Kurkutta (কুরকুট্টা) by Trijit kar



// ১ //


২০ শে জুন, ২০১৭


-" বেশ তাহলে চললাম রে! আবার একদিন জমিয়ে আড্ডা হবে এরকম।"- রেস্টুরেন্টের বাইরে দাঁড়িয়েই আকাশটাকে একবার জরিপ করে নিচ্ছিল অর্জুন। বেশ মেঘলা করে এসেছে। সকালের রোদ মাখা হাসিখুশি আকাশের মুখ এখন কেমন যেন গম্ভীর। এখানে ওখানে আকাশের বুকে শকুনের মত উড়ে বেড়াচ্ছে ছাই রঙা মেঘেদের দল। জোর বৃষ্টি নামবে বোঝাই যাচ্ছে। 


- " আবার আড্ডা! তোর সাথে! মাফ কর ভাই। তোকে আর ডাকছি না।"- সিগারেটে টান দিতে দিতেই উত্তর দিল প্রসেনজিৎ, অর্জুনের "স্কুল"তুতো বন্ধু। " ভাই আজ এতদিন পর সব স্কুলের বন্ধুরা এক হলাম। সব তো দূরে দূরে থাকি। ভাবলাম আজ একটু গল্প গুজব হবে। জমিয়ে আড্ডা দেব। তা না কোথাকার কি একটা বাজে টপিক নিয়ে বেকার তর্ক বিতর্ক। ধুর!"


-" আরে আমি কি করব।"- প্রসেনজিতের হাত থেকে সিগারেটটা ছিনিয়ে নিয়ে একটা টান দিল অর্জুন, " ওই অজিতই তো খোঁচাটা দিল। দেখ ভাই আমি নাস্তিক মানুষ। ওসব ধর্ম ঠাকুর ভগবান এসব জিনিস একদম বোগাস লাগে। ভগবান আছে কি নেই সেই নিয়ে ইচ্ছে করে আমাকে খোঁচাটা না দিলেই পারত। খুঁচিয়েছ যখন পাল্টা রিপ্লাই তো দেবই আমি।"


-" উফ তুই আর বদলালি না শালা! স্কুল জীবনেও যেমন গোয়ার ছিলিস এখনও একই আছিস।"- প্রসেনজিৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। " যাইহোক বাড়ি ফিরবি তো। মেঘলা করে এসেছে কেমন দেখেছিস। নতুন বৌদি কেমন আছে রে?"


- " নতুন বৌদি?"- কথাটা শুনে একটু হাসল অর্জুন, " ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে ঢং করতে শিখেছিস মাইরি। তন্দ্রা ভালো আছে। সাত মাস রানিং। জানিসই তো এখন একটু ক্রিটিক্যাল পিরিয়ড। দেখে শুনে রাখতে হচ্ছে। মা দেখেই রাখছে..."


-" বাঃ! আমাদের অর্জুনও তাহলে বাবা হচ্ছে শেষমেশ!"- প্রসেনজিতের কথায় অর্জুনের মুখটা এইবার আচমকাই কেন জানি না কালো হয়ে যায়। সিগারেটটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে এক মনে পা দিয়ে সেটা পিষতে থাকে সে। তারপর আর কোনো কথা না বাড়িয়েই বলে, " আজ আসি রে। মেট্রোর স্মার্ট কার্ডটা বাড়িতেই ফেলে এসেছি। টিকিট কাটতে হবে আবার। চল টাটা!" 


প্রসেনজিৎকে বিদায় দিয়ে মেট্রোর দিকে পা বাড়ায় অর্জুন। উহু আকাশের গতিক মোটেই ভালো না। ছাতাটাও সঙ্গে নিয়ে বেরোয়নি, ফলে তাড়াতাড়ি বাড়ি না পৌঁছতে পারলে ভিজেই যেতে হবে। যদিও আজকে মনটা বেশ ফুরফুরেই হয়ে আছে অর্জুনের। যতই হোক তর্কে জেতার একটা আলাদাই আনন্দ আছে। এই ভগবান নিয়ে যারা বড় বড় কথা বলে তাদের অতি ভক্তির মেকি বেলুনটা ফুস করে চুপসে দিতে অর্জুনের দারুণ লাগে...


-" বাবা! ভগবানের নামে দুটো টাকা দেবে?"- হাটতে হাটতেই আচমকা দাঁড়িয়ে পড়তে হল অর্জুনকে। একটা পাগলাটে লোক রাস্তা আটকে ধরেছে। মাথা ভর্তি উশকো খুশকো চুল, মুখ ভর্তি দাড়ি গোঁফ। গলায় তাবিজ মাদুলি আরও কিসব ঝুলছে। পরনে ধূলিমলীন কালো জোব্বা।


-" মাফ করো কিছু নেই!"- লোকটাকে এড়িয়ে এগিয়েই যাচ্ছিল অর্জুন ঠিক সেই সময়েই লোকটা আবার পিছু ডাকল।


-" ভগবান তোমার মঙ্গল করবেন বাবা! তিনি সবসময় আমাদের পথ দেখাচ্ছেন। আমি দুদিন কিছু খাইনি, তার দয়ায় দুটো টাকা আমায় দিলে তোমার কমবে না।"


আচ্ছা মুশকিল তো! নাহ অর্জুন এড়িয়েই যাবে ভাবছিল, কিন্তু উপায় নেই। পিছনে ফিরে লোকটির দিকে এগিয়ে যায় সে। তারপর মানিব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে বিরক্ত মুখে এগিয়ে দেয় লোকটার দিকে, " এই নিন। আর শুনুন আপনার ভগবান টগবানে আমি বিশ্বাস করি না। ভিক্ষা জিনিসটাই চূড়ান্ত অপছন্দ আমার। নেহাৎ খাননি বললেন। তাই টাকাটা দিচ্ছি।"


টাকাটা হাতে নিয়ে লোকটার মুখে এইবার একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। টাকাটা হাতে ধরেই আকাশের দিকে তিনি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে কি যেন দেখেন। তারপরের মুহূর্তেই অর্জুনের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটা রহস্যময় হাসি হেসে বলেন, " কি অদ্ভুত তাই না? আজ সকালেই কেমন রোদ ছিল, এখন আবার মেঘলা। কিছুক্ষণ পরেই মেঘ ডাকবে, বৃষ্টি হবে...বাজ পড়বে...মানুষের জীবনটাও এমনি তাই না! একটা সুন্দর জীবনে কখন যে বিপদের মেঘ ঘনিয়ে আসে কেউ বলতে পারে না..."


লোকটা শেষ কথাগুলো এমনই অদ্ভুত গম্ভীরভাবে বলল যে এক মুহূর্তের জন্য অর্জুনের বুকটাও কি এক অজানা বিপদের আশঙ্কায় যেন ধক করে উঠল! পরের মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল ও, " কী সব ভুলভাল বকছেন। টাকাটা দিলাম। খেয়ে নেবেন আর..."


কথাটা শেষও করতে পারেনি তার আগেই অর্জুনকে চমকে দিয়ে লোকটা আচমকা মাঝ রাস্তায় ওর ডান হাতটা খপ করে চেপে ধরল। তারপর দাড়ি গোফে ভরা মুখটা আচমকা ওর সামনে এগিয়ে এনে বলে উঠল, " ভগবানের পথে সবাইকেই কখনও না কখনও আসতে হয় বাবা! কেউ আগে আসে, কেউ পরে। তবুও তিনি কিন্তু সবাইকে পথ দেখান। যে দেখতে চায় তাকেও, যে দেখতে চায় না তাকেও..."


-" আরে করছেন কি ! হাতটা ছাড়ুন... এ কি পাগলের পাল্লায় পড়লাম..."


 কি অদ্ভুত! অর্জুনের কথা শুনে লোকটা তার হাত তো ছাড়েই না বরং অর্জুনের হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরে অদ্ভুত পাগলাটে ভঙ্গিতে খিলখিল করে হেসে ওঠে। তারপরের মুহূর্তেই আবারও অর্জুনের চোখে চোখ রাখে লোকটা, " এ জগতে কোনো কিছুই কারণ ছাড়া হয় না বাবা। সবকিছুর পিছনেই কোনো না কোনো কারণ আছে! মনে রেখো ভগবান সব সময় আমাদের সংকেত দেন। ভালো কিছু হওয়ার আগে দেন, খারাপ কিছু হওয়ার আগেও দেন। খেয়াল রেখো। সামনের কটা দিন যে খুব মেঘলা...খুব অন্ধকার...বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যেতে পারে!"


-" কি আবোল তাবোল বকছেন বলুন তো! পাগল যত রাজ্যের!"- এইবার এক ঝটকায় হাতটা সরিয়ে নেয় অর্জুন। তার চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। পাগলাটে লোকটি এইবার তাকে চমকে দিয়ে আবারও একবার খিলখিল করে হেসে ওঠে। তারপর আপন মনেই বলে ওঠে, " সংকেত সংকেত সংকেত...বুঝলে ভালো! না বুঝলে আরও ভালো। হে হে হে। আমার বলার কাজ বললাম। বাকি সবই তো তার ইচ্ছে! তাই না?"


// ২ //


মেট্রোর ভিতর দাঁড়িয়ে একমনে পাগলটার কথা ভাবছিল অর্জুন। কে জানে কেন লোকটার কথাগুলো কিছুতেই মাথা থেকে বের করতে পারছিল না ও। লোকটার চোখের দৃষ্টিতে এমন অদ্ভুত কিছু একটা ছিল, যতবারই মনে পড়ছে শরীরটা কেমন যেন শিরশির করে উঠছে। 


-" তুঝে ইয়াদ না মেরি আই কিসি সে আব ক্যায়া কহে না..."- এক কামরা লোকের মাঝখানে ফোনটা বেজে উঠতেই ভুত দেখার মত চমকে উঠল অর্জুন। উফ! তুলির কাজ এটা। বারবার ওর ফোনের ভালো ভালো রিং টোন পাল্টে যত্ত সব বিদঘুটে গানগুলো রাখবে!


-" হ্যালো! ও মা...হ্যাঁ বলো...হুম ফিরছি..." মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলছে আর কাচের গেট দিয়ে বাইরেটা দেখছে অর্জুন। শহরের পেটের ভিতর অন্ধকার হিমশীতল টানেল দিয়ে ছুটে চলেছে মেট্রো। কখনও আলোকোজ্জ্বল প্ল্যাটফর্ম, কখনও অন্ধকারের চাদর মোড়া নিঝুম টানেল। বাইরের দিকে একটানা চেয়ে থাকলে কেমন যেন ঝিম ধরে আসে...


ফোনে কথা বলতে বলতে বাইরের দিকেই দেখছিল অর্জুন এমন সময় একটা দিকে চোখ পড়তেই কেমন যেন চমকে উঠল ও! একটা বাচ্ছা ছেলে। বয়স বছর দশেক হবে। অদ্ভুত থমথমে মুখে নিজের সিটে বসে আছে। আর...আর এক দৃষ্টিতে অর্জুনের দিকেই তাকিয়ে আছে! প্রথমবার ছেলেটার চোখে চোখ পড়তেই অস্বস্তিতে চোখটা ফিরিয়ে নিল অর্জুন। 


কিন্তু না! ছেলেটা কিন্তু চোখ ফেরাচ্ছে না। আরে কি আশ্চর্য্য! এক দৃষ্টিতে ছেলেটা অর্জুনকে দেখেই চলেছে। 


-" আচ্ছা আচ্ছা তোমার গোপালের জন্য মিষ্টি নিয়েই ফিরব...এখন রাখলাম।"- মায়ের ফোনটা কেটে দিয়ে এইবার দরজার সামনে এগিয়ে যায় অর্জুন। শোভাবাজার এল। আর কিছুক্ষণ পরেই দমদম। এইবার আবারও একবার ছেলেটির দিকে অতি সন্তর্পণে চোখ ঘোরাল অর্জুন। আর সঙ্গে সঙ্গেই ওর বুকের ভিতরটা কেমন যেন ধক করে উঠল। আরে এখনও দেখছে! নিষ্পলক দৃষ্টিতে!


এইবার আগ্রহের বশেই ছেলেটাকে ভালো করে খেয়াল করল ও। আর পাঁচটা সাধারণ বাচ্ছাদের মতই সাদামাটা পোশাক। কিন্তু মুখটা! মুখটা কেমন যেন অস্বাভাবিক থমথমে! ফ্যাকাশেও। ছেলেটা অর্জুনের দিকে এক দৃষ্টিতে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন বহু দিনের কোনো চাপা রাগ নিয়ে ভিতর ভিতর ফুঁসছে সে। দু তিনবার অস্বস্তিতে চোখটা সরিয়েও নিল অর্জুন। অদ্ভুতভাবে ছেলেটা কিন্তু একবারের জন্যও চোখ সরাচ্ছে না। এমনকি চোখে চোখ পড়লেও না!


-" দিস ইস শ্যামবাজার। ইয়ে শ্যামবাজার স্টেশন হে..."- মেট্রোর ঘোষণায় সম্বিৎ ফিরল অর্জুনের। কে জানে কেন এইবার ওর একটু অস্বস্তি হচ্ছে। ঠিক বলে বোঝানো যাবে না, কিন্তু ছেলেটার দৃষ্টির মধ্যে একটা যেন অদ্ভুত শিরশিরে ব্যাপার আছে। যতবার চোখে চোখ পড়ছে ততবার কেমন যেন গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।


মেট্রোর দরজা বন্ধ হতেই পাশের কামরার দিকে এবার হাঁটা লাগাল অর্জুন। উহু, ওই কামরায় থাকতে ওর কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। পাশের কামরাটা মোটামুটি ফাঁকাই। অনেক লোকই নেমে গেছে। দরজার সামনে এসে হেলান দিয়ে দাঁড়াতে যাবে এমনি সময় পিছন ফিরতেই সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ খেলে গেল অর্জুনের! বাচ্চা ছেলেটা! আবার! 


ঠিক ওর পিছন পিছন ওই কামরা থেকে এই কামরায় চলে এসেছে। অদ্ভুত ব্যাপার তো। ছেলেটা চায় কী?বাচ্চাটা কি একা? ওর মা বাবা কাউকে দেখা যাচ্ছে না তো। এইবার আরেকটা জিনিসও চোখে পড়ল অর্জুনের। ছেলেটার হাতে একটা বাস্কেট। ঠিক ছোট কুকুর বা বেড়াল ছানা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যেরকম বাস্কেট ব্যবহার করা হয় ওরকম।


কিন্তু...একবার ভালো করে উকি মেরে দেখল অর্জুন। উহু বাস্কেটে কিছুই নেই। ফাঁকা। শুধু একটা পাতলা চাদর সামান্য উঁচু হয়ে আছে। তার তলায় যে কুকুর, বেড়াল বা খরগোশ ছানা কোনোটাই ঢুকবে না তা বলাই বাহুল্য। 


-" ইয়ে দমদম স্টেশন হে..."- এবারে মেট্রোর ঘোষণায় ভূত দেখার মত চমকে উঠল অর্জুন। ছেলেটাকে দেখতে এতই মগ্ন ছিল যে কি বলবে! ছেলেটা এখনও ওকে একইভাবে দেখেই চলেছে। যাক দমদম চলে এসেছে, বাঁচা গেল। গেটের সামনে কামরার বাকিরা ধীরে ধীরে জড়ো হচ্ছে। অর্জুন খেয়াল করল বাস্কেট হাতে ছেলেটা এবার ঠিক ওর পিছনে এসেই দাঁড়াল। কে জানে কেন অর্জুনের বুকের ভিতরটা কেমন ধড়াস ধড়াস করছে। ওঃ গেটটাও খুলছে তো না!


গেটটা খুলবে ঠিক তার কয়েক সেকেন্ড আগেই হঠাৎ একটা অদ্ভুত অনুভূতিতে অর্জুনের সারা শরীরটা কেমন যেন শিরশির করে উঠল! কি একটা ঠান্ডা ভেজা জিনিস এক মুহূর্ত ওর হাতের পাতাটা স্পর্শ করেই যেন আবার সরে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখল ছেলেটা একইরকম ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছে আর...আর অর্জুনের হাতের ঠিক সামনে ঝুলছে ওর বাস্কেটটা!


মাত্র কয়েক সেকেন্ড কিন্তু তবুও অর্জুনের স্পষ্ট মনে হল কিছু একটা নরম ভেজা ভেজা জিনিস যেন ওর হাতটা স্পর্শ করেই সরে গেল! 


গেট খুলতেই আর যেন দেরি করল না ও। সোজা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেটের দিকে হাঁটা দিল। বুকের ভেতরটা অদ্ভুত ঢিব ঢিব করছে। প্রথমে ওই পাগলটা, তারপর এই অদ্ভুত ছেলেটা। কি যে অদ্ভুত জিনিসপত্র হচ্ছে ওর সঙ্গে আজ! টোকেন ফেলার লাইনে দাঁড়াতেই বুঝল বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে। সঙ্গে বজ্রপাত। এতক্ষণ বুঝতেই পারিনি। 


লাইন এগোচ্ছে ঠিক এমনি সময় আবারও যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠল অর্জুন। বাচ্চা ছেলেটা! আবার ঠিক ওর পাশে এসেই দাঁড়িয়েছে। আবারও মাঝে মাঝেই ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাচ্ছে। অর্জুন অন্য দিকে চোখ ফেরাতে যাবে এমন সময় বাচ্চা ছেলেটা ওর ঠিক মুখের সামনে হাতের বাস্কেটটা তুলে ধরে তার ভিতরে কিছু একটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, " শশশশ...শব্দ করে না!"


আর তখনই, ঠিক সেই মুহূর্তে বাস্কেটের ভিতর ভাঁজ খাওয়া চাদরটা আলতো নড়ে উঠল। আর এক মুহূর্তের জন্য হলেও চাদরের তলায় থাকা জিনিসটার সঙ্গে চোখে চোখ পড়ল অর্জুনের! 


সাপ! টোকেনের লাইনে দাঁড়িয়েই কয়েক সেকেন্ডের জন্য ওর সারা শরীর পাথরের মত স্থির হয়ে গেল। ও স্পষ্ট দেখল ভাঁজ খাওয়া চাদরের তলা থেকে ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে এক জোড়া হিমশীতল সরীসৃপের চোখ! তার মুখ দিয়ে চেড়া জিভটা এক মুহূর্তের জন্য বাইরে এসে আবার ভিতরে ঢুকে গেল!


এর মানে কী! মেট্রোয় একটা বাচ্চা ছেলে বাস্কেটের ভিতর সাপ নিয়ে উঠবে কেন? আর ছেলেটা ওকে ওভাবেই বা দেখছিল কেন? কি উদ্দেশ্য ওর। আর তখন... এইবার কথা মনে পড়তেই পায়ের তলার মাটি যেন এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল অর্জুনের! তারমানে তখন ওর হাতে যে ঠান্ডা, ভেজা ভেজা জিনিসটা লেগেছিল সেটা আসলে ওই সাপের জিভ! অসম্ভব!


// ৩ //

 

" এ কিন্তু কোনো যে সে চালান নয় মা! তন্ত্রে উল্লিখিত অষ্টাদশ চালানের মধ্যে সবচাইতে ভয়ঙ্কর ও নৃশংস এই চালান বিদ্যা...এতে কাজ হবে না মানে! হতেই হবে!"- প্রায়ান্ধকার কক্ষের মধ্যেই এইবার খিলখিল করে হেসে ওঠেন বৃদ্ধা। তার সামনে মেঝেতে রাখা মোমদানিতে এই মুহূর্তে পাঁচটি ছোট ছোট মোমবাতি কোনোমতে টিমটিম করে জ্বলছে। তাদের অতি ক্ষীণ আলোতে বৃদ্ধার ভাঙাচোরা মুখাবয়ব যেন আরও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। 


   বৃদ্ধার মুখোমুখি বসে আছে এক মহিলা আর তার পাশেই বছর দশেকের একটি বাচ্ছা ছেলে। মোমবাতির ম্রিয়মান আলো তাদের মুখের ওপর মাকড়সার জালের মত নকশা তৈরি করছে। ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় বাচ্ছা ছেলেটি স্থির হয়ে বসে আছে, কিন্তু তার পাশের মহিলাটি যেন অচেনা কোনো এক আতঙ্কে ঠকঠক করে কাঁপছে। 


-" মাগী ভয় পাচ্ছে দেখো! এত ভয় পেলে হবে?"- মহিলাটিকে দেখে বৃদ্ধা এবার বিরক্তির সঙ্গে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন। তারপর দাঁত কটমট করে বলে ওঠেন, " বুকের ভিতর রাগ কই? ক্ষোভ কই ? ঘেন্না কই! ভেতর ভেতর বিষাক্ত সাপ না পুষলে এ কাজে যে নামা যায় না তাই তুই জানিস না ঢেমনি!"


