(১)


সকাল থেকে বৃষ্টি হয়ে চলেছে অনবরত, উত্তর কোলকাতার ছোট গলি গুলোতে জল জমতে শুরু করেছে একটু একটু করে। এমনই একটি গলি ব্যতিক্রম নয় এই চিত্রের। গলির মাঝবরাবর অবস্থিত একটি মাঝারি আয়তনের মুদিখানার দোকান, তার সামনেই মাথায় ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুইজন মধ্যবয়স্ক মানুষ। তাদের মধ্যে একজন বলে উঠল "মধু, আজ উঠলাম রে। সন্ধ্যেবেলায় আসছিস তো ক্লাবে?" মধুসূদন কিছু বললেন না, ঘাড় বুঁদ করে নিজের কাজ করতে করতে শুধু মাথা নাড়লেন।


"১০০ চিনি, ৫০ হলুদ, ৫০ লঙ্কার গুঁড়ো, ৫০০ সরষের তেল...আর কী যেন বললি?" কয়েকটা ঠোঙা আর একটা তেল ভর্তি শিশি নীল রঙের কাঠের পাটাতনের ওপরে রেখে নাকের কাছে নেমে আসা চশমাটা ঠিক করে নিয়ে বললেন মধুসূদন; পরণে ঘিয়ে রঙের ফতুয়া আর সাদা পাজামা, চুলের কোনো ছিরিছাট নেই, গলায় ঝুলছে একটা স্ট্র্যাপ যার সাথে বাঁধা মোবাইলটা রয়েছে ফতুয়ার পকেটে। মুদিখানার সামনেই মাথায় হলুদ রঙের প্লাস্টিক বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল বছর দশেকের একটি ছেলে, বলল "ছোট লাক্স। বাবা বলেছে লাক্স সাবান নিয়ে যেতে।" "আচ্ছা আচ্ছা... দাঁড়া।" কয়েকটা তাকে হাত চালিয়ে একটা ছোট লাক্স সাবান নিয়ে এসে ছেলেটির জন্য বরাদ্দ প্লাস্টিকের মধ্যে রাখলেন। তারপর একপাশে রাখা ছোট একটা প্যাড থেকে ছোট একটা কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে হিসেব করতে লাগলেন। ছেলেটি বলল "কাকু, বাবা বলল কাল টাকা দিয়ে দেবে।" মধুসূদন অল্প হেসে বললেন "আরে সে ও সময় করে দিক।", তারপরে প্লাস্টিকটা বেঁধে দিয়ে বললেন "এই নে। আর বৃষ্টিতে ঘোরাঘুরি করিস না, সোজা বাড়ি যা।জ্বর বাধাস না আবার। জ্বর বাধাস তোরা আর বাড়ি সুদ্ধু লোকে চিন্তায় মরে।" 


ছেলেটি চলে গেলে মধুসূদন একবার দোকানের ভেতরটা দেখে নিয়ে হাতঘড়িটা দেখলেন, নিজেই বলে উঠলেন "ওরে বাবা, দেড়টা বাজে। আরেকটু দেরী করলেই ফোনের বন্যা বয়ে যাবে।" ঠিক সেইসময় বুক পকেটে রাখা মোবাইলটা বেজে উঠল, মোবাইলটা দেখে একটু ইতস্তত করেই সবুজ বোতামটা টিপলেন মধুসূদন। 


"হ্যাঁ, এই তো আসছি, আসছি।" বললেন মধুসূদন।


"তা রোজ রোজ ফোন করে তোমায় কেন ডাকতে হয় বলোতো? রান্নাবান্না করে বসে রয়েছি, আর অন্যদিকে দোকান বন্ধ করার নাম নেই। বলি সময়টা দেখেছ?" একটু রেগেমেগেই বললেন মধুসূদনের স্ত্রী সুপ্রিয়া।


"আরে...." সুপ্রিয়া তখনো কিছু বলে যাচ্ছিলেন, কল ডিসকানেক্ট করে চটপট দোকান বন্ধ করতে উদ্যোগী হলেন মধুসূদন।


----


"হ্যাঁ, তোদের হরিদ্বারের ছবি গুলো দেখলাম রে। ভালোই তো ঘুরেছিস তোরা।" দোতলার বারান্দায় বৃষ্টির ছাঁট আসছিল, তাই জামা কাপড় গুলো তুলতে তুলতে সুপ্রিয়া দেবী কথা বলছিলেন ফোনে "আমরা আর কোথায় যাই। যাওয়ার মধ্যে দীঘা আর পুরী, তাও খুব বেশী হলে সাত দিনের জন্য।" অন্য পাড়ে আরো একজন মহিলার গলা শোনা যায়। সুপ্রিয়া বলেন "না রে বোন। তোর জামাইবাবুকে বললেই সে ফোঁস করে ওঠে। পনেরো কুড়ি দিন দোকান বন্ধ রাখলে ক্ষতি, এসব বলে। আমি আর কী বলি। তাছাড়া, এটাও তো সত্যি যে দুই ছেলে মানুষ হলো ঐ দোকান চলার পয়সা'তেই।" ঠিক এইসময় ঘরে ঢুকলেন মধুসূদন। সুপ্রিয়া একবার দেখে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন "এই বোন, শোননা এখন ফোন রাখছি। তোর জামাইবাবু‌ একটু ভিজে ফিরেছে। যাই, কেমন?" 


