আমি ঘুম চোখে গলা তুলে একবার জিগ্যেসও করি কিন্তু কেউ সাড়া দেয়নি ।!” 
“তারপর?” 
“আমি একবার ভেবেছিলাম উঠে দেখি। কিন্তু সারাদিন কাজ করি স্যার । রাতে বিছানা ছেড়ে উঠতে মন চায় না । দু’বার ডাকার পরে কেউ সাড়া দিচ্ছে না দেখে আমি আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ।” 
“তারপর আর পাননি আওয়াজটা?” 
“না। সকালে উঠে দেখি এই অবস্থা!” 
শর্মার মুখ থমথমে দেখায় । কিছুক্ষণ পরে মুখ তুলে তিনি বলেন, “ঠিকাছে। আমরা দেখছি কী করা যায় । তবে এই কথাটা আর কাউকে বলবেন না কেমন?” 
“হ্যাঁ স্যার।” 
শর্মা মাথা নেড়ে দিতে আবার ফেরার পথ ধরে
হাঁটতে থাকে শশাঙ্ক! খাসনবীশ সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে শর্মার দিকে তাকিয়ে বলেন, “তাহলে কি আগে শশাঙ্ক টার্গেট ছিল। তাকে না পেয়ে বাচ্চাটাকে…” 
“কিন্তু কেন?” 
“আমার তো সিরিয়াল কিলার মনে হচ্ছে । এভাবে রক্তারক্তি করে খুন, একজন ফস্কে যেতে আরেকজন… অ্যাবসেন্স অফ মোটিভ… দিস গট টু বি আ সিরিয়াল কিলার।” 
শর্মা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় তার ফোনটা বেজে ওঠে । সেটা পকেট থেকে বের করে স্ক্রিনের দিকে দেখে নিয়ে চাপা গলায় বলেন, 
“ফরেনসিক…” 
খাসনবীশ নিচে তাকিয়ে ভাবতে থাকে। খুনের সমস্ত ইঙ্গিত একসঙ্গে করলে একটা ছাচ ফুটে উঠছে । খুনি সম্ভবত পুরুষ, শক্তিশালী, আগেও খুন করেছে এবং ভিক্টিমের সুপরিচিত। কে হতে পারে?
 মাথাটা ঠান্ডা করে মুকেশ। যতই জটিল হোক না কেন তার মন বলছে এ কেস সল্ভ হতে বেশি সময় লাগবে না। বড় করে একটা দম নেয় সে। কতই বা জটিল হতে পারে? 
এতক্ষণে ফোনটা রেখে দিয়েছেন শর্মা! তিনি ধীরে হেঁটে খাসনবীশের কাছে এসে দাঁড়ান। প্রশ্ন করতেও উত্তর দেন না। কি যেন একটা ভাবনায় ডুবে গেছেন । অভিজ্ঞ গোয়েন্দাকে এত চিন্তিত এর আগে দেখেনি খাসনবীশ। 
বিড়বিড় করে উচ্চারণ করেন শর্মা, “ওই শশিভূষণ সরকারের ফাইলটা আজকের মধ্যে পাঠাও আমাকে । আই নিড দ্যাট রাইট নাও ।” 
“কেন স্যার? পোস্টমর্টেম কী বলেছে?” জিজ্ঞেস করে মুকেশ । 
“পোস্টমর্টেম বলছে…” পরের কথাটা বলার আগে একটু থামেন শর্মা, “এটা হোমিসাইড নয়… সুইসাইড 

 অষ্টম অধ্যায়

 “আর দে নাটস? একটা বাচ্চা ছেলে কী করে সুইসাইড করতে পারে? তাও এইভাবে ।” 
 “খুনই বা কীভাবে হতে পারে?”
“ সেটার চাইলে একটা এক্সপ্লানেশান দেওয়া যায় । পোস্টমর্টেমে কী ছিল এমন? যা দেখে সুইসাইড বলছে ওরা?”
“তা জানি না। তুমি কাল আসছ তো?”
“ইচ্ছা তো তাই আছে !” 
“বেশ, আর এসব নিয়ে বেশি ভেব না। আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তুলি শুধু একটু শকে আছে ।” 
“হ্যাঁ, ওকে একটু সাবধানে রেখো। ও বাড়িতে বাচ্চারাও সেফ নয় দেখছি ।” 
ফোনটা রেখে দেয় সুনন্দা । নীলাদ্রি নিজেই ফোন করেছিল আজ। তখনই খবরটা জানাতে হল। এ বাড়িতে এতগুলো মৃত্যু হয়েছে পরপর, নীলাদ্রিই আগে বারণ করেছিল নাথদের কাজটা নিতে। জেদটা সুনন্দারই ছিল! কিন্তু তাদের থাকতে থাকতে যে আর একটা মৃত্যু হবে সেটা আগে ভাবতে পারেনি সে।

 সকালের নতুন ছাদ! পায়েল একটু দূরে মেঝের উপরে বসে কাল রাতের ডায়েরিটা মন দিয়ে দেখছে । একটু দূরে পায়রার ঘরের সামনে দানা ছড়াচ্ছে তুলি। কাল রাতে এ বাড়ির কারও ভালো ঘুম হয়নি । দেহ সৎকার করা, ঘাটের কাজ ইত্যাদিতেই সময় কেটে গেছে । নিচের ঘরে বাইরে থেকে তালা দিয়ে ছাদে চলে এসেছে সুনন্দা। সকাল থেকে একগাদা জামাকাপড় নিজে হাতে কেচেছে সে । সদ্য চান করে উঠে একটা গামছা জড়িয়ে নিয়েছে মাথায় । গামলা থেকে কাপড় তুলে নিংড়াতে নিংড়াতে বলল, “আমি শুধু ভাবছি পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কী লেখা আছেঃ?” 
উত্তর না পেয়ে আবার প্রশ্ন করল, “আচ্ছা, সেটা দেখে তুমি কিছু বুঝবে না? তাই না?”
 “আমি ইংলিশের স্টুডেন্ট, বায়োলজির না।” ডায়েরির দিকে মন দিয়েই উত্তর দেয় পায়েল।! 

“অন্তত এটুকু তো বুঝবে কেন সুইসাইড বলছে?” 
এবার সে মুখ একটা একটা পেন থুতনিতে ঠেকিয়ে বলল, “কি জানি কেন বলছে, আমার কি মনে হয়েছিল জানো আগে?” 
“কেউ ওকে ড্রাগড করে কাজটা করেছে । সেই জন্যেই স্ট্রাগলের চিহ্ন 
নেই । কিন্তু সুইসাইড মানে শরীরে মাদকও পাওয়া যায়নি !” 
এইবার কাপড়গুলো মেলতে লাগল সুনন্দা, “আমারও ভারি আশ্চর্য লাগছে । ধরে নিলাম কোনো কারণে অতীন ঠিক করল সে সুইসাইড করবে। কিন্তু তার জন্যে সাতসকালে উঠে রান্নাঘরে এসে মাথা ঠুকতে যাবে কেন? কাছে পুকুর আছে, দীঘি আছে । ঝাঁপ দিতে পারত ।” 
“দড়ি কলসি নিয়ে যাবে বলছ? তাতে লাভ হত না। অতীন সাঁতার জানত।” 
“সে তুমি যাই বল! মাথা ঠুকে সুইসাইডটা কেমন যেন লাগছে আমার ।” 
“শুধু সেটা না, আর একটা জিনিস মিলছে না আমার।” 
“কী বলতো?” শেষ কাপড়টা রোদে দিয়ে জিজ্ঞেস করল সুনন্দা! 
“হোয়াই রান্নাঘর? এ বাড়িতে ঘরের শেষ নেই । কিছু কিছু ঘর এতদূরে যে লোকজনের শুনতে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই থাকে না। তাছাড়া রান্নাঘরে ভরতি বাসন কোসন। কোনোভাবে একটা খসে গেলেই দূর থেকে সেটা শোনা যাবে । সেটা সুইসাইডের জন্যেও ভালো না, খুনের জন্যেও নয় । এতকিছু থাকতেও রান্নাঘরটাই বেছে নিল কেন?” 
পায়েলের পাশে এসে এবার বসে পড়ল সুনন্দা। একবার মুখ তুলে তুলিকে দেখে নিল। তারপর আবার নিচে তাকিয়ে বলল, “আজব কাণ্ড! এ বাড়িতে যেই মারা যাক না কেন, সেগুলো খুন আর আত্মহত্যার মাঝামাঝি ঝুলে থাকছে ।” 
এবার পেনের ঢাকাটা খুলে নিয়ে নিজের ডায়েরির পিছনের একটা পাতা মেলে ধরল
পায়েল। তাতে ছোট ছোট অক্ষরে কী যেন লিখতে লাগল। স্বর্গতোক্তির মতো বলল, “ আমাদের হাতে রইল তাহলে ছ’টা খুন। এ)— সিক্সটিফোরে সিঁড়ি থেকে পড়ে, বি)—সেভেন্টি সিক্সে জলে ডুবে, সি)— নাইন্টি টুতে কুয়োয় পড়ে, ডি)— দু’ হাজার আটে সিলিং থেকে ঝুলে, ই)— দু’ হাজার আটেই দোকানের সিলিং থেকে ঝুলে, এফ)— দু’ হাজার আঠেরোতে দেওয়ালে মাথা ঠুকে। সব দশকেই একটা করে খুন, এক্সসেপ্ট 
এইট্টিস। খুনি কী করছিল তখন? মিস্টার ইন্ডিয়া দেখছিল? 
ধরে নিলাম তার নাম— এক্স। এখন প্রশ্ন হল এক্স কি কন্সট্যান্ট নাকি ভেরিয়েবেল? সেও কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পালটে যাচ্ছে?” 
“আমার তো তাই মনে হয় । এত বছর ধরে একটা মানুষের পক্ষে খুন করা সম্ভব না। কেউ তার স্টাইলগুলোকে কপি করে তার ঘাড়ে চাপাতে চাইছে।” 
“আচ্ছা এই টাইমলাইনে কিছু গ্লিচ চোখে পড়ল তোমার? মানে যেখানে প্যাটার্নটা প্রায় মেলেনি?” 
উত্তরটা সুনন্দার ঠোটের উপরেই ছিল, ‘“হ্যাঁ, দুটো । ছ’টার মধ্যে পাঁচটা খুন হয়েছে এ বাড়িতে, মানে বাড়ির চৌহদ্দিতে আর কি একমাত্র শশিভূষণ সরকার মারা গেছেন তার নিজের দোকানে। আর একটা হল দু’ হাজার আটেই দু’টো খুন হয়েছে। এই খুনি সাধারণত এত তাড়াতাড়ি খুন করে না!” 
“হুম… এ থেকে দুটো জিনিস বোঝা যায় । এক, কোনো একটা কারণে খুনটা করা ভীষণ দরকারি হয়ে পড়েছিল। দুই, খুনগুলো সে নিতান্তই ইচ্ছা হয় বলে করে না। তার একটা লজিকাল রিসেন আছে । হি ইজ নট আ সাইকোপ্যাথ। 
“শশিভূষণ সরকারকে খুন করার কারণটা স্পষ্ট। জমিদারী দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে লোকটা যদি এখানে এসেই থাকতে শুরু করে তাহলে কিছু একটা জেনে যেতে পারে সে। সেটা খুনির পক্ষে সুবিধের হবে না!” 
ডায়েরিটা হাতে নিয়ে পায়েল উঠে পড়ল মেঝে
থেকে। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়াল ছাদের কিনারায় । তার দিকে এগিয়ে এল তুলি; হেসে তার কাঁধে একটা হাত রেখে পায়েল বলল, “পুলিশরা কী জিজ্ঞেস করছিল রে তোকে?” 
ছাদের পাঁচিলের কিনারায় হাত দিয়ে তবলা বাজাতে বাজাতে সে বলল, “জিজ্ঞেস করছিল কাল রাতে কে বিছানা থেকে তুলে এনেছিল?” 
”তুই কী বললি?” ১৪০ তার চোখের তারায় 
“বললাম জানি না!” 
পায়েল সুনন্দার দিকে একবার চোখ তুলে বলল, “এখানে একটা ঝামেলা হবে মনে হচ্ছে। মালতীকে জিজ্ঞেস করলে ও তো বলে দেবে । কী বলবে ভেবেছ?” 
“ভেবেছি বলব তুমি সিগারেট খাচ্ছিলে, আমি সঙ্গ দিচ্ছিলাম!” 
“মানে! আমার নামে চালাবে?” রাগত স্বরে বলে পায়েল। 
“ভেবে দেখ, সিগারেট খাওয়াটা বড় পাপ না কবর ভাঙা? তাছাড়া কথাটা একেবারে মিথ্যেও না!” 
“সারারাত সিগারেট খাচ্ছিলাম এটা অতি বড় নেশারুও বিশ্বাস করবে না!” 
“সেই সঙ্গে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে গল্প করছিলে ।” 
হেসে ফেলে পায়েল। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, “নেশারু ও চরিত্রহীন বলে বাবা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে আমাকে । তারপর তুমি অ্যাডাপ্ট করো ।” 
এবার সুনন্দাও পাঁচিলের পাশে উঠে আসে। তারপর ডায়েরিটার দিকে দেখিয়ে বলে, “ওটা কিছু পড়তে পারলে?”