বৃদ্ধার ধমকে আবারও থর থর করে কেঁপে ওঠে মহিলাটি। কিন্তু কি অদ্ভুত তার পাশের বাচ্চা ছেলেটি এখনও একইরকম স্থির হয়ে বসে আছে। অবিকল পাথরের মূর্তির মত। তার দৃষ্টি আটকে আছে সামনে রাখা একটা চটের থলের দিকে। থলের মুখটি দড়ি দিয়ে বাঁধা। আবছায়া আলো অন্ধকারেও স্পষ্ট বোঝা যায় থলেটির ভিতরে কিছু একটা নড়ছে। 


-" কাজ হয়েছে?"- বৃদ্ধাটি এবার তার শীর্ণ হাতদুটি বাড়িয়ে দেন সেই থলিটির দিকে। 


-" হয়েছে!"- ভাঙা ভাঙা কন্ঠে মহিলাটি উত্তর দেয়।


আর তার পরক্ষনেই বৃদ্ধার মুখে আবারও ফুটে ওঠে নৃশংস হাসি। পুটুলিটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে তিনি এবার থলের দড়িটা খোলেন। তারপর থলির মুখটা অতি সন্তর্পণে এগিয়ে দেন মোমদানির পাশেই রাখা একটি পাত্রের দিকে। পাঁচটি মোমবাতির শীর্ণকায় শিখাও এবার যেন এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে প্রচন্ড ভয়ে দপদপ করে কেঁপে ওঠে। তাদের কম্পমান আলোয় বোঝা যায় সামনে রাখা পাত্রের ভিতর টলটল করছে লালচে তরল। 


-" দেখেছিল তো?"- বৃদ্ধা থলের মুখটা আস্তে করে পাত্রের ওপর খুলে দেন।


-" হ্যাঁ দেখেছিল..."- কথাটা বলতে গিয়েও শব্দগুলো গলার ভিতর যেন নুড়ি পাথরের মত আটকে যায় মহিলাটির। তার সারা শরীর অবশ হয়ে আসে। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতেই সে দেখে বৃদ্ধার হাতে ধরে রাখা থলের ভিতর থেকে ধীরে ধীরে রক্ত ভরা পাত্রের ভিতর বেরিয়ে আসছে আস্ত একটি সাপ! কালো কুচকুচে! উফ... জিনিসটাকে দেখা মাত্রই একটা অজানা অস্বস্তিতে সারা শরীর শিরশির করে ওঠে মহিলাটির। কিন্তু কি অদ্ভুত! বাচ্চা ছেলেটি এবারও স্থির ভাবে বসে থাকে। তার মুখে ভয়ের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।


-" আর মাত্র পনেরদিন!  তারমধ্যেই তুই যা চাইছিস তাই হয়ে যাবে! সব ছাই হয়ে যাবে... ছাই!"- পাত্রের ওপরে ধুনার মত কিছু একটা ঘোরাতে ঘোরাতে বৃদ্ধা এবার চিৎকার করে ওঠেন। তার হিমশীতল চোখের মণি দেখলে এই মুহুর্তে ভ্রম হয় যে আদৌ এইদুটি মানুষের চোখ না সরীসৃপের! 


-" মনস্থির করেছিস? কলস তৈরি?"- বৃদ্ধার হিসহিসে কন্ঠস্বরে আবারও মোমবাতির শিখাগুলি দপদপ করে কেঁপে ওঠে।


সামনে বসে থাকা মহিলাটি এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। বৃদ্ধার মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে।


-" মনে রাখিস! এই কলস পনেরদিন তোকে রক্ষা করতে হবে। সামান্য কোনো ত্রুটি হলেও কী ভয়ঙ্কর ফল হবে তুইও ভালো করে জানিস...আমিও..."- কথাগুলো বলতে বলতেই মহিলাটিকে চমকে দিয়ে বৃদ্ধা এবার খপাত করে পাত্রে থাকা সাপটার গলা চেপে ধরে। তারপর এক ঝটকায় পাত্র থেকে তুলে আনে ছটফট করতে থাকা সাপটাকে! মোমবাতির আলোয় দেখা যায় সাপটির গা বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে লালচে তরল।


-" দে মাগী দে! কলস এগিয়ে দে!"- বৃদ্ধা এবার দাঁতে দাঁত চিপে ভয়ঙ্কর গর্জে ওঠেন। তার কণ্ঠে সামনে বসা মহিলাটি আবারও থরথর করে কেঁপে ওঠে। তারপরের মুহূর্তেই সে তার পাশে বসে থাকা বাচ্চাটির হাত খপ করে চেপে ধরে এগিয়ে দেয় বৃদ্ধার দিকে। এই প্রথম বাচ্চাটির মুখে ভাবান্তর দেখা যায়। তার নিষ্পাপ মুখে ফুটে ওঠে আদি অকৃত্রিম ভয়। 


-" আহা রে! কি ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে! আসছে পনেরো দিন ওকে দেখে রাখিস কেমন..."- বৃদ্ধার এক হাতে ছটফট করছে রক্তমাখা সাপ। অন্য হাত দিয়েই বাচ্চা ছেলেটির হাত সজোরে চেপে ধরেন তিনি। 


-" আআআআ...আমায় ছেড়ে দাও...আমায় ছেড়ে দাও! আমায়  ছেড়ে দাও তোমরা!"- বাচ্চাটি হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে এবার!


-" ছেড়ে দিলে হবে বাছা? তোমার দেহকলসের ভিতরেই তো আগামী এক পক্ষকাল সে থাকবে!"- বৃদ্ধার চোখ হিংস্র শ্বাপদের মত আবারও চকচক করে ওঠে।


-" ক...ক...ক...কে থাকবে?"- বাচ্চা ছেলেটি ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে কাঁদতে কাদঁতেই জিজ্ঞেস করে।


বৃদ্ধার মুখে আবারও ফুটে ওঠে সেই বিশ্রী কুটিল হাসি! হাতে ধরা বিষাক্ত সাপটিকে আস্তে আস্তে তিনি ছেলেটির দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। তারপর একসময় তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে হিসহিসে কণ্ঠে বলে ওঠেন একটাই শব্দ! 


-" কুরকুট্টা!"


// ৪ // 


বড্ড দেরি হয়ে গেল। বৃষ্টির জন্য প্রায় এক ঘন্টা স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল অর্জুন। এখন অটোতে বসেই একে একে সমস্ত ঘটনাগুলো মনে মনে ঝালিয়ে নিচ্ছিল ও। একদিনে আরও কত অদ্ভুত ঘটনা ঘটবে ওর সঙ্গে? এসব কারুর মজা নয় তো? প্রথমে ওই পাগলটা, তারপর মেট্রোয় ওই বাচ্ছা ছেলেটা। এতদূর অব্দি তাও ঠিক ছিল। অর্জুন যথেষ্ট যুক্তিবাদী মানুষ। ফলে এই পর্যন্ত ঘটা সবকটা ঘটনাকেই কোনো না কোনো যুক্তির ফাঁদে ফেলে অঙ্কটা ও ঠিক মিলিয়েই ফেলছিল। কিন্তু প্রোগ্রামিং এ "বাগ" হয়ে দেখা দিল মেট্রো স্টেশন থেকে বেরোনোর সময় তৃতীয় ঘটনাটা। 


বাচ্ছা ছেলেটা কোনো একটি মহিলার সঙ্গে এসেছিল। টোকেন কাউন্টার থেকে বেরিয়ে তার কাছেই ছুটে গেল। মহিলাটার পরনে বোরখা। ফলে মুখটা দেখা গেল না। যাইহোক অর্জুনের ততক্ষণে অত আর কৌতূহলও অবশিষ্ট ছিল না। বাড়ি ফিরতে পারলে বাঁচে। 


এদিকে বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। স্টেশনের বেরোবার জায়গাটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখছে একমনে। অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে সার বেঁধে। আজ যে এরকম বৃষ্টি নামবে কেউ ভাবেইনি। বাইরে এত অন্ধকার করে এসেছে দেখলে বোঝাই যায় না যে ঘড়ির কাঁটা সদ্য চারটের কাঁটা ছুঁই ছুঁই। 


-" বৃষ্টি জিনিসটা খুব ভালো তাই না! যতক্ষণ না গায়ে পড়ছে ততক্ষণই।"- হঠাৎ একটা ভরাট পুরুষ কণ্ঠে চমকে উঠে পাশে তাকাতেই দেখে বছর পঁচিশ ছাব্বিশের এক তরুণ দাঁড়িয়ে আছে। পরণে ঢোলা পাঞ্জাবি আর জিন্স। ছেলেটা বেশ লম্বা চওড়া, সুপুরুষ। গালে মসৃণ করে ছাটা চাপ দাড়ি, চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমেছে। চোখের মধ্যে অসম্ভব একটা বুদ্ধিদীপ্ততার ছাপ। 


-" হ্যাঁ ওই আরকি..."- ছেলেটার কথাবার্তার মধ্যে একটা ঝকঝকে স্মার্টনেস আছে। অন্যদিন হলে হয়তো দু চারটে কথা বিনিময় করত অর্জুন কিন্তু আজ আর সেই অবস্থায় ও নেই । ফলে ছেলেটাকে একরকম এড়িয়েই যেতে চাইল ও। 


ছেলেটাও ব্যাপারটা বুঝল। কিছুক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়েই চুপ করে রইল। আকাশে ঘন নীল মেঘেদের বুকে বিদ্যুতের শিখা লুকোচুরি খেলছে। অনবরত ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। এর মধ্যেই হঠাৎ আবারও অর্জুনকে চমকে দিয়ে ছেলেটা বলে উঠল, " ওটার দিকে তাকিয়ে আপনি মোটেই ভালো করেননি একদম!"


হঠাৎ কথাটা শুনে এক মুহূর্তের জন্য অর্জুন চমকেই উঠল বলতে হবে। পরক্ষণেই জিজ্ঞেস করল, " মানে কোনটার দিকে তাকানোর কথা বলছেন?"


-" ওই যে ছেলেটার বাস্কেটে যেটা ছিল। আপনার ওটার দিকে একেবারে না তাকানোই উচিৎ ছিল। এত চেষ্টা করলাম, তাও আটকাতে পারলাম না। মারাত্মক জিনিস!"


-" কি বলছেন বলুন তো আপনি? আমি কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি না!"- অর্জুনের চোখে মুখে বিস্ময়।


-" যতদূর বুঝলাম ও চাইছিল জিনিসটা চালান করতে। দেখলেন না আপনার ঠিক সামনে এসেই বাস্কেটটা তুলে ধরল। আপনিই ফাঁদে পা দিলেন..বাস্কেটের ভিতর কী ছিল চোখে পড়েছে নিশ্চয়ই...সাপ!"


" সাপ " শব্দটা উচ্চারণ করা মাত্রই কিছুক্ষন আগেই বাস্কেটের ভিতরে দেখা জীবটার ছবি আবারও চোখের সামনে ঝলসে উঠল অর্জুনের। বাস্কেটের ভেতর ভাঁজ খাওয়া কাপড়...তার নীচে অন্ধকার...তার মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে একটা আস্ত সাপ...তার চেড়া জিভটা একবার বাইরে বেরিয়েই আবার ভিতরে ঢুকে গেল...অর্জুনের হাতে একটা ভেজা ভেজা নরম কিছুর স্পর্শ... মেট্রোর দরজা খুলছে...


-" এনাফ!"- প্রচন্ড ধমক দিয়ে মাথার মধ্যে চলা দৃশ্যগুলোকে যেন এক মুহূর্তে বন্ধ করে দিতে চাইল অর্জুন। পরের মুহূর্তেই সামনে দাঁড়ানো ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, " কে তুমি! কী চাও?" 


ছেলেটি এইবার নিজের দাঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতেই বেশ রহস্যময় একটা হাসি হাসল, " বাবার দেওয়া নাম কেদার, কেদার চ্যাটার্জি। আর ওই যে ওপরে যিনি বসে আছেন, সেই ভোলে বাবার দেওয়া নাম "অনন্তদৃষ্টি"। আপনার যে নামে খুশি সেই নামে ডাকতে পারেন আমায়!"


ছেলেটার কথা শুনে অর্জুন কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পরের মুহূর্তেই ওর চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠল একটা অজানা রাগে। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে উঠল, " হাউ ডেয়ার ইউ! ছেলেটা আপনারই ফিট করা তাই না? রাইট রাইট রাইট। প্রথমে পাগলটা, তারপর ছেলেটা তারপর আপনি। কোথা থেকে আমাকে ঠিক ফলো করছেন বলুন তো। কী ধান্দা? টাকা হাতানো?"


কেদার ওরফে অনন্তদৃষ্টি এবার মৃদু হাসে। " ভুল করছেন, ভুল করছেন। অবশ্য ভুল করাই স্বাভাবিক। আপনার অবিদ্যা এখনও ঘোচেনি। যাইহোক যেটা বলার সেটা বলি। বিশ্বাস অবিশ্বাস আপনার ব্যাপার।"


কেদার বলে ছেলেটি এবার সোজাসুজি চোখ রাখল অর্জুনের চোখে। " আপনি বুঝতে পারছেন না কিন্তু খুব খারাপ একটা জিনিস এই মুহূর্তে আপনাকে ফলো করছে। এবং সেটা আপনার পিছু পিছু আপনার বাড়িও যাবে।  আপনার কুলদেবতা রাধামাধব দেখছি। আপনি কাল বা পরশু যত শীঘ্রই সম্ভব বাড়িতে একটা নারায়ণ পুজো দিন নইলে..."


-" শাট আপ!"- স্থান কাল পাত্র ভুলে গিয়েই অর্জুন চিৎকার করে ওঠে, " চুপ! একদম চুপ। অন্য যে কারও সঙ্গে এসব বুজরুকী করবেন কিন্তু আমার সঙ্গে নয়। আমি খুব ভালোই জানি আপনার মত প্রতারকরা কিভাবে মানুষদের ঠকিয়ে ব্যবসা করেন।"


কথাগুলো বলতে বলতেই নিজের মনে হেসে ওঠে অর্জুন। " সরি, কিন্তু আমাকে এত সহজে মুরগি বানাতে পারবেন না। এসব ধাপ্পাবাজিতে আমার কানাকড়িও বিশ্বাস নেই। সুতরাং অন্য জায়গায় ট্রাই করুন। কিছু মুনাফা হলেও হতে পারে। আমাকে আর বেশি খোঁচালে সোজা পুলিশের হাতে..."


-" ব্যাস ব্যাস ব্যাস! বুঝে গেছি"- অর্জুনের কথা মাঝ পথেই থামিয়ে দেয় কেদার। তারপর আবারও স্মিত হেসে বলে - " আপনাকে বিরক্ত করার আমার আর ইচ্ছাও নেই। শুধু আপনার বাড়িতে যে চারজন আছে তাদের জন্য চিন্তা হচ্ছিল। যাই হোক সাবধানে থাকবেন আর..."


এইবার নিজের পকেট থেকে একটা ছোট্ট কার্ড বের করে অর্জুনের হাতে ধরিয়ে দিল কেদার। " খুব শিগগিরই আপনার আমাকে বিরক্ত করতে ইচ্ছা করবে। তখন এটা কাজে লাগবে!"


অর্জুনকে আর কোনো কথা বলতে না দিয়েই কেদার বলে ছেলেটি সামনের দিকে এগিয়ে চলে গেল। অর্জুন একই জায়গায় কিছুক্ষণ বোকার মত দাঁড়িয়ে থেকে কার্ডটায় চোখ বোলাল এবার। তারপর বিরক্ত মুখে স্টেশনের ডাস্টবিনে কার্ডটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে গেল অটো স্ট্যান্ডের দিকে। 


ঠিক সেই মুহূর্তে কেউ যদি ডাস্টবিনের মধ্যে থাকা সেই ছোট্ট কার্ডটা তুলে নিত তাহলে দেখতে পেত তাতে গোটা গোটা ইংরেজি অক্ষরে লেখা আছে,


" কেদার চ্যাটার্জি ( অনন্তদৃষ্টি )

 প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর

19/B কেশব চন্দ্র রোড, কলকাতা

( স্টার থিয়েটারের সন্নিকটে ) "


// ৫ //


-" এরপর শ্রীকৃষ্ণ বললেন, 'মামেকং শরণং ব্রজঃ! আমার স্মরণে এসো। তুমি কার্য করো অর্জুন। ফল আমি দেব।"- হাতে ধরা বইয়ের থেকে চোখ সরিয়ে নাতনির দিকে তাকালেন গায়িত্রী দেবী।


-" এটার মানে কি কন্যে? শ্রীকৃষ্ণ কী বলতে চাইল?"- ক্লাস থ্রিয়ের তুলির চোখে অপার বিস্ময়। 


-" শ্রীকৃষ্ণ বলতে চাইলেন যে মানুষ কাজ করার আগে কত কিছু ভেবে সময় নষ্ট করে। কখনও কাজের ফল কি হবে তাই ভেবে, কখনও কাজটা কত কঠিন হবে তাই ভেবে, কখনও এই ভেবেই সময় চলে যায় যে আদৌ কাজটা করতে পারব তো। কিন্তু..."- সামনে বিশাল শ্বেত পাথরের সিংহাসনে রাখা গোপালের মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে এবার একটু হাসলেন গায়িত্রী দেবী। তার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এ জায়গাটা যতবার বলেন ততবারই গায়ে কাঁটা দেয়।


-" কিন্তু?" 


-" কিন্তু কাজের ফল তো ঈশ্বরের হাতে তাই না। আমরা শুধু কাজটাই করতে পারি। তার ফল কি হবে তা তো আমাদের হাতে নেই। তাই শ্রীকৃষ্ণ বলছেন শুধু কাজেই মন দিতে, কাজ ঠিক করে করলে ফল ভগবান নিজেই দেবেন। তারজন্য আর চিন্তা করতে হবে না! বুঝেছেন গিন্নিমা!" 


-" হু বুঝেছি!" গায়িত্রী দেবীর কথা শুনে বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ায় তুলি। এই সন্ধ্যার সময়টা ঠাকুমা আর নাতনি মিলে গীতা চর্চা হয়। গীতার থেকে টুকরো টুকরো শ্লোক, কথা আবৃত্তি করে ছোট্ট তুলিকে শোনান গায়িত্রী দেবী। তিনি নিজে যথেষ্ট বিদুষী মহিলা। একসময় প্রেসিডেন্সি কলেজের সংস্কৃতে গোল্ড মেডিলিস্ট ছিলেন। দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করার পর আজ বছর পাঁচেক রিটায়ার হয়েছে। স্বামী তো কবেই চলে গেছে, এখন ছেলে, বৌমা আর নাতনিকে নিয়ে সুখের সংসার। আরেকজন আছে অবশ্য। যাকে ছাড়া তিনি দুচোখে অন্ধকার দেখেন। তার সাধের গোপাল ঠাকুর।


ঠিক এই সময়ই ফ্ল্যাটের কলিং বেলটা বেজে উঠল। 


-" ওই যে বাবা এসে গেছে! ইয়ে... এএএ..."- তুলি এক লাফ দিয়ে উঠে পড়ে নিজের জায়গা থেকে। 


-" যাও বাবাকে দরজা খুলে দাও। আমি গোপালকে তুলে নকুলদানা দিচ্ছি!"