মধুসূদনের হাতে একটা তোয়ালে দিলেন সুপ্রিয়া, তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললেন "যাও যাও চানে যাও, ঠাণ্ডা লেগে গেলে আবার মুশকিল। আমি তোমার জল রেডি রাখছি।" ভেজা মাথা মুছতে মুছতে মধুসূদন বললেন "কে ফোন করেছিল, শম্পা?" সুপ্রিয়া দেবী "হ্যাঁ" বললে মধুসূদন হাসতে হাসতে বললেন "হরিদ্বার নিয়ে গল্প করছিল নিশ্চয়ই? আর তুমিও দুঃখের কাহিনী শুনিয়ে দিয়েছ তাই না?" মধুসূদনের ব্যঙ্গের জবাব না দিয়ে সুপ্রিয়া দেবী বললেন "যাও যাও , মেলা বোকো না। অনেক বেলা হলো, চান করে এসো। পেটে আগুন জ্বলছে। ঐ দুই হনুমান আবার কখন আসবে কে জানে, এদের খেলা আর শেষ হয়না।" 


মধুসূদন স্নানঘরে ঢুকতে গিয়েও একবার দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন, বললেন "ছোটটার তো না হয় উচ্চমাধ্যমিক শেষ হয়েছে তাই উড়ে বেড়াচ্ছে। বড়টার তো ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ হলো, চাকরি বাকরির জন্য চেষ্টা চরিত্র কিছু করছে কী না কে জানে!" ঘরের টুকটাক কিছু কাজ করতে করতে সুপ্রিয়া বললেন "ঐ আবার শুরু হলো, তুমি স্নানে যাও তো। ওরা ঠিক চলে আসবে।"


(২)


একে বৃষ্টির দিন, তার ওপরে শনিবার...রাস্তাঘাটে মানুষের যাতায়াত অতটা নেই। রাস্তার এক পাশ‌ ধরে মাঝারি গতিতে এগিয়ে চলেছে একটি বাইক। বৃষ্টির গতি আপাতত একটু কমের দিকে। ঠাণ্ডা ঝোড়ো হাওয়ার অভাব অবশ্য নেই। 


"দাদা, ওটা কিন্তু অফসাইড ছিল। তাও ওরা ওটাকে গোল নিয়ে নিলো।" বাইকের পেছনে বসা বছর আঠেরোর ছেলেটি বলে উঠল।


বাইকটা চালাচ্ছে বছর বাইশের একটি ছেলে। ভাইয়ের কথা শুনে সে বলল "হ্যাঁ, গোল ছিল না। কিন্তু ওসব ঝগড়াঝাটিতে যাওয়ার দরকার নেই।" পেছনের ছেলেটি প্রতিবাদ করে বলে উঠল "কিন্তু যেটা ভুল সেটা তো ভুলই তাই না। এরপরের দিন এমন কিছু করে দেখুক, একদম ঘুষি মেরে নাকটাই ফাটিয়ে দেবো।" সামনের ছেলেটি বলে উঠল "সৌভিক, এমন কিছু করার কথা ভাবিসই না ভাই। আর পাড়ার ক্লাবের খেলা নিয়ে এতো কীসের ভাবনা? এসব তো হতেই থাকে।" সৌভিক কিছুক্ষণ চুপ থাকল, তারপর বলল "কী জানিস তো দাদা, ঐ রজতের বাবা তো পৌরসভার বড় অফিসার... তাই হেব্বি ভাও খায় মালটা।" সুজয় প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার চেষ্টা করল "ওসব ছাড়, মা আবার বকা না দেয়। কখন বলেছি ফিরব, রজতের সাথে কথা কাটাকাটি করতে গিয়েই তো দেরীটা করালি তুই।" সৌভিক আর কিছু বলল না, নিজের মনেই গজগজ করতে লাগল সে।


----


বাড়ি ফেরার পরে সুপ্রিয়া বেশী কিছু বললেন না দুই ছেলে সুজয় ও সৌভিককে। প্রতি রবিবারের মতোই আজকেও দুপুরে খাওয়ার টেবিলে একসাথে বসেছেন মধুসূদন ও দুই ছেলে। খাবার বেড়ে দিচ্ছেন সুপ্রিয়া। খাওয়া দাওয়ার মাঝেই মধুসূদন মাঝেমধ্যে সুজয়ের দিকে তাকাতে লাগলেন


- সুজয়, ভাইয়ের জয়েন্টের রেজাল্ট যদি ভাল হয় তাহলে ইঞ্জিনিয়ারিংয়েই দিই কী বলিস?