“না!” মাথা নাড়ে পায়েল, “ভাষাটা পড়া যাচ্ছে না !” 
সুনন্দা মুখ বেকায়, “ভারি যে বলছিলে ইংলিশের স্টুডেন্ট !” 
“আরে!” প্রতিবাদ করে পায়েল, “একবার খুলে তো দেখো । ভাষাটা আদৌ ইংরাজি নয় । অন্তত শুরুর দিকে খানিকটা হলেও দশ বারো পাতা পরে কীসব আজগুবি লিখেছে ।” 
খাতাটা হাতে নিয়ে সাবধানে পাতা উলটাতে থাকে সুনন্দা । প্রথমে সাদা পাতার উপরে মেয়েটার ডাক নাম লেখা আছে — বেথ। 
তারপরের পাতায় পুরো নামটা। সেটা দেখিয়ে পায়েল বলে, “দেখো, পুরানো ইংরাজির স্ক্রিপ্ট । তখন দু’ রকম এস হত । একটা সাধারণ এস আর একটা এফের মতো দেখতে লং এস! কোথায় কোন এস হবে তার ডিফাইণড কিছু নিয়ম ছিল । যেমন একসঙ্গে যদি দুটো এস থাকে তাহলে প্রথমটা লং হবে পরেরটা সর্ট হবে। মসক্রপ বানানটা দেখ, একটা এস এফের মতো দেখতে । তবে যে সময়ে এটা লেখা হয়েছে তখন লং এসের ব্যবহার প্রায় উঠে গেছে। তাও বাবা মা মেয়েকে লং এস শিখিয়েছেন মানে বাবা-মা একটু কনজারভেটিভ বলা যায় ।”
“বাবা! আরঃ?” লং এসট্টা দেখতে দেখতে বলে সুনন্দা। 
“মেয়েটা সম্ভবত বাঁহাতি ছিল ।” 
“সেটা কী করে বুঝলে?” 
“যারা ডান হাতি তারা জেনারেলি স্ট্রোক দেয় বাঁদিক থেকে ডানদিকে । বাঁহাতিরা ডানদিক থেকে বাঁদিকে !” 
ভালো করে লেখাগুলো দেখে ব্যাপারটা বুঝল সুনন্দা, বলল, “এখানে বৰ্ণগুলোর ডানদিকে কালি বেশি মোটা করে প্ড়েছে বাঁদিকে কম ! তাই বলছ বাঁহাতি। বেশ, আর?” 
“মেয়েটা খুব একটা স্বাভাবিক নয় ! মানে আই এর মাথাগুলো লক্ষ কর! সাধারণত এই বয়সের বাচ্চারা আই এর মাথার পুটকিটা গোল্লা পাকায় । এই মেয়েটা বড়দের মতে ডট দিয়েছে। বর্ণগুলো সামান্য বাঁদিকে হেলানো 
যেদিক থেকে লিখছে সেদিকেই যদি বর্ণ হেলে থাকে তার মানে লেখক একটু আত্মকেন্দ্রিক, লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করে না। আর একটা ব্যাপার ভারী ইন্টারেস্টিং, জানো? এইখানে দেখ ডিজিট লিখতে শিখছে… ওয়ান টু থ্রি ফোর… কিন্তু গণ্ডগোল বুঝতে পারছ?” 
ডায়েরিটা মন দিয়ে দেখে সুনন্দা বলে, “উঁহু… নাতো…” 
“আমরা বাঙালিরা যখন ইংরাজি ডিজিট লিখতে শিখি তখন আমাদের বাবা-মায়েরা আমাদের শেখায় যে বাংলার সাত-এর মতো করে ইংরাজি নাইন লিখতে । ফলে আমরা নয়ের নিচের আঁকড়াটা বাঁকিয়ে দিই না। সোজা থাকে। নেটিভ ইংলিশ স্পিকিংদের নয় সবসময় নিচের দিক বাঁকানো থাকে। এলিজাবেথ মসক্রপের নাইনগুলো সোজা… এর মানে কী হতে পারে?” 
“হতে পারে যে তাকে ডিজিট লেখা শিখিয়েছিল সে ছিল বাঙালি, তাই শিক্ষককে নকল করতে গিয়ে তারও নাইন সোজা হয়ে যায় ।” 
আবার কিছুক্ষণ পাতাগুলো ওলটাচ্ছিল সুনন্দা। এবার সে থেমে গিয়ে বলল, “বেশিরভাগই
ছাড়া ছাড়া শব্দ । যেন নতুন করে শব্দগুলো লিখতে শিখছে । ওয়াটার, বল্ এইসব ।” 
পায়েল কিছু উত্তর দেয় না। সে মন দিয়ে দেখে চলেছে পাতাগুলো । হলদে থেকে তামাটে হয়ে যাওয়া পৃষ্ঠা । বেশিরভাগ পাতাই কোণের দিক থেকে ক্ষয়ে গেছে। কোথাও কোথাও লেখা এতই হালকা হয়ে গেছে যে পড়াই যায় না ভালো করে । 
দশ-পনেরোটা পাতা ওলটানোর পরে থমকে যায় সুনন্দা । লেখাগুলো আর বর্ণ নয় ।বরঞ্চ তার বদলে কিছু দাগ টানা হয়েছে লাইন জুড়ে । কিছু কিছু দাগ একই রকম দেখতে । মনে হয় যেন অন্য কোনো ভাষায় লেখা হয়েছে বাকি ডায়েরিটা । শেষের দিকে কয়েকটা পাতা দেখতেই একটা খটকা লাগে সুনন্দার। 
“এই জায়গাটা দেখ । লেখাগুলো আরও ঝকঝকে । যেন অল্প কয়েকদিনে অনেকটা বড় হয়ে গেছে সে ।” 
অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে দেখেও ভাষাটা চেনা মনে হল না সুনন্দার।! সে 
লেখাগুলোর উপরে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “কী লিখেছে বল তো?” 
“কী জানি। আমার চেনা লাগছে না!” 
‘“আমারও।” 
“অথচ লেখাগুলো উদ্ধার করতে না পারলে আর এক পাও এগোতে পারব না আমরা।” 
“এমনভাবে বলছ যেন তোমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মার্ডারগুলো সল্ভ করার।” , “মার্ডারগুলো নিয়ে আমার অত মাথা ব্যাথা নেই। সেসব পুলিশে সামলাবে। আমি খালি মসক্রপের গল্পটা জানতে চাই !” 
আরও কয়েকটা পাতা উলটে আবার থেমে যায় পায়েল, ডায়েরিটা আড় করে ধরে বলে, “এখানে দেখো, কয়েকটা ছবি আঁকা আছে, মানে লিখতে শেখার পরপরই সে ছবি আঁকা শিখেছিল।” 
“তাই তো…” ছবিগুলো মন দিয়ে দেখে সুনন্দা। ছাড়া ছাড়া অস্পষ্ট ছবি! ভালো করে দেখলে মনে হয় যেন মাটির উপরে একটা গর্ত । গর্তের ভিতরটা ধবারবার কালি ঘষে গোল করা।
অর্থাৎ অন্ধকার! কখনও আবার বাড়ি, পুকুরপাড়, মানুষজন । একটা গ্রামের ছবি যেন। তবে সব কটা ছবির বিশেষত্ব হল সেগুলো সবই অসম্পূর্ণ। যেন ছবির কয়েকটা জায়গা কেউ ইচ্ছা করেই আঁকেনি । একটা কুঁড়ে ঘরের মাথার উপরে একটা গাছ উঠেছে, কাণ্ড, কিছুটা ডালপালা সবই আছে তার কিন্তু গাছের মাথার দিকে অনেকটা কেউ খাবলে নিয়ে ছবিটা সাদা করে দিয়েছে। পুকুরের মাঝে কিছু কিছু জায়গায় যেন আচমকাই জল নেই । সেখানটা ফাঁকা। 
“এরকম আঁকল কেন বলতো?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে পায়েল । 
“বুঝতে পারছ না? আমি কিন্তু বুঝেছি ।” দাঁতের ফাঁকে হাসতে হাসতে বলে সুনন্দা, “কোনো দৃশ্য আমরা দেখার পর থেকেই ভুলে যেতে থাকি? ফলে আঁকতে গেলে কিছু কিছু জায়গায় কি দেখেছি কিছুই মনে পড়ে না? ভাবো…” 
কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে উত্তর দেয় পায়েল, ‘“স্বপ্ন। হ্যাঁ… কোয়াইট 
পসিবেল। সেকালের বিশ্বাস অনুযায়ী খারাপ স্বপ্ন লিখে বা এঁকে রাখলে সেটা! আর ঘটে না। তাই হয়তো বেথ স্বপ্নগুলো এঁকে রাখত । কিন্তু এই স্বপ্নট। তো প্রায় দু’ পাতা অন্তর আঁকা আছে… মানে কী এটার?” 
সুনন্দা লক্ষ করে সত্যি পাতায় পাতায় সেই কালো গর্তের ছবিটা আঁকা রয়েছে। অর্থাৎ বারবার এই একই স্বপ্নটা দেখত মেয়েটা । গর্তের সঙ্গে কি চেনা কিছুর মিল রয়েছে? 
“রিকারিং ড্রিম । হয়তো তেমন কোনো মানে নেই । কিন্তু তাও…” কথাটা বলতে গিয়েও থেমে যায় পায়েল। এইমাত্র অন্যমনস্কভাবে একটা পাতা উলটেছে সে । নতুন পাতায় আবার সেই গর্তের ছবি কিন্তু এবার একটু বদলেছে সেটা। ভিতরে কালি ঘষে আগের মতোই অন্ধকার করা হয়েছে, কিন্তু এবার তার ভিতরে অন্ধকার ছাড়াও আরও কিছু দেখা যাচ্ছে —- একটা হাত। গর্তের ভিতর থেকে কেউ হাত বাড়িয়েছে । “স্পুকি” পায়েল নিজের মনেই বলে।
ছাদের ধার থেকে তুলিকে নিয়ে একটু সরে আসে সুনন্দা। তারপর ভাবুক গলায় বলে, “হয়তো একটু বেশি ভাবছি বলে, কিন্তু আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে দুটো ঘটনা কোনো জায়গায় গিয়ে একটা আরেকটার সঙ্গে মিলে গেছে।” 
“মানে বলছ এ বাড়ির খুন আর মসক্রপ?” 
মাথা নাড়ে সুনন্দা। আঁচল দিয়ে তুলির মুখের ঘাম মুছতে মুহতে বলে, “দুটোর একটা সল্ভ করতে পারলেই আর একটা সল্ভ হয়ে যাবে। কিন্তু…” 
“এ বাড়িতে খুনগুলো হবার সময় যারা বাড়িতে ছিল তারা কেউ ঝেড়ে কাশছে না। অন্তত অন্য কারও মুখে ঘটনাগুলো শোনা গেলেও একটা লাভ হত!” 
সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছিল সুনন্দা! হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, “সেরকম লোক একজন আছে বটে, এ বাড়ির লোক না। তবে জানে অনেক কিছু। আসার দিন আমরা এখানে একটা হোটেলে খেতে গেছিলাম, তার ম্যানেজার । নাম দেখেছিলাম মাধব চৌধুরী ।” 
“সে এখানকার সম্পর্কে জানল কী করে?” ভিতরের দিকে সরে এসে 
প্রশ্ন করল পায়েল। 
“ছোটবেলায় এ বাড়িতে খেলতে আসত। তখনই ওই ডুবে যাওয়ার ব্যাপারটা হয় । তারপর থেকে খেলা বন্ধ হয়ে যায় ।” 
“ব্যাস! একেই দরকার আমার । হোটেলের নাম বল !” 
“সে বলছি । কিন্তু একটা সমস্যা আছে ।” 
“কীরকম সমস্যা?” 
“বাড়িতে একটা এতবড় কাণ্ড ঘটে গেছে । এরপরেও তোমাকে এসব কথা খুলে বলবে কিনা সন্দেহ ।” 
“আলবাত বলবে। বয়স কীরকম লোকটার?” 
“এই বছর পাঁয়তাল্লিশেক হবে !” 
‘“মিডলাইফ ক্রাইসিসে ভুগছে, মেয়ে দেখলেই হুড়হুড় করে বলবে । নামটা বলো তুমি ।”
* * * * * *
মনসা হোটেলের ভিতরে তাকাতেই ম্যানেজারকে চোখে পড়ল। চেহারা দেখে মনে হয় মাঝবয়সের একটু বেশিই গড়িয়ে গেছে। চোখের নিচের চামড়া খুলে পড়েছে। এখন দুপুর বলে ব্যস্ততা একটু বেশি। তবে সেসব কর্মচারীদের । ইনি টাকাপয়সা মিটিয়েই চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিচ্ছেন । রুমালে একবার মুখ মুছে ভিতরে ঢুকে এল পায়েল । তাকে দেখে খানিক দূরের একটা চেয়ার দেখিয়ে দিলেন ম্যানেজার। পায়েল তাতে না বসে ম্যানেজারের ঠিক পাশের একটা টেবিলেই বসে পরে তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। 
“আপনাকে কী দেব?” পাশ থেকে এক বেয়ারা এসে জিজ্ঞেস করতে পায়েল খাবারের অর্ডার দিয়ে দিল । তারপর ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে একবার ঘড়ি দেখে বলল, “আপনারা সারা দুপুর খোলা রাখেন তো?” 
“দুপুরেই তো ব্যাবসা ।” গম্ভীর মুখে কথাটা বলে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন ম্যানেজার। 
“আসলে আমার বিকেলের দিকে আসতে হবে আবার । আপনাদের এদিকে খাবারের দোকান তো খুব একটা দেখছি না।” 
“হ্যাঁ, রেস্তোরা বলতে এই আমরাই । বাদবাকি যা আছে তা তো মুখে দেওয়ার যোগ্য নয়। আসুন না যখন হোক, রাত অবধি খোলাই আছে । বললে বাড়ি গিয়ে দিয়েও আসবে। কুড়ি টাকা এক্সট্রা লাগবে তাতে !” 
“না না, আসলে আমি ওই জমিদারবাড়িতে একটা কাজে এসেছিলাম! বিকেল অবধি স্টে করতে হবে। খেতেও বলেছিল। কিন্তু বুঝতেই পারছেন একটা ট্র্যাডেজি হয়ে গেছে ।” 
বিমর্ষ মাথা নাড়ুলেন ম্যানেজার । আর কিছু বললেন না। পায়েল এতক্ষণে বুঝেছে কাজটা খুব একটা সহজ নয় । লোকটা মিডলাইফ ক্রাইসিসে ভুগছে না মনে হয় । ভারী ভালো মানুষ। কিন্তু পায়েলের একটু অসহায় লাগল। 
“ঠিক কী হয়েছে বলুন তো?” জলের প্লাসে একটা চুমুক দিয়ে পায়েল জিজ্ঞেস করল।
জিভে একটা আওয়াজ করে সুইচ টিপে পায়েলের মাথার উপরের পাখাটা চালিয়ে দিয়ে ম্যানেজার বললেন, “ওই আপনি যদ্দুর জানেন আমিও তদ্দুরই জানি । একটা বাচ্চা ছেলে দেওয়ালে মাথা ঠুকে পড়ে গেছে ।” 
“অদ্ভুত ব্যাপার যাই বলুন, এরকম একটা বাড়িতে দুর্ঘটনা… ভাবাই যায় না।” 
টোপটা দিয়ে আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল পায়েল। 
“এটা কি প্রথম নাকি?” লোকটা পায়েলের দিকে ঘুরিয়ে নিল চেয়ারটা । মনে মনে হাসল পায়েল। কিন্তু মুখে আসতে দিল না সেটা, “মানে! আগেও হয়েছে?” 
“আমার নিজের চোখের সামনে হয়েছে ।” 
“বলেন কি! ঠিক একই ঘটনা!” পায়েল এতক্ষণে বুঝেছে লোকটাকে কামিনী কাঞ্চন দিয়ে বধ করা যায়নি ঠিকই কিন্তু তৃতীয় একটি ফলায় তিনি ধরা পড়েছেন — গসিপ 
এতক্ষণে পায়েলের খাবার এসে গেছে — ডিম টোস্ট আর চা। বেয়ারা চিনির ডিবে তুলে ধরে বলল, “চিনি দেব?” 
“দাও, তিন চামচ। আমার আবার মিষ্টির উপর একটা ফ্যাসিনেশান আছে ।” 
“তখন আমি নিতান্তই ছোট, বুঝলেন? বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে যা হয় আর কি। পুরনো জমিদারবাড়ি । তার উপরে চারিদিক কেমন অন্ধকার । একটু গা ছমছম করে। ওখানেই গিয়ে লুকোচুরি খেলতাম আমরা। অন্য জায়গায় খেলতে গেলে লোকের দেখে নেবার ভয় । তাই আমরা উত্তরের অন্দরমহলের দিকে খেলতাম। যে চোর হত সে দীঘির পাড়ে গিয়ে দীঘির দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকত । চল্লিশ অবধি গুণত । ততক্ষণে আমরা অন্দরমহলের ভিতরে লুকিয়ে পড়তাম! তো একদিন আমি চোর হয়েছিলাম আর সেই লোকটা দীঘির ধারে বসে জলের দিকে কিছু দেখছে । আমাকে দেখতে পেয়ে হাত তুলে ডাকল। আমি কাছে যেতে কীসব যেন বলেছিল । আমি অত মন দিয়ে শুনিনি । চল্লিশ গুণতে ব্যস্ত ছিলাম তো ।
ভারি মজা হত সেই সময়ে। তো তার পরদিন সকালেই শুনলাম জলের উপরে লোকটার লাশ পাওয়া গেছে।” 
লোকটা থামতে পায়েল তৎক্ষণাৎ কিছু উত্তর দিল না। লোকটার থেকে যতটা জানা যাবে বলে ভেবেছিল তার কিছুই জানা গেল না। সে বিমর্ষ হয়ে আবার খাবারে মন দিল। নাঃ ব্যাপারটা নিয়ে আর এগোনো মুশকিল । ডেড এণ্ড। লোকটা আবার কীসব বলতে শুরু করেছে, পায়েল অতটা কান দেয়নি এতক্ষণ 
“তবে শেষের দিকে আমরা আর লুকোচুরি বেশি খেলতাম না। অন্য খেলা খেলতাম !” 
“কেন?” একটু আগে আগ্রহ দেখিয়েছিল, এখন নিরুত্তাপ দেখালে কিছু বুঝে ফেলতে পারে লোকটা। সেজন্যেই অনিচ্ছা সত্বেও প্রশ্নটা করে। 
লোকটা একটু হেসে বলে, “সে কারণটাও ভারি অদ্ভুত। লুকোচুরি খেললে হরে সবসময় জিতে যেত।” 
“কী করে?” অন্যমনস্কভাবেই প্রশ্নটা করে পায়েল। 
“সে এমন কোথাও একটা লুকাতো যে কেউ খুঁজে পেত না। 
“সে কি! কী করে?” হাতের চামচটা প্লেটের উপরে রেখে ঘুরে বসে পায়েল। 
“সেইটাই সে বলতে চায়নি আমাদের । ওই অন্দরমহলের গলিঘুপচি এমনিতেই অন্ধকার । ভালো করে ভিতরটা দেখা যায় না। অন্য সবাই কেউ সিঁড়ির নিচে লুকাতো, কেউ দোতলার ভাঙা দরজার আড়ালে। হরে ছিল টকটকে ফর্সা, তাকে অন্ধকারে খুঁজে নেওয়া সহজ। কিন্তু সে ব্যাটা এমন কোনো জায়গা জানত যেখানে লুকিয়ে থাকলে খুঁজে বের করা মোটেই সহজ না। প্রথম প্রথম আমরা তাকে খুব জোরজার করতাম বলে দেওয়ার জন্যে, কিন্তু সে কিছুতেই বলতে চায়নি । তাই আমরা রেগে গিয়ে লুকোচুরি খেলাই বন্ধ করে দিলাম ।” . 
“ওঃ…° আর কথা না বলে খাওয়া শেষ করে বাইরে বেরিয়ে এল পায়েল। উত্তেজনায় একটু
বেশি টাকাই টিপ দিয়ে ফেলেছে বেয়ারাটাকে। অনেকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়েছিল বেয়ারাটা। বাইরে এসে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সুনন্দার নম্বরটা ডায়াল করল পায়েল। তুলি প্রথমে ফোন ধরল, তারপর সুনন্দা। 
“দিদি, তোমার আশেপাশে মধুবাবু বা শশাঙ্কদা আছে?” 
“একটু দূরে আছে । কেন বলতো?” অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল সুনন্দা । 
“ওদের মধ্যে যাকে হোক জিজ্ঞেস করো এখানে আশেপাশে হরি বা হারাধন নামের বছর পাঁয়তাল্লিশের কেউ আছে কিনা । হরিনাথ, হরিপ্রসাদ সব চলবে!” 
“কিন্তু কেন?” 
“ধুর বাবা, আগে জিজ্ঞেস কর । পরে বলছি ।” 
“শুধু নাম? সারনেম জানা না?” 
“নাঃ” 
কিছুক্ষণ ওপাশ থেকে আওয়াজ এল না । দূরে ক্ষীণ কথাবার্তা শোনা গেল। তারপর পায়ের আওয়াজের পর আবার সুনন্দার গলা পাওয়া গেল, “তিনজন 
আছে । হরিনাথ, বলহরি আর হারান। হারানের ভালো নাম মধুদা জানে 
“এদের মধ্যে কার গায়ের রং ফৰ্সার দিকে?” 
“ঊফ সেটা তো আগে বললেই হত !” কথাটা বলে আবার দূরে যায় সুনন্দা । পায়েল হাসে । গায়ের রং ফর্সাটা মানুষের পার্মানেন্ট অ্যাট্রিবিউট না। এই গ্রাম্য রোদে জ্বলে লোকটা এখন যদি কালো হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে প্রথমেই সে ফিল্টার হয়ে যাবে । গায়ের রঙটা প্রায়োরিটি না। 
“তিনজনের কেউই ফর্সা নয় । তবে হরিনাথ নাকি একসময়ে খানিক ফর্সা ছিল বলা যায়।” 
“বেশ। এ যেখানে থাকে সে জায়গাটা আমাকে মেসেজ করে পাঠাও জলদি । আমি পরে ফোন করছি ।” 
“কিন্তু হয়েছেটা কী? এরা কারা?” 
ওদিক থেকে উত্তর আসার আগেই ফোনটা
কেটে যায় । সুনন্দা মধুবাবুর থেকে জায়গাটা জেনে নিয়ে মেসেজ করে দেয় । তারপর আবার ভিতরের ঘরে ঢুকে আসে । 
*******
আগের দিনের পুলিশ অফিসারদের মধ্যে একজন আজ আবার এসেছেন। গিরিজাকে এতক্ষণ প্রশ্ন করা হচ্ছিল । তিনি তেমন কিছু উত্তর দিতে পারছেন না। মাঝে মধ্যে কথা বলতে বলতে কপাল চাপড়াচ্ছেন। ক্ষেত্রমোহন বসে আছেন তার পাশে । স্ত্রীর কাঁধে একটা হাত রেখে আগলে রেখেছেন তিনি । 
সুনন্দা বিছানায় তার পাশে বসে পড়ে একটা হাত গায়ে, মাথায় বুলিয়ে তাকে সামলানোর চেষ্টা করল। 
পুলিশ অফিসারটি তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনারা তাহলে এই বিল্ডিংয়ের একতলায় ছিলেন?” 
সুনন্দা মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালো। 
“কোনো আওয়াজ শোনেননি রাতে? মানে দেওয়ালে মাথা ঠোকার 
আওয়াজ তো অনেকদূর যাবার কথা। বিশেষ করে আপনারা তখন সদ্য ঘুমিয়েছেন হয়তো ।” 
“আমি কোনো আওয়াজ পাইনি ।” 
ইন্সপেক্টার আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। সুনন্দা এবার নিজে প্রশ্ন করল, “আমি বুঝতে পারছি না আপনারা এটাকে সুইসাইড বলছেন কী করে? শুধু বাসনপত্র তোলপাড় হয়নি বলে?” 
“খুন তো আমাদেরও প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছিল । ছেলেটা শুয়েছিল দোতলায় । রান্নাঘর একতলায় । এতটা রাস্তা সে একা আসেনি। হয় কেউ ডেকে এনেছিল নাহলে কোনো শব্দ শুনেছিল। কিন্তু আপনারা যখন কিছু শোনেননি তার মানে ডেকেই এনেছিল কেউ ।আজ আমরা ওর মায়ের থেকে জানলাম ছেলেটি স্লিপ ওয়াকিং করত । এমনও হতে পারে রাতে দরজা খোলা পেয়ে হেঁটে বেরিয়ে আসে সে। এবং তারপর খুনি দেখতে পায় ছেলেটিকে । আমাদের এটা ভাবারও যথেষ্ট কারণ আছে যে খুনির কোনো নির্দিষ্ট টার্গেট
ছিল না। তার একটা লাশের দরকার ছিল শুধু!” 
“তাহলে আত্মহত্যা বলছেন যে ।” 
“প্রধান কারণ দুটো। এক, মাথার একই জায়গায়, প্রিসাইস্লি একই পয়েন্টে বার চারেক ব্লো হয়েছে । যেটা খুনের ক্ষেত্রে হয় না। বডি তার স্বাভাবিক নিয়মে একটু আশেপাশে হবেই । আর দুই ভিক্টিমের মাথার পিছনের চুলে কোনো ডিস্টারবেন্স ছিল না। অর্থাৎ পিছন থেকে কেউ ধরে ছিল না তাকে!” 
“এমনও তো হতে পারে রান্নাঘরে কিছু পাড়তে গেছিল সে । নিচে পড়ে গেছে ।” 
“তাহলে চারটে ব্লো আসবে কী করে?” 
নিজের বোকামিটা বুঝতে পেরে মাথা নামিয়ে নেয় সুনন্দা। ক’দিন হল তার মাথাটা একদম কাজ করতে চাইছে না। এটুকু বেশ বুঝতে পারছে এ বাড়িতে যতক্ষণ আছে ততক্ষণ একটা বিষণ্নতা এসে ঘিরে থাকবে তাকে । বিশেষ করে তুলি তো চোখের আড়াল হলেই আতঙ্ক ধরে যায় বুকের মাঝে 
পায়েল কাছে পিঠে থাকলে তাও খানিকটা শান্তি পাওয়া যায় । মেয়েটার বয়স অল্প তবু তার মধ্যে কোথাও একটা ভরসা করার মতো জায়গা আছে! কাল নীলাদ্রি এসে গেলে হয়তো একটু দূরে দূরে থাকবে সে। তখন আবার কি নতুন করে ভয় লাগবে সুনন্দার? 
এইসব ভাবতে ভাবতে বাইরের দালানে বেরিয়ে এল সে। এখন আর কেউ নেই প্যাসেজে । রান্নাঘরের সামনের জায়গাটা খালি । অথচ কাল সারাদিন কত লোক গিজগিজ করছিল । গিরিজার হাহাকারে সমস্ত জায়গাটা যেন ঝাপসা হয়ে আসছিলবারবার । অথচ আজ কি শান্ত । 
নিজের মেয়ের কথা মনে পরে সুনন্দার । রিন্টি মারা যাবার পর বেশ কিছুদিন মুখ খুলতে পারেনি সে। একফোঁটাও কাঁদেনি। স্থবির পাথরের মতো বসেছিল । আগুনে খুব ভয় পেত রিন্টি । বলেছিল বড় হয়ে মায়ের মতো ইন্ডাকশান ওভেন কিনে রান্না করবে । গ্যাস জ্বালাবে না! অথচ কয়েক মুহূর্তে তার গোটা শরীরটা ছাই হয়ে গেল চুল্লির
আগুনে। চুল্লির ভিতর যেতে কি ভয় পেয়েছিল রিন্টি? 
ঘণ্টাখানেক চাতালেই বসেছিল সুনন্দা । ভাবনার মাঝে কোথায় ডুবে গেছিল নিজেরই খেয়াল ছিল না। আচমকা পিঠে একটা হাত এসে পড়ায় চমকে ফিরে তাকাল সে — পায়েল! সদর দরজা দিয়ে ঢুকে কখন যে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি সুনন্দা! বুকের ভিতরের উত্তাপটা নেভানো মোমের মতো কমে আসছে । একটু হেসে সুনন্দা বলল, “ব্যাপার কী তোমার? কাকে খুঁজছিলে এত?” 
“সে বলছি । কিন্তু তুমি কী ভাবছিলে?” সুনন্দার পাশে বসে পড়ে জিজ্ঞেস করে পায়েল। তার জামার গলার কাছটা ঘামে ভিজে গেছে। 
“ভাবছিলাম যে তুমি মেয়েটা খুব ভালো ।” 
“বাবা! কি বলছ গো?” একটু অবাক হয় পায়েল। 
“হ্যাঁ, শুধু একটু বেশি সিগারেট খাও । আর মাথায় খানিকটা ছিটও আছে। সেই সঙ্গে একটুখানি বুদ্ধি।” 
চাপা শব্দ করে একবার হেসে ওঠে পায়েল । হাসলে ভারি সুন্দর দেখা। তাকে। গোটা মুখ জুড়ে ছড়ানো খোলা হাসি। কাজলপড়া চোখের একপ্রাপ্ত ঝিকমিকিয়ে ওঠে সেই হাসির সঙ্গে। 
“এবার বলতো লোকটাকে কী কারণে দরকার? ম্যানেজারের থেকে কিছু পেলে?” 
“যা চাইছিলাম সেটা পাইনি তবে অন্য একটা জিনিস পেয়েছি। উইচ আঃ থিঙ্ক ইজ আ ফ্রুটফুল বারগেন।” 
“কী পেলে আবার?” 
কাঁধ ঝাঁকিয়ে চারিদিক দেখে নিয়ে পায়েল বলে, “তোমাদের উত্তরের অন্দরমহল, যার ভিতর থেকে তুলিকে কেউ ডাকছিল, সেখানে যতদূর সম্ভব একটা হিডেন প্যাসেজ আছে !” 
“অ্যা! সে আবার কী!” চমকে ওঠে সুনন্দা। 
“ইয়েস । আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে কিছু ছেলেপুলে সেখানে লুকোচুরি খেলতে আসত। তার মধ্যে একজনের কাছে হদিস ছিল সেই প্যাসেজের
। সম্ভবত কো-ইন্সিডেন্টালি সে সেটা খুঁজে পেয়েছিল!” 
“কে পেয়েছিল?” 
“এই যে হরিনাথ ঘোষ। লোকটা এই শহরেই থাকে । ক্রেডিট গোস টু মধুবাবু 
“তো তুমি দেখা করেছিলে তার সঙ্গে?” 
“করেছিলাম !” পায়েলের গলায় হতাশার ছাপ। 
“কী বললেন তিনি?” 
“বললেন, কিস্!” 
”মজা না করে সত্যিটা বলবে?” 
“আরে মজা করিনি । ভদ্রলোক বছরতিনেক হল এলঝাইমারসে ভুগছেন। আমি প্রশ্নটা করতে কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থাকলেন, তারপর বললেন ওই, কিস । এখন সেটা কিসমিস নাকি কিস্তি নাকি বুড়োর সত্যি চুমু খাওয়ার 
ইচ্ছা হয়েছিল তা আমি বলতে পারব না।” 
“তাহলে এখন উপায়?” 
সুনন্দার কাঁধে চাপ দিয়ে উঠে দাঁড়াল পায়েল, “উপায় এখন একটাই । একটা খেলা খেলতে হবে।। যেভাবে হরিনাথ জায়গাটা বের করেছিল সেভাবে আমাকেও বের করতে হবে!” 
“কিন্তু ওখানে যে কিছু থাকবেই তার কি মানে আছে?” চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করে সুনন্দা! 
“তা জানি না…” স্বরতেক্তি ফুটে ওঠে পায়েলের গলায়, “বাট সামওয়ান ওয়ানটস টু প্লে হাইড-অ্যাণ্ড-সিক !”