-" হু!"- বাধ্য মেয়ের মত ঠাকুর ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে যায় তুলি। দরজা খুলতেই দেখা যায় দুহাতে দুটো প্লাস্টিক নিয়ে অর্জুন দাঁড়িয়ে আছে। ভিজে একশা জামা কাপড়।


-" ঢুকতে দেব না!" - দরজা আটকে দাঁড়ায় তুলি।


-" এ বাবা! কেন ! কী অন্যায় করলাম!"- অর্জুন বড় বড় চোখ পাকায়।


-" যেটা আনতে বলেছি এনেছো?"- কোমরে দুহাত দিয়ে পাকা গিন্নিদের মত জিজ্ঞেস করে তুলি।


-" এ বাবা যাঃ ভুলে গেলাম। কি যেন আনতে বলেছিল আমার প্রিন্সেস!"


-" আঃ তুলি! বাবাকে ভিতরে ঢুকতে দাও। ইশ ভিজে একশা হয়ে গেছ একেবারে।"- কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে তন্দ্রা। তার পরনে নাইটি। সাত মাসের সন্তান সম্ভবা সে। এখন বেশ দেখে শুনেই হাটতে চলতে হয়।


-" আরে তুমি বেরোতে গেলে কেন আবার!"- অর্জুন বাইরে দাঁড়িয়েই ব্যস্ত হয়ে ওঠে।


-" সত্যি আনোনি বাবা!"- তুলি এবার কাঁদো কাঁদো দৃষ্টিতে বলে। তার দিকে তাকিয়েই ডান হাতের প্যাকেটটা উঁচু করে ধরে অর্জুন। 


- " মাটন বিরিয়ানি উইথ চিকেন চাপ! রাতে সবাই মিলে খাবো।" 


-" ইয়েএএএ! থ্যাংক ইউ বাবা!"- ভিজে অবস্থাতেই অর্জুনকে জড়িয়ে ধরে তুলি।


-" ঠিকাছে ঠিকাছে। আমি চেঞ্জ করে নিই তারপর বাবাকে আদর করো কেমন? আর এই মিষ্টিটা ঠাকুরের। কন্যেকে দিয়ে এসো যাও"- অর্জুন দু হাতের দুটো প্লাস্টিক নিয়ে ঘরে ঢোকে। তারপর তুলিকে ঠাকুরের মিষ্টির বাক্সটা দিয়ে খাবারের বাক্সগুলো টেবিলে রেখে সোজা ছুট বাথরুমের দিকে। তুলিও ঠাকুরের মিষ্টি রাখতে ছুটল ঠাকুর ঘরের দিকে। ড্রয়িং রুমে তন্দ্রা একা...


-" ও মাগো!"- আচমকাই সোফায় বসে প্রচন্ড চিৎকার করে উঠল তন্দ্রা। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই দড়াম করে সদর দরজাটা একবার বন্ধ হওয়ার শব্দ হল।


-" কি হয়েছে বৌমা! কী হল?"- গায়িত্রী দেবী ঠাকুর ঘর থেকে ছুটে এসেছেন। অর্জুনও বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে আওয়াজ শুনে।


-" এ...এ...একটা লম্বা ছায়ার মত কিছু ঘরে ঢুকতে গিয়েই আমায় দেখেই ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল! ওটার জন্যই দরজাটা ওরকম জোরে বন্ধ হয়ে গেল।"


- " কি বলছ কি! নিশ্চয়ই ভুল দেখেছ বৌমা! ভর সন্ধ্যেবেলা কে আসবে! অন্য কিছু ভাবছিলে হয়তো..."


-" না আমি স্পষ্ট দেখেছি।"- তন্দ্রার কন্ঠস্বর কাঁপছে, " অ...অ... অনেকটা লম্বা জিনিসটা। ঘরে ঢুকতে গিয়ে আমায় দেখেই...বেরিয়ে গেল! কেমন মনে হল ওটা অর্জুনের পিছন পিছন এসেছিল...ক...ক...কী ছিল ওটা!"


****

মাঝরাত। ঘুমটা আচমকাই ভেঙে বিছানায় ধড়ফড় করে জেগে বসল তন্দ্রা। উফ কি বাজে একটা স্বপ্ন দেখল। সন্ধ্যের ঘটনাটার পর থেকেই মাথায় ভুলভাল সব জিনিস চলছে। কি জানি হয়তো ওর মনের ভুলই! মাই হয়তো ঠিক বলছেন।


 কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ব্যাপারটা টের পেল তন্দ্রা। বড্ড তেষ্টা পেয়েছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এ বাবা! বেড সাইড টেবিলে রাখা জলের বোতলটাও খালি। অর্জুনকে ডাকবে একবার। নাকি...না থাক। বেচারা অকাতরে ঘুমোচ্ছে। ভিজে একশা হয়ে সন্ধ্যেবেলা ফিরেছিল। ওকে জাগিয়ে লাভ নেই আর!


নিজেই আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নামে তন্দ্রা। ঘর অন্ধকার। ছোট্ট সবুজ নাইট বালব মিটমিট করে জ্বলছে।  ধীরে ধীরে ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ায় ও। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। কটা বাজল এখন? ড্রইং রুমেও ছোট লাল রঙের একটা বালব জ্বলছে। তার লালচে আলোয় ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে সময় রাত পৌনে তিনটে।


টেবিলের ওপরেই রাখা ছিল বোতলগুলো। হাতে নিয়ে জলটা খেতে যাবে তখনই শব্দটা পেল তন্দ্রা। ঠক ঠক ঠক ঠক। একটানা কিছু একটা দরজায় ঠোকার শব্দ না? প্রথমটা মনের ভুল বলে এড়িয়ে যেতে যাচ্ছিল, কিন্তু পরের মুহূর্তেই একটু ভালো ওরে শুনতেই গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল তন্দ্রার। উহু ও ভুল শুনছে না! বরং একদম ঠিক শুনছে কাঠের দরজায় কেউ এক নাগাড়ে কিছু একটা ঠুকছে এবং সেটা আর কারুর না ওদেরই সদর দরজায়! 


কিন্তু এত রাতে ওদের দরজায় কেউ কিছু ঠুকতে যাবে কেন? অর্জুনকে ডাকবে একবার?  বুকের ভিতরটা কেমন যেন ঢিব ঢিব করছে। না একবার নিজেই দেখুক না, ব্যাপারটা কি! দরজা তো বন্ধই। বুক ভরে একটা শ্বাস নেয় তন্দ্রা। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে ড্রয়িং রুমের প্রান্তে থাকা সদর দরজাটার দিকে। 


কে জানে কেন যত এগোচ্ছে ওর বুকের ভিতর অস্বস্তিটা ক্রমশ বাড়ছে। একসময় দরজার একবারে সামনে এসে দাঁড়ায় ও। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ব্যাপারটা বুঝতে পারে ও। এও কি সম্ভব? কেউ যেন একটা ওদের সদর দরজায় মাথা ঠুকছে! ধপ ধপ ধপ ধপ! 


প্রত্যেকটা শব্দের সঙ্গে কেঁপে কেঁপে উঠছে তন্দ্রা। ওই তো! কি একটা শব্দও ভেসে আসছে না দরজার ওপার থেকে? কেউ কিছু বলছে কি? একবার শুনবে? দুরুদুরু বুকে দরজার আরও সামনে এগিয়ে গেল তন্দ্রা। ধীরে ধীরে কান পাতল দরজার গায়ে। আর তৎক্ষনাত ওর সারা শরীর যেন বরফের মত ঠান্ডা হয়ে গেল প্রচন্ড আতঙ্কে! ও স্পষ্ট শুনল এই মাঝরাতে ওর সদর দরজার বাইরে কেউ যেন মাথা ঠুকতে ঠুকতে এক নাগাড়ে ফিসফিস করে বলছে, 


" আমায় ভিতরে ঢুকতে দিবি না? আমায় ভিতরে ঢুকতে দিবি না?    আমায়...ভিতরে...ঢুকতে...দিবি...না?"


// ৬ //


জুন, ২০১২


হাসপাতালের এই কেবিনটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কেবিনটিতে একটাই বেড। তাতে একটি বছর পঁচিশের মেয়ে অচেতন হয়ে শুয়ে আছে। অচেতন নাকি একটা ঘোর লাগা তন্দ্রা? কে জানে! মেয়েটির মুখটা বড় ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। মাঝে মধ্যেই গাঢ় তন্দ্রার মধ্যেই যেন দুঃস্বপ্ন দেখার মত কেঁপে উঠছে ও! 


-" আসুন! আপনার স্ত্রী এখন ভালো আছে। জ্ঞান ফিরেছিল। এখন ঘুমোচ্ছেন।"- নার্সের কথায় ঝিম ধরা তন্দ্রা ভাবটা তৎক্ষণাৎ কেটে গিয়ে মেয়েটা যেন ধড়ফড় করে উঠে বসল বেডের উপর। তারপর সেই ঝিম ধরা অবস্থাতেই পাগলের মত এদিক ও দিক তাকিয়ে একবার কাকে যেন খুজল। পরের মুহূর্তে চোখ কচলে ভালো করে সামনে তাকাতেই দেখল দরজার সামনে তার স্বামী দাঁড়িয়ে আছে। পাশে নার্স।


-" আপনারা কথা বলুন। আমি আসছি।"- নার্স ভদ্রমহিলা এইবার দুজনকে একলা ছেড়ে চলে গেলেন। পরিপাটি পরিচ্ছন্ন কেবিনের বুকের ওপর কেউ যেন নিঃস্তব্ধতার পাথর চাপিয়ে দিয়ে গেল।


-" সরি রঞ্জু... আই এম সরি!"- মেয়েটি এবার বেডে বসেই কান্নায় ভেঙে পড়ে। কিন্তু কি অদ্ভুত! তার আকুল কান্না দেখে তার স্বামীর কোনো ভাবান্তর হয় না। প্রস্তরমূর্তির মত একরকম ভাবাবেগহীন মুখ নিয়ে সে শুধু মেয়েটির সামনে এসে দাঁড়ায়। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতেই তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরে,


-" সরি রঞ্জু আমি বুঝতে পারিনি এমনটা হবে...ভগবান এইভাবে আমাদের বেবি দিয়ে আবার তাকে নিয়ে নেবেন...আমি ভাবতেও পারিনি!"


-" তোমার মত নিকৃষ্ট একটা মেয়েকে ভগবান সন্তান দেবেন না এটা আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল!"


স্বামীর কথাগুলো যেন ধারালো অস্ত্রের মত মেয়েটির বুকে গিয়ে বেঁধে। থরথর করে কেঁপে ওঠে সে। বিস্ময় ভরা চোখে মেয়েটি তার ভালোবাসার মানুষটির চোখের দিকে তাকায়। নিষ্পলক, অভিব্যক্তিহীন। তবু বোঝা যায় এই দৃষ্টিতে ঘেন্না ছাড়া আর কিচ্ছু নেই।


-" রঞ্জু! "


-" তুমি এবং তোমার মা...তোমরা দুজনে একটু একটু করে আমার জীবনটা শেষ করে দিলে। আজ আমার সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই নষ্ট হয়ে গেছে শুধুমাত্র তোমাদের দুজনের পাপের ফলে!"- ছেলেটির মুখ ক্রমশ পাথরের মত শক্ত হয়ে উঠছে।


-" তুমি ভুল করছ রঞ্জু, ইট ওয়াজ জাস্ট এন এক্সিডেন্ট...এতে মায়ের কোনো দোষ নেই।"- মেয়েটির কন্ঠ আবেগঘন।


-" আছে দোষ! ছিল, আছে আর থাকবে! তোমার আর আমার এতদিনের ভালোবাসার, প্রেমের সম্পর্কটা যে আজ এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তার কারণ একমাত্র তোমার মা।"


-" এনাফ ঋজু! আমি আর নিতে পারছি না! তোমার স্ত্রীর প্রথম সন্তান মিস ক্যারেজ হয়ে গেছে...তোমার এখন আমাকে জড়িয়ে ধরে আগলে রাখার কথা সেখানে তুমি আমায় এসব বলছ! রঞ্জু..."- মেয়েটি এবার তার স্বামীর হাত ধরে কাতর দৃষ্টিতে চায়, " আমার জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে না রঞ্জু? চিন্তা হচ্ছে না?"


মেয়েটির স্বামী এইবারে এক ঝটকায় তার হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। তার চোখে মুখে কারুণ্যের পরিবর্তে ফুটে ওঠে অপরিসীম ঘৃণা! অতি সংক্ষেপে সে শুধু উত্তর দেয়, " না, হচ্ছে না!" 


// ৭ //


২১ জুন, ২০১৭


-" উফ তন্দ্রা! তুমি যে কী করো... তোমার জন্য আমার চিন্তার শেষ নেই।"- বিছানায় বসিয়ে তন্দ্রার হাতে ফু দিচ্ছিল অর্জুন। 


-" উফ! আরে বাবা আমার কিছু হয়নি। সামান্য তেলের ছিটে লেগেছে। একটু ফোস্কা পড়বে। আর কিছু হবে না।"- অর্জুনের কান্ড কারখানা দেখে মনে মনে হাসে তন্দ্রা। বিয়ের পর যত সময় গড়াচ্ছে অর্জুন যেন আরও বেশি যত্নশীল হয়ে উঠছে তন্দ্রার প্রতি। বিশেষ করে গর্ভবতী হওয়ার পর থেকে যত্নটা যেন একটু বেশিই বেড়ে গেছে।


-" সরি মা। আমার জন্য লুচি করতে গিয়েই এরকম হল।"- বিছানার ওপর স্কুলের ড্রেস পরে গোমড়ামুখো হয়ে বসেছিল তুলি। ঘড়ির কাটা পৌনে নটা ছুঁই ছুঁই। সাড়ে নটায় স্কুলের গাড়ি আসবে। ওর টিফিনের জন্যই লুচি ভাজতে গিয়েছিল তন্দ্রা।


-" হয়েছে, বাবার দেখে দেখে আর পাকামী করতে হবে না! দাঁড়াও আমি ভেজে দিচ্ছি তোমায় লুচি।"- তন্দ্রা বিছানা থেকে উঠতেই যাবে তখনই অর্জুন ওকে ধরে আবার বিছানায় বসিয়ে দিল, " ওয়েট ওয়েট ওয়েট। তোমাকে আর কিছু করতে হবে না। তুমি রেস্ট নাও।"


-" তাহলে আমার টিফিনের লুচি!"- ছোট্ট তুলি করুণ মুখে চায়।


-" আরে নো চিন্তা ম্যাডাম! বাবা আছে কী করতে? তুলির জন্য আজকে লুচি তরকারি বানাবে নান আদার দ্যান শেফ অর্জুন!"- হাতে একটা কাল্পনিক খুন্তি ধরার ভঙ্গি করে অর্জুন এমনভাবে হাত নাড়ায় যে তন্দ্রা আর তুলি দুজনেই হো হো করে হেসে ওঠে। 


-" আচ্ছা তুলি, চুপটি করে মায়ের কাছে বসো। মা যেন কোথাও না নামে খেয়াল রাখবে কেমন! আমি গেলাম লুচি অভিযানে।"- মেয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ টেপে অর্জুন।


-" ওক্কে ক্যাপ্টেন!"- বাবাকে পাল্টা স্যালুট ছুড়ে দিয়ে তুলি।


বাবা আর মেয়ের কান্ড দেখে তন্দ্রা মুখে হাসে বটে কিন্তু মনে মনে একটা অদ্ভুত স্বস্তি অনুভব করে। একসময় যে জীবনে বেঁচে থাকাটাই বিষম যন্ত্রণা বলে মনে হয়েছিল সেই জীবনটাই যে ঈশ্বর এত সুন্দর করে সাজিয়ে দেবে তা ও কখনও ভাবতেও পারিনি। নিজের জন্য নয়, তুলির জন্যই সবচেয়ে বেশি স্বস্তি অনুভব করে ও। ছোট্ট বয়সে মেয়েটা অনেক কিছু দেখে ফেলেছে। ভগবান এইটুকু সুখ যে অন্তত ওর কপালে লিখেছে এই জন্যই তন্দ্রা ঈশ্বরের কাছে অশেষ ঋণী।


-" তুলি আমাকে আজকের হরোস্কোপটা খবরের কাগজ থেকে পড়ে শোনাও তো। দেখি কেমন বাংলা পড়তে পারো।"- বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে পা'টা টানটান করে শোয় তন্দ্রা। কিছুক্ষণ আগেই পাশে ঠাকুর ঘর থেকে ঘন্টার আওয়াজ আসছিল। এখন আওয়াজ বন্ধ। ভারী অদ্ভুত তো! তন্দ্রার শাশুড়ি মা'র পুজো এত তাড়াতাড়ি তো শেষ হওয়ার কথা নয়।


তুলি খবরের কাগজটা খুলে মাকে এবার হরোস্কোপ পড়ে শোনাতে শুরু করে। প্রতিদিন এই একই কাজ করায় ও ভালোই জানে কোন পাতায় কোনটা পড়তে হবে।

- " তুলা রাশির জাতকদের জন্য আজকের দিনটি বিপদসঙ্কুল। পদে পদে বিপদের সম্ভাবনা। আগামী এক পক্ষকালের মধ্যে অর্থহানি, স্বাস্থ্য ক্ষয় অথবা স্বজনহানির সম্ভাবনা...মা স্বজনহানি মানে কী?"


তুলির প্রশ্নে যেন থমকে যায় তন্দ্রা। কেন জানি না হঠাৎই ওর কাল রাতের ঘটনাটার কথা মনে পড়ে যায় আবার। সেই মধ্যরাত...নিভু নিভু লালচে আলোয় রাঙা ড্রয়িং রুম... সদর দরজায় ধপ ধপ মাথা ঠোকার শব্দ...দরজার ওপার থেকে কে যেন বলছে "আমায় ভিতরে আসতে দিবি না"...দৃশ্যগুলো মনে পড়তেই বিছানায় বসে সাত সকালেই কেঁপে ওঠে তন্দ্রা।


উহু অর্জুনকে ও কিছুই বলেনি। কাল রাতে আওয়াজটা কিছুক্ষণ শোনার পরই বন্ধ হয়ে যায়। দরজা খুলে দেখবার সাহস অবশ্য হয়নি ওর। বরং ঘটনাটা সম্পূর্ণ মনের ভুল ভেবেই ও ঘরে এসে শুয়ে পড়ে। সকালে অর্জুনকে একবার বলবে ভেবেছিল, কিন্তু অর্জুন আবার এসবে বিশ্বাস করবে কি করবে না। ও তো এমনিতেও নাস্তিক গোছের...


-" মা এরপর আরও লেখা আছে পড়বো?"- মাকে অন্যমনস্ক দেখে খবর কাগজ হাতে ধরেই এবার জিজ্ঞেস করে তুলি।


-" হ্যাঁ? হুম...পড় কী লেখা আছে!"


-" এরপর লেখা আছে, ' যা আপনাকে ও আপনার পরিবারকে রক্ষা করত, তাকে দূরে যেতে দেবেন না। নচেৎ বিপদ গৃহের অন্দরে প্রবেশ করবে।' "


তন্দ্রা ভুরু কুঁচকায়। মানে? এতকাল হরোস্কোপ পড়ছে। এমন অদ্ভুত কথা তো কখনও পড়েনি আগে। খবরের কাগজটা তুলির হাত থেকে নিয়ে নিজেই একবার চোখ বোলায় ও। হ্যাঁ তুলি ঠিকই পড়েছে। কিন্তু...


তন্দ্রার চিন্তার জাল হঠাৎই ছিন্ন হয়ে যায় গায়িত্রী দেবীর কন্ঠে, " এই বাবু তাড়াতাড়ি শোন। মহা অঘটন হয়েছে। হে রাধামাধব, ভালো মানুষটার সঙ্গেই এমন করতে হল! হে ভগবান..."