- হ্যাঁ।

- তোর কলেজেই চেষ্টা করে দেখব, কিন্তু ক্যাম্পাসিং কী ভাল হবে? তোর সময়ে তো কোম্পানি গুলো এলো না ঠিকঠাক।

- এখন চাকরির অবস্থা বেশ খারাপ কিন্তু আইটিতে।

- চাকরির ব্যাপারেই মনে পড়ল, তোর এই সপ্তাহেই একটা পরীক্ষা আছে না?

- হ্যাঁ বাবা, এই তো বুধবার।

- হুমমম, তাহলে আজ তো পড়তে পারতিস বাড়িতে বসে। 

- হ্যাঁ বাবা, সব রেডি করা রয়েছে। 

- থাকলেই ভাল। যাই হোক, ভাইয়ের অ্যাডমিশনের দায়িত্ব কিন্তু তোকেই দিয়ে রাখলাম; খোঁজ খবর নিয়ে জানাস।

- আচ্ছা বাবা।


(৩)


লেকটাউনের মনসা মন্দিরের কাছাকাছি কোনো একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল একটি বাইক। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে আবার। বাইকের পেছনে বসে থাকা বছর বাইশের সোহিনী নামল, খোলা চুলটা একটু ঝাকিয়ে নিয়ে একটু হেসে বাইকের চালকের উদ্দেশ্যে বলল "কী দেখছিস কী?" চালক আর কেউ নয়, সুজয়। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে সে বলল "কিছু না।" মন্দিরের ভেতর থেকে ঘন্টার শব্দ ভেসে আসছে। মেয়েটি সুজয়কে প্রায় হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল "একটু কিছু খেয়ে নে। অত চিন্তা করিস না, কালকের ইন্টারভিউ খুব ভাল হবে দেখিস।"  


একটি ফাস্টফুডের দোকানে ঢুকে একটা চাউমিনের প্লেট অর্ডার করল সোহিনী। মুখটা একটু ভার করেই একটা টেবিলে বসেছিল সুজয়, অন্যান্য কিছু টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু লোক বসে আছে বটে। সুজয়ের মুখোমুখি এসে বসে সোহিনী। দুজনেই চুপ করে বসে থাকে বেশ কিছুক্ষণ; তবুও কাহাতক চুপ করে বসে থাকা যায়। 


- কী হয়েছে বলতো সুজয়?

- মাঝেমধ্যে খুব চিন্তা হয় রে সোহিনী, বাবার তো বয়স হচ্ছে। যদি একটা চাকরি না পাই।

- আরে তা কেন‌ পাবি না? এরকম মাইন্ডসেট নিয়ে ইন্টারভিউ দিতে যাস না। বি কনফিডেন্ট, সুযোগ যখন পেয়েছিস ১০০% দে।

- ভাইয়ের অ্যাডমিশনের ব্যাপারটাও বড় মুখ করে আমাকেই দেখতে বলেছে বাবা। আর কতদিন মুদিখানা করে একা একা সংসার টানবে বাবা, বাবার পাশে দাঁড়াতে না পারলে....


সুজয়ের হাতে হাত রাখে সোহিনী, কিছুক্ষণ একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। সোহিনী চোখ টিপে ওকে ভরসা দেয়। মিষ্টি হাসি ফুটে ওঠে ওর মুখে, সুজয় একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ওর গালে পড়া টোলের দিকে।


চাউমিন খাওয়া শেষ করে রেস্টুরেন্ট থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে ওরা। কয়েক ঢোক জল খেয়ে সুজয় বাইকে উঠতে যায়, কিন্তু সোহিনী ওঠে না। সুজয় একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে "কী হলো রে? বস!" সোহিনী একটু হাসল, সুজয়ের কাছে এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রাখল "তুই একা ফের আজ, কনসেন্ট্রেট কর। আমি বাস ধরে নেব। কেমন?" সুজয় কিছু বলে না, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। সোহিনী বড় রাস্তার ওপরে গিয়ে বাস ধরে নেয়, বাসটা আস্তে আস্তে দূরে চলে যায়। সোহিনী সত্যিই তার জীবনে একটা ভরসার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সুজয় ভাবে।