নবম অধ্যায়


“সে তো পুরনো কেস, নয় নয় করে বছর দশেক আগের, তা নিয়ে এখন মাথা ব্যথা কীসের?” 
“একটা ছোট লিড দেখতে পাচ্ছি । মনে হয় কিছু লিঙ্ক আপ পেয়ে যাব ।”
“কী থেকে বলছ?”
“মানে প্যাটার্নটা দেখে মনে হচ্ছে !”
“মার্ডার?” 
“না। প্রিজিউমড সুইসাইড । তবে আপনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলে বুঝতেন ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না ।!”
একটা লম্বা শ্বাস নিলেন ও.সি. বিশ্বরূপ ঠাকুর। তারপর একটা ছোট চিঠি সামনে ফেলে দিয়ে বললেন, “বেশ, গো এহেড। তবে দশ বছর আগের কেস তো, যারা আই উইটনেস ছিল তারা কতটা মনে রাখতে পেরেছে সেটা নিয়ে আমার যথেষ্ট ডাউট আছে ।”
 “আমারও তেমন আশা নেই । তবে লোকটার বাড়িতে একবার ঢু মারাটাই বড় কথা । সেই সঙ্গে অফিসের ক’জন কর্মচারীকে যদি নাগালে পাওয়া যায় ।” 
 আর কিছু না বলে চায়ে চুমুক দিলেন ঠাকুর। তারপর সামনে রাখা কম্পিউটারের উপরে ঝুঁকে পড়ে কিছু দেখতে লাগলেন। 
হাতের ফাইলটা খুলে পাতা ওলটালো মুকেশ খাসনবীশ । তারপর মুখ তুলে বলল, “এই দোকানটা কি এখনও আছে?” 
“হ্যাঁ। পার্টনারশিপ ব্যাবসা ছিল । ভদ্রলোক মারা যাবার পরে তার পার্টনার একাই হাল ধরে ।” 
 “আর বাড়িটা কোথায়?”
 “সে সময়ে বাড়ি একটা ছিল বটে, তবে ভদ্রলোক মারা যাবার পরে স্ত্রী ও ছেলে বাড়ি বেচে দিয়ে কিছুদিনের জন্যে বাপের বাড়ি চলে যায় । মহিলা নাকি পুলিশের উপরে বেজায় খাপ্পা। তারা এখন কোথায় আছে না আছে জানাতে আমার বিকেল কাবার হয়ে যাবে ।” 
 “তাই সই । সেরকম হলে আজকের দিনটা এখানে কাটিয়ে কাল ফিরব। আপনি দোকানের অ্যাড্রেসটা দিন !” 
হোটেলের ঘরে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে দুপুর গড়াবার আগেই বেরিয়ে পড়ল খাসনবীশ । বড়বাজার তার মোটামুটি চেনা। না চিনলেও দোকানের নাম দেখে চিনে নেওয়া ঝামেলার কিছু হবে না। তবে মুশকিলটা হল তখনকার কর্মচারীদের ক’জনকে এখানে পাওয়া যাবে সেটা বলা মুশকিল । অন্তত ঘটনার সময় যারা উপস্থিত ছিল তাদের দু-একজনকে পাওয়া গেলেও ঢের । 
সিভিলিয়ান ড্রেসেই ট্যাক্সি করে দোকানটার সামনে চলে এল মুকেশ। ট্যাক্সিওয়ালাকে দোকানের নাম বলতেই নিয়ে এল সে। 
দোকানটা যতটা ভেবেছিল এখন তার থেকে বেশ খানিকটা বড় হয়েছে । মূলত মশলাপাতির দোকান। মাঝ দুপুর বলে লোকজনের ভিড় অন্য সময়ের তুলনায় খানিকটা কম! মুকেশ ভিতরে ঢুকে এল । গদিতে চড়াও হয়ে বসে থাকা মুশকো লোকটাকে পরিচয় দিতেই সে খানিক নড়েচড়ে বসল । ইনকাম 
ট্যাক্সের লোক ভেবে বিষম খেয়েছিল আর কি। শেষে মুকেশ অন্য কাজে এসেছে জেনে খানিক শান্ত হল । বিনয়ে গলে পড়ে বলল, “আপনার জন্যে কি করতে পারি স্যার? চা খাবেন?” 
“কিছু খাব-টাব না। কয়েকটা প্রশ্ন আছে, তাড়াতাড়ি উত্তর দিন, আমি কেটে পড়ি।” 
“বলুন না।” 
“আপনিই মৃগাঙ্ক অধিকারী?” 
লোকটা উপর নিচে মাথা নাড়ল, ‘‘হ্যাঁ, দোকানটা আমারই ।” 
“সে তো এখন, আগে পার্টনারশিপ ছিল, তাই না?” 
“হ্যাঁ স্যার।” অধিকারী সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন । 
‘“শশিভূষণ সরকার ছিল আপনার পার্টনার, তাই তো?” 
এবার মাথা নাড়লেন মৃগাংকবাবু। উদাস গলায় বললেন, “আপনি বুঝি সেই কেসের জন্যেই
আজ…” 
“আঃ, যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দিন শুধু। সেই ভদ্রলোক যেদিন আত্মহত্যা করেন সেদিন আপনি কোথায় ছিলেন?” 
“আমার বাড়িতে। আমাদের ব্যবসা তখন খানিকটা ঝিমিয়ে চলছে । দোকানটা ভালো করে দাঁড় করাতে পারি না! লসও হত খানিকটা। ফলে কর্মচারী ছিল না বেশি । রাতে দোকান খালি রেখে যেতে ভয় করত। ফলে একদিন আমি আর একদিন শশি রাতটা দোকানেই থেকে যেতাম!” 
“আগের দিন রাতে দোকান কণ্টা অবধি খোলা ছিল?” 
“প্রায় দশটা। এখন অবশ্য নগায় বন্ধ হয়ে যায় ।” 
“সেদিন মিস্টার সরকারকে দেখে আপনার আলাদা করে কিছু মনে হয়েছিল? মানে কোনো কারণে মন খারাপ বা ডিপ্রেসড লাগছে এই ধরনের কিছু?” 
এইবার একটু ভেবে জবাব দিলেন মৃগানঙ্কবাবু, “আজ্ঞে না। বললুম যে ব্যবসাটা ভালো চলছিল না সেই সময়ে। তবে এমন কিছু ক্ষতিও হচ্ছিল না। মানে সুইসাইড করার মতো তো একেবারেই না। তবে বাড়িতে যদ 
কিছু হয়ে থাকে তাহলে আমার জানার কথা নয় ।” 
চেয়ারে বসা অবস্থাতেই একটু পিছিয়ে এল মুকেশ। এ লোকটার থেকে আর তেমন কিছু জানা যাবে না। তবে হাবভাব দেখে কিছু গোপন করতে চাইছে বলেও তো মনে হচ্ছে না। এখানে আসার আগে ভেবেছিল এর কাছ থেকে আত্মহত্যার কিছু মোটিভ পাওয়া যাবে । অথচ না, লোকটার যেন একদিন রাতে হঠাৎ খেয়াল হল আর টুক করে সিলিঙে ঝুলে পড়ল!
“আচ্ছা, আপনাদের শাটার নামিয়ে যদি তালা দেওয়া থাকে তাহলে বাইরে থেকে কোনো লোকের পক্ষে কি ভিতরে ঢাকা সম্ভব?” 
একটু হাসলেন মৃগানঙ্কবাবু, “এখন সম্ভব নয় । কিন্তু তখন সেটা করা যেত!। তবে ভিতর বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন তার উপর নির্ভর করছে। একটু আসুন এদিকে, বুঝিয়ে দিচ্ছি।” 
গদি থেকে উঠে মুকেশকে নিয়ে একটু বাইরের দিকে এলেন মৃগাঙ্কবাবু। একটু দূরেই দোকানের বড়সড় শাটারটা । বাইরে থেকে কেউ দোকানে ঢুকতে চাইলে আগে তাকে শাটার পেরোতে হবে। তারপর একটা এক মিটারের বর্গক্ষেত্রের ফাঁকা জায়গা! এখন সেখানে কয়েকটা ডালের বস্তা আর দাঁড়িপাল্লা রাখা আছে । বোঝা যায় এ জায়গাটা দোকানে ডিসপ্নে আর 
মাপার আউটলেট । সেটাও পেরিয়ে এলে দোকানের ভিতরে একটা কাঠের বড়সড় দরজা । সেটা ভিতর থেকে ছিটকানি লাগিয়ে দেওয়া যায়। 
দাঁড়িপাল্পা রাখা জায়গাটার উপরের দিকটা দেখিয়ে মৃগানঙ্কবাবু বললেন, “উপরটা এখন ছাদ
 দেখছেন । ওটা তখন ঢালাই করা ছিল না। ফলে খানিকটা ফাঁক হয়ে থাকত । এখন কারও যদি ভিতরে ঢাকার ইচ্ছা হয় তাহলে পাশের দোকানের বাইরের পাঁচিলের উপরে উঠে ওখান থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়তে পারে । কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে না!” 
“কেন?” 
“কারণ এই কাঠের দরজাটা । এটা প্রতি রাতে ভিতর থেকে লোহার ছিটকানি দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় । লাফিয়ে কেউ যদি ওপাশে নামেও, এ দরজাটা না খুলে সে ভিতরে যেতে পারবে না । বড়োজোর একটা দাঁড়িপাল্লা আর একটা পাপোষ চুরি করতে পারবে !” 
“সে রাতে এই কাঠের দরজাটা বন্ধ ছিল আপনি সিওর?” 
“কোনো সন্দেহ নেই । এমনকি সকালে যারা দেহ উদ্ধার করে তাদের শাটারের তালা খুলে কাঠের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকতে হয় !” 
“কাঠের দরজা দোকান খোলার পর থেকে সারাদিন খোলা থাকে, শুধু রাতে বন্ধ হয়, তাই তো?” 
“হ্যাঁ স্যার। দিনে ওর সামনেটায় দাম লেখা বোর্ড আর বস্তা রাখা থাকে । চাইলেও বন্ধ করা যাবে না।!” 
“হুম…” দরজাটা দেখতে দেখতে ভিতরে ঢুকে আসে মুকেশ, তারপর বলে, “যারা বডি উদ্ধার করেছিল তাদের মধ্যে কাউকে এখন পাওয়া যাবে?” 
মাথা নাড়েন মৃগাঙ্ক অধিকারী, “কেন পাওয়া যাবে না। পাশের দোকানের কয়েকজন ছিল। তবে বেশিরভাগই আমাদের দোকানের কর্মচারী । তারা এখনও আছে । শশির নিজের দেখাশোনায় নিয়োগ করা লোক । আমি আর ছাটতে চাই না!” 
“বেশ। তাদের কাউকে ডেকে দিন ।” 
গদির উলটোদিকের চেয়ারে বসে মন দিয়ে ভাবতে থাকে মুকেশ । মিলছে না, কিছুতেই উত্তর মিলছে না। যদি চেনা কারও গলা পেয়ে শশিভূষণ দরজা খুলে দেয় তাহলে খুন করার পর আগন্তুক
দরজা আটকালো কী করে? ভিতরে তো তখন শশিভূষণের ঝুলন্ত শরীর ছাড়া আর কেউ ছিল না। তাছাড়া চেনা কেউ দোকান বন্ধ হয়ে যাবার পর ছাদ টপকে দোকানে ঢুকছে দেখে সন্দেহ হল না শশিভূষণেরঃ? স্ট্রেঞ্জ! 
একটু পরে একটা মাঝবয়সী লোক এসে দাঁড়াল মুকেশের সামনে। লোকটাকে দেখে বোঝা যায় সে সারাদিনই মশলাপাতি নিয়ে থাকে। সাদা স্ট্রাইপ শার্টের বেশ কিছু জায়গায় লাল হলুদের ছোপ । তবে মাথার চুল বেশ পরিপাটি করে আঁচড়ানো । 
লোকটা মুকেশকে নমস্কার করে বসে পড়ল তার সামনে । মুকেশ দুটো হাত জড়ো করে নমস্কার করে বলল, “আপনার নাম?” 
“সুধাংশু রায় ।” 
“শশিভূষণবাবুর দেহ আপনিই উদ্ধার করেন?” 
“শুধু আমি না। অনেক লোকই তো ছিল।” 
পকেট থেকে একটা টেপ রেকর্ডার বের করে রেকর্ডিংয়ের বাটানটা অন করে দেয় মুকেশ। তারপর একটু পিছনে সরে আসে, “সেদিনের ঘটনা যা মনে আছে একটু বলুন তো, একেবারে আগের দিনের রাত থেকে । আমি থামাব না আপনাকে ।” 
প্রায় আধ মিনিট ভাবেন সুধাংশু । তারপর গোড়া থেকে বলতে শুরু করেন, “দোকানের শাটার নেমে যেত দশটায় । তবে আমাদের সব গোছগাছ করে বাড়ি যেতে বারোটা পার হয়ে যেত । আমার বাড়ি সামনেই । হেঁটে যেতে আধঘণ্টার বেশি লাগে না সেদিন বারোটার সময় আমি আর বদ্রিনাথ নামে আর একজন কর্মচারী বের হয়ে যাই । বদ্রিনাথের স্কুটার ছিল, তাতে করেই বাড়ি ফিরতাম । কিন্তু…” 
একটু থামলেন সুধাংশু কি যেন ভেবে নিজেই অবাক হলেন একটু 
ধীরে ধীরে বললেন, “কিন্তু সেদিন বদ্রিনাথের সঙ্গে ফিরিনি । কেন ফিরিনি ঠিক মনে পড়ছে না।” 
“বেশ, পরে ভেবে বলবেন। তারপর?”
“তারপর বাড়ি গিয়ে কিছু কাজকম্ম করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । আমি দোকানে আসতাম সকালে সাড়ে ন’টায় । শশিদা নাহলে মৃগাংকদা ততক্ষণে ভিতরের ঘর খুলে দিতেন। আমি গিয়ে শাটার তুলতাম । সেদিন চাবি দিয়ে শাটার খুলে দেখি ভিতরের দরজা খোলেনি । প্রায় আধঘণ্টা কি পয়তাল্লিশ মিনিট ডাকাডাকি করলাম । বাইরের একটা ফোন থেকে ভিতরের ল্যান্ড লাইন নাম্বারে ফোন করলাম । সেটা বেজে যাওয়ার আওয়াজ পেলাম কিন্তু কেউ দরজা খুলল না। তারপর শুরু হল ধাক্কাধাক্কি।। ততক্ষণে আমার চেচামিচিতে আশেপাশের দোকানের লোক এসে জড়ো হয়েছে । কাস্টমাররাও ছিল । করাত দিয়ে দরজা চিরে ফেলা হয়। সেখান দিয়ে লোক ঢুকে দেখে সিলিং থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছেন শশিদা । তারপরেই পুলিশে আর ডাক্তারে খবর দেওয়া হয় !” 
কথাগুলো বলে একটু থামলেন সুধাংশু । মুকেশ গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, “আপনারা যখন ঘরে ঢোকেন তখন ঘরের আলো জ্বলছিল?” 
“না।” 
“জানালা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল?” 
“হ্যাঁ। বডি নামানোর পর সন্দেহ হওয়াতে আমি নিজে দেখেছিলাম ।” 
“আর দরজার ছিটকিনিটা?” 
“হ্যাঁ স্যার। ওটা তখনও আংটাতেই গলানো ছিল। পুলিশ এসেই সে ছিটকিনি খোলে ।” 
কয়েক সেকেণ্ড থেমে পরের প্রশ্নটা করে মুকেশ, “সেদিন আপনি বাড়ি যাবার আগে মিস্টার সরকারকে কেমন দেখেছিলেন?” 
“কেমন বলতে?” 
“মানে মন-মেজাজ খারাপ, কথা বলতে চাইছেন না কারও সঙ্গে বা ধরুন 
অন্য কোনো ভাবনায় ডুবে আছেন, এরকম কিছু?” 
মাথা নাড়তে গিয়েও থেমে গেলেন সুধাংশু । কিছু যেন একটা মনে পড়েছে তার। খানিক ভেবে
  নিয়ে বললেন, “মন খারাপ নয়, তবে মাথাটা একটু গরম ছিল।” 
“কেন?” 
“সেদিন দুপুরে টিফিনবেলার দিকে আমরা খেতে গেছিলাম । বদ্রি যায়নি । সে কীসব পুজোআচ্চা করত বলে দুপুরে খেত না। ঘুমিয়ে পড়েছিল । এই সময়ে একটা ছোকরা দোকানে ঢুকে কীসব চুরি করছিল যেন। আমরা ফিরে তাকে দেখতে পেয়েই ধরতে যাই । সে দৌড়ে পালিয়ে যায় ।’ 
একটু নড়েচড়ে বসে মুকেশ, “কীরকম ছোকরা? তাকে দেখেছেন আগে?” 
“না। এমনি দেখলেই চোর-চোর মনে হয় । ভেবেছিলাম ধরে খানিক শাসানি দিয়ে ছেড়ে দেব । কিন্তু সে তো পালিয়ে গেল! শশিদা বদ্রিকে খুব বকাবকি করলেন । তারপর থেকে সারাদিনই বোধহয় মাথাটা গরম ছিল । কিন্তু তার জন্যে আত্মহত্যা…” 
“না না। সে কথা নয় । যাই হোক, আজ আপাতত চলি আমি। সেদিন আপনি কেন বদ্রিনাথের সঙ্গে ফেরেননি সেটা মনে পড়লে একটু জানাবেন আমাকে। কেমন?” 
সুধাংশু বিনীত মাথা নেড়ে দিতে বেরিয়ে এল মুকেশ। তারপর পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কেশব শর্মার নম্বরটা ডায়াল করল। ওপাশ থেকে গলা শোনা গেল। 
— বলো মুকেশ। 
— এদিকে কিছু সুবিধে হচ্ছে না স্যার। মোটিভ, খুনের থিওরি, কিছুই খাঁড়া করা যাচ্ছে না। বরঞ্চ মনে হচ্ছে একদিন রাতে লোকটা টুক করেই ঝুলে পড়েছে। কোনো লিড নেই । জাস্ট নাথিং 
— পুলিশ সুইসাইড বলার পরেও ওখানকার লোকেরা নাকি খুন বলছিল । কেন বলছিল জিজ্ঞেস করেছ? 
— সরকার সুইসাইড করার মতো লোক ছিল না স্যার। ব্যবসাপাতি খানিকটা মন্দ গেলেও সামলে নিচ্ছিল ধীরে ধীরে। তবে দোকানে একটা
  ছিচকে চোর আসায় এক কর্মচারীর উপর মাথাটা সেদিন একটু গরম ছিল। 
— রাগের মাথায় আত্মহত্যা! 
— সেটা অ্যাবসারড । ভাবছি সন্ধ্যাবেলা ওর বাড়িতে একবার হানা দিয়ে আসব । যদি কিছু পাওয়া যায় । 