কথাগুলো বলতে বলতে গায়িত্রী দেবী এবার তন্দ্রার ঘরে এসে ঢুকলেন। পিছন পিছন অর্জুনও। 


-" কী হয়েছে কাঁদছ কেন মা? কারুর কিছু হয়েছে?"- অর্জুন জিজ্ঞেস করে।


-" আর বলিস না...তোর ছোট মামা। কাল মাঝরাতে হঠাৎ হার্ট এট্যাক হয়েছে। হাসপাতালে যেতে হবে। একেবারে যায় যায় অবস্থা। আমি গিয়ে শেষ চোখের দেখাটা দেখে আসি...আমায় দেখতে চাইছে..."


-" ছোট মামা! সে তো নবদ্বীপে বাড়ি। তুমি একা একা যেতে পারবে? আর এত দূর, গিয়েই তো ফিরতে পারবে না..."


-" আমি যেতে পারব। অসুবিধা হবে না। তুই ট্রেনের টিকিটটা কেটে দে।"- চোখের জল মুছতে মুছতে বলতে থাকেন গায়িত্রী দেবী, " ওখানে গিয়ে বোধহয় দু তিন দিন থাকতেও হতে পারে। দেখি কিরকম কি অবস্থা। আমি তাড়াতাড়ি চলে আসব। তুই একটু বৌমাকে দেখে রাখিস..."


-" হুম!"- অর্জুন মাথা নাড়ে। পরের মুহূর্তেই কি যেন মনে পড়ে ওর, " এই রে লুচির তরকারি! যাহ পুড়ে গেল!" 


আর কোনো কথা না বলেই রান্নাঘরের দিকে ছুট দেয় অর্জুন। গায়িত্রী দেবী কিন্তু যান না। কেমন অদ্ভুত একটা থমথমে মুখ নিয়ে তন্দ্রার দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসেন তিনি।


-" কিছু বলবে মা?"- তন্দ্রা জিজ্ঞেস করে।


-" না কিছু না..."- কেমন যেন ইতস্তত করেন তন্দ্রার শাশুড়ি মা, পরক্ষণেই বলেন, " আমার মনটা কেমন যেন কু ডাকছে বৌমা! কিছু একটা খারাপ হতে চলেছে!"


-" এরকম বলছেন কেন?"- তন্দ্রা নড়ে চড়ে বসে।


-" আর বলো না। তুমি তো জানো আমি যেখানে যাই গোপালকে সঙ্গে নিয়ে যাই। এবারেও সেটাই ভেবেছি। এমনিতেও তুমি এই অবস্থায় গোপালের সেবাও দিতে পারবে না ঠিক করে। তাই আরকি। তো ফোনটা রেখেই আমি গোপালের প্রসাদ তুলতে গেছি, ও মা! কোথাও কিছু নেই হঠাৎ সিংহাসন থেকে গোপাল গড়িয়ে মাটিতে পড়ে গেল। কে জানে কেন ব্যাপারটা আমার একদম ভালো লাগল না জানো..."


-" তোমার গোপাল আসলে এই বাড়ি ছেড়ে এখন যেতে চাইছে না কন্যে!"- তুলির কথা শুনে গায়িত্রী দেবী মৃদু হাসলেন। তারপর কিছু না বলেই চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। কিন্তু তুলির বলা এই সামান্য কথাটায় কে জানে কেন আচমকাই তন্দ্রার গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল। ওর চোখ একমুহূর্তের জন্য আবার আটকে গেল হাতে ধরা খবরের কাগজের ঠিক সেই জায়গাটায় যেখানে লেখা আছে,


- " তুলা রাশির জাতকদের জন্য আজকের দিনটি বিপদসঙ্কুল। পদে পদে বিপদের সম্ভাবনা। আগামী এক পক্ষকালের মধ্যে অর্থহানি, স্বাস্থ্য ক্ষয় অথবা স্বজনহানির সম্ভাবনা। যা আপনাকে ও আপনার পরিবারকে রক্ষা করত, তাকে দূরে যেতে দেবেন না। নচেৎ বিপদ গৃহের অন্দরে প্রবেশ করবে।"


// ৮ //


-" হ্যাঁ রে বাবা ঠিক আছি। কোনো সমস্যা হচ্ছে না...উহু তুলি এখনও ফেরেনি, ফিরলে ফোন করব...এখন রাখছি!"- অর্জুনের ফোনটা কেটে দিয়েই সোফায় এসে বসল তন্দ্রা। অর্জুন যে এই বারবার ওকে ফোন করে খবর নিচ্ছে তন্দ্রার সেটা ভালোই লাগে, আবার মাঝে মাঝে একটু বিরক্তও লাগে। তন্দ্রা কি বাচ্ছা নাকি! না এই ওর প্রথম বাচ্ছা হচ্ছে ! এইসময় কেমনভাবে থাকতে হয় তন্দ্রা সবই জানে। অবশ্য অর্জুনের এটা প্রথমবারই ফলে ওর দিক থেকে টেনশন হওয়া স্বাভাবিক...


মাইক্রোওভেনের ডিজিটাল স্ক্রিনে একবার চোখ বুলিয়ে নিল তন্দ্রা। আরও মিনিট দশেক। তারপরেই কেক তৈরি। এমনিতে তন্দ্রার খুব বেকিং এর শখ। মাঝেমধ্যেই মন খারাপ থাকলে বেকিং করে। তুলিও কেক, কুকি খেতে খুব ভালোবাসে। ফলে মনটাও ভালো থাকে, তুলির নিত্যনতুন খাবার জিনিসও হয়।


আজকে যেমন সকাল থেকেই মনটা ভালো নেই তন্দ্রার। একে কালকের ওই ঘটনাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তারওপর আবার আজ সকালে মা অমন আচমকা চলে গেলেন। তন্দ্রার শাশুড়ি মা গোপাল অন্ত প্রাণ। তন্দ্রা বলেছিল বটে বার কয়েক কিন্তু শাশুড়ি মা শুনলেন কই! গোপালকে নিয়েই নবদ্বীপ চলে গেলেন। কে জানে কেন তারপর থেকেই তন্দ্রার মনটা বড় কু ডাকছে...কিছু কি খারাপ ঘটতে চলেছে! কে জানে...


এই রে কি জোরে বৃষ্টি নামল! এ বাবা, রান্না ঘরের দিকের জানলাটা খোলা। এক্ষুণি না বন্ধ করলে বৃষ্টির ছাটে পুরো ওভেন ভিজে একশা হবে। তন্দ্রা সোফা থেকে উঠে পড়ে। আস্তে আস্তে ধীর পায়ে রান্না ঘরের দিকে এগোতে থাকে। বাইরে ইতিমধ্যে বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। দুপুর সবে সাড়ে তিনটে, কিন্তু এমন অন্ধকার করে এসেছে যেন কত রাত! সত্যি বলতে এই ফ্ল্যাটে এখন একা থাকতে কেমন যেন গা ছমছম করছে তন্দ্রার।


রান্না ঘরে ঢুকে আলো জ্বলানোর সুইচটা টিপতেই ব্যাপারটা টের পেল তন্দ্রা। কারেন্ট নেই। স্বাভাবিক। দুয়েকবার আকাশে বিদ্যুতের ঝলক দেখলেই এখানে কারেন্ট অফ করে দেওয়াটা দস্তুর। তারমানে কেকটাও গেল। যত্তসব! এ হে বৃষ্টির ছাট ঢুকে রান্না ঘরের মেঝেটা জলে ভেসে গেছে। নাইটিটা তুলে ধরে অত্যন্ত সাবধানে পা টিপে টিপে জানলার দিকে এগোতে থাকে তন্দ্রা। 


জানলাটা এবার বন্ধ করতে যাবে তন্দ্রা ঠিক এমন সময় খুব কাছেই কোথাও প্রচন্ড জোরে একটা বাজ পড়ল! 

-" ও বাবা গো!"-  জানলাটা বন্ধ করার আগেই প্রচন্ড একটা ঝোড়ো হাওয়ায় কাঁচের জানলাটা সজোরে একবার আছাড় খেল ধাতব গ্রিলের বুকে! পরমুহূর্তেই ঝনঝন করে ভেঙে যাওয়া কাঁচের টুকরোগুলো বুলেটের মত ধেয়ে এল তন্দ্রার দিকে। উফ! ভাগ্যিস বিদ্যুতের আওয়াজ সইতে না পেরে তন্দ্রা ঠিক সময় বসে পড়েছিল নইলে আজ কাঁচের টুকরোয় হাত পা কেটে একশা হত।


সারা মেঝেতে ছনছন আওয়াজ করে কুচি কুচি বরফের মত ছড়িয়ে পড়ল কাঁচের টুকরোগুলো। হে ভগবান! কি অনর্থ শুরু হয়েছে! সদ্য ঘটে যাওয়া এই আকস্মিক ঘটনার প্রত্যাঘাতে তন্দ্রার বুকের ভেতরটা এখনও কেমন ঢিব ঢিব করছে। ইশ! চুলেও কাঁচের টুকরো পড়েছে! হাত দিয়ে কাঁচের টুকরোগুলো ঝেড়ে ফেলতে যাবে তখনই আওয়াজটা পেল তন্দ্রা।


-"ঝসসসসস!"- কল থেকে এক নাগাড়ে জল পড়ার শব্দ না! কিন্তু কোনো কল তো খোলা নেই! তাহলে? ভালো করে শুনতেই বুকের ভিতর অস্বস্তিটা কেমন যেন ক্রমশ বাড়তে লাগল তন্দ্রার। রান্না ঘরের বেসিন! ওই বেসিনের কলটা থেকেই জল পড়ছে। কিন্তু তা কি করে সম্ভব! কলটা তো একটু আগেই বন্ধ ছিল...নিজে নিজে এভাবে কল চালু হয়ে যাবে কি করে?


তন্দ্রা এবার কোনো মতে উঠে দাঁড়ায়। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বাইরের অন্ধকার যেন এই সদ্য ভেঙে যাওয়া জানলা গলে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে সারা ঘরের ভিতর। কিচেনটা ড্রয়িং রুমের একেবারে পাশেই। এই মুহূর্তে কিচেন থেকে দাঁড়িয়ে দেখলে মনে হচ্ছে পুরো ড্রয়িং রুম জুড়ে কেউ যেন একটা আবছায়া অন্ধকারের পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছে!


অত্যন্ত সন্তর্পণে মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা কাঁচগুলোকে এড়িয়ে সামনে দু পা এগিয়ে যায় তন্দ্রা। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছে বেসিনের কল খোলা! আশ্চর্য! নিজে থেকে কি করে খুলে গেল? কলটা এবার বন্ধ করে দেয় তন্দ্রা। এইটুকু সময়েই বেসিন অর্ধেক ভরে গেছে। অর্জুন এলে বলতে হবে বেসিনের মুখটা দেখতে কিছু আটকে আছে কিনা... কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সামনে এগোতেই যাবে ঠিক তখনই আবার....


-" ঝসসসস..."- শব্দটা পেয়ে ভূত দেখার মতোই চমকে উঠল তন্দ্রা। এইবার কেমন যেন ওর তীব্র অস্বস্তি হচ্ছে। ঘাড়ের কাছটা শিরশির শিরশির করছে। এসবের মানে কী? পিছনে ঘুরতেই ও অবাক হয়ে দেখল বেসিনের কলটা আবার খুলে গিয়েছে। নিজের থেকেই! তার থেকে প্রচন্ড গতিতে বেরিয়ে আসছে জলের ধারা। ঠিক এই মুহূর্তে তন্দ্রার কি হল কে জানে, তৎক্ষণাৎ কলটা ঘুরিয়ে বন্ধ করে দিল। তারপর কলটার দিকে তাকিয়েই দমবন্ধ করে রইল কয়েক সেকেন্ড। এক...দুই...তিন...


-" ঝসসসস..."- তন্দ্রা যা দেখছে তা কি সত্যি? কলের নবটা নিজের থেকেই ঘুরে গিয়ে আবার জল পড়তে শুরু করেছে। এইবার তন্দ্রার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কি হচ্ছে এখানে এসব? ও বাড়িতে একা তখনই এসব হতে হল! বেসিনের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েইছিল তন্দ্রা আচমকাই প্রচণ্ড ঝনঝন শব্দে আতঙ্কে প্রায় চিৎকার করে উঠল ও। বাসনগুলো! দেওয়ালের গায়ে র‍্যাকে রাখা বাসনগুলো নিজে থেকেই ঝনঝন করে মেঝেতে পড়ে যাচ্ছে! এ কি করে সম্ভব! কোথাও কিছু নেই...


-" আআআআ!"- বাসনের র‍্যাক থেকে একটা চিনামাটির কাপ সজোরে ছুটে এসে ধাক্কা খেল কিচেনের পিছনের দেওয়ালটায়। প্রথমে একটা তারপর আরেকটা! এক মুহূর্তের জন্য তন্দ্রার মনে হল অদৃশ্য কেউ একজন যেন সমস্ত বাসন প্রবল আক্রোশে ছুড়ে মারছে ওর দিকেই! 


-" আআআআ!"- প্রচন্ড ভয়ে আবারও একবার চিৎকার করতে করতে মাটিতে ধপ করে বসে পড়ল তন্দ্রা। হে ঈশ্বর! কি হচ্ছে এখানে! মাথার উপর ঝনঝন করে বাসন ভেঙে পড়ছে। উফ প্রচন্ড আতঙ্কে তন্দ্রার নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে  ক্রমশ...অর্জুন...অর্জুনকে ফোন করতে হবে...ফোনটা সোফায় রাখা... বুকের ভিতর জোরে একটা শ্বাস নেয় তন্দ্রা! তারপর হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগোনোর চেষ্টা করে ও...

-" আহ!"- কাঁচ! মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা কাঁচের টুকরো হাতের নরম চামড়া ভেদ করে ঢুকে গেছে! বেশ বড় টুকরোটা, হাত থেকে বের করতেই এবার গলগল রক্ত বেরোতে শুরু করল তন্দ্রার। এর ঠিক পরের মুহূর্তেই তন্দ্রা বুঝতে পারল ওর কিচেনের মেঝে ক্রমশ ভেসে যাচ্ছে জলে...জল জল জল...এত জল আসছে কোথা থেকে? পরক্ষনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেল তন্দ্রার জন্য। বেসিন ভরে গেছে। এইবার সেখান থেকেই জল উপচে পড়ছে মাটিতে! 


ঠিক এই সময় বাইরে প্রচন্ড জোরে একটা বাজ পড়ল। আর তাতেই এক মুহূর্তের জন্য সামনের ড্রয়িং রুমটা সিনেমার পর্দার মত আলোকিত হয়ে উঠল তন্দ্রার সামনে। আর সঙ্গে সঙ্গেই ওর সারা শরীর যেন বরফের মত ঠান্ডা হয়ে গেল নিমেষেই! কিছু একটা লম্বা ছায়ার মত দেখল না ও? ও...ও...ওই সোফাটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল! হ্যাঁ স্পষ্টই তো দেখল তন্দ্রা। 


এইবার প্রচন্ড ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কোনোমতে উঠে দাঁড়াল ও। বাসন পড়া বন্ধ হয়েছে। সারা মেঝে ভেসে যাচ্ছে জলে। তারমধ্যে দাঁড়িয়েই তন্দ্রা স্থির হয়ে চেয়ে আছে সামনের ড্রয়িং রুমের দিকে। ওর সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। উহু কোনো চোখের ভুল নয়। আবছায়া অন্ধকারে ও এবার স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ওর ড্রয়িং রুমে ঠিক সোফার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা বাচ্চার অবয়ব। বাচ্চাটা হাতে কিছু একটা ধরে আছে মনে হচ্ছে না? আর ওর পিছনে...একটা লম্বাটে কালো ছায়া...হে ঈশ্বর ওটা কী!


ঠিক এই মুহুর্তেই আরেকবার বিদ্যুৎ চমকে উঠল! আর সঙ্গে সঙ্গেই এক মুহূর্তের জন্য পুরো দৃশ্যটা স্পষ্ট দেখতে পেল তন্দ্রা। একটা বছর দশেকের বাচ্চা ছেলে, অসম্ভব থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে ওর দিকে চেয়ে। হাতে ধরা একটা মাটির কলসি। আর তার পিছনেই জমাট বেঁধে আছে এক রাশ অন্ধকার! 


এসব কি দেখছে তন্দ্রা! ও পাগল হয়ে যায়নি তো! এসবের মানে কী! প্রচন্ড আতঙ্কে ভয়ে ও চিৎকার করে উঠতে যাবেই তার আগেই ও দেখল অন্ধকার ভেদ করে বাচ্চাটা ধীরে ধীরে ওর সামনে এগিয়ে আসছে! একদম কিচেনের সামনে এসে দাঁড়াতেই ছেলেটার মুখটা এইবার আরও স্পষ্ট দেখল তন্দ্রা। লাশের মত ধবধবে ফ্যাকাশে মুখ। হাতে ধরা একটা মাটির কলসি। ওকে চমকে দিয়েই ছেলেটা এবার আঙুল তুলে ওর পেটের দিকে দেখাল। ঠিক এর পরের মুহূর্তেই পিছন থেকে প্রচন্ড একটা ধাক্কা অনুভব করল তন্দ্রা। 


-" আআআআ!"- মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়তে গিয়ে কোনো মতে বাঁচল ও! কিন্তু হাতে চোট লেগেছে। ধড়ফড় করে উঠে বসতে যাবে তখনই একটা শব্দে সারা শরীর যেন প্রচন্ড অস্বস্তিতে শিরশির করে উঠল ওর!


-" সসসস...."- সাপ! সাপের শব্দ! সামনে চোখ তুলে তাকাতেই প্রচন্ড আতঙ্কে ও বিস্ময়ে তন্দ্রা দেখল ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চা ছেলেটার কলসি থেকে বেরিয়ে আসছে কালো কুচকুচে একটা সাপ! কে জানে কেন তন্দ্রার মনে হচ্ছে সাপটা ওই কলসি থেকে নেমে এঁকে বেঁকে ক্রমশ যেন এগিয়ে আসছে ওর পেটের দিকেই!


 প্রচন্ড ভয়ের আতঙ্কে ও চিৎকার করে উঠতে যাবে তার আগেই একটা ফিসফিসে হিমশীতল কন্ঠস্বরে ওর সারা শরীর যেন জমে বরফ হয়ে গেল! ও স্পষ্ট শুনল ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্ছা ছেলেটা এইবার ফিসফিস করে বলে উঠল একটাই কথা, " আমায় ভিতরে ঢুকতে দিবি না? আমায় ভিতরে ঢুকতে দিবি না? আমায়...ভিতরে...ঢুকতে...দিবি... না?"


// ৯ //


-" তন্দ্রা! ঠিক আছো এখন?"- অর্জুন প্রচন্ড জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে টেনশনে। মাত্র একটা দিন বাড়িতে কেউ নেই। তাতেই কি থেকে কি যে হয়ে গেল! বাড়ি ফিরে দেখছে এই অবস্থা! তন্দ্রা কিচেনের মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। সারা গা হাত পায়ে কাটা ছেড়ার দাগ। সারা কিচে ভেসে যাচ্ছে জলে। এখানে ওখানে কাঁচের টুকরো, বাসন, ভাঙা কাপ-বাটি! হে ঈশ্বর! কী হয়েছে এখানে আজ! কোন ঝড় বয়ে গেছে তন্দ্রার ওপর দিয়ে? 


এতবার ফোন করেও যখন তন্দ্রা ফোন ধরেনি তখনই মনে সন্দেহটা হয়েছিল অর্জুনের। তাও ভেবেছিল হয়তো দুপুরে ঘুমাচ্ছে। তারপর তুলি স্কুল থেকে ফিরে অনেকবার ডেকেও কাউকে না পেয়ে, শেষমেশ ওপরের অনিতা জ্যেঠিমাদের কাছে গিয়ে বলে। ওরাই ফোন করে খবর দেয় অর্জুনকে। ভাগ্যিস ডুপ্লিকেট চাবিটা ছিল। নইলে তো ঢোকাই যেত না! 