----


সন্ধ্যাবেলায় একটি ক্লাবঘরের বারান্দায় বসেছে পাঁচ ছয়'জনের আড্ডা। সকলের বয়স  পঞ্চাশোর্ধ। এদের মধ্যে মধুসূদন একজন, রবিবার সন্ধ্যায় দোকান বন্ধ রাখেন তিনি। হাসি ঠাট্টায় কাটতে থাকে তাদের সময়। মধুসূদন তোলেন আসন্ন দুর্গাপূজোর কথা, কীভাবে পূজো পরিকল্পনা করা হবে, চাঁদা তোলা কবে থেকে শুরু হবে, কোনো স্পন্সর আনা যায় কী না...এইসব নিয়ে চা আর সিঙাড়া সহযোগে আলোচনা চলতে লাগল। আলোচনা শেষ হওয়ার নাম কেউ নিচ্ছিল না, এরইমধ্যে সুরেন উঠে দাঁড়ালেন। বললেন "আজ উঠি, কাল আবার মিউনিসিপ্যালিটির অফিসে যাব। বাড়ির দোতলার প্ল্যানটা অ্যাপ্রুভই করছে না ঐ শম্ভুনাথ। যাই কাল আবার হত্যে দেবো।" সেটা শুনে আবার মধুসূদন বললেন "আমার বাড়ির দোতলা করার সময়ও বড্ড ঝামেলা করেছিল ঐ শম্ভুনাথ। মহা ঝামেলার লোক, ঘুষ টুষ খায় নাকি।"


রাত নয়টা নাগাদ সকলে যখন উঠলেন, তখনো হালকা বৃষ্টি পড়ছে। সকলকে বিদায় জানিয়ে হেঁটে ফিরতে লাগলেন মধুসূদন। যে গলি দিয়ে সাধারণত ঢোকেন, সেখান দিয়ে না ঢুকে পেছনের গলি দিয়ে ঢুকে ওষুধের দোকানের চন্দনের সাথে কুশল সংবাদ বিনিময় করে আবার হাঁটতে লাগলেন। ফেরার সময় নিজের দোকানের সামনে এসে পড়লেন তিনি, আড়াল থেকে দেখলেন ছোট ছেলে সৌভিক কেমন দক্ষ হাতে দোকানের খরিদ্দারদের সামলে নিচ্ছে, হিসেব করছে। ছেলের স্বপ্ন আইআইটিতে পড়া, তবু সেই ছেলে বাবার সাহায্যেও পিছপা হয়না। ছোট ছেলের প্রতি গর্বে বুক ভরে ওঠে তার।


"কী রে, বেশ পটু ব্যবসায়ীর মতোই তো দোকান সামলাচ্ছিস দেখছি।"


"তোমায় ছোটবেলা থেকে দেখেছি বাবা।"


"আইআইটি হয়ে গেলে তো ভাল। কিন্তু তারপর তুই দূরে চলে যাবি বাবু। দাদাও কোথাও চাকরি পেয়ে হয়তো চলে যাবে। তখন এই দোকান, বাড়ি, পাড়া ছাড়া আর কী আছে?"


"বাবা, তুমি তো এমন করছ যেন কোথায় না কোথায় চলে যাব। আমি না আসতে পারলেও তোমরা তো ভিসিট করতেই পারবে।"


"খড়গপুর হলে তো একদম কাছেই হবে।"


"একদম, বাবা।"


সৌভিক আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ছোট ছেলের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকেন মধুসূদন; ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটে ওঠে তার। ধীরে ধীরে হেঁটে তিনি এগিয়ে যান বাড়ির দিকে।


(৪)


পুরসভার অফিসে সকাল সকাল এসে পড়েছেন সুরেন, প্রায় এক ঘন্টা বসে অপেক্ষা করার পরেও এখনো ডাক এলো না পৌরসভার কর্মচারী শম্ভুনাথের দিক থেকে। সুরেনের পাশের পাড়ার লোক হলেও কারোর সাথেই খুব একটা ভাল ব্যবহার করেনা শম্ভুনাথ। তবুও বাড়ির দোতলার প্ল্যানটা শম্ভুনাথের কাছ থেকেই অ্যাপ্রুভ করানো দরকার। সাথে করা আনা ফাইলটা বগলদাবা করে নিয়ে শম্ভুনাথের টেবিলের দিকে আরো একবার এগিয়ে গেলেন সুরেন। 


শম্ভুনাথের টেবিলের সামনে যে লোকটা এখন বসে রয়েছে, তাকে চিনতে কষ্ট হয়নি সুরেনের। ঐ পাড়ার নন্দী বাবুকে শুধু উনিই নন, সকলেই চেনেন। তবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই যে নন্দী বাবু নিজের কাজের‌ জন্য সুপরিচিত, তাকে প্রায় সকলেই একজন অসাধু প্রোমোটার হিসেবেই চেনে। অঢেল টাকার মালিক তিনি, বলাই বাহুল্য যে সেই টাকার বেশীরভাগ টাই কালো। পুরোনো ভগ্নপ্রায় বাড়ির মালিকদের মোটা টাকা দিয়ে বা ভয় দেখিয়ে তাদের বাড়ি আত্মসাৎ করায় নন্দী বাবুর জুড়ি মেলা ভার। 