— বেশ। কাল সকালে ফিরবে তাহলে? 
— তেমনই তো দেখছি। 
ফোনটা রেখে দিয়ে থানায় আর একবার ফোন করল সে। ও.সি. সাহেব এখনও পাঠাননি ঠিকানা। দোকানে জিজ্ঞেস করলে হয়তো পাওয়া যেত কিন্তু পুলিশের তত্ত্বাবধানে যাওয়ার একটা আলদা ভার আছে। 
দোকানের বাইরে থেকে আর একবার পুরো জায়গাটা দেখল মুকেশ । মনে মনে কল্পনা করার চেষ্টা করল সেই রাতটা । 
চতুর্দিক ঢেকে আছে অন্ধকারে । রাস্তার ধারগুলোতে শুধু সোডিয়াম ভেপারের আলো মিটমিট করে জ্বলছে । সমস্ত দোকান বন্ধ । হয়তো রাস্তায় একটা কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে । মনে মনে একবার হাসল মুকেশ । ভাবনাটা একটু বেশি খেলছে তার । 
সেই অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে একটা লোক । বেশ শক্তসমর্থ চেহারা। ধরা যাক তিরিশ থেকে চল্পিশের মধ্যে । সে একটু একটু করে এসে দাঁড়াল এই দোকানের সামনে । তখনও দোকানের ছাদটা তৈরি হয়নি । উপরের দিকে অনেকটা ফাঁক । পাশের দোকানের পাঁচিলের উপরে উঠে সেই ফাঁক গলে নিচে নামল সে। এখন আর তাকে বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না! ঢেকে গেছে শাটারের পিছনে। কিন্তু তারপর? ছিটকানি না খুলে ঘরের ভিতরে ঢুকল কী করে? বেরোলই বা কী করে? দূর থেকে গুলি করে বা ছুরি দিয়ে খুন না, গলায় দড়ির ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া । এ কী করে সম্ভব? 
নাঃ, আত্মহত্যাই করেছিলেন শশিভূষণ সরকার। শুধু জানা দরকা 
মোটিভটা । সেটা জানার জন্যে তার বাড়ি না
   গেলে চলবে না । 
মোবাইলটা বের করে আবার চেক করে মুকেশ । একটা মেসেজ এসেছে তাতে। 
রাজারহাট নিউটাউনের ঠিকানাতে যখন সে পৌঁছাল তখন সন্ধে গড়িয়ে সাড়ে আটটা বেজেছে । এদিকে রাস্তাঘাট এমনিতেই শুনশান থাকে । তার উপরে রাত বাড়লে একেবারেই জনমানবহীন হয়ে পড়ে। স্কাইরাইজ অ্যাপার্টমেন্টের ছ’তলায় ছায়া সরকার লেখা নেমপ্লেটের পাশের কলিং বেলটা যখন বাজাল তখন তার নিজের শরীর ক্লান্ত হয়ে এসেছে । সারাদিন টোটো করে বেরিয়েও নতুন কিছু পাওয়া যায়নি । উলটে এখন মনে হচ্ছে শশিভূষণের সুইসাইড আর অতীনের মৃত্যুর মধ্যে আদৌ কোনো যোগসূত্র নেই । 
“আসুন ।!” দরজা খুলে বললেন ছায়াদেবী । তাকে আগে থেকেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল মুকেশ; তাই আর নতুন কোনো প্রশ্ন করলেন না। 
মহিলার বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে । ছেলেমেয়ে আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। অন্তত ঘরের ভিতর তো তেমন কোনো চিহ্ন নেই । 
“অসময়ে বিরক্ত করছি বুঝতে পারছি কিন্তু বিশ্বাস করুন জরুরি দরকার না হলে…” মুকেশকে কথার মাঝেই থামিয়ে দিলেন ভদ্রমহিলা । 
“আমার আপনাদেরকে জরুরি দরকার ছিল আজ থেকে দশ বছর আগে । বড্ড দেরি করে ফেললেন দাদা !” কঠিন গলায় কথাগুলো বলে একটা সোফার দিকে নির্দেশ করে দিলেন ছায়াদেবী । নিজে বসলেন উলটোদিকের চেয়ারে । 
“তা হঠাৎ এতদিন পরে ওঁর কথা মনে পড়ল আপনাদের!” 
মুকেশ বুঝল ভদ্রমহিলা কোনো কারণে পুলিশের উপরে খাপ্পা হয়ে আছেন। সেটা শুভ সংকেত। ।মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে যতটা কথা চেপে রাখতে পারে,ইমোশানালি ভালনারেবল থাকলে ততটা পারে না। সে একটা বিনয়ের হাসি হেসে বলল, “আসলে আমি কেসটার সময়ে এখানে ছিলাম না! মানে দশ বছর আগে আমি
পুলিশে জয়েনই করিনি, তাই ঠিক জানি না…” 
“জানার মতো কিছু নেই । আমার স্বামী মারা গেছেন । আপনারা বলেছেন 
তিনি আত্মহত্যা করেছেন । আর জানার কী থাকতে পারে?” 
“আর আপনি কী বলছেন? আত্মহত্যা নয়?” ঠিক জায়গা মতো প্রসঙ্গটাকে য়ে যায় মুকেশ। 
“আমি কেন? ওঁর সব কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করুন। সব বন্ধুবান্ধবকে জিজ্ঞেস করুন, আশেপাশের দোকানদারদের জিজ্ঞেস করুন। পুলিশ ছাড়া যাকে খুশি জিজ্ঞেস করুন, উত্তর পাবেন!” 
‘“আজ সারাদিনই প্রায় তাদের জিজ্ঞেস করেছি । সত্যি কথা বলতে আমার নিজের মনে হচ্ছে এটা সুইসাইড নয় । কিন্তু খুন বললেই তো আর হয়ে গেল না। সেটা হল কীভাবে?” 
“সেটা আপনারা বুঝবেন। আমি শুধু জানি সেই রাতে আত্মহত্যা করার ধারে কাছেও সে ছিল না।” 
“উনি তো সারাদিন বাড়ি ফেরেননি । আপনি সেরকম নিশ্চিত হয়ে বলছেন কী করে? হয়তো সারাদিনে এমন কিছু ঘটেছিল যাতে উনি ডিপ্রেসড হয়ে গেছিলেন।” 
“সেটা আমাকে ফোনে বলততো না?” 
“ফোন করেছিলেন? কখন?” । 
থেমে একটু দম নিলেন ছায়াদেবী । তার গলার পারদ কয়েক দাগ নিচে নেমে এল, “দু’বার করেছিল । একবার বিকেলে আর একবার রাতে। ওরা সবাই বেরিয়ে যাবার পর।” 
“কখন?” 
“তা প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ। ভিতরে বসেই কিছু হিসেবের কাজ করছিল । সেসব শেষ করে ঘুমোতে যাবার আগে আমাকে ফোন করে ।” 
অর্থাৎ সাড়ে বারোটা অবধি বেঁচে ছিলেন শশিভূষণ । মনে মনে কয়েকটা হিসেব গুছিয়ে নিল মুকেশ। 
“তখন গলা শুনে কী মনে হয়েছিল আপনার?” 
“কী আবার মনে হবে? যে অফিসার আমাকে
জেরা করেছিলেন তিনি 
প্রকারন্তরে আমাকে বলিয়ে নিয়েছিলেন যে সে রাতে ওর গলাটা আমা অন্যরকম লেগেছিল !” 
“সত্যি লেগেছিল?” এবার সোফায় সোজা হয়ে বসে মুকেশ । তার পুলিশি নাক কিছুর একটা গন্ধ পেয়েছে। 
চেয়ার ছেড়ে এবার উঠে পড়েন ছায়াদেবী । তারপর থুতনিতে একটা হাত রেখে কয়েক পা এগিয়ে এসে বলেন, “দেখুন অন্যরকম লাগার দুটো মানে হয় । এক, গলায় এমন কিছু ইম্পালস থাকা যা অন্য সময়ে শুনতে পাওয়া যায় না। দুই, গলার আওয়াজটাই অন্যরকম! আমি একবার বলে ফেলার পর পুলিশকে আর কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারিনি যে আমার অন্যরকম লাগাটা দ্বিতীয় জাতের । সেদিন রাতে ওর গলাটা অচেনা লেগেছিল আমার ।” 
“আপনার সন্দেহ হয়নি তাতে? মানে হঠাৎ করে একটা মানুষের গলা অন্যরকম লাগবে কেন?” 
“একেবারেই না। তখন ল্যান্ডফোন এসেছে বেশিদিন হয়নি । অনেকেরই গলার আওয়াজ পালটে যেত তাতে। তাছাড়া যেদিন রাতে ও দোকানে থাকত সেদিন ঠিক ওই সময়েই ফোন করত আমাকে !” 
গবেশ, তা ফোন করে কী বলেছিলেন তিনি?” মুকেশ গালে হাত রাখে। 
“বলেছিলেন ওঁর একটা কাগজ উনি খুঁজে পাচ্ছেন না। সেটা কোথায় থাকতে পারে জিজ্ঞেস করছিলেন।” 
“আপনি জানবেন কী করে?” 
“আমাকে সব কথাই বলতো ও !” 
“কীসের কাগজের কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন?” 
“একটা জমিদার বাড়ির কীসব যেন কাগজ । ক’দিন ধরে খুব ছোটাছুটি করেছিল ওটা নিয়ে । আমি মনে করে ওকে জায়গাটা তখনই বলে দিই ।” 
মুহূর্তে মুকেশের ক্লান্ত পিঠ সোজা হয়ে যায়। এই
প্রথম এ খুনের সঙ্গে জমিদারবাড়ির একটা লিঙ্ক পাওয়া গেছে। আজ কলকাতায় আসা একেবারে বৃথা যায়নি তার মানে । 
“সে কাগজ এখন কোথায়?” 
মাথা নাড়েন ছায়াদেবী, “আমি জানি না। ও মারা যাবার পরে সেটাকে আর দেখতে পাইনি ।” 
“তার আগে দোকানেই ছিল?” 
“দোকানের ড্রয়ারে ওর একটা পারসানাল ফাইলের মধ্যে ওটাকে রাখত । বিশেষ হাতছাড়া করতে চাইত না!” 
‘পকেট থেকে কাগজ বের করল মুকেশ । সেটা মহিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে ধলল, “দেখুন তো, এটার কোনো মানে বুঝতে পারেন কিনা…” 
হাতে নিয়ে কাগজটা দেখলেন ছায়াদেবী । তিনটে শব্দে লেখা -আছে কাগজে । পড়ে অচেনা ঠেকল তার। মাথা নেড়ে সেটা ফেরত দিতে দিতে তিনি বললেন, “আপনারা কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। আজ হঠাৎ এসবের কথা উঠছে কেন?” 
“উঠছে কারণ আমার মনে হয় আপনার লেট হাসব্যান্ডের মৃত্যুর সঙ্গে একটা নতুন কেসের কোথাও একটা যোগাযোগ আছে !” 
“কীরকম যোগাযোগ?” মহিলাকে উৎসাহিত দেখায় । 
“একটি বাচ্চাছেলেকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ফরেনসিক বলছে আত্মহত্যা কিন্তু আমাদের তা মনে হচ্ছে না।” 
“এটুকুই মিল? ব্যস?” 
“না। ছেলেটি সেই বাড়িতে মারা গেছে যার কাগজপত্র আপনার স্বামীর কাছে ছিল।” 
“অতীন, আপনি কি অতীনের কথা বলছেন?” 
আজ সন্ধের মধ্যে দ্বিতীয়বার ধাক্কা খেল মুকেশ, “‘আপনি চেনেন তাকে? মানে… চিনতেন?” 
সোফার উপরেই বসে পড়লেন ছায়াদেবী, “মুখ চিনতাম না! তবে ওঁর মুখে কয়েকবার শুনেছি ছেলেটার কথা। শেষের দিকে তো মাঝে মাঝেই বলতে ।
“কী বলতো?” মুকেশের শিরদাঁড়ায় এতক্ষণে পিপড়ে দৌড়াতে শুর করেছে । 
“বলতো ছেলেটা নাকি বিপদে আছে। অথচ তখন ছেলেটার বয়স তিণ কি চার মাত্র।” 
“সে কি! ঠিক কীসের জন্যে বিপদে আছে সেকথা জানতে চাননি আপনি? মানে কৌতূহল হয়নি?” 
“জানতে চেয়েছিলাম কয়েকবার । কিন্তু বলেনি । এই ব্যাপারটা নিয়ে ও বেশি কথা বলতে চাইত না! কিছু যেন গোপন করত!” 
“ওঁর ডায়েরি বা ওই জাতীয় কিছু আছে আপনার কাছে? বা কোনো কাছের বন্ধু যাকে এসব কথা বলে থাকতে পারেন?” 
“তেমন কেউ নেই । খাতাপত্র যা কিছু ছিল বহুদিন আগে হারিয়ে গেছে। বাড়ি বদলের পরে তো কিছুই নেই ।” 
টেবিলের উপর থেকে জলের প্লাস তুলে এক টোক খেল মুকেশ, বলল, “আপনার হাসব্যান্ড দাবি করেছিলেন তার কাছে এমন কিছু কাগজপত্র আছে যা তাকে জমিদারবাড়ির দেখাশোনার দায়িত্ব দেয় । কাগজখানা তিনি কীভাবে পেয়েছিলেন জানেন? মানে জমিদারবাড়ির সঙ্গে ওঁর পূর্বপুরুষের কীরকম সম্পর্ক ছিল?” 
“বিয়ের আগে কয়েকবার বলেছিল জমিদারবাড়ির কথা। তখন কিছু বলে থাকলেও এখন আমার আর মনে নেই ।” 
আরও মিনিট দশেক নানা কথাবার্তার পর উঠে পড়ল মুকেশ । বেশ কিছুটা সমবেদনা জানালো মহিলাকে । যদিও তার মনের মধ্যে ঝড় বইছে। শশিভূষণ তাহলে জানতেন ছেলেটার কোনো কারণে বিপদ আসছে । হয়তো সেজন্যেই বাড়িটা দেখাশোনার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিলেন । কিন্তু কী বিপদ? একটা চার বছরের ছেলের প্রতি কার রাগ থাকতে পারে? 
এই সব প্রশ্নের উত্তর জানতেন বলেই তাহলে খুন করা যায় শশিভূষণকে । কিন্তু কে করল? কীভাবেই বা করল।
ফরেনসিক রিপোর্ট বলছে সাড়ে বারোটা থেকে একটার মধ্যে আত্মহত্যা করেন শশিভূষণ । ঠিক সেই সময়েই তার বাড়িতে ফোন করে স্ত্রীয়ের কাছ থেকে কেউ কাগজের হদিস জানতে চায় । অর্থাৎ শশিভূষণকে শুধু খুন করলেই হবে না। পৃথিবী থেকে সেই কাগজের অস্তিত্বও সরিয়ে ফেলতে হবে। কাগজ খুঁজে না পেয়েই বাধ্য হয়ে বাড়িতে ফোন করতে হয় । 
এখান থেকে দুটো ব্যাপার পরিষ্কার হয় । এক, খুনি জানত শশিভূষণ ওইসময়ে বাড়িতে ফোন করে । দুই, খুনি এও জানত কাগজ বাড়িতে নেই । দোকানেই আছে । 
এ থেকে আন্দাজ করে নেওয়া কঠিন নয় যে খুনি শশিভূষণের চেনা কেউ । এবং চেনা কেউ বলেই তাকে কোনো কারণে কাঠের দরজা খুলে দেয় শশিভূষণ । সেক্ষেত্রে আবার দুটো নতুন প্রশ্ন উদয় হয় । 
এক, অতীন খুন হতে পারে সে কথা শশিভূষণ জানতো কিন্তু কে খুন করবে সেটা কি জানতো না? তাহলে দরজা খুলে দিল কেন? 
দুই, যদি ধরেও নেওয়া যায় কোনো কারণে দরজা খুলে দেয় শশিভূষণ, তাহলে সেই দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে পালাল কী করে খুনি? হাউ ইজ অল দিস ড্যাম থিং পসিবল? 
হোটেলে ফিরে কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বিছানার উপর ঝাঁপিয়ে শুয়ে পড়ল মুকেশ । ঘরের আলোটা নেভাতে গিয়েও নেভালো না। সকালে ও.সির দেওয়া ফাইলটা টেনে নিয়ে দেখতে শুরু করল । এতে যা লেখা আছে তার সবই একটু আগে নিজের কানে শুনেছে। 
ঝুলন্ত শশিভূষণের মরদেহের বিবরণ, ফরেন্সিকের রিপোর্ট, যে ক’জন তাকে ঝুলতে দেখেছিল তাদের জবানবন্দী। কোথাও কোনো গণ্ডগোল নেই । এমন কি ছায়া সরকারের ‘অন্যরকম গলা’র কথা অবধি লেখা আছে । সেখান থেকেই পুলিশ ডিসাইফার করেছে যে কোনো কারণে ডিপ্রেসড ছিলেন ভদ্রলোক । 
সব কিছুই ঠিকঠাক মিলে যাচ্ছে, এবং
সেইখানেই গণ্ডগোল । সবকিছু মিলে যাচ্ছে কী করে? 
ফাইলে কয়েকটা পাতা উলটে মুকেশ দেখল ঘটনার দিন সকালে পুলিশের তোলা কয়েকটা ছবি পিন দিয়ে আটকানো আছে রিপোর্টের গায়ে । মরদেহ নামানোর তুরন্ত পরের ছবি, মরদেহের ছবি, দেওয়াল, ঘড়ি, মশলার বস্তা, ভাঙা দরজা, সিলিং… 
সেগুলো পর পর দেখতে দেখতে আচমকা মুকেশের মনের ভিতরে একটা খচখচানি শুরু হল। একটা ছবি । ছবিটাকে যত ভালো করে সে দেখছে তত মনে হচ্ছে কিছু একটা গণ্ডগোল আছে ছবিতে । কোথায় একটা বড়সড় অসঙ্গতি আছে অথচ কিছুতেই চোখে পড়ছে না। ঘড়িতে কি তাহলে কিছু আছে? নাঃ ঠিক সকাল সাড়ে দশটা বেজে আছে তাতে। তাহলে? 
ছবিটা ভালো করে দেখতে লাগল মুকেশ । এরকম খচখচানি তো সচরাচর হয় না তার। কী আছে ছবিতে? 
কোথায়? 
মুকেশ খাসনবীশ অস্থির হয়ে উঠল…