-" মা! ও মা! কী হয়েছে তোমার! এরকম ঘুমোচ্ছ কেন মা?"- তুলিও আজ মাকে অমন অচেতন অবস্থায় দেখে কেমন যেন ঘাবড়ে গেছে। আর কেউ না জানুক অর্জুন তো অন্তত জানে তুলির অতীতে কিছু ট্রমা আছে। কে জানে এসব দেখে বাচ্চা মেয়েটার মনে কী প্রভাব পড়েছে!


-" অর্জুন! অ...অ... অর্জুন!"- আধো জাগরণেই তন্দ্রা এবার কথা বলে ওঠে।


-" হ্যাঁ তন্দ্রা বলো! এই তো আমি এখানেই আছি। কি হয়েছে বলো!"- তন্দ্রার হাতটা অর্জুন আরও শক্ত করে চেপে ধরে।


-" ও...ও ভিতরে ঢুকতে চাইছে অর্জুন...ও ভিতরে ঢুকতে চাইছে...ওকে ভিতরে ঢুকতে দিও না...ও মাগো কি ভয়ঙ্কর!"-  প্রচন্ড ভয়ে আধো ঘুমের মধ্যেই কেঁপে কেঁপে উঠছে তন্দ্রা।


-" কে ভিতরে ঢুকতে চাইছে? কালকে থেকে এসব কী বলছ তন্দ্রা? আজ দুপুরে কী হয়েছে তোমার সঙ্গে?"


-" ও মাগো পেটে কী যন্ত্রণা...সাপ...সাপটা এগিয়ে আসছে...আমার বাচ্ছাটাকে শেষ করে দেবে...ও মাগো...ও মা!"- পেটটা চেপে ধরেই এবার প্রচন্ড কাতরাতে থাকে তন্দ্রা। কিন্তু এদিকে তন্দ্রার কথা শুনে অর্জুন কেমন যেন পাথরের মত স্থির হয়ে গেছে।


সাপ! ঠিক শুনল ও? তন্দ্রা হঠাৎ সাপের কথা কেন বলছে? এই শব্দটা শোনামাত্রই ওর কেমন হঠাৎ করেই আগের দিনের ঘটনাগুলো সিনেমার দৃশ্যের মত চোখের সামনে ভেসে উঠল। আর তার সঙ্গেই কানের সামনে ঝনঝন করে বেজে উঠল গতকাল সেই পাগলের বলা কথাটা, " কোনোকিছুই এ জগতে কারণ ছাড়া হয় না! সবকিছুর পিছনেই কোনো না কোনো কারণ আছে!"


তাহলে কি এই সবকিছুর পিছনে কোনো কারণ আছে? কাল থেকে পরপর ওর সঙ্গে যা কিছু হচ্ছে সব কি আসলে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত? কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব? ওর এতদিনকার যুক্তি বুদ্ধি বিশ্লেষণের শৃঙ্খল যেন এক নিমেষে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে মুহূর্তের মধ্যে। 


-" অর্জুন অর্জুন! বাচ্চা ছেলেটা...ও কোথা থেকে এল অর্জুন! ও মাগো! ওর চোখদুটো কি ঠান্ডা....অর্জুন ওর হাত থেকে কলসিটা নিয়ে নাও...প্লিজ!"- আবারও ঘুমের মধ্যেই ছটফট করে ওঠে তন্দ্রা। ডাক্তার তো ওকে চেকআপ করে সন্ধ্যেবেলা কড়া ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেল তাও ও এরকম করছে কেন পাগলের মত?


আর বাচ্ছা ছেলে! কোন বাচ্চা ছেলের কথা বলছে তন্দ্রা? কে জানে কথাটা ভাবামাত্রই নিজের অজান্তেই কেমন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল অর্জুনের। আজ সকালেরই একটা ঘটনার কথা স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠল আচমকাই...


মাকে স্টেশনে ট্রেনে তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরছে অর্জুন। ওদের ফ্ল্যাটটা তিন তলায়। এই ফ্লোরে বাকি দুটো ফ্ল্যাট ফাঁকা, কেউ থাকে না। ওপরের ফ্লোরে থাকে দুটো ফ্যামিলি। অনিতা জ্যেঠিমারা আর কাকলিদিরা। তখন সকালবেলা তিনতলায় উঠে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে যাচ্ছে এমন সময় পিছনে কাকলিদির গলা,


-" এই অর্জুন! তোমার মা কোথায় গেল গো সাতসকালে অত জিনিসপত্র নিয়ে? কারুর কিছু হয়েছে?"- কাকলিদি এমনিতে খুব ভালো। সবসময় খোঁজ খবর নেয়। গায়িত্রী দেবীর সঙ্গে খুব ভাব।


-" হ্যাঁ ওই আমার ছোট মামার কাল রাতে হঠাৎ হার্ট এট্যাক হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি। মা দেখতে গেল। নবদ্বীপ!"


-" ও বাবা! সে তো অনেক দূর। এ কদিন তোমরা যখন থাকবে না তন্দ্রা তাহলে বাড়িতে একা থাকবে?"


-" হ্যাঁ ওই আরকি! দেখছি কি ব্যবস্থা করা যায়। কাকু ভালো আছে?"- সৌজন্যতাবশত জিজ্ঞেস করে অর্জুন।


-" বাবার কথা আর বলো না! এখন একটু ভালো আছে। তাও পুরোপুরি ঠিক হয়নি। মাঝেসাঝেই ভুলভাল বকছে। যখন তখন ঘর খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে। কি যে করি!"- কাকলিদির বাবা মানসিকভাবে অসুস্থ। সম্ভবত ওদের বংশগত কোনো রোগ। মাঝে মাঝে ভুলভাল বলেন, কখনও ফিট লেগে পড়ে যান...রাত ঘুমের মধ্যে উঠে বাড়ি থেকে বেরিয়েও চলে যান।


-" ও! আর কি বলি বলোতো! দেখে রাখো কাকুকে!"- একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্জুন। তারপর নিজের ঘরের দিকে এগোতে যাবে তখনই আবার কাকলিদি পিছনে ডাকল, " কাল রাতে একটা কান্ড হয়েছিল বুঝলে। রাত তখন কত হবে দুটো আড়াইটে! বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিল!"


-" আবার?"- অর্জুনের চোখে মুখে ছদ্ম বিস্ময়।


-" হ্যাঁ। অন্যদিন তো নীচে নেমে যায়। সিকিউরিটি দাদা আটকায়। কাল দেখি ঠিক এইখানটা তোমাদের ঘরের সামনেটা এসে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে।"


-" তারপর?"


-" আমি আর ভাই উঠে এসেছি ঘুমের মধ্যে। বাবাকে ওপরে নিয়ে যাব। ও মা হঠাৎ তোমার ঘরের দরজার দিকে হাত দেখিয়ে বলে, " ওখানে ওই বাচ্চাটা কে দাঁড়িয়ে আছে রে কাকলি? ওকে ভিতরে ঢুকতে দেয়নি কেন? ও তো ভিতরে ঢুকতে চাইছে!" কিন্তু আমি আর ভাই তক্ষুনি টর্চ মেরে দেখলাম। উহু তোমাদের ঘরের সামনে কেউ নেই! কি বলব অর্জুন রাত বিরেতে ওই অন্ধকারের মধ্যে বাবার কথা শুনে আমি আর ভাই দুজনেই খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। বাবাকে ধরে সঙ্গে সঙ্গে ওপরে নিয়ে গেলাম। আজ সকালে মনে পড়তে দুজনেই হাসছি...বাবা একেকসময় এমন ভয় পাইয়ে দেয় না..."


-" বাবা তোমার ফোন বাজছে!"- হঠাৎই তুলির কণ্ঠে যেন সম্বিৎ ফিরে পায় অর্জুন। সকালের কথাটা ভাবতে ভাবতে ডুবেই গেছিল প্রায়। সকালে কাকলিদির কথাটা তখন এমনিই হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন কে জানে কেন অর্জুনের বুকের ভিতর একটা দমবন্ধ করা অস্বস্তি ক্রমশ কাঁকড়া বিছের মত কামড় করছে। সবকিছু তাহলে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত! কি যেন বলেছিল ওই পাগলা লোকটা...সংকেত! সমস্ত কিছু ঘটার আগে ভগবান সত্যিই সংকেত দেয়?


-" বাবা তোমার ফোন বাজছে! ও বাবা!"- তুলির ধাক্কায় এবার যেন জ্ঞান ফেরে অর্জুনের। সত্যিই ওর চোখের সামনে ফোনটা বাজছে অথচ ও ধরছেই না। ফোনটা হাতে তুলে নেয় অর্জুন। আননোন নম্বর! কে হতে পারে? ডাক্তার বাবু? ফোনটা রিসিভ করে অর্জুন,


-" হ্যালো কে বলছেন?"


কি অদ্ভুত! ফোনের ওপারে কোনো প্রত্যুত্তর নেই। শুধু একটা বোবা নীরবতা।


-" হ্যালো কে বলছেন? হ্যালো শুনতে পাচ্ছেন?"


উহু এবারও কোনো সাড়া নেই।


-" কি অদ্ভুত তো! ফোন করে চুপ করে আছে। যত্তসব!"- ফোনটা কেটে দিতে যাবে তখনই ফোনের ওপারে আওয়াজ শোনা গেল। একটা মিহি সুরেলা কন্ঠ ভেসে আসছে ফোনের ওপার থেকে। অদ্ভুত তো? কেউ গান গাইছে কী? নাকি মিউজিক প্লেয়ার চলছে? আরেকটু মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করল অর্জুন। পরমুহূর্তেই একটা অদ্ভুত বিস্ময়ে ক্রমশ যেন গ্রাস করল ওকে। ও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ফোনের ওপারে কোনো মানুষ কথা বলছে না। বরং তার বদলে সজোরে একটা গান বাজছে। একটা রবীন্দ্রসংগীত। খুব চেনা কোনো এক নারীকণ্ঠে...


-" যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায়

   নব প্রেমজালে

যদি থাকি কাছাকাছি,

দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি...

 তবু মনে রেখোওওও আমায়!"


****

-" বাবা! ও বাবা আমার সঙ্গে একটু টয়লেটে যাবে!"- অর্জুনকে ঘুমের মধ্যেই ধাক্কা দেয় ছোট্ট তুলি। বেচারির মাঝরাতে আচমকা খুব টয়লেট পেয়েছে। এমনিতে তার অত ভয় করে না, কিন্তু আজ মাকে দেখার পর থেকেই ওর কেন জানি না খুব ভয় করছে। ছোটবেলার অনেক স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে না চাইতেও...


-" বাবা! ও বাবা নিয়ে চলো না টয়লেটে...খুব জোরে পেয়েছে!"- অর্জুনকে জোরে জোরে ঠেলা দেয় তুলি। কিন্তু অর্জুনের কি আর হুশ আছে! আজ সকাল থেকে একের পর এক যা চলছে। বাড়িতে এসেও এত কাজ। সব নিজের হাতে পরিষ্কার করা, রাতের খাবার বানানো, তন্দ্রাকে খাওয়ানো, বাসন মাজা... ফলস্বরূপ এই মুহূর্তে অর্জুন আর এই দুনিয়ায় নেই। এমনই গভীর ঘুমে ও আচ্ছন্ন যে ভূমিকম্প হয়ে গেলেও টের পাবে না!


এদিকে তুলির যে খুব জোরে টয়লেট পেয়ে গেছে। মাকে জাগাবে? উহু মায়ের শরীর তো এমনিই ভালো নেই। থাক বরং নিজেই যাক আজ একা একা। কন্যে তো বলেই তুলি এখন বড় হয়ে গেছে। ও সবই একা একা করতে পারবে। আর তাছাড়াও কন্যে সবসময় বলে মনে সাহস রাখতে। অকারণ ভয় না পেতে। সুতরাং তুলি নিজেই যেতে পারবে টয়লেট। ভয়-টয় পেয়ে লাভ নেই!


খাট থেকে নেমে পড়ে তুলি। ড্রয়িং রুমে লাল আলোয় কেমন যেন গা ছমছমে পরিবেশ। আজ প্রচন্ড ঠান্ডা। সারাদিন এক নাগাড়ে বৃষ্টি হওয়ার ফল। এখনও হাওয়া দিচ্ছে। কিচেনের ভাঙা জানলাটা দিয়ে সেই ঠান্ডা হাওয়া ঘরে ঢুকে যেন আঁচড় কেটে গেল তুলির গায়ে। 


-" উহুহুহু!"- ঠান্ডায় একবার শিউরে উঠল তুলি। তারপর সোজা এসে দাঁড়াল টয়লেটের সামনে। দরজা খুলতে যাবে তার আগেই চমকে উঠল ও! তুলি দরজাটা খোলার আগেই ওটা নিজের থেকেই কেমন খুলে গেল আস্তে আস্তে! বাবা কি দরজাটায় ছিটকিনি দেয়নি? হতে পারে। ঐজন্যই বোধহয় হাওয়ায় খুলে গেল! এই বলেই নিজের মনকে খানিকটা সান্ত্বনা দিল তুলি। তারপর লাইট জ্বালিয়ে ঢুকে গেল ভিতরে। 


এমনিতে তুলি রাতে বাথরুম গেলে ভয়ে দরজা লক করে না। কিন্তু আজকে তুলি বাথরুমের ভিতরে সবে ঢুকেছে এমন সময়ই আচমকা দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল নিজে থেকেই। ঘটনাটা এত তাড়াতাড়ি ঘটল যে এক মুহূর্ত পিছনে ফিরে বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল তুলি। তারপরের মুহূর্তেই যা ঘটল তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না ও! বাথরুমের লাইটটা! আচমকাই দুম করে নিভে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে পুরো বাথরুম ডুবে গেল অন্ধকারে! প্রচন্ড ভয়ে তুলি চিৎকার করতে যাবে তার আগেই আবার লাইটটা জ্বলে উঠল।


অন-অফ। অন-অফ। একবার লাইটটা জ্বলছে একবার নিভছে। কি হচ্ছে এখানে! তুলির সারা শরীর এইবার প্রচন্ড ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। গুটি গুটি পায়ে ও কিছুটা পিছু এগোতেই আচমকাই মাথার ওপর শাওয়ারটা কিভাবে যেন চালু হয়ে গেল! বরফের মত কনকনে ঠান্ডা জল মাথার ওপর পড়ছে তুলির! বাথরুমের কলটাও কিভাবে যেন খুলে গেছে...সেই জলে বাথরুম ভেসে যাচ্ছে।


-" মা! বাবা!"- প্রচন্ড ভয়ে চিৎকার করে ওঠে তুলি! কিন্তু হায়! কোনো লাভ নেই! কলের একটানা জলের আওয়াজ যেন ওর সমস্ত আওয়াজ গিলে খাচ্ছে...লাইট নিভছে জ্বলছে... নিভছে জ্বলছে...ঠিক এমনি সময় একটা অদ্ভুত অস্বস্তি বুকের ভিতর অনুভব করল তুলি! কেন জানি না ওর মন বলছে ঠিক ওর মাথার পিছনে বাথরুমের দেওয়ালে কিছু একটা আছে...বড়...লম্বাটে...ছায়ার মত...জিনিসটা দেওয়ালের টিকটিকির মত আটকে থেকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তুলির দিকে...


একটা বড়সর ঢোক গেলে তুলি। শাওয়ারের জলে ভিজে গিয়ে রীতিমত ঠকঠক করে কাঁপছে ও। তারমধ্যেই কোনোমতে ধীরে ধীরে এইবার ও পিছনে চোখ ঘোরায়। আর তার পরক্ষণেই এক মুহূর্তের জন্য ও যা দেখে তাতে ওর হৃদস্পন্দন যেন বন্ধ হয়ে যায়! আর ঠিক সেই মুহূর্তেই শেষবারের মত বাথরুমের আলোটা দপ জ্বলে উঠেই আবার নিভে যায়! আবারও পুরো বাথরুম ডুবে যায় গভীর অন্ধকারে...


তারপরের মুহূর্তেই সেই অন্ধকারের বুক চিরে শুনতে পাওয়া যায় একটা বাচ্চা ছেলের ফিসফিসে কন্ঠস্বর, "আমায় ভিতরে ঢুকতে দিবি না? আমায় ভিতরে ঢুকতে দিবি না? আমায়...ভিতরে...ঢুকতে...দিবি না?"

-" তুলি! কী হয়েছে তুলি! দরজা খোলো!"- পাগলের মত বাথরুমের দরজাটা ধাক্কাতে থাকে অর্জুন। একটু আগেই তুলির প্রচন্ড চিৎকারে ওর ঘুমটা ভেঙে গেছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিছানা ছেড়ে পাগলের মত ছুটতে ছুটতে এসেছে ও বাথরুমের কাছে। কিন্তু এ কি! বাথরুম ভিতর থেকে বন্ধ এবং অন্ধকার! তুলি তো অন্ধকারে প্রচন্ড ভয় পায়। তাহলে ও একা একা এভাবে বাথরুমের ভিতর কি করছে?


-" তুলি! শুনতে পাচ্ছ? তুলি!"- অর্জুনের বুকের ভিতর প্রচন্ড জোরে কেউ যেন হাতুড়ি পিটছে। ওই তো! ভিতর থেকে শাওয়ারের জল পড়ার আওয়াজ হচ্ছে না? কলটাও খোলা...কী করছে কি তুলি ভিতরে? আরও একবার দরজাটা ধাক্কাতেই যাবে তার আগেই ওকে চমকে দিয়ে বাথরুমের দরজাটা নিজে থেকেই খুলে গেল...


-" ত...ত...তুলি!"- নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না অর্জুন! বাথরুমের মাঝখানে ঠিক শাওয়ারের নিচে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে তুলি! ওর সারা শরীর থরথর থরথর করে কাঁপছে, কিন্তু নিজের জায়গা থেকে এক চুলও নড়ছে না ও। যেন ওর পাদুটো চুম্বকের মত আটকে গেছে মেঝের সঙ্গে!


অর্জুন আর দেরি করে না! বাথরুমে ঢুকেই লাইটটা অন করে দেয় ও। তারপর এক দৌড়ে গিয়ে তুলিকে জড়িয়ে ধরে ও। কিন্তু তুলিকে ধরে সামনে ফেরাতেই অর্জুনের বুকের ভেতরটা এক মুহূর্তের জন্য যেন বরফের মত জমে যায়। তুলির মুখ অদ্ভুত ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। চোখ দৃষ্টি শূন্য। আর...জিনিসটা দেখেই ভেতর ভেতর কেঁপে ওঠে অর্জুন। তুলির গালে একটা বিশাল আঁচড়ের দাগ! সেখান দিয়ে গলগল করে বেরোনো রক্তের ধরা তুলির গাল বেয়ে চুইয়ে পড়ছে ওর জামা কাপড়ে। প্রচন্ড আতঙ্কে অর্জুন এবার কিছু বলতেই যাবে তার আগেই তুলি ওর হাতটা চেপে ধরে। তারপর ওকে চমকে দিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করে বলে ওঠে একটাই অদ্ভুত কথা, 


-" ও ভিতরে ঢুকতে চায় বাবা! ও ভিতরে ঢুকতে চায়। ও 'আমার' ভিতরে ঢুকতে চায়!"