সম্প্রতি নিজের পেল্লায় বাড়ির তিনতলার কাজে তিনি হাত দিতে চলেছেন বলেই খবর এসেছিল সুরেনের কানে। সেই সংক্রান্ত কাজেই নন্দী বাবু এসেছেন নিশ্চয়ই, ওর বাড়ির সামনের রাস্তাটা এতটাই ছোট যে তিনতলা হওয়ার কথাই নয়। তবুও নন্দীবাবুর কাছে পয়সা আছে খরচ করার জন্য এবং শম্ভুনাথ রয়েছে সেই পয়সা আত্মসাৎ করার জন্য। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সুরেন।


নন্দীবাবুর কাজ হয়ে গেলে হাসিমুখে তিনি বেরিয়ে গেলেন, যাওয়ার আগে শম্ভুনাথ এবং নন্দীবাবু করমর্দন‌ করলেন একবার। সুরেন ধীরপায়ে এগিয়ে গেলেন শম্ভুনাথের দিকে, তার মুখের কৃত্রিম হাসি মিলিয়ে যেতে সময় লাগল না সুরেনকে দেখে। ফাইলটা খুলে দেখানোর আগেই পান চিবোতে চিবোতে শম্ভুনাথ বলল "সুরেন বাবু, আমি তো আপনাকে বলেছি যে আপনার প্ল্যানে ভুল আছে, এই ভুলে ভরা প্ল্যান অ্যাপ্রুভ হয় নাকি! যান ঠিক করে নিয়ে তারপর আসবেন।" সুরেন একটু থতমত খেয়ে ইতস্তত বোধ করে বললেন "কিন্তু এই প্ল্যানে তো আমি কিছু ভুল পাচ্ছি না, তুমি..ইয়ে আপনি যদি একবার দেখে দেন.." সুরেনকে প্রায় ধমকের সুরে থামিয়ে দিয়ে শম্ভুনাথ বলল "এখন প্রচুর কাজ। আপনি এক কাজ করুন, দশদিন‌ পরে আসুন। আরে এমনভাবে কী আর প্ল্যান অ্যাপ্রুভ হয়? কত জায়গায় ফাইল ঘুরবে জানেন? দশদিন পরে আসবেন যান।" 


আর কিছু বলতে পারেন না সুরেন; মনের অদম্য ইচ্ছে ছিল যে নন্দী বাবুর‌ প্রসঙ্গ তুলবেন, কিন্তু সাহস পেলেন‌‌ না। অন্যদিকে ততক্ষণে শম্ভুনাথের মোবাইলে ফোন এসেছে, স্ত্রীর রান্না করা শোল মাছের ঝোল যে কতটা সুস্বাদু সেই কথা নিয়ে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সে। বেশ হতাশ‌ হয়েই ধীরপায়ে পুরসভার অফিস ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন সুরেন।


----


"ওয়েল সুজয়..আই অ্যাম ডান ফ্রম মাই সাইড। উই উইল বি রিলিজিং দ্য অফার লেটার ইন টু উইকস।" ইন্টারভিউয়ারের শেষ কথাটা শুনে সুজয়ের বুকে যেন বল‌ এলো, মনটা আনন্দে ভরে গেল তার। বাকি সমস্ত ফর্মালিটি শেষ করে বেরিয়ে পড়ে সুজয়; আকাশ তখন মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও সুজয়ের মনের আকাশে তখন আলোর ছটা। সঙ্গে সঙ্গে ভাই সৌভিক'কে ফোন করে‌ জানায় সে খবরটা। 


- বল রে দাদা।

- চাকরিটা হয়ে গিয়েছে রে!

- কী বলছিস কী? এ তো দারুণ খবর! পার্টি তো বনতা হ্যায় বস!

- আরে আবার পার্টি...

- আরো কর্পোরেটে‌ নোট ছাপবি আর পার্টি দিবি না তাই হয় নাকি!

- আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে..

- তুই ওখানেই দাঁড়া, আমি আসছি। তারপরে সোজা গোলবাড়ি।

- গোলবাড়ি?

- রুমালি রুটি আর কষা মাংস দিয়েই তো হবে পার্টি!

- আচ্ছা ঠিক আছে। তা তোর আসতে কতক্ষণ লাগবে?

- আরে এই তো শিয়ালদায় একটা বন্ধুর বাড়ি এসেছিলাম, তাও আধ ঘন্টা লাগবে।

- ঠিক আছে, তুই এসে আমায় ফোন করিস। আমি এখানেই একটা কাফেতে থাকব।

- ও...সোহিনী দি আসছে নাকি? 