দশম অধ্যায়

ভোরের একটা সময় থাকে যখন সূর্যের আলোর ঘুমও ঠিক করে ভাঙে না। ঘুমমাখা ঢুলুঢুলু অলস চোখে সে তাকায় পৃথিবীর মাটির দিকে । কোনোরকমে একটুথখানি আলো দিয়ে আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়তে চায় ।
বিরাট জমিদারবাড়ির উপরেও তেমনই আলো এসে পড়েছে এখন। তবে পুরোটা জুড়ে পড়েনি। জমিদারবাড়ির প্রাসাদগুলো পূর্বদিকে। ফলে সেগুলোর উপরে আলো এসে পড়ে প্রথমে! তার ছায়াতেই পিছনের অন্দরমহলগুলো ঢাকা পরে যায়। সেগুলোতে বেলা গড়িয়ে যাবার আগে আলো পড়ে না। আজ তেমনই অর্ধেক বুক আলো করে দাঁড়িয়ে ছিল জমিদারবাড়ি । 
অন্দরমহলের সামনে পুরনো কাঠগোলাপের গাছের উপরে ছায়া, দীঘির অর্ধেকটা জুড়ে গাছপালার ছায়া। হালকা ঢেউ উঠে পাড় অবধি এলোচুলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে । দূর থেকে অনেকবার মোরগের ডাক শোনা গেছে । সমস্ত এস্টেট জেগে উঠছে একটু একটু করে ।
 অনেক কথা কাটাকাটির পর তুলিকে সঙ্গে নেওয়া হয়েছে আজ । পায়েলকে একা যেতে দিতে রাজি নয় সুনন্দা । আবার তুলিকে ফেলে যেতেও ভরসা হচ্ছে না। পরশুর ঘটনার পরে এটুকু বুঝেছে এ বাড়িতে সাপের থেকে ভয়ঙ্কর আরও কিছু আছে । তাছাড়া এখন দিনের আলো আছে পরিষ্কার । সাপখোপ যদি কিছু থাকেও তার গায়ে একমাত্র পা না তুলে দিলে সে আক্রমণ করবে না। তাছাড়া আজ বেলার দিকে নীলাদ্রি এসে পড়লে পায়েলকে তেমন সঙ্গও দিতে পারবে না সুনন্দা ।ফলে এখনই যতটুকু ঘোরার ঘুরে নেওয়া দরকার । তুলির উৎসাহের শেষ নেই । মালতীর কাছে 
থাকতে সে মোটেই পছন্দ করে না। 
কাঠের বেড়াটা পেরনোর আগেই আগের দিনের সেই সাপের খোলসটার কথা মনে পড়ল সুনন্দার । এখন সেটা আর নেই । এর মধ্যেই কেউ সরিয়ে নিয়েছে হয়তে । আজ শাড়ির বদলে সালওয়ার

পড়েছে সুনন্দা । তুলির গলা থেকে তার হাতের ব্যাগটা ঝুলছে । পায়েলের রোজকার মতো কাঁধে কাপড়ের ঝোলা নেই । তেরচা করে পরা একটা ব্যাগ ঝুলছে কাঁধ থেকে। 
সে আগে গিয়ে কোলে করে তুলে নিল তুলিকে । তারপর সুনন্দা বেড়া ডিঙিয়ে ভিতরে ঢুকে এল। 
বাইরে থেকে যতটা মনে হত ভিতরে ঢুকলে ঝোপঝাড় তার থেকে খানিকটা বেশি মনে হয় । তাছাড়া এদিকের মাটি এখনও আগের দিনের বৃষ্টিতে নরম হয়ে আছে । তার উপর দিয়ে হাটতে বেশ ভয় লাগে। তবে আজ তিনজনেই বেশ বড় জুতো পড়েছে। ফলে পোকামাকড় ঢুকে পায়ে কামড়ে দেওয়ার সম্ভবনা কম! 
পিছন ঘুরে একবার বাড়ির দিকে দেখে নিল সুনন্দা! এখন সবে ঘুম ভেঙেছে হয়তো সবার । কারও এদিকে দেখার সময় নেই । দেখলেও তেমন 
একটা সমস্যা হবার কথা নয় । এদিকটা মানুষ নিজের প্রাণের ভয়ে আসে না। নিষেধ তো নেই । 
“কাল রাতে একটা কথা মনে হচ্ছিল, জানো?” 
“তোমার বড্ড বেশি মনে হয় !” সুনন্দা মুখ বাঁকাল! 
“বেশ, শুনতে হবে না।”
 “আরে তা নয়, বল না।” 
অভিমানটা ঝেড়ে ফেলে পায়েল বলল, “এ বাড়িতে থাকতে থাকতে একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি । এখানে তেমন মন্দির টন্দির নেই । বা ধর কোনো ঠাকুরঘর । এরা কি নাস্তিক ছিল নাকি?”
 সুনন্দা দেখে শুনে পা ফেলতে ফেলতে বলল, ‘“হতে পারে কোনো ঠাকুরঘর আগে ছিল । এখন সেটা ভেঙে পড়েছে ।”
 “কোথায়? যেখানে একটা ইমারত ছিল সেখানে অন্তত কিছু চিহ্ন তো থেকে যাবে । নাথিং। 
“আলাদা করে ইমারত বানাবে তার কি মানে আছে? এতগুলো যে ঘর তার মধ্যেই একটা ঘরে ধরো ঠাকুর থাকতো ।”
“ধুর, তা হয় না। সেকালের মানুষের কাছে ধর্ম একটা পায়াভারী জিনিস ছিল । এত বড় বাড়ি কিন্তু তার জন্য একটা আলাদা দেখার মতো কিছু 

নেই । সেটাই অবাক কাণ্ড !” 
“তো তুমি কী ভাবছ? এই অন্দরমহলে ঠাকুরঘর খুঁজে পাবে?” 
“পাওয়া যেতে পারে। মানে অন্য কোথাও নেই যখন এখানে থাকার সম্ভাবনাই বেশি।” 
“আগে বললে ফুল বেল পাতা নিয়ে আসতাম না হয় । পুজো দিয়ে তোমার মাথাটা ঠান্ডা করার একটা চেষ্টা করতাম !” 
‘“হু… কফিন ভাঙাভাঙি করে যে পাপ করেছি তাতে দেবতা আর এজন্মে আমার উপর সম্ভষ্ট হবেন বলে তো মনে হয় না।” 
অন্দরমহলের সামনে এসে দাঁড়ায় দু’জনে। এখানে মাটিতে ঘাসের 
পরিমাণের সঙ্গে সঙ্গে তাদের উচ্চতাও বেড়েছে । প্রায় গোড়ালি অবধি ঢেকে গেছে সবুজ ঘাসে । সুনন্দা একবার তুলিকে টোকা দিয়ে বলল, “কিরে, ভয় করছে না তো?” 
ভয় অবশ্য লাগার কথা । অন্দরমহলটা বহুকাল হতে চলল পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে । দেখাশোনার অভাবে প্রায় সমস্ত বাইরেটা জুড়েই লতাগুল্মের আস্তরণ পড়েছে। ভিতরে যতদূর দেখা যায় একটা লম্বা প্যাসেজ চলে গেছে! তার শেষ প্রান্তে একটা সিঁড়ির শুরুর দিকটা আছে । তবে দরজা দিয়ে তাকালে যেটা সব থেকে বেশি চোখে পড়ে সেটা হল বটের ঝুরির মতো নেমে আসা ছাদ থেকে মাটি পর্যন্ত লম্বা ঝুল । গোটা প্যাসেজটাকে যেন আলাদা আলাদা ঘরে ভাগ করেছে তারা । 
কিছু ভাঙা জিনিসপত্রও চোখে পড়ল ভিতরে । একটা চেয়ারের হাতল, একটা ভাঙা ইট, এমন কি পেতলের ফেলে দেওয়া বাসন অবধি। 
মহলটা বেশ বড় । সিঁড়ি যখন আছে তখন দোতলা আছে । তবে উচ্চতা দেখে তিনতলাটাও আছে বলে ধরে নেয়া যায় । সেখানে একটা ত্রিভুজের মতো জানালা আছে । সেই জানালা থেকেও গুল্মের সারি নেমে এসে আবার একতলার সদর দরজার উপরে ঝুলছে । 
হাত দিয়ে সেগুলো খানিকটা পাশে সরিয়ে দিল পায়েল। তারপর ভিতরে তাকিয়ে বলল, “এখানে
যা ঝুল আছে তাতে সাবধানে না গেলে আজ এখানে থেকে বেরবো যখন ভাল্লুক মনে হবে!” 
“আমি তো ভাবছি অন্য কথা !” চিন্তিত গলায় বলল সুনন্দা, “এত ধুলো এখানে । নাকে গিয়ে তুলির না শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়।” 
“সেটাতো আগে ভাবা উচিৎ ছিল । ইনহেলার এনেছ?” 
“হ্যাঁ। ওটা ওর কাছেই থাকে। ওর ব্যাগে ।” 
“এখন আছে দেখে নিয়েছ?” 
“হ্যাঁ। কাল সন্ধেবেলাই দেখে নিয়েছি ।” 
“তাহলে আর কিছু করার নেই। এখন আবার ওকে রেখে আসতে 
গেলে কেউ দেখে ফেলবে!” 
“বেশ, চল তাড়াতাড়ি, বাইরে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক না।!” 
বাইরে একটা বড় দরজা হয়তো ছিল একসময় । তার একদিকের পাল্লাটা খোলা। সেটা বাইরে থেকে দেখা যায় না। আর একটা পাল্লা হয়তো ভেঙে পড়েছে । সেটা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে আসতেই একটা কাশির দমক এসে চেপে ধরল ওদেরকে। কাশির আওয়াজ মহলের ভিতরে বেশ কয়েকবার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল । 
ভিতরে ঢুকলে গোটা একতলাটা চোখে পড়ে। এখানে দাঁড়িয়ে বাড়িটাকে সত্যিকারের জমিদার বাড়ি মনে হয়। দরজা দিয়ে ঢুকেই প্রায় একখানা বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের সমান ডাইনিং ।। তার শেষ প্রান্ত থেকে চওড়া সিঁড়ি উপরের দিকে উঠে গেছে । সিঁড়ির দু’ধারে নকশা রেলিং । সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে বড় একটা প্যাসেজ । তার দু’দিকে ছোট ছোট ঘরের সারি। ডানদিক বাঁদিকে খানিক দূর গিয়ে প্যাসেজটা পিছনের দিকে চলে গেছে । সেদিকে গেলে হয়তো পিছনের বারান্দাটা দেখা যাবে। 
সিঁড়ির নিচে দু’পাশে আরও দুটো ঘর ! জমিদারবাড়ির নিয়ম অনুযায়ী এখানে হয়তো চারক-বাকররা থাকত । উপরের সিঁড়ির পাশের ঘরে মূল পরিবারের লোকেরা। 
এখানে অবশ্য সমস্তটাই অযত্নে পড়ে আছে ।
কোথাও কাঠের উঁচু স্তম্ভ ঠেকনা দিয়ে রাখা আছে দরজার গায়ে । কোথাওবা পড়ে আছে মাটিতে । 
“লুকোচুরি খেলার আদর্শ জায়গা।” বিড়বিড় করে বলল পায়েল! 
“তুমি ম্যানেজারকে একবার জিজ্ঞেস করে আসতে পারতে জায়গাটা ঠিক কোনখানে হতে পারে ।” 
“কারণ জিজ্ঞেস করলে কী বলতাম? আপনার বন্ধু যেখানে লুকাত সেখানটা আমরা একবার খুঁজে দেখতে চাই?” 
“তুমিই তো বলেছিলে তোমাকে দেখেই নাকি সব হড়হুড় করে বলে দেবে, তাহলে?” 
একটু আহত হল পায়েল । মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ‘“বুড়োটারও আর অন্য রোগ হতে পারল না। সব ছেড়ে এলঝাইমারস। এখন এত বড় মহলে কোথায় খুঁজি…” 
“সহজ কোনো জায়গা হবে না। তাহলে হরিনাথের বন্ধুরা সহজেই খুঁজে পেয়ে যেত তাকে। টর্টটা দাও তো।” 
ব্যাগের ভিতর থেকে টর্চটা বের করে দিল পায়েল! কাল রাতেই দোকান থেকে কিনে রেখেছে সেটা । মহলের ভিতরে কিছু কিছু জায়গা হয়তো দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে থাকে । তাছাড়া সামনে হুট করে কিছু এসে পড়লে লম্বা বাঁটের ঘা বসিয়ে দেওয়া যাবে। 
টর্চটা জ্বালিয়ে আগে উপরের দিকে ধরল সুনন্দা। উপরে সিমেন্টের উপরে মোজাইকের নকশা করা কড়িকাঠ! সেখান থেকে কয়েকটা বাদুড় ঝুলছে । তাদের চোখে আলো পড়তেই আলোটা সরিয়ে নিল সুনন্দা। তারপর তুলির দিকে তাকিয়ে বলল, “ওগুলো কী বলতো?”