// ১০ //


১৭ ই জুন, ২০১৭ ( ঘটনার তিন দিন আগে )


-" অ্যানাগ্রাম? সেটা কী ম্যাম?"- তুলি চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে তার স্কুলের নতুন নাচের ম্যাডামকে।


-" অ্যানাগ্রাম একটা মজার খেলা বলতে পারো!"- স্মিত হেসে উত্তর দেয় " মর্নিং সানশাইন " স্কুলের নতুন নাচের শিক্ষিকা। তার পরনে শাড়ি, কপালে টিপ। লম্বা খোলা চুল নেমে এসেছে কোমর পর্যন্ত। চোখদুটি বেশ টানা টানা মায়াময়। তুলির স্কুলে মাস কয়েক আগেই নতুন জয়েন করেছেন ইনি। নাম বিদিশা, বিদিশা সরকার।


-" কীরকম খেলাটা?"- তুলি বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে প্রশ্ন করে।


-" উমমম...খুব সহজ। ধরো আমি তোমাকে একটা ইংরেজি শব্দ বললাম। সেই শব্দটার অক্ষরগুলো ওলট পালট করে আরেকটা নতুন শব্দ বানাতে হবে।"


-" কীরকম?"


-" এই ধরো আমি বললাম "Care", এই শব্দটার মানে হল যত্ন নেওয়া। এবার এই শব্দের অক্ষরগুলোই উল্টে পাল্টে লিখলাম " Race"। এর মানে কী? প্রতিযোগিতা। একই শব্দের অক্ষরগুলো আলাদাভাবে সাজালে কেমন মানেটা পাল্টে গেল তাই না?"- তুলির দিকে তাকিয়েই আবারও স্মিত হাসে বিদিশা। মাত্র মাস কয়েক এখানে এসেছে। তারমধ্যেই প্রত্যূষা ওরফে তুলির সঙ্গে দারুন ভাব জমে গেছে তার নতুন ম্যাডামের।


-" বাঃ! হেবি সুন্দর তো খেলাটা। আরেকটা ওয়ার্ড দাও আমি ট্রাই করব।"- ব্যাগ থেকে নিজের খাতাটা বের করে বিদিশার দিকে এগিয়ে দেয় তুলি। এই কদিন ওর স্কুলের গাড়ি বেশ দেরি করে আসছে। ফলে স্কুল ছুটি হলেই বিদিশার কাছে চলে আসে তুলি। নতুন এই ম্যাডামের সঙ্গে গল্প করতে খুব ভালো লাগে তুলির।


-" বেশ আরেকটা ওয়ার্ড দিচ্ছি। চেষ্টা করো।"- এইবার তুলির খাতাটা কোলে নিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে তাতে বিদিশা শব্দটা লেখে, " Earth "


শব্দটা দেখে যথারীতি পেন মুখে দিয়ে তুলি ভাবতে বসে যায়। উমমম... কি হতে পারে! কি হতে পারে! তুলি একমনে ভাবছে এমনি সময়ই বিদিশার ফোনটা বেজে ওঠে, " তুঝে ইয়াদ না মেরি আই কিসি সে আব ক্যায়া কহে না..."


ফোনটা রিসিভ করে বিদিশা। পরের মুহূর্তেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে একটি বয়স্ক পুরুষ কন্ঠ, " ম্যাডাম আপনার এডপশনের পেপার্স রেডি হয়ে গিয়েছে...আপনি কবে আসতে পারবেন?"


-" আমি আজকেই যাবো। আমি আর লেট করতে চাইছি না।"- তুলির খাতায় চোখ বোলাতে বোলাতেই উত্তর দেয় বিদিশা।


-" ওকে ম্যাডাম। আপনি এবং আপনার হাজবেন্ড দুজনে একসঙ্গে আসলেই ভালো হয়..." - ফোনের ওপার থেকে ভেসে কথাগুলো যেন সূচালো কাঁটার মত গেঁথে যায় বিদিশার কানের নরম পর্দায়। চোয়াল শক্ত করে সে উত্তর দেয়, " আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন আপনাকে আমি আগের দিন কী কী বলেছিলাম..."


- " না ম্যাম সবই মনে আছে। আসলে একা একজন মহিলা বাচ্চা এডপ্ট করতে এলে অথরিটি নানান প্রশ্ন করে..."


-" শাট আপ!"- রাগে কাঁপতে কাঁপতেই এবার নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় বিদিশা। তুলি খাতার লেখা ভুলে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকায়। তুলির সেই বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতেই লজ্জা পেয়ে খুব সম্ভবত বিদিশা নিজের মুখের অভিব্যক্তি বদলে ফেলে। তারপর গলা নামিয়ে হাসতে হাসতেই বলে, " সাদা খামটার কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। বেশ ভারী ছিল ওটা। তাই না?"


ওপাশে বয়স্ক পুরুষ কণ্ঠটি এবার ইতস্তত করতে থাকে। 


-" কাজটা হয়ে গেলে ওরকম আরেকটা খাম আপনার বাড়িতে পৌঁছে যাবে। চিন্তা নেই। বেশ ভারী হবে ওটাও।"


-" আপনার কাজ হয়ে যাবে ম্যাডাম। কোনো চিন্তা নেই। আমি দেখে নিচ্ছি সবটা। আপনি চলে আসুন।"- ওপাশ থেকে ভেসে আসা পুরুষ কণ্ঠটির কথায় এবার যেন হাসি ফুটে ওঠে বিদিশার চোখে মুখে। 


অতি সংক্ষেপে সে উত্তর দেয়, " বেশ "। পরক্ষণেই ফোনটা কেটে বসে পড়ে চেয়ারে।


-" কী হল? বানাতে পারলে আরেকটা ওয়ার্ড?"


-" না ম্যাম পারিনি!"- দুইদিকে ঘাড় নাড়ায় ছোট্ট তুলি।


- " এ বাবা! এটা কিন্তু খুব সহজ। এই দেখো Earth এর এইচটাকে সামনে আনলেই তো হয়ে গেল Heart । হার্ট মানে হৃদয়।"- স্মিত হাসে বিদিশা। তারপর বলে, " তোমার বাড়ির সবাই কেমন আছে তুলি?"


-" সব্বাই ভালো আছে। কন্যে,বাবা, মা সব্বাই। শুধু মায়ের পেটটা ভুলে যাচ্ছে। বাবা বলেছে ওটার মধ্যে আমার ভাই বা বোন আছে জানো।"


-" ও বাবা তাই নাকি! তুলি তাহলে এবার দিদি হয়ে যাবে।"- কথা বলতে বলতে এক মুহূর্ত যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে বিদিশা। পরক্ষণেই ফের জিজ্ঞেস করে, " আছা তোমরা তোমার মায়ের যত্ন নিচ্ছ তো? তুমি...তোমার বাবা..."


-" হু নিচ্ছি তো! বাবা তো সবসময় মাকে দেখে দেখে রাখে। কোনো কাজ করতে দেয় না। রাতের বেলা জানো মাকে ধরে ধরে বাথরুমেও নিয়ে যায়...ও মা ম্যাম তুমি পাতায় ওরকম হিজিবিজি কাটছ কেন?"- তুলির কথায় চমকে ওঠে বিদিশা। সত্যিই তো খেয়ালই করেনি ও। তুলির কথাগুলো শুনতে শুনতেই কখন যে খাতায় হিজিবিজি কাটতে শুরু করেছে। এত  চাপ দিয়ে পেনটা ঘষছিল, পাতাটা ফুটোই হয়ে গেছে। 


-" ম্যাম। তোমার ফোনের রিং টোনটা খুব সুন্দর। ওই গানটার মানে কী?"- তুলের প্রশ্নে বিদিশা আবার যেন খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। তারপর একসময় নিজের মনেই বলে, " ধরো তুমি কারুর জন্য খুব অপেক্ষা করে আছো। কিন্তু সে আসছেই না। তবু তুমি অপেক্ষা করেই যাচ্ছ। তোমার স্থির বিশ্বাস সে একসময় না একসময় তোমার কাছে আসবেই। কিন্তু একদিন অপেক্ষা করতে করতেই তুমি হঠাৎ জানতে পারলে যে যার জন্য তুমি অপেক্ষা করছিলে তার আর তোমার কথা মনেই নেই। সে তোমায় ভুলে গিয়ে দিব্যি নিজের জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তখন তুমি তোমার মনের কষ্টটাকে গানের সুরের মধ্যে দিয়ে তার কাছে প্রকাশ করছ, মনে মনে তাকে বলছ যে তোমারই যখন আমার কথা মনে পড়ল না তখন আমি কাকেই বা আর দোষ দেব..." 


কথাগুলো বলতে বলতেই বিদিশা কোথায় যেন একটা হারিয়ে গেছিল। বাইরে গাড়ির একটানা হর্নের আওয়াজে আবার যেন হুশ ফিরল ওর। পরক্ষণেই তুলির গাল টিপে দিয়ে বলল, " কিছু বুঝলে পাকা বুড়ি?"


-" হু! "- তুলি ঘাড় নাড়াল, " আমার বাবা যখন অফিস থেকে অনেক লেটে বাড়ি ফেরে। আমি আর মা ওয়েট করি। তখন বাবাকে এই গানটা শোনানো উচিৎ!"


বিদিশার মুখে একটা অপ্রস্তুত হাসি ছড়িয়ে পড়ল এবার। 


-" তুলি তোমার গাড়ি চলে এসেছে বোধহয়। ওই যে হর্ন দিচ্ছে। যাও এবার।"


-" হু যাবো। তার আগে একটা রিকুয়েস্ট আছে।"


-" কী রিকুয়েস্ট?" - বিদিশা অবাক হয়।


-" আমি একটা ওয়ার্ড দেব। ওটার অ্যানাগ্রাম বানিয়ে দিতে হবে। দেবে ম্যাম?"


-" আচ্ছা বেশ দাও।"


তুলি এবার খাতাটা নিয়ে কি একটা লেখে। তারপর সেটা এগিয়ে দেয় বিদিশার দিকে। খাতাটা হাতে নিয়ে বিদিশা অবাক হয়ে দেখে তাতে আঁকা বাঁকা হাতের অক্ষরে লেখা আছে একটাই শব্দ, " ARJUN "।


// ১১ //


২৯ এ জুন, ২০১৭


-" তন্দ্রার আল্ট্রাসোনোগ্রাফির রেজাল্টটা খুবই অদ্ভুত অর্জুন । এরকম স্ট্রেঞ্জ কেস এর আগে আমি কখনও দেখিনি।"- ডাক্তার গোস্বামীর চোখে মুখে চাপা অস্বস্তি।


-" কী হয়েছে ডাক্তারবাবু! আমার কাছে প্লিজ কিছু লুকোবেন না। বেচারি এই কদিন কি অসম্ভব যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তা শুধু আমি জানি।"- কথাগুলো বলতে বলতেই অর্জুনের বুকের ভেতরটা যেন শুকিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কদিন ধরে কি যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে ওর পরিবারের ওপর দিয়ে শুধু ওই জানে।


-" না লুকানোর কোনো ব্যাপার নেই অর্জুন। তুমি বাচ্চার বাবা। তোমাকে তো জানতেই হবে।"- বাচ্চার কথাটা শোনামাত্রই বুকের ভেতরটা যেন ধড়ফড় করে ওঠে অর্জুনের। 


-" বেবি! বেবির কী হয়েছে ডাক্তার! বেবি ঠিক আছে তো?"


ডাক্তারের মুখে এবার যেন আষাঢ়ের মেঘ ঘনিয়ে আসে। তিনি অর্জুনের দিকে টেস্টের রিপোর্টগুলো এগিয়ে দিতে দিতেই বলেন, " ভেরি স্ট্রেঞ্জ কেস! ভেরি ভেরি স্ট্রেঞ্জ...জানি না এটা কিভাবে হচ্ছে। বাট বাচ্চার গলার চারিদিকে আম্বিলিকাল কর্ডটা ক্রমশ সাপের মত পেঁচিয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে জন্মের আগে গর্ভের মধ্যেই বাচ্চাটা হয়তো শেষ হয়ে যাবে..."


-" নাআআআ!"- বাড়িতে সোফায় বসেই নিজের মাথাটা চেপে ধরে অর্জুন। সকালে ডাক্তারের চেম্বারে শোনা কথাগুলো যতবার মনে পড়ছে ওর, ততবার ওর মাথাটা যেন প্রচন্ড যন্ত্রনায় ছিড়ে যাচ্ছে। কী হচ্ছে এসব ওর সঙ্গে! বিগত এক সপ্তাহ ধরে যা যা চলছে সেসবকিছু কি আদৌ স্বাভাবিক! 


  সেইদিনের পর থেকেই তন্দ্রা কেমন যেন একটা হয়ে গিয়েছে। ঠিক করে খায় না, কথা বলে না। মাঝেমধ্যেই ঘরের মধ্যে অদৃশ্য কাকে একটা দেখে যেন চমকে চমকে ওঠে। মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যায়। যখন জ্ঞান ফেরে পাগলের মত পেট ধরে ছটফট করতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে, " আআআআ...অর্জুন... আমার বাচ্ছাটাকে ও শেষ করে দেবে অর্জুন! আমার বাচ্ছাটাকে ও শেষ করে দেবে!"


   এই কদিনে তুলিও যেন আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। সেই রাতের পর থেকে সবসময়ই কেমন যেন থম মেরে থাকে। কথা নেই বার্তা নেই, মাথার ওপর দেওয়ালের দিকে এক নাগাড়ে চেয়ে থাকে। কি দেখে কে জানে! খাতার মধ্যে খালি হাবিজাবি আঁকিবুকি করে। তার মধ্যে আবার মায়ের এই অবস্থা! অর্জুন যে কোন দিকে যাবে! গায়িত্রী দেবীর ঘটনাটাও যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই অর্জুনের মাথায় এসে পড়েছে। 


  দিন তিনেক আগের ঘটনা। এমনিতেই তখন তুলি আর তন্দ্রাকে নিয়ে পাগল হয়ে আছে অর্জুন। হঠাৎই সকালবেলা গায়িত্রী দেবীর ফোন। পাছে মা দুশ্চিন্তা করে, সেইকারণে অর্জুন মাকে ফোনে বিশেষ কিছু একটা খুলে বলেনি।  শুধু বলেছিল তন্দ্রার শরীরটা একটু খারাপ, তাড়াতাড়ি চলে আসতে। গায়িত্রী দেবীও আর দু তিনদিনের মধ্যেই ফেরার তোড়জোড় করছিলেন। তারমধ্যেই সেদিন সকালে হঠাৎ ওনার ফোন।


-" অর্জুন! আমি আজই ফিরব। আমার মন একদম সায় দিচ্ছে না রে এখানে থাকতে। কাল এত বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছি। আমার মনটা খুব কু ডাকছে..."


-" কেন কী দেখলে আবার?"- কৌতূহল বশেই জিজ্ঞেস করে অর্জুন।


-" আর বলিস না। তখন বোধহয় মাঝরাত। অথচ স্বপ্নের মধ্যে দেখছি ভোর হয়ে গেছে। জানলা দিয়ে ভোরের আলো ঘরে ঢুকছে। এর মধ্যেই হঠাৎ শুনি একটা বাচ্চা কাঁদছে। কেমন বুকটা ধক করে উঠল। এত সকালে কে কাঁদে? বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে বেরোতেই খেয়াল করলাম কান্নাটা ভেসে আসছে ঠাকুর ঘরের দিকে থেকে। ঠাকুর ঘরে যেতেই আমি অবাক! দেখলাম সিংহাসনে রাখা আমার গোপাল ঠাকুর কাঁদছে। আমি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, " কী হয়েছে গোপাল কাঁদো কেন!"  সে কাঁদতে কাঁদতেই উত্তর দিল, " আমায় বাড়ি নিয়ে চল। ওখানে বড় বিপদ। আমায় বাড়ি নিয়ে চল!" আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই ঘুমটা ভেঙে গেল জানিস।"


  ঠাকুর দেবতায় অর্জুনের বিশ্বাস নেই। কিন্তু কে জানে কেন সেদিন মায়ের কথা শুনে আচমকাই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল ওর। সঙ্গে সঙ্গেই মাকে ফোনে বলেছিল, " বেশ ফিরে এসো। আমি ওলা বুক করে দেব। একেবারে স্টেশন থেকে বাড়ি চলে আসবে।"


   তখনও অর্জুন অবশ্য জানে না কি ভয়ঙ্কর বিপদ অপেক্ষা করে আছে পর জন্য! মায়ের ফোন এল বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। স্টেশনে চলে এসেছে। এবার ওলা বুক করে দিতে হবে। অর্জুন বুক করেও দিল গাড়ি। এর ঠিক আধঘন্টার মাথায় এল ফোনটা। মায়ের ফোন নম্বর দেখে ফোনটা রিসিভ করলেও উল্টো পিঠ থেকে ভেসে এল একটা অচেনা পুরুষ কন্ঠ। তার কথা শুনে পায়ের তলায় মাটি যেন কেঁপে উঠল অর্জুনের। এক্সিডেন্ট! ভয়ঙ্কর একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে গায়িত্রী দেবীর। দুটো ওলা মুখোমুখি সংঘাত। ড্রাইভার স্পট ডেড। গায়িত্রী দেবী তখনও জীবিত। কিন্তু অবস্থা ভীষন ক্রিটিক্যাল। 


  ওঃ! সেই রাতটা যে কী কেটেছে তা শুধু অর্জুন জানে। তাও ভাগ্যিস কাকলিদি এসে পরপর দুদিন ছিলেন তন্দ্রা আর তুলির সঙ্গে। নইলে একদিকে মা আরেকদিকে তন্দ্রা এসব একার হাতে করত কি করে সামলাত অর্জুন! গায়িত্রী দেবী এখনও  ঠিক হননি। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন প্রতি মুহূর্ত। রোজই দুবেলা করে দেখে আসে অর্জুন। যতবার দেখে বুকের ভেতরটা যেন প্রচন্ড যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যায় ওর। এসব কী হচ্ছে ওর সঙ্গে! কোন পাপের ফল ভোগ করছে ও! 


-" ভগবানের পথে সবাইকেই কখনও না কখনও আসতে হয় বাবা! কেউ আগে আসে কেউ পরে..."- সেদিন সেই পাগলের বলা কথাটা বারংবার আজ যেন কানে বাজছে অর্জুনের। তাহলে ওর জীবনে ঘটে চলা প্রত্যেকটা দুর্ঘটনার সঙ্গে আদতে কোনো অতিলৌকিক যোগ আছে? এসব কি এমনিই ঘটছে নাকি কেউ ঘটাচ্ছে? কী যেন বলেছিল লোকটা। ভগবান সবাইকেই সংকেত দেন। যে দেখতে চায় তাকেও, যে দেখতে চায় না তাকেও...


 -" বাবা!"- তুলির কথায় আচমকা চমকেই ওঠে অর্জুন। এই কদিনেই মেয়েটা কেমন শুকিয়ে গেছে। 

আগের মত সেই প্রাণোচ্ছলতা যেন হারিয়ে গেছে। আজ থেকে দেড় বছর আগে যখন তন্দ্রার সঙ্গে আলাপ হল, তখনও তুলি এরকমই ছিল। নির্জীব, প্রাণহীন ভেতর ভেতর কুঁকড়ে যাওয়া একটা ছোট্ট বাচ্ছা। তন্দ্রার প্রাক্তন স্বামী দিনের পর দিন ওর আর ওর মায়ের ওপর যে অকথ্য অত্যাচার করে গেছে তাতে এমনটা হওয়ারই কথা অবশ্য...


-" কী হয়েছে তুলি? কিছু বলবে?"- তুলির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে অর্জুনের চোখে জল চলে আসে।


-" হু!"- তুলির হাতে একটা খাতা ধরা। " তোমায় দেখানো হয়নি। আমার স্কুলের নাচের ম্যাডাম আমায় একটা নতুন খেলা শিখিয়েছিল। অ্যানাগ্রাম। তুমি জানো খেলাটা কী?"


-" হু জানি তো সোনা!"


-" ম্যাম তোমার নামেরও একটা অ্যানাগ্রাম বানিয়ে দিয়েছে। দেখবে?"


-" হু দেখাও!"