- বেশী বকিস না।

- আচ্ছা আচ্ছা বেশ। আসছি আমি।


সৌভিকের সাথে‌ কথা শেষ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে এসে উপস্থিত হয় সোহিনী। সোহিনী ও সুজয় দুজন দুজনের হাত ধরে বেশ কিছুক্ষণ হাসে, ফাঁকা রাস্তা ধরে অলস ভাবে হাঁটতে শুরু করে ওরা। হাঁটতে হাঁটতে কাছাকাছি একটা ক্যাফেতে ঢুকে পড়ে দুজনে।


---- 


বড় বাজারের একটি চেনা পরিচিত দোকানে দোকানের স্টকের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অর্ডার দিচ্ছিলেন মধুসূদন। দোকানের কাজের ছেলেটিকে তার দরকার মতো জিনিসপত্রের তালিকা বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। কথাবার্তার শেষে কয়েকটা কড়কড়ে নোট বের করে গুনে নিয়ে দোকানের মালিকের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছিলেন মধুসূদন।


- ও মধু কাকা, আজকেও পুরো টাকাটা দেবে না!

- এই, কী বলছিস কী? প্রতিবারের মতোই অ্যাডভান্স দিচ্ছি।

- আরে এবার তো পুরো দিয়ে যাও..

- বাকিটা মাল গুলো আমার দোকানে দিয়ে যাওয়ার পরে দেবো। তোদের সাথে কী আজকের সম্পর্ক নাকি? এই মধুসূদন না কথার খেলাপ করে না টাকা মারে..কাউকে দেওয়া কথা কীভাবে রাখতে হয় সেটা জানে মধুসূদন।


দোকানের মালিক হাসে, আর কথা বাড়ায় না। দোকান থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে দেখলেন মোবাইলে সুজয়ের দুটো মিসড কল। তৎক্ষণাৎ ফোন করলেন তিনি বড় ছেলে'কে।


- কেমন হলো রে?

- চাকরিটা হয়ে গেছে বাবা, আমরা বাড়ি ফিরছি।

- আরে দারুণ খবর তো! আমরা আবার কারা?

- ভাই আমায় নিয়ে গোলবাড়িতে গিয়েছিল বাবা; একটু রুটি মাংস নিয়ে বাড়ি ফিরছি আমরা। বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছি প্রায়।

- তা বেশ‌ বেশ। ঠিক আছে, আমি বড়বাজার থেকে কড়া পাকের সন্দেশ নিয়ে আসছি তাহলে; পাড়ায় বিলোবো।

- আরে এসব আবার...

- আরে ফ্যামিলির কেউ এই প্রথম এত বড় চাকরি পেলো, একটু দেখাবো না! তোর মা আমায় কঞ্জুস বললেই হলো! চল, তোরা সাবধানে আয়।

- আমরা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িতে ঢুকব, তুমি এসো।


মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি কিনতে একটু সময় লেগে গেল, ভিড়টা একটু বেশীই ছিল দোকানে। মিষ্টি কিনে নিয়ে যখন বাসে উঠলেন মধুসূদন, তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় দেড়টা ছুঁই ছুঁই। বাড়িতে এখন নিশ্চয়ই উৎসবের মেজাজ, ভেবে হাসলেন মধুসূদন। আরো কিছুক্ষন সময় যাওয়ার পরে মধুসূদনের মোবাইল ফোন বেজে উঠল, সুজয়ের ফোন এসেছে।


- আরে এই তো কাছাকাছি এসে প...

- ....

- সুজয়? কী হয়েছে সুজয়?

- বাবা...

- কী হলো রে, গলাটা এমন শোনাচ্ছে কেন?

- একটা অ্যাক্সিডেন্ট..

- কী? কী হয়েছে কী? তোরা কোথায়?

- .....

- কথা বলছিস না কেন?

- বাড়ির কাছাকাছি নার্সিংহোমে...বাবা...

- আমি আসছি...

- বাবা, ভাই..

- কী? ভাই কী বল?

- ভাই আর নেই বাবা!

- এসব ইয়ার্কি মারবি না!


বাকি কথা গুলো আর শুনতে পেলেন না মধুসূদন। তার আশপাশটা কেমন যেন গুলিয়ে যেতে লাগল। হাতে ধরা কড়া পাকের সন্দেশের বাক্স ছিটকে পড়ল মেঝেতে।


(৫)


ভয়াবহ দৃশ্যটা মধুসূদনের চোখের সামনে বারবার ফিরে আসছে। আঠেরো বছর বয়সের ছেলের চিতায় আগুন দিতে গিয়ে হাজারবার ভেঙেছে একটা মন, গলা বারবার বুজে এসেছে, জগদ্দল পাথর চেপে বসেছে বুকের ওপরে। যতক্ষণ ছেলেটার নিথর মৃতদেহ চোখের সামনে ছিল, ততক্ষন অন্তত এই আশ্বাস ছিল যে ছেলের মুখ তো অন্তত দেখতে পারছে মধুসূদন; একবার চুল্লীতে ঢুকে গেলে সবকিছু পঞ্চ ভূতে বিলীন হয়ে যায়। 