“বাদুড় । ওরা রক্ত খায়।” তুলি ধরা গলায় জবাব দিল। 
সুনন্দা হাসল, ‘“সব বাদুড় রক্ত খায় না । খালি ভ্যাম্পায়ার বাদুড় খায় এগুলোতে ভয় পাবার কিছু নেই ।” 
তুলির ভয়টা কিন্তু সহজে কাটতে চায় না।! ওরকম উলটো হয়ে ঝুলে থাকা ব্যাপারটা মোটেও ভালো লাগে না তার। চোখগুলোও আলো পড়তে কীরকম জ্বলজ্বল করে উঠেছিল । সে দু’জনের মাঝখানে নেমে হাঁটতে লাগল। 
পায়েল সিঁড়ির কাছ অবধি এগিয়ে গেছিল। সুনন্দা তাকে পিছু ডেকে বলল, “শোন না, বলছি তিনজনে একসঙ্গে দাপাদাপি করে লাভ নেই । তুমি উপরের তলাটা দেখো। আমি তুলিকে নিয়ে নিচটা দেখছি ।” 
“বেশ দেখো। আমার যতদূর মনে হয় একটা সুড়ঙ্গ আছে এখানে কোথাও । তার মুখটা বাড়ির কোনো ঘরের মেঝেতে। সেরকম যদি হয় তাহলে একতলাতে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তা যদি না হয় তাহলে মাটি থেকে বেশ খানিকটা উপরে কিছু আছে হয়তো ।” 
“দেখা যাক । কিছু পেলে আমাকে ফোন করে জানিও । চিৎকার কোরো না।! এমনিতেই গলার আওয়াজ ইকো করছে। লোকে শুনতে পেয়ে যাবে।
সুনন্দা আর তুলি নিচের দিকে এগিয়ে যেতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এল পায়েল । সিঁড়িটা এত বড় যে দুটো মানুষ তাতে দিব্যি আড়াআড়ি শুয়ে পড়তে পারে। রেলিংগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায় ইংরেজ আমলে পুরনো রেলিং পালটে আবার নতুন রেলিং লাগানো হয়েছিল । কারণ ব্রিটিশ আসার আগে ভারতীয় স্থাপত্যে ফুল লতাপাতার নকশা দেখা যায় । ইংরেজ আমলে ভারতের জমিদারদের সেই দাপট আর ছিল না। ফলে কম নকশার লম্বা গরাদের মতো রেলিং রীতি হয়েছিল । এখানেও সেরকমই রেলিং । সেগুলোর উপরে হাত রাখতেই পায়েলের হাত ধুলোতে ভরে গেল। বিশ্রীরকম নোংরা হয়ে আছে জায়গাটা । 
সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে এসে প্যাসেজে একটা ঘরের সামনে দাঁড়াল পায়েল। দক্ষিণের মহলের সঙ্গে এ মহলের বেশ অনেকটা তফাত আছে । মনে হয় 
যেন এ মহলটা কেউ আলাদা করে তৈরি করেছিল বিশেষ কিছু লোকের থাকার জন্যে । জমিদারবাড়িতে অবশ্য সেটা অস্বাভাবিক কিছু না। 
প্যাসেজের বারান্দা দিয়ে একটা ছেড়া মাদুর ঝোলানো আছে । মেঝেতে পাতা আছে একটা কার্পেট । ধুলোয় ঢেকে সেটার রং আর বোঝা যায় না। দেওয়ালে একসময় ছবি ঝোলানোর জন্যে কিছু আংটা লাগানো ছিল। ছবিগুলো আর নেই, আংটাগুলো রয়ে গেছে। ‘ এইতলার ঘরগুলোর সামনে কিছু বর্গাকার ষ্টীলের বাক্স রাখা আছে। অনেকটা ব্যাংকের ভল্টের মতো দেখতে। একসময়ে এগুলোর ভিতরে তাদের দরকারি জিনিসপত্র রাখতেন জমিদারবাড়ির লোকেরা । তাদের প্রত্যেকের জন্যে আলাদা লকার ছিল । বহু বছর আগে লকারের ভিতরের জিনিসপত্র নিয়ে গিয়ে রাখা হয়েছে মিউজিয়ামে। লকারগুলো শুধু তালাবন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে এখানে । পায়েল সেগুলোর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে একটা ঘরের দিকে সরে এল। 
ঘরের দরজা খোলা । দরজার সামনে একটা
কাঠের খাম্বা আড় হয়ে পড়ে আছে । সেটা পা দিয়ে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে একটু অবাক হল পায়েল। প্রাসাদের ঘরগুলোর তুলনায় এ ঘরটা বেশ বড়সড় । শুধু তাই নয়, দেওয়ালে যত্ব করে শ্বেতপাথরের কারুকাজ করা আছে । 
এবাড়িতে শ্বেতপাথর এতদিন চোখে পড়েনি খুব একটা। এ ঘরে যেন রঙবেরঙের পাথরের ছড়াছড়ি । এখন যদিও ফাঁকা তাও বোঝা যায় একসময় রীতিমতো ঝলমলে করে সাজানো থাকত এই ঘর । দেওয়ালের কিছু জায়গায় রত্ন পর্যন্ত গাঁথা ছিল । এখন অবশ্য তার চিহ্ন নেই । এগিয়ে গিয়ে পিছনের জানলাটা খুলে দিল পায়েল। 
এখান থেকে পিছনের দীঘিটা পরিষ্কার চোখে পড়ে। রোদ মেখে চিকচিক্ করে বয়ে চলেছে জল। তার আলো যেন এই জানালাতেও এসে পড়ছে । সেই সঙ্গে একটা উদাস নরম হাওয়া। পায়েলের মনটা শান্ত হয়ে এল। 
সে ঘরটা থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরটাও দেখে নিল পায়েল! আলাদা কিছ 
নেই এর মধ্যে । মাটিতে একটা খাটের পায়ার দাগ চোখে পড়ল । চারটে দাগের দূরত্ব দেখে বোঝা যায় এ ঘরে যে খাটটা ছিল সেটা আয়তনে বিরাট । অর্থাৎ এইটা ছিল শোবার ঘর। হয়তো ভৃপতি দত্ত আর তার স্ত্রী থাকতেন এই ঘরে । 
এখরের জানালাটাও খুলে দিল পায়েল। আর খুলতেই তার মুখ হাঁ হয়ে গেল।! মুহূর্তের জন্যে এতক্ষণের জমাট উত্তেজনা আর কৌতূহল মুগ্ধতায় বিলীন হয়ে গেল। 
এঘরে ঢাকার দরজাটা এখন খোলা আছে । উপরের কড়িকাঠের ফাঁক দিয়ে আলো আসছে ঘরের ভিতরে । একটুকরো আলোর রেখা যেন বাড়িটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে ফেলেছে । সেই আলো এসে পড়েছে জানালায়। 
এখন পায়েল জানালায় দাঁড়িয়ে আছে বলে তার ছায়াটুকুনি সেই আলোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে । সমস্ত বাড়ির ছায়াটা গিয়ে পড়েছে পুকুরের জলে।
ফলে পুকুরের জলে দেখা যাচ্ছে একটা বাড়ির ছায়া । আর সেই বিরাট ছায়ার ঠিক মাঝখানে চৌক একটুখানি আলোর মাঝে পায়েলের ছায়া। 
বেশ কিছুক্ষণ একটানা তাকিয়ে থাকল পায়েল! দিনের ঠিক এই সময়ে ছাড়া দেখা যাবে না অদ্ভুত দৃশ্যটা। একসময় হয়তো জমিদার গিন্নি এসে দাঁড়াতেন এখানে । তারপর প্রায় দু’শো বছর কেটে গেছে । অথচ এখনও একই ভাবে ছায়া পড়ে জানালায় । 
ঘর থেকে বেরিয়ে প্যাসেজের একপ্রান্তে চলে এল সে। এদিকটায় আরও কয়েকটা ঘর আছে । সেগুলো হয়তো অন্য ভাই বোনেদের থাকবার ঘর । আকারে আগেরগুলোর মতো হলেও দেওয়ালের নকশা একটু কম । এখানেও কয়েকটা ছেড়া মাদুর পড়ে আছে । সেগুলো তুলে দেখল পায়েল। নাঃ নিচে কোন ফাঁকা জায়গা নেই । 
একটু ভেবে দেখল পায়েল । হরিনাথ যখন যেতে পারত তখন নিশ্চয় জায়গাটা তার নাগালের মধ্যে ছিল । একটা ওইটুকু বয়সের ছেলের পক্ষে উঁচু কোনো জায়গায় ওঠা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ জায়গাটা মাটি থেকে খুব বেশি উঁচুতে নয় । বরঞ্চ কাছাকাছি। 
কড়িকাঠের দিকটায় উপরের দিকে তাকাতে একটা আশ্চর্য জিনিস চোখে পড়ল তার । দেওয়ালের প্রায় ছাদের দিকে একটা ছোট চৌকো খোপ করা আছে । ভালো করে না তাকালে সেটা চোখে পড়বে না এতটাই উপরে । ওটাই কি তাহলে সেই জায়গাটা? কিন্তু তাহলে হরিনাথ কী করে… 
প্রশ্নটা মনে ভেসে ওঠার আগেই উত্তরটা পেয়ে যায় পায়েল । খোপটার ঠিক নিচেই সিমেন্টের উপরে কয়েকটা চাঙড় খসে পড়েছে । সেখানে পা দিয়ে একটা বাচ্চা ছেলের পক্ষে দিব্যি সেখানে উঠে যাওয়া সম্ভব। 
মনঃস্থির চরে নিল পায়েল । এখানে যখন একবার আসা গেছে তখন না দেখে সে ফিরবে না । খুব বেশি হলে পা হড়কে মাটিতে এসে পড়বে। তাতে গায়ে হাতে পায়ে দুইদিন ব্যথা থাকতে পারে বড়োজার !
ফলে পুকুরের জলে দেখা যাচ্ছে একটা বাড়ির ছায়া । আর সেই বিরাট ছায়ার ঠিক মাঝখানে চৌক একটুখানি আলোর মাঝে পায়েলের ছায়া। 
বেশ কিছুক্ষণ একটানা তাকিয়ে থাকল পায়েল! দিনের ঠিক এই সময়ে ছাড়া দেখা যাবে না অদ্ভুত দৃশ্যটা। একসময় হয়তো জমিদার গিন্নি এসে দাঁড়াতেন এখানে । তারপর প্রায় দু’শো বছর কেটে গেছে । অথচ এখনও একই ভাবে ছায়া পড়ে জানালায় । 
ঘর থেকে বেরিয়ে প্যাসেজের একপ্রান্তে চলে এল সে। এদিকটায় আরও কয়েকটা ঘর আছে । সেগুলো হয়তো অন্য ভাই বোনেদের থাকবার ঘর । আকারে আগেরগুলোর মতো হলেও দেওয়ালের নকশা একটু কম । এখানেও কয়েকটা ছেড়া মাদুর পড়ে আছে । সেগুলো তুলে দেখল পায়েল। নাঃ নিচে কোন ফাঁকা জায়গা নেই । 
একটু ভেবে দেখল পায়েল । হরিনাথ যখন যেতে পারত তখন নিশ্চয় জায়গাটা তার নাগালের মধ্যে ছিল । একটা ওইটুকু বয়সের ছেলের পক্ষে উঁচু কোনো জায়গায় ওঠা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ জায়গাটা মাটি থেকে খুব বেশি উঁচুতে নয় । বরঞ্চ কাছাকাছি। 
কড়িকাঠের দিকটায় উপরের দিকে তাকাতে একটা আশ্চর্য জিনিস চোখে পড়ল তার । দেওয়ালের প্রায় ছাদের দিকে একটা ছোট চৌকো খোপ করা আছে । ভালো করে না তাকালে সেটা চোখে পড়বে না এতটাই উপরে । ওটাই কি তাহলে সেই জায়গাটা? কিন্তু তাহলে হরিনাথ কী করে… 
প্রশ্নটা মনে ভেসে ওঠার আগেই উত্তরটা পেয়ে যায় পায়েল । খোপটার ঠিক নিচেই সিমেন্টের উপরে কয়েকটা চাঙড় খসে পড়েছে । সেখানে পা দিয়ে একটা বাচ্চা ছেলের পক্ষে দিব্যি সেখানে উঠে যাওয়া সম্ভব। 
মনঃস্থির চরে নিল পায়েল । এখানে যখন একবার আসা গেছে তখন না দেখে সে ফিরবে না । খুব বেশি হলে পা হড়কে মাটিতে এসে পড়বে। তাতে গায়ে হাতে পায়ে দুইদিন ব্যথা থাকতে পারে বড়োজার !
কাঁধের ব্যাগটা মাটিতে রেখে ডানহাত দিয়ে দরজার একটা পাল্লার উপর প্রান্তটা ধরল পায়েল। তারপর বাঁহাতে ধরল পুরনো বেরিয়ে থাকা ছবির একটা হুক । উত্তেজনায় সুনন্দাদের ডাকার কথা ভুলেই গেল সে। 
খসে যাওয়া চাঙড়ের ফাটলে একটা পা রাখতেই অসুবিধাটা বুঝতে পারল সে। একটা বাচ্চাছেলের তুলনায় তার পাটা খানিকটা বড় । ফাটলের বাইরে বেশ খানিকটা বেরিয়ে আছে পায়ের অনেকটা । ধীরে ধীরে স্লিপ খেতে খেতে নিচের দিকে নামছে সেটা! এই অবস্থায় যদি আর একটা পা মাটি থেকে তুলে নেয় তাহলে পড়ে যাবার প্রবল সম্ভাবনা আছে । 
নিচে নেমে আবার ফাটলে পা দিয়ে, একটা হাত ছেড়ে কোমরের জোরে লাফ মারল পায়েল । খোপের নিচের দিকটা তার হাতের একটা নখ ভেঙে বেরিয়ে গেল। সে এসে পড়ল নিচে । মাথাটা কোনোরকমে ধাক্কা লাগার হাত থেকে বাঁচিয়ে নিল সে । কোমরটায় জোরদার ব্যথা লেগেছে । হালকা যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল সে। তারপর কোমরে হাত বোলাতে বলাতেই মোবাইলটা বের করে সুনন্দার নম্বরটা ডায়াল করতে ওপাশ থেকে সঙ্গে সঙ্গে গলা শোনা গেল — 
“পেলে কিছু? 
“হ্যাঁ। ব্যথা। কোমরে। একবার উপরে এসো তো ।” 
সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় এসে পায়েলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল সুনন্দা, “পড়ে গেছিলে নাকি?” 
তুলির দিকে তাকিয়ে পায়েল বলল, “কীরে অসুবিধা হচ্ছে?” 
তুলি দু’পাশে মাথা নাড়ল। সুনন্দা বলল, “বড্ড ধুলো । কাশি হচ্ছে ওর, বেশিক্ষণ থেকো না। যা করার তাড়াতাড়ি করে ফেলো !” 
আঙল দিয়ে উপরের খাপটা দেখিয়ে পায়েল বলল, “এটাই জায়গাটা মনে হচ্ছে। আমাকে একটু তুলে ধরতে পারবে? আমার ওজন ঠিক চুয়াল্লিশ কেজি।”কাঁধের ব্যাগটা মাটিতে রেখে ডানহাত দিয়ে দরজার একটা পাল্লার উপর প্রান্তটা ধরল পায়েল। তারপর বাঁহাতে ধরল পুরনো বেরিয়ে থাকা ছবির একটা হুক । উত্তেজনায় সুনন্দাদের ডাকার কথা ভুলেই গেল সে। 
খসে যাওয়া চাঙড়ের ফাটলে একটা পা রাখতেই অসুবিধাটা বুঝতে পারল সে। একটা বাচ্চাছেলের তুলনায় তার পাটা খানিকটা বড় । ফাটলের বাইরে বেশ খানিকটা বেরিয়ে আছে পায়ের অনেকটা । ধীরে ধীরে স্লিপ খেতে খেতে নিচের দিকে নামছে সেটা! এই অবস্থায় যদি আর একটা পা মাটি থেকে তুলে নেয় তাহলে পড়ে যাবার প্রবল সম্ভাবনা আছে । 
নিচে নেমে আবার ফাটলে পা দিয়ে, একটা হাত ছেড়ে কোমরের জোরে লাফ মারল পায়েল । খোপের নিচের দিকটা তার হাতের একটা নখ ভেঙে বেরিয়ে গেল। সে এসে পড়ল নিচে । মাথাটা কোনোরকমে ধাক্কা লাগার হাত থেকে বাঁচিয়ে নিল সে । কোমরটায় জোরদার ব্যথা লেগেছে । হালকা যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল সে। তারপর কোমরে হাত বোলাতে বলাতেই মোবাইলটা বের করে সুনন্দার নম্বরটা ডায়াল করতে ওপাশ থেকে সঙ্গে সঙ্গে গলা শোনা গেল — 
“পেলে কিছু? 
“হ্যাঁ। ব্যথা। কোমরে। একবার উপরে এসো তো ।” 
সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় এসে পায়েলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল সুনন্দা, “পড়ে গেছিলে নাকি?” 
তুলির দিকে তাকিয়ে পায়েল বলল, “কীরে অসুবিধা হচ্ছে?” 
তুলি দু’পাশে মাথা নাড়ল। সুনন্দা বলল, “বড্ড ধুলো । কাশি হচ্ছে ওর, বেশিক্ষণ থেকো না। যা করার তাড়াতাড়ি করে ফেলো !” 
আঙল দিয়ে উপরের খাপটা দেখিয়ে পায়েল বলল, “এটাই জায়গাটা মনে হচ্ছে। আমাকে একটু তুলে ধরতে পারবে? আমার ওজন ঠিক চুয়াল্লিশ কেজি।”
এবারে একটু হাসল সুনন্দা, বলল, “সে পারব। তবে হাত ফসকে পড়ে গেলে জানি না!” 
“বেশ তো, পড়ে আমার মাথা ফাটলে শুধু আমার খুনই নয় অতীনের খুনের জন্যেও তোমাকেই ধরবে পুলিশ !” 
আর কথা বাড়াল না সুনন্দা! পায়েলের কোমরের দু’দিকটা দু’হাতে ধরে উঁচু করে তুলে ধরল তাকে । পায়েল এবার উপরের খাঁজে পা দিল । এই খাঁজটা বেশ গভীর। একটা হাত দিয়ে খোপের নিচের দিকটা ধরে উপরে উঠে এল। প্রথমে একটা পা খোপের ভিতরে রেখে মাথাটা ঢুকিয়ে পরে আর একটা পা তুলে নিল ভিতরে । তুলি হাঁ করে তাকিয়েছিল সেদিকে। সে দু-একবার বায়না করল সুনন্দার কাছে যে সেও ওইভাবে উপরে উঠতে চায়। সুনন্দা তেমন কান দিল না। মাথা তুলে জিজ্ঞেস করল, “কিছু কি দেখতে পাচ্ছ ভিতরে?” 
“আজ্ঞে না। সব অন্ধকার। জায়গাটা বেশি বড় না।” 
“তাও কত বড় হবে?” 
“আমাকেই ঘাড় নিচু করে বসতে হচ্ছে। হাত ছড়ানোর জায়গা নেই তেমন!” 
“তাহলে?” 
“মনে হচ্ছে কেবলই স্বপন করেছি বপন বাতাসে । টর্চটটা দাও দেখি একবার।” 
নিচ থেকে ছুড়ে টর্চটটা খোপের ভিতরে ঢুকিয়ে দিল সুনন্দা । সেটা কুড়িয়ে নিয়ে চারপাশে একবার ঘোরাল পায়েল। তারপর গলা তুলে বলল, “জায়গাটা সিমেন্টের নয় । কাঠের! কাঠের উপরে তিন জায়গায় পেরেক মারা আছে । আশ্চর্য।” 
“এতে আশ্চর্যের কী আছে? কাঠে পেরেক মারা থাকতে পারে না?” 
“উঁহু… পেরেকগুলোর অবস্থান দেখে আবার একটা জিনিসের কথা মনে পড়ছে ।।” 
“কী জিনিস?” 
“কিস না ক্রুশ, যাকে গ্রামের দিকের ছেলেপুলে কুস বলে । বুড়োর জিভে সেটা জড়িয়ে কিস
হয়েছে । যিশুর ছড়ান দুই হাতে দুটো পেরেক ছিল আর পায়ে একটা । এখানে পেরেকগুলো একদম সেইভাবে আছে ।” 
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সুনন্দা বলল, “বেশ, যিশু হল না হয়। তারপর?” 
দোতলায় ধুলো আগের থেকে একটু বেড়ে উঠেছে । কয়েকবার কাশি হল তুলির। সুনন্দাও মুখের উপরে হাত চাপা দিল। 
“আমার ব্যাগে মার্কার আছে, ছুড়ে দাও তো।” উপর থেকে আবার গলা শোনা গেল। মুখ থেকে রুমাল সরিয়ে পায়েলের ব্যাগটা খুল ফেলল সুনন্দা। তারপর মার্কার খুঁজে নিয়ে ছুড়ে দিল উপরের দিকে। 
সেটা কুড়িয়ে নিয়ে পায়েল পেরেকগুলোকে দুটো রেখা দিয়ে জয়েন করল। সব মিলিয়ে একটা ইংরিজি ‘টি’-এর মতো অক্ষর ফুটে উঠল কাঠের উপর। সেটার দিকে তাকিয়েই পায়েল অবাক হয়ে গেল। 
ক্রসের দুটো লাইন যেখানে একে অপরকে ছেদ করেছে সেখান থেকে একটা ছোট সুতো বেরিয়ে আছে । সুতোটার রং একদম কাঠের রঙ্গের মতোই । ধুলোয় ঢেকে আছে বলে কালি না লেগে থাকলে বোঝাই যায় না সুতো 
একটা আঙুল সুতোর উপরে রাখতেই পায়েল বুঝল সুতোটা সাধারণ 1 বেশ শক্ত সেটা । টানাটানি করে ছিড়ে ফেলা সম্ভব নয় । টর্চের হাতলটা মুখের ভিতরে ঢুকিয়ে সুতোটা শক্ত করে ধরে জোরে টান দিল পায়েল।


বিস্ময়ে প্রায় একটা আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে। এতক্ষণ যে কাঠের পাটাতনটা তার মুখের সামনে ছিল সেটার একধার একটুখানি সরে গেছে । ঠিক একটা স্লাইডিং জানালার মতো । আর মুখে ধরা টর্চের আগা গিয়ে পড়েছে সেই ফাঁকের ভিতরে । উত্তেজনায় পায়েলের হাতের টর্চ কেঁপে উঠল কয়েকবার । কী থাকতে পারে ভিতরে? আর একটা কফিন? 
বেশ কিছুটা ভিতর দিকে গিয়ে একটা দেওয়ালে ধান্ধা খেয়েছে আলোটা একটা ঘর । তার ভিতরের বেশিরভাগটাই এখন অন্ধকার । সম্ভবত বহুবছর পরে আলো পড়ছে তাতে। 
পায়েলের মুখ দিয়ে একটা চেনা বাক্য বেরিয়ে এল, “ওয়েল, দিস ইজ 
স্সুকি…” 
একটা জমাট বাঁধা হাওয়া একছুটে বাইরে বেরিয়ে এসে পায়েলের মুখে ধাক্কা মারতেই মুখ সরিয়ে নিল সে। 
হাত দিয়ে টেনে বাকিটুকুনি সরিয়ে ফেলল পায়েল। ঘরঘর করে একটা শব্দ করে ফাঁকটা আরও খানিকটা বড় হল!। নিচের ঘরটার
 অনেকটা অংশ দেখা যাচ্ছে এখন 
নিচ থেকে সুনন্দার গলা শোনা গেল, “এবার ফিরতে হবে পায়েল! তুলির অসুবিধা হচ্ছে ধুলোয় ।” 
“জাস্ট একটু ওয়েট কর । আমি একটা জিনিস পেয়েছি ।” 
উত্তরের অপেক্ষা না করে মাটির দিকে টর্চ ফেলে একবার দেখে নিয়ে একটা লাফ দিয়ে ঘরটায় নেমে এল সে। তার চোখ থেকে বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি এখনও । এ ঘরে কোনো জানালা নেই । এই বিরাট প্রাসাঁদের ভিতরে মিটার পাঁচেক বর্গক্ষেত্রের এক গুপ্তকক্ষ । 
ঘরটা ফাঁকা। ভিতরে ধুলোর সঙ্গে আরও নানারকম গুঁড়ো পড়ে আছে । তবে তার থেকে বড় কিছুই নেই । 
দেওয়ালের দিকে আলো ফেলতে একটু থমকে গেল পায়েল। কি আশ্চর্য! দেওয়ালগুলোর রং কিন্তু এবাড়ির অন্য দেওয়ালগুলোর মতো নয় । ঘন মিশমিশে কালো রঙের দেওয়াল । পরক্ষণেই ব্যাপারটা বুঝতে পারল। ওগুলো রঙ নয় ! আগুনের দাগ । একসময় হয়তো আগুনের পুড়ে গিয়েছিল ঘরটা। কিন্তু কেন? কীভাবে? 
সব থেকে বড় কথা অন্দরমহলের ভিতরে এভাবে লুকিয়ে ঘর বানালোই বাঁ কে? কী লুকিয়ে রাখত সে এখানে। 
এবড়ো খেবড়ো কিছুর উপরে পা পড়তে নিচের দিকে আলো ফেলল পায়েল। মেঝেতে কিছু একটা পড়ে আছে। একটা ছোট দেশলাইকাঠি। নিচু হয়ে হাত দিয়ে সেটা তুলে নিল পায়েল। টর্চের আলোয় বোঝা যায় সেটা স্ফটিকের মতো কিছু একটা । সাদা নিলের মাঝামাঝি রঙের গুড়ো সম্ভবত বহুযুগ আগে এঘরে কেউ মোমবাতি জ্বালিয়েছিল । কিন্তু কেন? 
এই লুকানো ঘরে এত বছর আগে কী হয়েছিল? 
দেওয়ালের দিকে এগিয়ে আসতে দেওয়াল জুড়ে কয়েকটা সরু সরু দাগ দেখতে পেল পায়েল । খুব ক্ষীণ, যেন কয়েক শতাব্দী আগে কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে দেওয়ালে লম্বা দাগ দিয়েছিল
কেউ । 
পায়েলের পায়ের আওয়াজ ঘরময় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে । সেটা মন দিয়ে শুনলে মনে হয় মাটির নিচ থেকে যেন আঙ্গুল দিয়ে আঁচড়াচ্ছে কিছু একটা। 
ঘরের ঠিক মাঝে দাঁড়িয়ে একবার চোখ বন্ধ করল পায়েল। কিছু একটা ঘটেছিল এই ঘরে । সময়ের পথ ধরে দু’শো বছর আগে ফিরে গেলেই জানা যাবে ঘটনাটা । চোখ খোলার আগে একবার থমকে গেল সে। মনে হল কেউ যেন এসে দাঁড়িয়েছে চোখের ঠিক সামনে। চোখ খুললেই দেখতে পাওয়া যাবে তাকে!। একবারের জন্যে ভয়ে পায়েলের বুক কেঁপে উঠল । মনে হল একটা অন্ধকার ধোয়া এসে একটু একটু করে জড় হচ্ছে তার শরীরের চারপাশে। একটা জীবন্ত ঘন ধোয়া। 
একটা গুনগুন আওয়াজ শুনতে পেল সে। যেন বহুদূর থেকে কথা বলছে কেউ । সে কি কিছু বলতে চাইছেঃ? নাকি সব ফাঁকা ঘরের দেওয়ালেই এমন কিছু আওয়াজ ধরা থাকে। যা বয়ে চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে । একটা হালকা বাঁশির আওয়াজ । জমাট খানিকটা ধোয়া লুকিয়ে আছে এই ঘরের ভিতরে। আর কেউ আছে কি? 
সুনন্দার গলা যেন বহুদূর থেকে আসছে । খোপের দিকে সরে আসে পায়েল । মাটি থেকে বেশ খানিকটা উপরে সেটা। কী বলছে সুনন্দা? পায়েল দেরি করছে দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েছে? 
টর্চটটা আবার দাঁতের ফাকে মুখে ধরে শেষবারের মতো ঘরের চারিদিকে চোখে বুলিয়ে নেয় পায়েল । দু’হাতে খোপের নিচের দিকটা ধরে উপরে উঠে আসে পায়েল । পাল্লাটা আবার বন্ধ করে । যেই ঘরটা বানিয়ে থাকুক সে ঘরটাকে গোপন রাখতে চেয়েছিল । হয়তো গোপন থাকাই ভালো । 
পাল্লাটা বন্ধ করতেই সুনন্দার গলা শোনা যায়। কোনো একটা কারণে 
চিৎকার করছে সে। মুখ বাড়িয়ে পায়েল বলে, “আরে আছি আমি এখানে। এত চিৎকার করলে লোক ছুটে আসবে। ভালো হবে সেটা?” 
“প্লিজ নিচে এসো পায়েল। সর্বনাশ হয়ে
গেছে।” 
খোপের ভিতর থেকে বাইরে মুখ বাড়াতেই পায়েলের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। 
বাইরে মেঝের উপরে শুয়ে শ্বাসকষ্টে ছটফট করছে তুলি । তার বুকটা খুব দ্রুত ওঠানামা করছে । সমস্ত মুখটা ভরে উঠেছে ঘন লাল রঙে । সুনন্দা হাঁটু মুড়ে বসেছে তার পাশে । কিছু যেন খোঁজার চেষ্টা করছে । 
‘“আশ্চর্য! শ্বাসকষ্ট হচ্ছে যখন ইনহেলারটা দাও ওকে!” উপর থেকেই চিৎকার করে ওঠে পায়েল । কিছু একটা সন্দেহ করে তার গলা কেঁপে যায়। 
কী যেন খুঁজতে খুঁজতে তুলির গলায় ঝোলানো ব্যাগটা তুলে ধরে সুনন্দা। তারপর আগের মতোই হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “ইনহেলার নেই — কেউ সরিয়ে নিয়েছে।”