তুলি এইবার খাতাটা বাড়িয়ে দেয় অর্জুনের দিকে। অর্জুন হাসতে হাসতে হাতে নেয় বটে কিন্তু সেটার দিকে তাকাতেই কে জানে কেন মুহূর্তের মধ্যে যেন তার মুখটা বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তার হাত থরথর করে কাঁপতে থাকে। সে দেখে তুলির খাতায় তার নামের পাশে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে তার অ্যানাগ্রাম! 


" ARJUN,  RANJU "


// ১২ //


৩০ শে জুন, ২০১৭


দুপুর প্রায় পড়ে এসেছে। উত্তর কলকাতার গলিগুলো এইসময় এখানকার মানুষদের মতই খানিক অলস দিবানিদ্রায় মগ্ন থাকে। চুন সুরকি খসা সুপ্রাচীন বাড়িগুলোর গায়ে দুপুরের মিঠে রোদ এই সময়  আলপনা আঁকে। এই ভর দুপুরে এইসব গলির মধ্যে এসে দাঁড়ালে আচমকা মনে হয় হাল আমলের ধোপদুরস্ত কলকাতার খোলসের মধ্যে এখনও সেই পুরোনোকালের " কলিকাতা "   নিভু নিভু লণ্ঠনের শিখার ন্যায় ধিকধিক করে কোনোমতে জ্বলছে আর তার ম্রিয়মান আলোয় রাঙা হয়ে উঠছে এই শশব্যস্ত শহরের তপ্ত দুপুরগুলো।


-" উমমম...স্টার থিয়েটারের পাশেই কোনো একটা গলির কথা লেখা ছিল তো কার্ডটায়...কোন গলি কোন গলি কোন গলি! উফ কিছুতেই মনে পড়ছে!" - স্টার থিয়েটারের কাছেই একটা গলিতে ঢুকে এদিক ওদিক চাইছিল অর্জুন। আজ পাগলের মত যাকে খুঁজতে খুঁজতে এইখানে সে এসেছে সপ্তাহখানেক আগেই তাকেই এক স্টেশন লোকের সামনে ভর্ৎসনা করে ফিরিয়ে দিয়েছিল সে। নিয়তির কী অদ্ভুত খেলা! আত্মদম্ভের বশে আমরা একসময় যাকে ফিরিয়ে দিই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে আবার তার স্মরণ নেওয়াই অপরিহার্য হয়ে ওঠে। মানুষ এবং ঈশ্বর দুজনের ক্ষেত্রেই কথাটা বোধহয় খাটে।


  -" আমাকে খুঁজছেন বুঝি!"- হঠাৎ একটা ভরাট পুরুষ কণ্ঠে চমকে উঠল অর্জুন। পিছনে ফিরতেই তার মুখে ফুটে উঠল একরাশ আশার আলো। সেই বছর ছাব্বিশের সুদর্শন ছেলেটিই। পরণে আজও ঢোলা পাঞ্জাবি আর জিন্স। চোখে মুখে প্রাজ্ঞ মনীষার দীপ্তিচ্ছটা।


- " না মানে..."- হঠাৎ ছেলেটির প্রশ্নে কেমন যেন থতমত খেয়ে যায় অর্জুন। 


-" ও খুঁজছেন না আমায় বেশ..."- ছেলেটি এগিয়ে যেতে যাবেই তার আগেই অর্জুন তার হাতটা চেপে ধরে, " আমি তোমার সন্ধানেই এসেছি ভাই! আমায় ফিরিয়ে দিও না প্লিজ। সেদিন আমি বুঝতে পারিনি কিন্তু..."


-" বুঝতে পারেননি! কেন দিব্যি বুঝলেন যে। আমি ফ্রড, জোচ্চোর, চিটিংবাজ। ঠিকই বুঝেছেন সবই আমার আগে থেকে ফিট করা..."- ছেলেটির চোখে মুখে কৌতুক।


-" আমায় মাফ করে দাও ভাই! আমি বুঝতে পারিনি। আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি। বড় বিপদে পড়ে তোমার কাছে এসেছি। আমাকে ফিরিয়ে দিও না প্লিজ। কি যেন নাম তোমার! হ্যাঁ হ্যাঁ কেদার। না না অনন্তদৃষ্টি!"


অর্জুনের কথায় ছেলেটির মুখে এবার হাসি ফুটে ওঠে। পরক্ষণেই সে বলে, " দুটোই আমার নাম। যাইহোক আমার সঙ্গে আসুন। সামনেই আমার বাড়ি। ভিতরে বসে কথা। আর আমার হাতটা ছাড়ুন। এমন শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছেন রাস্তার লোকে দেখলে অন্য কিছু ভাববে!"

 

কেদারের কথায় চমকে উঠে অর্জুন বিদ্যূতের শক খাওয়ার মত লাফিয়ে উথে তখনই হাতটা ছেড়ে দেয়। তারপর কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে বলে, " ইয়ে মানে হ্যাঁ চলুন।"


*****


গলিটা পুরোনো হলে কি হবে কেদার চ্যাটার্জির বাড়িটা কিন্তু বেশ নতুন। বাড়িটার গঠন দেখলেই বোঝা যায় পুরোনো অট্টালিকা নতুন করে খোল নোলচে বদলে এটি হাল আমলেই নির্মাণ করা হয়েছে। সামনের ফটক দিয়ে ঢুকতেই একটি লম্বা বারান্দা। তারপর বসার ঘর। সেখানে ঢুকতেই একরকম অবাক হয়ে গেল অর্জুন। 


  বিভিন্ন পুরোনো আমলের কাঠের আসবাবপত্র দিয়ে বসার ঘরটি সুন্দরভাবে পরিপাটি সাজানো। দেওয়ালে বিভিন্ন শিল্পীদের তৈলচিত্র। ডানদিকের বড় দেওয়ালটিতে কাঁচের ফ্রেমে বাঁধানো একটি সুবিশাল ছবি ঝুলছে। ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে অর্জুন ভালো করে দেখতে লাগল অর্জুন। এক মধ্যবয়স্কা মহিলা একটি কাঠের চেয়ারে বসে আছেন। তার কোলে বছর ছয়েকের একটি শিশু। ইনি যে কোনো সাধারণ মহিলা নয় তা এনার মুখ দেখলেই বোঝা যায়। অসামান্য ব্যক্তিত্ব ও তেজোদীপ্তির প্রকাশ এনার মুখশ্রীতে। বাচ্চাটি শান্ত, স্থির কিন্তু চোখদুটি অসম্ভব উজ্জ্বল। যে জিনিসটা অর্জুনের সবচেয়ে নজর কাড়ছে তা হল মহিলাটির গলায় পরে থাকা একটি লকেট। ভারী অদ্ভুত লকেটটা। একটা গোলাকার রিং তার মধ্যে একটা চোখ। 


- " ইনি আমার গুরুমা। আর ওনার কোলে আমি। আমার অনন্তদৃষ্টি নামটিও ওনারই দেওয়া।"- অর্জুনের পাশে এসে দাঁড়াল কেদার, " আমার যতটুকু যা সামান্য ক্ষমতা সেও ওনারই দান।"


-" ওনার নাম কী?"- বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে অর্জুন। 


-" বলবো তবে পরে। আপাতত ওনার পরিচয় জানার থেকেও আরেকজনের পরিচয় জানা অনেক বেশি জরুরি।"- কেদারের কথায় বিস্মিত দৃস্টিতে তার দিকে তাকায় অর্জুন। 


তারপর তাকে অনুসরণ করে এসে বসে কাঠের চেয়ারে। কেদারও বসে উল্টো দিকের চেয়ারে। মাঝে একটি কাঠের ছোট টেবিল। তার উপরেই এবার ছবিটা বের কপ্রে রাখে কেডার।


-" চিনতে পারছেন?" 


ছবিটার দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে অর্জুন। 


-" হ্যাঁ এ তো সেই বাচ্চা ছেলেটা। সেদিন মেট্রোয় আমায় যে ফলো করছিল।"


-" হুম ঠিক।"- কেদার ঘাড় নাড়ায়। তারপর আরও কয়েকটি ছবি টেবিলে রাখে। বাচ্চাটিরই ছবি। আরও অনেকগুলো বাচ্চার সঙ্গে। পিছনে একটা বড় বাড়ি। সব বাচ্চার পোশাক এক রকমের। একটা ছবিতে বিল্ডিং এর নামটা স্পষ্ট পড়া যায়। গীতবিতান অনাথাশ্রম।


-" অনাথ আশ্রম?"- অর্জুন বিস্মিত দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করে।


-" আজ্ঞে! ছেলেটির মোহন। মোহন দাস। বয়স দশ বছর তিন মাস সাত দিন। বছর দুই আগে বাবা মার সঙ্গে পাহাড়ে ঘুরতে গেছিল। সেখানে একটা এক্সিডেন্টে বাবা মা দুজনেই মারা যায়। সেরকম কোনো আত্মীয় স্বজন নেই ছেলেটির। তাই ওর ঠাঁই হয় এই অনাথ আশ্রমে।" 


কেদারের কথা এক মন দিয়ে শুনছিল অর্জুন। এবার আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করে, " কিন্তু এই সমস্ত ঘটনার সঙ্গে এই ছেলেটির কী সম্পর্ক! ও এসব করবেই বা কেন?"


-" উহু ও করবে না। ওকে দিয়ে করানো হবে। মহাভারতের যুদ্ধে কত হাজার হাজার সৈন্য মারা গিয়েছিল বলুন তো। সবাই কি যুদ্ধ চেয়েছিল? উহু তাদের দিয়ে যুদ্ধ করানো হয়েছিল।" 


-" মানে?"- অর্জুন ক্রমশ অবাক হচ্ছে।


-" মানে এই খেলায় মোহন সামান্য একটা ঘুঁটি। আসলে পেছনে মাস্টার মাইন্ড অন্য কেউ।"- একটু থামে কেদার। তারপর চোখ বন্ধ করে ফের বলে, " সতেরোই জুন, সন্ধ্যেবেলা এক মহিলা ছেলেটিকে দত্তক নেয়। মহিলাটি একা আসেন। হাজবেন্ড ছাড়াই। ছেলেটিকে দত্তক নেন। তারপর সেখান থেকে চলে যান। এরপর আশ্চর্যজনকভাবে মহিলাটির ফোন নম্বরে ফোন করলে তাকে আর পাওয়া যায় না। বাচ্চাটিরও তারপর আর কোনো খোঁজ নেই।"


অর্জুনের মাথায় ক্রমশ জমাট বাঁধছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কেদার এইবার চোখ বন্ধ করে। তাকে দেখে মনে হয় যেন অদৃষ্ট কিছু তার চোখের সামনে ক্রমশ ভেসে উঠছে।


-" যিনি ছেলেটিকে দত্তক নেন সেই মহিলাটির বয়স তিরিশের কোটায়। লম্বা। ফর্সা। চোখদুটো টানা টানা। বা গালে একটা ছোট্ট আঁচিল আছে। মহিলাকে খুব সম্ভবত আপনি চেনেন। ওনার নাম..."


-" বিদিশা! বিদিশা সরকার!"- কেদারের কথা শেষ হওয়ার আগেই দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে অর্জুন। 


-" ইনি আপনার..."


-" প্রাক্তন স্ত্রী!" 


// ১৩ //


" আর এক সপ্তাহ! তারপরেই আসবে কালরাত্রি!"- অন্ধকার কক্ষে ম্রিয়মান মোমবাতির আলোয় বৃদ্ধার মুখ সেইভাবে বোঝা যায় না। তবুও তার চোখদুটিতে যে লেলিহান বহ্নিশিখা এই মুহূর্তে দাউ দাউ করে জ্বলছে তার স্পষ্ট আঁচ পাওয়া যায়।


-" কালরাত্রি এলে কী হবে মা?"- বিদিশার কন্ঠস্বর কাঁপা কাঁপা শোনায়। 


বৃদ্ধা এইবার খিলখিল করে মাথা দোলাতে দোলাতে হেসে ওঠেন, " এদ্দিন আমার সঙ্গে এই কাজে আছিস। তাও তোর জ্ঞান হল না ঢেমনি! কালরাত্রি এলে কী হয় জানিস না? সব জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়!"


-" অর্জুনও মারা যাবে মা?"- প্রশ্নটা করতে গিয়ে একবারের জন্য কন্ঠটা যেন কেঁপে ওঠে বিদিশার।


বৃদ্ধা এইবার উঠে দাঁড়ান। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসেন নিজের মেয়ের কাছে। প্রথমে আলতো করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। তারপর আচমকাই একসময় খপ করে তাই চুলের মুঠি চেপে ধরেন সজোরে! 


-" বুকের ভেতরে এখনও ভালোবাসা আছে নাকি ওই ছেলেটার জন্য? আছে আছে আছে?"


বৃদ্ধার চাপের মুখে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে বিদিশা। ওর কান্না যেন সমস্ত উত্তর দিয়ে দেয় ওর হয়ে। 


-" মাগীর ঢং দেখে বাঁচি না! থুহ!"- বৃদ্ধা এইবার মোমদানিটা হাতে তুলে নেন। তারপর তার চুলের গোছা মোমবাতির ওপরে ঘোরাতে ঘোরাতে সারা ঘর প্রদক্ষিণ করতে থাকেন।


-" এইটুকু ছিলিস তুই যখন তোকে অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক নিয়ে আমার কাছে আনি। আমার সোয়ামী তো কবেই মারা গেছে। সেই ছোটবেলা থেকে তোর বাবাও আমি। মাও আমি। তিলতিল নিজের বুকের রক্ত জল করে তোকে মানুষ করেছি। কী করিনি?"


বৃদ্ধার হুঙ্কারে বিদিশা কেঁপে ওঠে, " হ্যাঁ করেছ!"


-" তোকে পড়াশুনা শিখিয়েছি। স্কুলে পাঠিয়েছি। কলেজেও পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তুই আমার বিশ্বাসের কী মর্যাদা রাখলি! কলেজে গিয়ে পড়াশোনার বদলে প্রেম করলি!"


বিদিশা এখনও থর থর করে কাঁপছে। 


-" ওই ছেলে যে তোকে কোনদিনও শান্তি দেবে না, সুখ দেবে না। তোকে আমি বলিনি? কিন্তু তোর মায়ের ক্ষমতায় তুই বিশ্বাস রাখলি না। হাজার জেদ ধরে ওই ছেলেটাকেই বিয়ে করলি। আর তার ফলও হাতে নাতে পেলি। টিকল বিয়ে? থাকল তোর সঙ্গে?"


বিদিশা নিশ্চুপ। বৃদ্ধার হাতে মোমবাতির শিখাগুলিও যেন ভয়ে দপদপ করে কাঁপছে। 


-" শুধু তোর বাচ্ছা হল না বলে তোকে ছেড়ে চলে গেল। যায়নি? তারপর অন্য একটা মাগীর সঙ্গে বে থা করে তিনি এখন সুখে সংসার করছেন। আর তুই এখানে বসে বসে এখনও শোক পালন করছিস মাগী!"


বৃদ্ধার ঝাঁঝালো কন্ঠস্বর যেন তীরের মত এসে বিধল বিদিশার বুকে। বৃদ্ধা এবার বিদিশার সামনে এসে উপবেশন করলেন। তারপর নিজের চুলের গোছাটা বিদিশার মাথার চারদিকে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, " আমাদের শরীরটা একেকটা কলস মা। এই কলসেই কেউ সাপ পোষে, কেউ আবার মধু ভরে রাখে। মধু ভরে তো দেখলি। কোনো লাভ হল?"


বিদিশার চোখ তার মায়ের চোখে আটকে গেছে। তার বুক ঢিব ঢিব করছে প্রচন্ড শব্দে।


- " সাপ চাই মা। সাপ চাই। লেজে পা পড়লে সাপের মত ফোঁস করতে হয় মা। প্রয়োজনে যে লেজ পাড়াল তার শরীরে বিষ ঢেলে তার জীবনটা বিষাক্ত করে দিতেও দুবার ভাবতে নেই। এই জগতে যাদের কলসে মধু ভরা তারা বাঁচে না মা, যারা বুকের ভিতর সাপ পোষে তারাই শুধুই টিকে থাকে!"


 বিদিশার চোয়াল এবার আরও কঠিন হয়ে ওঠে। স্পষ্ট কণ্ঠেই সে এবার জিজ্ঞেস করে, " কুরকুট্টা তার কলস পেয়েছে মা!"


-" পেয়েছে পেয়েছে!"- বৃদ্ধা আবারও উন্মাদিনীর ন্যায় খিল খিল করে হেসে ওঠেন, " মহানরকের আগুন থেকে তাকে আহ্বান করে আনা হয়েছে। এই একপক্ষ কাল সে সাময়িকভাবে শুধু অবস্থান করবে ওই বাচ্চা ছেলেটির দেহকলসের মধ্যে। সেখানে থেকেই অর্জুন আর তার পরিবারের সবার জীবন নরক করে তুলবে সে। তারপর ঠিক একপক্ষকাল পর, আসবে কালরাত্রি। সেইদিন কুরকুট্টা তার আসল কলসে চালান হবে। যে কলস সে এতদিন ধরে খুঁজছে। সেখানে একবার প্রবেশ করলে সে সব্বাইকে শেষ করে দেবে। সব্বাইকে! অর্জুন ও তার পুরো পরিবার এক রাতের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যাবে। আমার মেয়েকে যন্ত্রনা দেওয়ার শাস্তি হাড়ে হাড়ে পাবে ওরা। কেউ মুক্তি পাবে না। কেউ না..."


বিদিশার বুকের ভেতরটা এখনও যেন প্রচন্ড ঢিব ঢিব করছে। এইবার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সে শুধু জিজ্ঞেস করে,

 

" কাকে সে বেছেছে কলস হিসেবে মা? কালরাত্রি এলে কার দেহে প্রবেশ করবে সে?"


// ১৪ //


বেশ অনেকক্ষণ হয়ে গেল অর্জুন ফিরছে না। এদিকে ঘন ঘন ঘড়িটা দেখছে কাকলী। আচ্ছা বিপদে পড়া গেল বটে। আজকাল মানুষের উপকারও করতে নেই। সে ছেলে বউ এর মেয়ের দায়িত্ব দিয়ে সেই দুপুরবেলায় বেরিয়েছে। বলে গেল, " কাকলীদি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। ওটা সেরে মাকে দেখেই বিকেলের মধ্যেই ফিরে আসব।"  আর এদিকে এখন সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নটা বাজতে চলল তার কোনো পাত্তা নেই।


  সত্যি বলতে এই ফ্ল্যাটে থাকতেই কেমন যেন গা ছমছম করছে কাকলীর। এর আগের কদিনও ওর এরকম অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে। তন্দ্রাও কেমন যেন অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছে যেন। ওর সঙ্গে ঠিক করে কথাও বলা যাচ্ছে না। 


আর তুলি! তাকে দেখলে তো রীতিমত ভয় করছে কাকলীর। ওইটুকু বাচ্ছা মেয়ে। কেমন রক্তজল করা দৃষ্টিতে তাকায়। দেখলেই বুকের ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে যায়। উফ কখন যে এখান থেকে বেরোবে ও। আজ আবার ভাইও নেই, বাবাও ওপরে একা আছে। কে জানে কী করছে। আবার বেরিয়ে পড়লে মুশকিল।


কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই তন্দ্রাদের সদর দরজায় হঠাৎ ধাক্কার আওয়াজ শোনা গেল। প্রথমটা শুনে ভয়ই পেয়েছিল কাকলী। পরমুহূর্তেই যেন বল ভরসা ফিরে পেল। যাক অর্জুন ফিরেছে তবে। অদ্ভুত তো! বেল না বাজিয়ে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে কেন! তৎক্ষনাৎ উঠে গিয়ে দরজাটা খোলে কাকলী। আর পরমুহূর্তেই চমকে ওঠে। ওর বাবা! দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু বাবাকে কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে! 


-" বাবা তুমি আবার নেমে এসেছ! কী হয়েছে নামলে কেন..."