ছেলের গলার কাছে যখন পিণ্ডটা রাখছিলেন মধুসূদন, তখন নিজের মনেই হয়তো বারবার বলে উঠেছেন "চোখটা খোল বাবা! এই দ্যাখ, তোর বাবা তোর সামনেই আছে।" যে ছেলেকে একসময় হসপিটালে কোলে নিয়েছিলেন, সেই ছেলেকে শেষ বিদায় জানাতে পারছিলেন না তিনি। না, সৌভিক ওঠেনি; তবুও ওর একটাই কথা বারবার মধুসূদনের কানে বাজছে "এমন করে বলছ যেন কোথায় না কোথায় চলে যাব।" ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে সৌভিক কে একবারের জন্য চোখের দেখা দেখার সুযোগ হয়নি মধুসূদনের, সেদিন নার্সিংহোমে গিয়ে ডাক্তারের কাছে শুধু শুনেছিলেন একটাই কথা "আমাদের কিছু করার ছিল না।" 


সৌভিকের মৃতদেহ যখন সকলকে বিদায় জানিয়ে পাড়ি দিচ্ছিল মহাপ্রস্থানের পথে, তখন সুপ্রিয়া স্বামীকে জড়িয়ে ধরেছিলেন; স্ত্রীয়ের কষ্ট লাঘব করার কোনো প্রক্রিয়া জানা ছিল না মধুসূদনের। সুজয় মা'কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। "ফিরে আয় বাবা! ফিরে আয়...ফিরে আয়।" সুপ্রিয়ার সেই আকুল প্রার্থনা তিনদিন পরেও মধুসূদনের কানে বাজছে। ঘুমোনোর চেষ্টা করছেন না তিনি; চোখ বুজলেই সৌভিকের নিষ্পাপ মুখ ভেসে উঠছে। হাতঘড়িতে তখন সময় রাত তিনটে, চোখের এক পাশ থেকে অজান্তেই জল গড়িয়ে পড়ল। বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় চলে গেলেন মধুসূদন। বাইরে ঝোড়ো হাওয়া বইছে তখনো, কিছুটা দূরে অবস্থিত নারকেল গাছটা নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য ঝোড়ো হাওয়ার সাথে লড়াই করে চলেছে; উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকেন মধুসূদন। 


----


- বাড়িতে দমবন্ধ লাগছিল। গত দশ দিন ধরে দিনরাত নিজেও কেঁদেছি, মা'কেও কাঁদতে দেখেছি। তোর বাড়ি চলে এলাম তাই...

- তোর যখন মনে হবে চলে আসবি সুজয়, এতে এতো ফর্মালিটি করছিস কেন?

- কিছু না সোহিনী...এমনি...

- কাকু কেমন আছেন?

- বুঝতে পারছি না রে, বাবাকে কাঁদতে দেখিনি। কিন্তু এতটা গম্ভীর কখনো দেখিনি বাবাকে।


বাকি কথা গুলো বলতে গিয়ে গলার কাছটা কেমন যেন ধরে আসছিল সুজয়ের, মাথা নীচু করে কিছুক্ষণ বসে রইল সে। সোহিনী খাট থেকে নেমে এসে জড়িয়ে ধরে সুজয়কে। সুজয় ভাঙতে চায়না, গত কয়েকদিন অন্যের কান্না থামিয়েছে সে। কিন্তু আজ তার মাথায় সোহিনীর হাত পড়তেই তার চোখের জল বাঁধ মানলো না।


- জানিস সোহিনী, সেই দিনটা বারবার আমার মাথায় সিনেমার মতো প্লে হচ্ছে। সেদিন যদি ভাই'কে না আসতে বলতাম তাহলে এইসব হতো না। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে রে।

- চুপ কর! চুপ কর সুজয়।

- জলে ভর্তি রাস্তার ওপর দিয়ে বেশ জোরেই ছুটছিল বাইকটা। সাইকেলটা সেদিন উল্টো দিক থেকে এমনভাবে চলে এলো, ভাই ওকে  বাঁচাতে গিয়ে ঐ একই স্পিডে বাইক নিয়ে গিয়ে পড়ল পটহোলের মধ্যে। জলে জলাকার রাস্তায় কোথায় পটহোল কোথায় কী কিছুই বুঝতে পারিনি সেদিন, তারপরেই দেখি জলের এক অংশ লাল হয়ে গিয়েছে। ভাই ছটফট করার সুযোগও পায়নি বোধহয়।

- আর না, ব্যস।


সুজয়কে আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সোহিনী, মাথায় বিলি কেটে দিতে থাকল।