একাদশ অধ্যায়

“এবাড়িতে কারও হাঁপানি আছেঃ? মানে তুলি ছাড়া?” 
কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে ভাবল মালতী, তারপর একবার থেমে জবাব দিল, “অতীনদাদার ছিল ।” 
“ওর ইনহেলারটা কোথায় আছে জানো ?” 
“টেবিলের ড্রয়ারে রাখত !” 
লাফ দিয়ে খোপ থেকে নেমে সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল পায়েল।! তার মিলিয়ে আসা গলা সিঁড়ির কাছ থেকে শোনা গেল, “তুমি মুখে মুখ দিয়ে হাওয়া দেওয়ার চেষ্টা করো । আমি দেখছি কারও ইনহেলার আছে কিনা, আর শুইয়ে রেখো না।
 আবার হরিণের মতো দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরের দিকে উঠে এল পায়েল। ক্ষেত্রমোহন তাকে দেখে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন, পায়েল শুনল না। ঝড়ের মতো ঢুকল পাশের ঘরে । 
জানালার ঠিক নিচেই টেবিলটা । সেটার কাছে গিয়ে ড্রয়ারটা খুলতেই একটা আতঙ্কের স্রোত পায়েলের ভাবনা চিন্তায় তালা লাগিয়ে দিল — ইনহেলার এখানেও নেই । 
মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল পায়েল । ওদিকে মেয়েটা এখন কী অবস্থায় আছে কে জানে । তার কপাল দিয়ে দরদর করে ঘাম পড়তে লাগল। কান গরম হয়ে উঠল ক্রমশ!
 দৌড়ে অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে এল পায়েল । এক ছুটে চলে এল দক্ষিণের প্রাসাদের কাছে। চাতালটা পেরিয়েই সিঁড়ির কাছে মালতীকে দেখা গেল। পায়েলকে এভাবে বিভ্রান্তের মতো ছুটে আসতে দেখে খানিকটা ভয় পেয়ে গেছিল সে, হতচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে দিদি? দৌড়াচ্ছ কেন?” 
মাটিতে বসে বিছানার তলায় মেঝের উপরে চোখ পড়তেই আশঙ্কার মেঘটা 
কেটে গেল তার! বিছানার একটু নিচের দিকেই
পড়ে আছে ইনহেলারটা। সাপের মতো মাটিতে শুয়ে পড়ে সেটা তুলে আনতে গিয়ে একটা কাগজ হাতে লাগল পায়েলের । অনেকটা ফেলে দেওয়া ওয়েস্ট পেপারের মতে । কাগজটা সরিয়ে ফেলতে গিয়েও ফেলল না পায়েল। ইনহেলারের সঙ্গে সেটাও একহাতে ধরে তেমনই দ্রুত বেগে আবার দৌড় দিল বাইরের দিকে । সিঁড়ির উপর দিয়ে নামতে গিয়ে উত্তেজনায় তার পা কেঁপে গেল। 
এতক্ষণে তুলিকে নিয়ে অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে এসেছে সুনন্দা। পায়েল তাদেরকে দেখেই ইনহেলারটা এগিয়ে দিল । সুনন্দা একহাতে তুলির মাথাটা ধরে আর একহাত দিয়ে ইনহেলারটা পাম্প করতে লাগল তার মুখে। 
মেয়েটা এতক্ষণে অবশ হয়ে এসেছে । সুনন্দার কাধের উপরে নেতিয়ে পড়েছে তার শরীরটা। মুখটা রক্ত জমে লাল হয়ে ফুলে আসছে । ফাঁকা হাওয়ার শব্দ আসছে গলার ভিতর থেকে । 
কিছুক্ষণ পাম্প করার পর আওয়াজটা বন্ধ হল। মুখের রঙটা একটু ফ্যাকাশে হয়ে এল। পায়েল তার মাথায় একটা হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘“আর কষ্ট হচ্ছে?” 
খুব অল্প মাথা নাড়ল তুলি । দু’দিকে । যদিও বেশ বোঝা যাচ্ছে তার শরীরটা এখনও যন্ত্রণায় ঝুঁকড়ে আছে । বুকের কাছটা খামচে ধরার মতো ব্যথা ছিড়ে নিচ্ছে তাকে । 
“কীসের জন্যে করছে এরকম?” সুনন্দার মুখ রাগে লাল হয়েছিল। পায়েলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল সে। 
“যেই করে থাকুক সে কাল সন্ধ্যা থেকে আজ সকালের মধ্যে তোমার ঘরে ঢুকেছিল ।” 
“সেতো অনেকেই ঢুকেছিল…” 
একটু ভেবে সুনন্দা বলে, “মালতী, মধুবাবু, শশাঙ্কদা… আরও কেউ ঢুকতে পারে। আমি সব সময় ছিলাম না ঘরে।” 
“অর্থাৎ বোঝার উপায় নেই কে নিয়েছে। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা 
হল, কেন? কে তুলির ক্ষতি করতে চায়? করেছেটা কী ও?”
চাতাল পেরিয়ে এগিয়ে আসে দু’জনে । পায়েল প্রাসাদের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলে, ‘“অতীনের সঙ্গে এ বংশের একটা তাও সম্পর্ক ছিল! কিন্তু তুলি একেবারেই অজানা। তার ক্ষতি করে লাভ কিছু কারও হবার নেই । আনলেস…” 
“আনলেস কী?” 
“আচ্ছা এই যে তুলির বাবা-মা, তাদের বয়স কেমন বলতো?” 
“কত হবে, ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশ ।” 
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে থেমে গেল পায়েল, “তুলির বয়স দশ ! অর্থাৎ তুলি যখন হয় তখন ওর বাবা মায়ের বয়স ছত্তিরিশের কাছাকাছি । ওয়াইল্ড গেস, তাও মনে হচ্ছে তুলি ওর বাবা-মার অ্যাডাপ্টেড চাইল্ড ।” 
“মানে বলছ সন্তান না হওয়ার জন্যে নিজেদের বয়স বেড়ে যাচ্ছে দেখে অ্যাডাপ্ট করেছিল ওকে?” 
সুনন্দার কোল থেকে তুলিকে নিজের কোলে নেয় পায়েল । মেয়েটা এখন চোখ বুজে আছে । সম্ভবত ঘুমাচ্ছে। তার কপালে একবার হাত বুলিয়ে চুলগুলো সরিয়ে দেয় পায়েল, “হয়তো এ বংশের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আছে ওর । যার জন্যে খুনির রাগ গিয়ে পড়েছে ওর উপরে ।” 
“কিন্তু এ বংশের সঙ্গেই ওর সম্পর্ক, আবার ঘুরে ফিরে এই জমিদারবাড়িই লিজ নিলেন নাথবাবু। ব্যাপারটা কেমন কাকতালীয় মনে হচ্ছে না?” 
“বা এমনও হতে পারে যোগেন্দ্র নিজেও এ বাড়ির ব্যাপারে কিছু জানেন এবং তুলিকে এখানে পাঠানোটাই তার উদ্দেশ্য ছিল । বিদেশ যাত্রাটা ছল !” 
“তাহলে তুলির এখানে বিপদ আছে বুঝেই পাঠানো হয়ছে তাকে?” একটা অজানা আশংকায় সুনন্দার মুখ ভরে উঠল। 
“আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে এই নাথ ফ্যামিলি ততটা ইনোসেন্ট নয় যতটা আমি মনে করছি ।” 
“সে যাই হোক না কেন আমাদের আর জানার
 যে আজ সে বেঁচে নেই । তাহলে?” 
“এমনও হতে পারে কন্দর্পের পদ্ধতি অন্য কেউ অবলম্বন করছে । কোনোভাবে হয়তো সেটা জানতে পেরেই খুনগুলো করেছে সে ।” 
“এগুলো বড্ড বেশি অবাস্তব হয়ে যাচ্ছে পায়েল । তুমি নিজেও জানা উইচক্রাফট বলে কিছু হয় না। অন্তত এ যুগের মেয়ে হয়ে কয়েকটা মৃত্যু এক্সপ্নেন না করতে পেরে উইচক্রাফট বলে চালানো তোমার সাজে না!” 
পায়েলের গম্ভীর হয়ে আসা মুখে এবার এক টুকরো হাসি খেলে যায়, পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে সেটা ধরিয়ে বলে, “ঠিক বলেছ, উলটোপালটা ভাবতে শুরু করেছি। আসলে এতগুলো প্রশ্ন এমন ঘেঁটে দিয়েছে না, যে কিছুই ভেবে উঠতে পারছি না। আর ভেবে কাজ নেই অবশ্য । আমার যাবার ডাক এসে গেছে।” 
“সেকি! বাড়ি চলে যাবে!” 
“ইয়েস ।” সিগারেটে আরামের লম্বা টান দিল পায়েল, “বাবা আজই ফোন করেছিল । বলল দিন তিনেকের মধ্যে ব্যাক টু শান্তিনিকেতন ।!” 
“বাঃ, তারপর আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে না।” 
“তাতে তোমার কি, তুমি সংসারী মানুষ। আজ তো আবার তিনি চলেও আসছেন !” 
“সে আসুক। কাউকে দিয়ে কাউকে রিপ্লেস করা যায় না।” 
সুনন্দার মনটা খারাপ হয়ে গেছিল। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল সে। এই ক’দিনে পায়েলের সঙ্গে বেশ একটা বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল। এখানে সবাই তার অচেনা । এমনকি পায়েল নিজেও । তা সত্ত্বেও এক-একজন মানুষ থাকে যাদের ভিতরে তাড়াতাড়ি কাছে চলে আসার একটা অলৌকিক ক্ষমতা থাকে! তারা যে খুব মিশুকে তা নয়, খুব যত্নশীল তাও নয় তবু! তবে তাদের হাসিটা অনেক অন্ধকারের মধ্যেও ভরসা জোগাতে পারে । 
সনাতন খাবারের থালা নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল । সে তুলির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “দিম্মনির কী হয়েচে?”উপায় নেই।” 
প্রাসাদে ঢাকার মুখে ক্ষেত্রমোহনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ওদের । তিনি একটু এগিয়ে এসে তুলির মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে বলতো? ওইভাবে ঘরে ঢুকলে…” 
‘“আসলে তুলির একটু শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, ওর ইনহেলারটা হারিয়ে গেছে আবার । এইটা আপনার ছেলের…” হাতের ইনহেলারটা ক্ষেত্রমোহনের দিকে বাড়িয়ে দিল পায়েল। 
হাত তুলে বাধা দিলেন ক্ষেত্রমোহন, “থাক ওটা আপনারাই রাখুন। অতীনের তো আর লাগবে না।” 
“তাও… আপনার ছেলের স্মৃতি…” কথাটা শেষ না করেই থেমে গেল সুনন্দা। ক্ষেত্রমোহন হাসলেন, “‘স্মৃতি নিয়ে আর কী করব বলুন । এ বাড়িটাও তো ছেড়ে দিচ্ছি।” 
“সে কি!” আঁতকে উঠল পায়েল, “ছেড়ে দিচ্ছেন কেন?” 
“এখানে থাকতে আর ভালো লাগছে না। গিরিজাকে দেখে ডাক্তার বলছে ওকে এখান থেকে দূরে নিয়ে যেতে…” 
পায়েল সুনন্দার দিকে একবার তাকিয়ে প্রায় অস্ফুট চাপা স্বরে বলল, “চা, চা অফার করো ।” 
সুনন্দা চকিতে ইশারাটা বুঝে নিয়ে বলল, “আপনি চা খাননি তো সকালে । এদিকে আসুন না!” 
ক্ষেত্রমোহন খুব একটা আপত্তি করলেন না । প্রাসাদের দিকে পা বাড়ালেন। সুনন্দা পায়েলের দিকে ফিরে বলল, “কাজটা ভালো করলে না ।!” 
“কী কাজ?” 
“উনি ওদিকের রান্নাঘরে যেতে চান না কেন তুমি জান। সেই সুযোগে চায়ের নেমন্তন্ন করলে । সুযোগ নিলে।” 
“তাতে কী এমন ক্ষতি হল?” 
“ক্ষতি কিছু হত না, যদি তুমি নিঃস্বার্থভাবে ডাকতে । তুমি ওঁর থেকে কিছু জানতে চাও, তাই ডাকলে । 
“বেশ, তাহলে কাল তুলির ইনহেলার কে
সরিয়েছিল সেটা তুমিই খুঁজে বের করো।” 
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুনন্দা, বলে, “তা আর হবে না। আজ একটু পরেই নীলাদ্রি আসবে। তখন আর এত সময় পাব না তোমাকে দেওয়ার ।” 
পায়েল আর কিছু বলল না। তিনজনে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে সুনন্দার ঘরে চলে এল! ক্ষেত্রমোহনকে ঘরের ভিতর ঢুকতে বলে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল সুনন্দা। হঠাৎ পায়েল তার একটা হাত ধরে থামিয়ে দিল। 
ঠিক এই মুহূর্তে চমকে পায়েলের চোখের দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল সুনন্দা । অসহ্য উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চোখ দুটো । কীসের আগুনের যেন ধিকিধিকি জ্বলছে তারা। মেয়েটাকে এভাবে এর আগে দেখেনি সুনন্দা। হতবাক গলায় বলল, “কী হল তোমার?” 
“একটা কথা ছিল ।” থমথমে গলা! একফোঁটা আবেগের চিহ্ন নেই । 
“হ্যাঁ! বল।” 
কেটে কেটে উচ্চারণ করল পায়েল, “আমার মনে হয় যে শশিভূষণ সরকার আর অতীনকে খুন করেছে, যে তুলির শ্বাস আটকে তাকে খুন করতে চেয়েছে সে একই লোক। সে যদি সত্যি ধরা পড়ে, পুলিশই ধরুক অথবা অন্য কেউ । তুমি তার কী শান্তি চাও” 
“আইন যা বলবে…” 
“যে লোকটা তোমার মেয়েকে চাপা দিয়ে গেছিল, তাকে পুলিশে ধরতে পেরেছিল । কয়েকমাস জেল আর কিছু টাকা ফাইন হয়েছিল তার । তুমি খুশি ছিলে তাতে?” 
মাহা নামিয়ে নেয় সুনন্দা। একটু একটু করে মাথা নাড়ে। 
“তাহলে কী চাও তুমি?” একই রকম শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করে পায়েল। উত্তর দেয় না সুনন্দা, পায়েল আবার ঝাঁকুনি মারে তার হাতে, “বল কী চাও?” 
“মৃত্যু।” অস্ফুটে কথাটা বলে একছুটে রান্নাঘরের দিকে চলে যায় সুনন্দা! 
পায়েল সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ঘরে
ঢুকে এল। তারপর ক্ষেত্রমোহনের পাশে বসে পড়ে বলল, “আপনার স্ত্রী কেমন আছেন এখন?” 
“খুব একটা ভালো নেই !” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা দোলালেন ক্ষেত্রমোহন, “কান্নাকাটিটা করছে না বটে কিন্তু কথা বলছে না কারও সঙ্গে, খাওয়া দাওয়াও একরকম ছেড়ে দিয়েছে।” 
‘“ঠিক হয়ে যাবে। একটু সময় দিন। ওঁর মা-বাবা বেঁচে আছে?” 
“না। আমার বিয়ের আগেই মারা গেছেন তারা ।” 
“আর আপনার?” 
“তারাও মারা গেছেন।” 
“আচ্ছা এ বংশের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ মায়ের দিক থেকে না বাবার দিক থেকে?” 
“মা।চাণক্য দত্তের স্ত্রী আশারানি দত্ত আমার মায়ের কোনো এক পূর্বপুরুষ ছিলেন। পরে আমার কোনো এক পূর্বপুরুষকেই এ বাড়িতে নায়েব নিযুক্ত করা হয় !” 
পায়েল দু’হাতে ভর দিয়ে একটু পিছনে হেলে পড়ে বলল, “দত্ত বংশের সব দিক থেকেই বংশধর পাচ্ছি শুধু কন্দর্প দত্ত ছাড়া। বড় ছেলের কী হল বলুন তো?” 
“সে অত সংসারি ছেলে ছিল না। শুনেছি ভূপতি দত্ত বেঁচে থাকতে থাকতে কন্দর্পকে একবার ত্যাজ্য করতে চেয়েছিলেন ।” 
“কেন?” 
“লোকে বলে সে নাকি বদ সঙ্গে পড়ে উইচক্রাফট শিখেছিল ।” 
“বাবা!” পায়েল অবাক হবার ভান করে, “সেই সময়ে উইচক্রাফট! কী ডেঞ্জারাস ।” 
“সেসময় ওসবের আরও বেশি চল ছিল বাংলায় । কন্দর্প লেখাপড়া শিখেছিল কিছু। ইংরাজি বইপত্র পড়ে তার মাথাটা ওইদিকে চলে যা 
বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াত। মানুষের সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তাও বলতো না। লোকে রাস্তাঘাটে পড়ে থাকতে দেখে বাড়ি দিয়ে যেত। জমিদারবাড়ির তাতে মান যায়!”
“তো এই কন্দর্পের কী হল?” 
“সেটা জানা যায় না। অবাক করা ব্যাপার হল ওঁই আঠেরোশ সাল থেকে আস্তে আস্তে নানা কারণে জমিদারদের বংশ কেমন যেন ছোট হয়ে আসতঙে থাকে । কন্দর্পের পাগলামি, নৃপতি দত্তের হত্যা, জমিদারগিন্নিদের বন্ধ্যা হয়ে যাওয়া, লোকে বলাবলি করত বংশে অভিশাপ লেগেছে ।” 
“কীসের অভিশাপ বলুন তো?” 
“ধুর, অভিশাপ টভিশাপ বলে কিছু নয় না ।” ক্ষেত্রমোহন মৃদু হাসার চেষ্টা করলেন।” 
“না না আমি অভিশাপটা নিয়ে ভাবছি না । তবে লোকে যখন অভিশাপের কথা বলাবলি করত তখন বাড়িতে এমন কিছু একটা ঘটেছিল যাতে লোকের মনে অভিশাপের কথাটা আসতে পারে ।” 
ঘরে চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকছিল সুনন্দা । সে টেবিলের উপরে প্লেট রাখতে রাখতে বলল, “আপনাকেও জেরা করা শুরু করেছে । এই মেয়েটা পুলিশের থেকেও ভয়ানক!” 
“না না, জেরা কোথায়? ওর এসবে আগ্রহ একটু বেশি। ভারি ভালে। মেয়ে।” 
লাজুক হাসল পায়েল।! তারপর কি মনে পড়তে ব্যাগ থেকে সেই কাগজটা বের করে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এইটা একটু দেখুন তো, আপনি লিখেছিলেন?” 