----


ক্লাবঘরে আজ হাসির রোল ওঠেনি। সুরেন সহ বাকি কয়েকজন বসে রয়েছেন। কেউই খুব একটা কথাবার্তা বলছেন না। এক কোণে রাখা টিভিতে খবর চলছে, সেদিকেই সবার নজর। খবরের বলা বক্তব্য খানিকটা এরকম - 


"দুর্গাভারতী লেনের কাছে রাস্তার ওপরে তৈরী হওয়া এই ভয়ঙ্কর পটহোল সেদিন সাক্ষাৎ মৃত্যুকূপে পরিণত হলেও পৌরসভার তরফ থেকে খুব একটা বেশী হেলদোল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় মানুষদের বক্তব্য যে তারা পৌরসভার কয়েকজন কর্মকর্তাকে অনেক আগে থেকেই রাস্তাটা ঠিক করার ব্যাপারে বলেছিলেন কিন্তু কর্মকর্তারা ব্যাপারটা কানেই তোলেন নি। কোলকাতা শহরের রাস্তায় রাস্তায় এমন অনেক পটহোল দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু পৌরসভা কিছুই করে না। আমরা কী আরো একজন সৌভিক দে'র মৃত্যু হওয়ার অপেক্ষা করছি? পুরমন্ত্রী'কে এই ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো কমেন্ট করেন নি। এই সরকার কী সত্যিই মানুষের জীবনের মূল্য দেয় নাকি সবটাই শুধু ভোটের জন্য তোলা থাকে?" 


ঘরের কোণে বসে থাকা নিশীথ বলে উঠলেন "আমার ছেলে তো মিউনিসিপ্যালিটির অফিসেই কাজ করে। ও বলছিল যে এই রাস্তাটা ঠিক করার দায়িত্ব নাকি শম্ভুনাথের ওপরে ছিল, কিন্তু ও আর কিছুই করেনি। ঘুষ খাওয়া ছাড়া আর কি কিছু করে ও?" কিছুক্ষণ বাকিরা চুপ করে বসে থাকলেন। সুরেন বললেন "মধুসূদনদা'কে সেদিন দেখলাম বাজার করে ফিরছেন। ডাকলাম কিন্তু জবাব পেলাম না। চিন্তা হচ্ছে গো ওনাকে নিয়ে, বয়স তো কম হলো না আর এই বয়সে এমন একটা ধাক্কা; আড্ডাতেও আসেন না। বাড়িতেও যে যাব, গিয়ে কী যে বলব বুঝতে পারিনা!" সবকিছু শোনার পরে অন্য একজন বললেন "আচ্ছা, শম্ভুনাথ'কে গিয়ে চেপে ধরলে হয় না?" সুরেন কিছুক্ষণ ভেবে বললেন "দেখো, ওর প্রচুর পলিটিক্যাল কানেকশন; আমি তো এও শুনেছি যে ওর সাথে রাজীব বাবুর বেশ ভালোই ওঠাবসা রয়েছে। তাছাড়া, ও তো এটাকে আর‌ অপরাধ বলে.." ঘরে বসে‌ থাকা অন্য একজন তীব্র প্রতিবাদ করে বলে উঠলেন "সুরেন, তুমি কী ভেবেছ যে আমরা কিছু জানিনা? দোতলার প্ল্যান পাশ করানোর জন্য টাকাটাও দিয়েছ তুমি শম্ভুনাথ'কে আর তুমি চাওনা যে এইসবের মাঝে পড়ে তোমার সবকিছু ভন্ডুল হয়ে যায়।" সুরেন কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন‌ না। নিশীথ বিরক্ত হয়ে বললেন "আরে নিজেদের মধ্যে ঝামেলা কোরো না। আমি একজন‌ উকিল'কে চিনি। ওর সাথে কথা টথা বলে যদি একটা PIL ফাইল করা যায় সেটা একবার দেখব, কী বলো!" বাকিরা যে ব্যাপারটা নিয়ে খুব উৎসাহ দেখালো তা বলা যায় না, কোট কাছারিতে ঘুরে বেড়াতে কেউই চায় না। তবুও দুইতিন জন নিশীথ বাবুর এই প্রস্তাবে সম্মতি জানায়।


---- 


তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। রাস্তাঘাট ফাঁকা। কয়েকটা গাড়ি আসা যাওয়া করলেও ভিড় তেমন নেই। বৃষ্টি তেমন‌ নেই বলে কয়েকজন মানুষ এখানে ওখানে মর্নিং ওয়াকে ব্যস্ত রয়েছেন। শুধু একজন মানুষ ঠায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। রাস্তার ওপরে সৃষ্ট পটহোলের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন মধুসূদন, একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছেন সেদিকেই; গাল বেয়ে নেমে আসছে জলের ধারা।