কাগজটা দেখলেন ভালো করে ক্ষেত্রমোহন। তারপর ঠোট উলটে মাথা নাড়িয়ে বললেন, “নাতো! কী কাগজ এটা?” 
“আপনার ছেলের বিছানার তলায় পড়েছিল ইনহেলারের সঙ্গে । তাহলে কি ওই লিখেছে? কিন্তু ‘তার চোখের তারায়’ মানে কী?” 
এক সেকেণ্ড পরেই ক্ষেত্রমোহন মুখে একটা বিদ্যুৎ রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল, “এটা কবে একটা শুনলাম যেন… ও হ্যাঁ আপনিই তো সেদিন…” 
ক্ষেত্রমোহনের আংগুলটা সুনন্দার দিকে । সুনন্দা নিজেও এতক্ষণে দেখছে সে কাগজটা, এবার সেটা ফেরত দিয়ে বলল, “হ্যাঁ। এ কথাটা আমি সেদিন বলছিলাম বটে কিন্তু সেখানে তো
আমি আপনি আর শশাঙ্কদা.ছাড়া আর কেউ ছিল না। অতীন তো নয়ই ।” 
“তাহলে কথাগুলো লিখল কী করে?” 
“তাহলে নিজের খেয়ালে লিখে থাকবে হয়তো… ও একটু ওরকমই ছিল!” 
“কিন্তু এই কথাটার তো একটা…” কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সুনন্দা! পায়েল চোখের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিল । তারপর মাথা নামিয়ে বলল, “এতে হয়তো আপনার মনের সব প্রশ্ন যাবে না। তবে আপনার একটা প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারি ।” 
“কী? বল!” পায়েলের দিকে ঘুরে তাকান ক্ষেত্রমোহন । 
“সেদিন রাতে অতীন কেন বাইরে গেছিল সেটা বলতে পারি ।” 
ক্ষেত্রমোহন আর কিছু বলেন না। তার কপালের রগগুলো দপদপ করে ওঠে। সুনন্দা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পায়েলের দিকে । সে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করে, “সম্ভবত ভোর রাতের দিকে অতীনের হাঁপানির টান ওঠে। ওইসময়ে শ্বাসকষ্ট হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু ঘটনাচক্রে সেই সময়ে সে ইনহেলারটা খুঁজে পায় না । ফলে বেশ কিছুক্ষণ দম বন্ধ হয়ে যায় তার । শেষে যখন খুঁজে পায় তখন তার শ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে । ঠিক আজকে তুলির যেমন হয়ছিল । ইনহেলারটা নেবার পর তার হাত থেকে খসে বিছানার পাশে পড়ে গড়িয়ে নিচে ঢুকে যায় সেটা। 
খানিকটা দম নেবার পর ঘরের বাতাসটা বদ্ধ মনে হয় অতীনের । ফলে বাইরে বেরিয়ে আসে এবং সেই সময়ে রান্নাঘর থেকে কিছুর আওয়াজ শোনে সে। সম্ভবত বাসন বা ওই জাতীয় কিছুর ।” 
“তার মানে তখনই কিছু দেখে ফেলেছিল বলে…” কথাটা বলতে গিয়ে থেমে যান ক্ষেত্রমোহন। 
কয়েকটা নিস্তন্ধ মুহূর্ত কাটে । চা খেতে খেতে কেউ কোনো কথা বলে না। 
চা শেষ হতে উঠে পড়েন ক্ষেত্রমোহন । বাইরে দিকে এগোতে এগোতে বলেন, “ওকে একা রেখে
এসেছি, চলি। আবার পরে কথা হবে না হয় !” 
তিনি বেরিয়ে যেতে পায়েলের কাছে সরে আসে সুনন্দা । তারপর নামানো মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “বাকিটা বিশ্বাস করলাম, শেষটা করতে পারলাম না।” 
“মানে? বাসনের আওয়াজের ব্যাপারটা?” 
“হ্যাঁ। এত জায়গা থাকতে খুনি রান্নাঘরে কী করছিল? আর তার থেকেও বড় কথা ফরেনসিক রিপোর্টে তাহলে আত্মহত্যা বলছে কেন?” 
“ধর খুনি মাথার কাছটা না ধরে ঘাড়ের দিকটা ধরেছিল । তাই মাথার চুল ছেড়েনি ।” 
“কিন্তু কেন? খুনি তো এখানে একবারও প্রমাণ করতে চায়নি যে এটা আত্মহত্যা। তা যদি করতে চাইত তাহলে দড়ি দিয়েই ঝুলিয়ে দিত । বরঞ্চ ফরেনসিক বলছে উলটোটা ।” 
প্রশ্নটার উত্তর দিল না পায়েল। উলটে নতুন একটা প্রশ্ন করল, “আচ্ছা সুনন্দাদি, তুমি ভূতে বিশ্বাস করো?” 
প্রথমে কিছু উত্তর দিল না সুনন্দা, তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, “ভগবানে বিশ্বাস করি যখন ওটা জোর করেও অস্বীকার করতে পারি না।” 
“আর অভিশাপে?” 
“অভিশাপ! কীসের অভিশাপ?” 
“এই যে লোকে বলে কিছুর একটা অভিশাপে নাকি জমিদার বংশ শেষ হয়ে গেছে? এরকম কি সত্যি হতে পারে?” 
“কি জানি। আমি এসব এত ভেবে দেখি না।” 
“আমিও ভাবতাম না। কিন্তু আজ ওই ঘরটায় ঢোকার পর থেকে মনটা কেমন জানি হয়ে আছে ।” 
“কোন্ ঘর?” 
“ওই খোপের মধ্যে দিয়ে একটা ঘরে যাওয়া যায় । সম্ভবত কিছু একটা লুকানোর জন্যে তৈরি করা হয়েছিল ওটা । তেমন কিছু নেই শুধু দেওয়ালে কয়েকটা চেরা দাগ আর সমস্ত ঘরের দেওয়াল জুড়ে আগুনের দাগ ।” 
“আগুন!” 
“হ্যাঁ, আগুন। মনে হয় বহুবছর আগে ওখানে
আগুন জ্বলেছিল । সেই আগুনে হয়তো পুড়ে মারা গিয়েছিল কেউ। কেউ ঘরে ঢুকিয়ে জ্বেলে দিয়েছিল আগুনটা এবং তার ফলেই জমিদারবাড়ির উপর অভিশাপ নেমে আসে !” 
“কিন্তু কেন? খামোখা একটা মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে কার কি লাভ?” 
“জানি না। তবে একটা কথা আমার মনে হচ্ছে।” 
“কীরকম কথা?” 
“উত্তরের ওঁই অন্দরমহলটা তৈরি হয়েছিল অনেক আগে । মানে এই প্রাসাদগুলো তৈরি হবার বহু আগে এবং বিশেষ কোনো কারণে তৈরি হয়েছিল । শুধু কয়েকটা মানুষের থাকার জন্যে নয়। সম্ভবত এমন কিছু হত ওখানে যেটা লোকসমাজে রটে গেলে বড়সড় সমস্যা হতে পারত।” 
ঘরের বাতাস ক্রমশ ভারি হয়ে উঠছে। একটা চাপা অস্বস্তি শুরু হয়েছে সুনন্দার। সে নিচু গলায় বলে, “কী হত বলে মনে হয় তোমার?” 
“এমন একটা কিছু যার সন্ধান পায় কন্দর্প। সম্ভবত ওই ঘরে সে নিজেও ঢুকেছিল। কিছু একটা আন্দাজ পেয়েছিল । কিছুর একটা খোঁজ করছিল সে যেটাকে লোকে উইচক্রযাফট বলে ভুল করে। পেয়েছিল কিনা, তারপর খুঁজে পেতে কী হল সেটা আর জানতে পারছি না। তবে আঠেরোশো 
তিরিশে কুড়িজন এসাসিনেটারের শরীর দীঘির জলে যখন ভেসে ওঠে তখন সে পাড়ে দাঁড়িয়েছিল !” 
থমথমে গলায় উত্তর দেয় সুনন্দা, “মানে বলতে চাইছ উইচক্রাফট শিখেই সে অতগুলো ডাকাতকে কাবু করে?” 
“না। সে নিজে প্রায় কিছুই করেনি । করেছিল সেই নারীমূরতি । যাকে তুলি দেখেছে, অতীন দেখেছে এবং এই বাড়িতে এর আগে চারজনের মৃত্যুর পিছনেও তারই হাত ছিল।” 
“কিন্তু সেটা অসম্ভব । কন্দর্প যদি সত্যি উইচক্র্যাফট শিখেও থাকে তাহলেও এটুকু নিশ্চিত
যে আজ সে বেঁচে নেই । তাহলে?” 
“এমনও হতে পারে কন্দর্পের পদ্ধতি অন্য কেউ অবলম্বন করছে । কোনোভাবে হয়তো সেটা জানতে পেরেই খুনগুলো করেছে সে ।” 
“এগুলো বড্ড বেশি অবাস্তব হয়ে যাচ্ছে পায়েল । তুমি নিজেও জানা উইচক্রাফট বলে কিছু হয় না। অন্তত এ যুগের মেয়ে হয়ে কয়েকটা মৃত্যু এক্সপ্নেন না করতে পেরে উইচক্রাফট বলে চালানো তোমার সাজে না!” 
পায়েলের গম্ভীর হয়ে আসা মুখে এবার এক টুকরো হাসি খেলে যায়, পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে সেটা ধরিয়ে বলে, “ঠিক বলেছ, উলটোপালটা ভাবতে শুরু করেছি। আসলে এতগুলো প্রশ্ন এমন ঘেঁটে দিয়েছে না, যে কিছুই ভেবে উঠতে পারছি না। আর ভেবে কাজ নেই অবশ্য । আমার যাবার ডাক এসে গেছে।” 
“সেকি! বাড়ি চলে যাবে!” 
“ইয়েস ।” সিগারেটে আরামের লম্বা টান দিল পায়েল, “বাবা আজই ফোন করেছিল । বলল দিন তিনেকের মধ্যে ব্যাক টু শান্তিনিকেতন ।!” 
“বাঃ, তারপর আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে না।” 
“তাতে তোমার কি, তুমি সংসারী মানুষ। আজ তো আবার তিনি চলেও আসছেন !” 
“সে আসুক। কাউকে দিয়ে কাউকে রিপ্লেস করা যায় না।” 
সুনন্দার মনটা খারাপ হয়ে গেছিল। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল সে। এই ক’দিনে পায়েলের সঙ্গে বেশ একটা বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল। এখানে সবাই তার অচেনা । এমনকি পায়েল নিজেও । তা সত্ত্বেও এক-একজন মানুষ থাকে যাদের ভিতরে তাড়াতাড়ি কাছে চলে আসার একটা অলৌকিক ক্ষমতা থাকে! তারা যে খুব মিশুকে তা নয়, খুব যত্নশীল তাও নয় তবু! তবে তাদের হাসিটা অনেক অন্ধকারের মধ্যেও ভরসা জোগাতে পারে । 
সনাতন খাবারের থালা নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল । সে তুলির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “দিম্মনির কী হয়েচে?”
“তেমন কিছু না। একটু শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল ।” 
টেবিলের উপরে দুটো প্লেট রেখে সনাতন বলে,‘“‘আপনারা অন্দরমহলের দিকে গেচিলেন?” 
একটা ছোটোখাটো কম্পন অনুভব করে সুনন্দা বুকের মাঝে। মুখ তুলে বলে, “হ্যাঁ। ওঁই একটু দেখার ইচ্ছা হয়েছিল ভিতরে কী আছে।” 
“রমেনবাবুও খুব যেতেন । শেষে আমি মানা করতে আর যাননি !” 
“রমেন কে?” পায়েল প্রশ্ন করে। 
“ওই যে চার্চে যিনি আছেন এখন !” 
“চার্চের ফাদার?” দু’জনে প্রায় একসঙ্গে প্রশ্ন করে । 
“আজ্ঞে হ্যাঁ। একদিন রাতের বেলা ঘুম ভেঙি গেল, তো একতলায় পেসাপ করতে গে দেখি বাবু একটা আলোয়ান জড়িয়ে প্রাসাদের ফাঁক দি বেরিয়ে আসচেন।! আমি ভাবলাম জোরে ডাকি, শেষে তার পিচু পিচু গেলাম । দেকি তিনি চোরের মতো মহলের দিকে যাচ্ছেন! আমি তকন দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরতে তিনি ঘাবড়িয়ে গেলেন। প্রথমে টাকা দিতে চাইলেন। আমি বললুম আর যদি কোনোদিন ওভাবে চোরের মতো ওখানে না যায় তাহলে কাউকে আজকেরের কথা বলব না।” 
“তাহলে আমাদের বললে যে ।” 
সনাতন হাসল। তারপর ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলল, “আপনারা 
আজ গেছিলেন যে । আমার ভারী জানতে ইচ্ছা করে ওখানে কী আছে যে সবাই যায়।” 
পায়েল আর সুনন্দা একবার দু’জনে চোখাচোখি করে নেয় । তারপর বলে, “তেমন কিছু নেই । কিছু পুরনো সিন্দুক আছে । সবাই ভাবে তার ভিতরে হয়তো এখনও রত্ন-টত্ন আছে !” 
উত্তরটা খুব একটা যে পছন্দ হয় না সনাতনের সেটা বোঝা যায় । আর কিছু জিজ্ঞেস না করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে। 
পায়েল একবার দরজাটা দেখে এসে বলে, “মালটা কি ঘাঘু দেখেছ? আমাদের দেখে
ফেলেছে সেটা চেপে রেখেছিল পেট থেকে কথা বের করবে বলে।” 
“তুমি তার থেকে বড় ঘাঘু, বের করলে কোথায়?” 
বিজয়ীর হাসি হাসে পায়েল, তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বলে, “কিন্তু ফাদার ওখানে কী ধান্দায় যেত বলতো? কিছু জানতে পেরেছিল নাকি?” 
“জানাটা অস্বাভাবিক নয় । চার্চের নিজস্ব কিছু রেকর্ড বুক থাকে । সেখান থেকে অতীতের কিছু ঘটনা জেনে থাকতে পারে । ঘরটার কথাও হয়তো জানে ।” 
“তাহলে আজ একবার দেখা দিয়ে আসি? কি বল?” 
“বেশ। বিকেলের দিকে যেও । এখন খেয়ে নাও ।” 
বিছানা থেকে উঠে একবার প্লেটের দিকে উঁকি মারে পায়েল । তারপর হতাশ হয়ে বলে, “‘ধুর… শুকনো রুটি, পৌঁয়াজকলি ভাজা আর চাটনি । এই নাকি শালা জমিদারবাড়ির খাওয়া।” 
“মাত্র দু’শো বছর লেট করে ফেলেছো জন্মাতে। তখন এ বাড়িতে থাকলে দেখতে খাওয়া কাকে বলে !” 
বিরক্তি ভরা মুখে প্লেটটা টেনে নিয়ে একটুকরো রুটি মুখে দেয় । তারপন সেটা চেবাতে চেবাতে বলে, “যাই বল তুমি । এই সনাতন বুড়োটার রান্নার 
হাত একেবারে যাচ্ছেতাই । সবজি খাইয়ে খাইয়ে পেটে গ্রিন রিভোলিউশান ধরিয়ে দিল শালাটা ।” 
“তা তোমার কী খেতে ভালো লাগে?” 
হাতে করে রুটি মুখের কাছে তুলে এনেছিল পায়েল। সেটা নামিয়ে রেখে খুশি খুশি মুখে বলল, “কোল্ড কফি ।” 
“ধুর, ওসব এখানে কোথায় পাব?” 
পায়েল চোখ বড়বড় করে বলে, “এই, পাবে মানে? তুমি কি আমাকে খাওয়াবে ভাবছ নাকি?” 
“ধর যদি খাওয়াই?” সুনন্দা চাটনি চাটতে চাটতে বলে, “মানে তুমি চলে যাবার আগে ভাবছি
একদিন রান্না করে খাওয়াবো তোমাকে ।” 
“তাহলে…” পায়েল কয়েক সেকেণ্ড ভেবে নেয় । তারপর বলে, “ফ্রায়েড রাইস বানাতে পারো? আর ঝাল ঝাল করে চিলি চিকেন?” 
“হুঃ, ওসব তো বাচ্চারাও পারে ।” 
“ব্যস। ওই খাইয়ে দাও । তোমাকে আশীর্বাদ করে যাব !” 
“বাবা! তা কী আশীর্বাদ করবেন গুরুদেব?” 
“সেটা আগে খাওয়াও তারপর বলে দেব না হয়।” 
“বেশ।” 
এবার বেশ খুশি মনে খেতে লাগল পায়েল। সুনন্দা তার মুখের দিকে তাকিয়ে অল্প হাসল। 
তুলি এতক্ষণে উঠে বসেছে । সে দু’হাতে চোখ রগড়ে সুনন্দার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার তো খিদে পেয়েছে।” 
সুনন্দা মাটি থেকে উঠে নিজের প্লেট থেকে একটু রুটি ছিড়ে তার মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, “এখন আর কষ্ট হচ্ছে না তো?” 
“না।” তুলি চিবাতে চিবাতে বলল, “আমি আর ওখানে যাব না। খুব ধুলো !” 
“না না। পাগল নাকি? আর যাই ওখানে?” 
পায়েল তার দিকে ফিরে বলল, “হ্যাঁরে বাবু। সেদিন তুই যাকে দেখতে পেয়েছিলি, সেই যে একটা মেয়ে, তাকে আর কোনোদিন দেখতে পেয়েছিস?” 
তুলির ফ্যাকাসে মুখে একটা অস্বস্তির রেখা দেখা দেয় । ধীরে ধীরে উপরে নিচে মাথা নাড়ায় সে। 
“কবে?” সুনন্দা জিজ্ঞেস করে । 
“আজ একটু আগে । ওর ভিতরে ।” আঙল দিয়ে অন্দরমহলটা দেখিয়ে দেয় তুলি। 
“সুনন্দা আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল । পায়েল চোখের ইশারায় বারণ করে তাকে । তুলির পাশে বসে তাকে খাওয়াতে থাকে সুনন্দা। 
উলটো দিকে ঘুরে বসে কি যেন বিড়বিড় করে পায়েল । অস্পষ্ট হলেও শব্দগুলো শুনতে পায় সুনন্দা,
“পাঁচটা খুন। চারটে আলাদা দশকে । যেন সব কণ্টাই হয় দুর্ঘটনা না হয় আত্মহত্যা। একজন সিঁড়ি থেকে পড়ে, একজন জলে ডুবে, একজন কুয়োতে পড়ে আর বাকি দু’জন গলায় দড়ি… এদের মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই… নাকি আছে? আছে… নিশ্চয়ই আছে… কী হতে পারে? কী… কী… 
আচমকাই প্লেট বিছানায় রেখে প্রায় লাফিয়ে ওঠে পায়েল, “আছে, একটা ভয়ানক মিল আছে । ইশশ… এতক্ষণ দেখতে পাইনি! কত বড় গাধা আমি…” 
সুনন্দা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সুনন্দার দিকে ফেরে সে, ““সুনন্দাদি, বড়বাজারের শশীবাবুর কীসের দোকান ছিল?” 
“মশলার।” সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয় সুনন্দা। 
“মশলার…” পায়েলের চোখ দুটো মুহূর্তে নিষ্প্রভ দেখায়, “মশলা হলে তা…” 
“কী ব্যাপার বলতো? কিছু হয়েছে?” 
“নাঃ, একটু এক্সাইটেড হয়ে গেছিলাম !” 
কথাটা বলে খাবারে মন দেয় পায়েল । অস্বাভাবিক রকম হতাশ দেখায় তাকে।