-" এখানে কেন আছিস তুই! কী কাজ তোর এখানে!"- বাবার কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠল কাকলী! কী অদ্ভুত তার বাবার কন্ঠস্বর তো এমন ভারী নয়। 


-" আমি ঐ তন্দ্রা আর তুলিকে..."- কাকলী তার কথা শেষ করেনি তার আগেই বৃদ্ধ তার প্যান্টের পকেট থেকে কি একটা বের করে আনল। আর সেটা দেখামাত্রই কাকলীর বুকের ভেতরটা আতঙ্কে ঠান্ডা হয়ে গেল যেন।


 ছুরি! একটা ধারালো ছুরি হাতে ধরে আছে কাকলীর বাবা! তার চোখে মুখে ক্রমশ ফুটে উঠছে ভয়ঙ্কর হিংস্রতা। কাকলীকে চমকে দিয়েই এবার ঘরঘরে কর্কশ কণ্ঠস্বরে সে বলে উঠল, " এখান থেকে চলে যা...চলে যা! নইলে শেষ করে দেব তোকে! যা...এক্ষুনি যা...!"


-" বাবা এসব কি বলছ তুমি!"- কথাটা শেষও করতে পারেনি কাকলী তার আগেই দুম করে কারেন্ট অফ হয়ে গেল। পুরো ফ্ল্যাট ডুবে গেল গভীর অন্ধকারে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই সামনে তাকাতেই প্রচন্ড ভয়ে আবারও থরথর করে কেঁপে উঠল কাকলীর সারা শরীর। ও দেখল ওর ঠিক সামনে ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে আছে ওর বাবা। আর তার ঠিক পিছনেই জমাট বেঁধে আছে একটা লম্বাটে ঘন অন্ধকার। সেই অন্ধকারের বুকে দুটো চোখ ক্ষুধার্ত শ্বাপদের ন্যায় ধকধক করে জ্বলছে। এরপর ঠিক কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। পরের মুহূর্তেই অন্ধকার ভেদ করে শোনা গেল কাকলীর সুতীব্র আর্তনাদ, 


" আআআআ...."


// ১৫ //


সেপ্টেম্বর, ২০০৯


বিকেল প্রায় হয়েই এল। গঙ্গার ধার ঘেষে আস্তে আস্তে জন সমাগম বাড়ছে। বিকেলের দিকটায় এই বাগবাজার ঘাটের দিকে বহু মানুষ হাটতে আসেন। অনেক কলেজ পড়ুয়া কলেজ ছুটির পর বাড়ি ফেরার আগে এই ঘাটে বসে খানিকটা সময় কাটিয়ে যায়। বাদামওয়ালা  "বাদাম বাদাম" বলে হাঁক পাড়ে। "ঘটিগরম ঘটিগরম" বলে চেঁচাতে চেঁচাতে জনৈক বিক্রেতা কৌটার মধ্যে ঘটিগরম নাড়তে থাকেন। দূর থেকে ভেসে আসা অনেকগুলি তরুণী কণ্ঠের খিলখিল হাসি বিকেলটাকে আরও মনোরম করে তোলে। নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে করতেই তারা বলে, " এই টকজল টকজল...আরেকটু ঝাল দাও না কাকু!"


এই হাজারও কোলাহলের মধ্যেই ঘাটের একপ্রান্তে আজ এক তরুণ তরুণী পাশাপাশি বসে আছে। দুজনেরই পিঠে ব্যাগ। তরুণীটির মাথা তরুণটির কাঁধে রাখা। একটা ঠোঙা থেকে নিয়েই দুজনে ঘটিগরম খাচ্ছে। সামনে জাহ্নবীর বুকে বহুদূরে ভাসতে দেখা যাচ্ছে দুটি নৌকা। নৌকাদুটি বহুক্ষণ একসঙ্গে ভেসে ছিল। এইবার তারা ক্রমশ একে অপরের থেকে বিপরীত অভিমুখে দূরে ভেসে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়েই আনমনা হয়ে মেয়েটি এবার বলে উঠল, 


-" আচ্ছা রঞ্জু এই যে আজ আমরা একসঙ্গে। এই মুহূর্তটা কতটা দামী তাই না! কাল যদি না থাকি, দূরে চলে যাই..."


-" উফ আবার ওসব কথা কেন। তোমার মুখে এসব কথা শুনতে ভালো লাগে না বিদিশা..."- মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই বলে ওঠে ছেলেটা।


-" এমনিই বলছি। হতেও তো পারে এরকম। আমরা আলাদা হয়ে গেলাম কখনও। যেই মানুষগুলোর সঙ্গে আমরা ভীষণভাবে আমাদের সারাটা জীবন কাটাতে চাই তাদের সঙ্গেই কি সব সময় আমাদের জীবনটা কাটাতে পারি? সময় পরিস্থিতি কত কিছুই তো পাল্টে দেয়। আজ যাকে ছাড়া চোখে অন্ধকার দেখছি এমনও হয়তো একদিন আসতে পারে যে প্রানপণে তারই ক্ষতি চাইলাম..."


-" বিদিশা..."- অর্জুন এবার বিদিশার মুখের দিকে তাকায়। বিকেলের রোদ্দুরে রাঙা হয়ে উঠেছে ওর মুখ, ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে।


-" আচ্ছা অর্জুন। যদি কখনও আমাদের মধ্যে আর ভালোবাসা না থাকে তাহলে কি আমরা একে অপরের শত্রু হব?"- বিদিশার চোখদুটো এখনও স্থির হয়ে আছে জাহ্নবীর বুকে ভেসে যাওয়া নৌকাদুটির দিকে।


-" উহু হবো না। কেন জানো?"


-" কেন? "


-" কারণ আমি বিশ্বাস করি যাকে সত্যিকারের ভালোবাসা যায় তার কখনও ক্ষতি চাওয়া যায় না। সময় পরিস্থিতি বিশেষে হয়তো তার ওপর রাগ হতে পারে, অভিমান হতে পারে, ঘেন্নাও হতে পারে। কিন্তু ক্ষতি! উহু জেনেবুঝে তার ক্ষতি করা সম্ভব নয়! আমি তো পারবো না...."- একটু থামে অর্জুন। নৌকাদুটি গঙ্গার বুকে ভাসছে টলোমলো টলোমলো। সেদিকে চেয়েই মুচকি হেসে আবার জিজ্ঞেস করে, " তুমি পারবে বিদিশা আমার ক্ষতি করতে? "


বিদিশা এবার অভিমানী দৃষ্টিতে অর্জুনের দিকে চায়। কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না। শুধু ওর বুকের আরেকটু কাছে এসে বসে।


-" কী হলো পারবে?"- অর্জুন আবারও জিজ্ঞেস করে।


-" উহু কখনও না!"- অর্জুনের চোখে চোখ রেখেই বিদিশা এবার উত্তর দেয়, " যদি কখনও তোমার কোনো ক্ষতি করতে যাই বুঝবে তোমার বিদিশা মরে গেছে। আমার শরীরে অন্য কেউ বাস করছে!"

 

অর্জুন আর কিছু বলে না। নিঃশব্দেই বিদিশাকে এবার আরও শক্ত করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। শুধু সকলের অলক্ষ্যে বসে থাকা মহাকাল এই দৃশ্য দেখে নীরবে মুচকি হাসেন। এই জগৎপ্রপঞ্চ তো স্বয়ং মহামায়ার লীলাক্ষেত্র। এখানে কখন কি যে হয় কেউ কি বলতে পারে!


// ১৬ //


৩০ শে জুন, ২০১৭


-" এতে বিদিশার ক্ষতি হবে?"- কেদারের দিকে তাকিয়েই কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে প্রশ্ন করে অর্জুন। 


  যদিও অর্জুনের প্রশ্ন শুনে কেদার শুধু মুচকি হাসে। তারপর বলে, " হায় রে মানুষের অবুঝ মন! সব ত্যাগ করতে পারে শুধু মায়া ত্যাগ করতে পারে না।"


 অর্জুন এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ঠিক এই মুহূর্তে ওর কি বলা উচিৎ ও জানে না। সত্যিই তো বিদিশা একের পর এক ওর ক্ষতি করেছে। আজ অর্জুনের জীবন যে এরকম নরক হয়ে গিয়েছে তারজন্যও বিদিশাই দায়ী। তবুও ওর মনে হঠাৎ এমন কাঁটা বিধছে কেন? কিসের কারণে ?


-" অর্জুন বাবু আমাদের পুরাণে সাতখানা পাতালের উল্লেখ আছে জানেন নিশ্চয়ই। সেই সাতখানা পাতালের মধ্যে ভয়ঙ্কর ও ভয়াবহ পাতাল কোনটি জানেন? রসাতল!"


কেদারের মুখের দিকে এবার বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাকায় অর্জুন। কী বলতে চাইছে কেদার?


-" এই রসাতলে যে সকল ভয়ঙ্কর কুটিল অপশক্তিদের বাস তাদের মধ্যে একটি হল কুরকুট্টা। বিভিন্ন শাস্ত্রে বলে যে এরা যেইখানে থাকে সেইখানে সদা সর্বদা নরকের আগুন জ্বলে। এদের সামান্য উপস্থিতিও মানুষের জীবনে ভয়াবহ অনর্থ ডেকে আনে। এরা রক্তলোলুপ, নৃশংস এবং ক্ষমাহীন। নরকের আগুন থেকেই এদের জন্ম। এমন একটি ভয়াবহ অপশক্তি যদি একবার আপনার মেয়ের শরীরে প্রবেশ করে কী হবে বুঝতে পারছেন?"


 কেদারের কণ্ঠে কিছু একটা যেন ছিল। এক মুহূর্তের জন্য কথাটা শুনে এই ভর সন্ধেবেলাতেও সারা শরীর শিউরে উঠল অর্জুনের। পরমুহূর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠল তুলির মুখটা। তুলি, নিষ্পাপ ফুটফুটে একটা বাচ্ছা মেয়ে। এই সারা পৃথিবী হয়তো বলবে অর্জুন তুলির জন্ম দেয়নি অতএব ও ওর আসল বাবা নয়, কিন্তু তবুও অর্জুনই একমাত্র জানে যে তুলিকে ও ঠিক কতটা ভালোবাসে। কিন্তু তাই বলে...


-" একজন মানুষ যার সঙ্গে আপনার পাঁচ বছর আগে ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। এতগুলো বছরে যার সঙ্গে আপনার কোনো যোগাযোগ নেই। এমনকি যে আপনার এত বড় ক্ষতি করতে চাইছে। তার প্রতি আপনার এত দুর্বলতা?"- কেদার যেন খানিকটা কটাক্ষ করেই বলল কথাটা।


-" উহু দুর্বলতা নয়। সহমর্মিতা। কারণ আমি জানি এসব ও কিচ্ছু নিজের ইচ্ছায় করছে না। এই সব কিছুর জন্য ওর মা দায়ী। ঠিক যেমন আমাদের বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার পিছনেও ওর মায়ের হাত ছিল।"


-" কীরকম?"- কেদারের চোখে মুখে কৌতূহলের ছাপ। যদিও অর্জুন এ কথার উত্তরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর বেশ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলতে শুরু করে, 


-" একটা সুন্দর সম্পর্ক কখন ভাঙে জানেন তো? যখন দুজন মানুষের মধ্যে তৃতীয় একজন মানুষ ঢুকে যায়। এই তৃতীয় মানুষটা যে সবসময় অবৈধ প্রেমিক প্রেমিকা হবে তার কোনো মানে নেই। এই তৃতীয় ব্যক্তিটা কিন্তু খুব সাধারণ কেউও হতে পারে। যেমন বন্ধু, ভাই, বোন, পরিবারের কেউ এমনকি মা বাবাও।  আমাদের সম্পর্কে এই তৃতীয় ব্যক্তিটি ছিলেন বিদিশার মা। কৃষ্ণা সরকার।"


একটু থামে অর্জুন। ওর চোখে মুখে যেন ফেলে আসা অতীতের কালো মেঘ ক্রমশ ঘনিয়ে আসতে থাকে। ও ফের বলতে থাকে, 


" বিদিশাকে ওর মা খুব ছোটবেলায় অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক নেয়। তারপর নিজেই গড়ে পিঠে ওকে মানুষ করে। এইজন্য বিদিশার মধ্যে ওর মায়ের প্রতি একটা অদ্ভুত আনুগত্য ছিল। প্রথমটা বুঝিনি। পরে আস্তে আস্তে টের পাই। বিদিশা নিজের মাকে ভগবানের মত মানে। ঠিক ভালোবাসায় নয়, অনেকটা ভয়ে, অনেকটা কৃতজ্ঞতায়। যাইহোক আমার অবশ্য ওর মাকে কেমন একটা অদ্ভুত লেগেছিল। মহিলার কথাবার্তার ধরণ খুব অদ্ভুত। হাবভাবও রহস্যময়। বিদিশার মা যেমন আমার সঙ্গে ওর বিয়ে দিতে চায়নি, আমার মা বাবাও তেমন আপত্তি করেছিল এই বিয়েতে..."


-" কেন?"


-" কারণ বিয়ের আগে ওর মায়ের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে গিয়ে আমার এক মামা কিছু অদ্ভুত খবর পেয়েছিল। এই কৃষ্ণা দেবী নাকি গোপনে বিভিন্ন তন্ত্র, মন্ত্র, কালা জাদু এসব জিনিস করতেন। আমি যদিও এসবে বিশ্বাসই করতাম না কখনও। ফলে কথাটা উড়িয়ে দিই। বিদিশাও আমাকে ভালোবেসেই একরকম জোর করে ওর মাকেও রাজি করায় এই বিয়েতে। কিন্তু বিয়ের পরপরই আমার খটকাটা লাগে।"


-" কীরকম খটকা?"


-" বলছি। বিয়ের পরই লক্ষ্য করি বিদিশা মাঝে মাঝেই হঠাৎ হঠাৎ মায়ের কাছে চলে যেত। তারপর যেদিন গেল তার ঠিক দুতিনদিন পর ফিরত। কিন্তু যখন ফিরত তখন কখনও দেখতাম ওর হাতে আঁচড়ের দাগ, কখনও দেখতাম চুলের নীচের দিকে খানিকটা কাটা। একবার ওর ব্যাগের মধ্যে সিঁদুর মাখা একটা পুতুল টাইপের কিছুও পেয়েছিলাম। পরে বিদিশাকে চেপে ধরি। ও নরম স্বভাবের মেয়ে। আমার জেরার মুখে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। 

    

    হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতেই স্বীকার করে যে ওর মা সত্যিই এসব তন্ত্র মন্ত্র ব্ল্যাক ম্যাজিক করে। মারণ উচাটন বশীকরন আরও কিসব যেন।  লোকের থেকে টাকা নিয়ে এসব করে অন্যের ক্ষতি সাধন করাই ওর মায়ের প্রধান জীবিকা। আর এসব কাজে বিদিশা হল ওর মায়ের ডান হাত। ওকে ছাড়া নাকি ওনার কোনো উপাচার পূর্ণই হয় না।"


    আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অর্জুন। "প্রথমে এটা শুনে আমি খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। বিদিশাকে বলেছিলাম যে এসব যেন ও আর কখনও না করে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসব থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। কিন্তু ও পারেনি। সত্যি বলতে ওর মা একরকম ওকে নিয়ন্ত্রণই করত। ফলে হাজার চেষ্টা করেও সেখান থেকে ও বেরোতে পারেনি। ফলস্বরূপ আমার থেকে ও ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিল। তারপর বাচ্ছা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ঘটল। ওই ঘটনাতেই আমি এতটা শক পেলাম..."


এতক্ষণ অর্জুনের সবকথা চোখ বন্ধ করে একমনে শুনছিল কেদার ওরফে অনন্তদৃষ্টি। এইবার আচমকাই অর্জুনকে মাঝপথে থামিয়ে সে বলে উঠল, " এত বড় সত্যিটা আপনি বিদিশার থেকে লুকিয়ে গেছেন? কেন?"


 কেদারের কথায় অর্জুন যেন খানিকটা থতমত খেয়ে যায়। পরের মুহূর্তেই ওর চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।


- " ও আপনি জেনে গেছেন।"


-" হ্যাঁ... এত বড় ঘটনা বেমালুম চেপে গেলেন?"


-" হ্যাঁ গেলাম কারণ প্রমানটা পাওয়ার আগেই আমি বিদিশাকে বলেছিলাম আমার সন্দেহের কথা কিন্তু ও বিশ্বাস করেনি। তখন রাগের মাথায় ওকে আমি বলি ওর মা আর আমার মধ্যে কাউকে একজনকে বেছে নিতে। ও একবারও না ভেবে নির্দ্বিধায় মাকে বেছে নিয়েছিল।"


 কথাগুলো বলতে বলতেই অর্জুন যেন হাপিয়ে উঠেছে। বুকের ভেতর চেপে রাখা বহুদিনের না বলা কথা আচমকা বেরিয়ে এলে মানুষ কি এমনই ক্লান্ত বোধ করে? 


-" তারপর যখন প্রমানটা হাতে এল। ততদিনে জল অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। আমার বাড়িতে ডিভোর্সের নোটিশ এসে গেছে। তখন আর ইচ্ছে হল না বুঝলেন। মনে হল যে যাবে মনস্থির করেই ফেলেছে তাকে হাজারটা প্রমাণ দেখালেও সে কি আদৌ বিশ্বাস করবে? তার চোখদুটোই তো বাধা। তারচেয়ে তাকে যেতে দেওয়াই ভালো। এতে ও আমি দুজনেই ভালো থাকব।"


-" জিনিসটা আছে আপনার কাছে এখনও?"- চেয়ারে এবার নড়ে চড়ে বসে কেদার।


-" হাতের কাছে নেই। তবে খুঁজলে পাবো। কেন বলুন তো?"- অর্জুনের চোখে মুখে বিস্ময়।


-" এই বিপদ ঠেকানোর একটা উপায় পেয়েছি। কিন্তু তাতে আমি যা বলব আপনাকে পুরোপুরি মেনে চলতে হবে।" কেদার এবার উঠে দাঁড়ায়। তারপর এক পা এক পা করে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় দেওয়ালে টাঙানো সেই বিশাল ছবিটার সামনে। তারপর ফের বলে, 


- " একদিকে আপনার অতীত আরেকদিকে আপনার বর্তমান। এ এক কুরুক্ষেত্র অর্জুন বাবু। লড়াইটা আপনি লড়বেন না যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাবেন সে সিদ্ধান্ত আপনার হাতে। তবে ঈশ্বর অবশ্যই পথ 

দেখান। আমাকেও দেখালেন। আপনাকেও দেখাবে...দেখুন কোন পথ বাছেন! আমি আমার সাধ্যমত সবটুকু করব।"


অর্জুনও এবার উঠে পাশে এসে দাঁড়ায় কেদারের। ওর মুখে চোখে এখনও দ্বন্ধ। কেদার ওর দিকে তাকিয়ে নীরবে শুধু হাসে। তারপর বলে, " আমার গুরুমা একটা কবিতা আমাকে মাঝে মাঝেই শোনাত জানেন। তার থেকেই দুটো লাইন আজ খুব মনে পড়ছে। শুনবেন?"


-" হু বলুন।"


কেদার এবারও স্মিত হাসে। তারপর আবৃত্তির মত করে বলে ওঠে দুইখানি পঙক্তি, 


"যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,

তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ? তুমি কি বেসেছ ভালো?"


 // ১৭ // 


 ৩ রা জুলাই, ২০১৭ 


" পিতার হাতে খুন হতে হতে বাঁচলেন কন্যা! দমদমের কাছেই ঘটে যাওয়া এই ভয়াবহ ঘটনায়  শিউরে উঠছে সারা শহরবাসী। এখনও পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী কাকলীদেবীর বাবা বহুদিন ধরে মানসিক রোগে ভুগছিলেন। গত তিরিশ তারিখ সন্ধ্যেবেলা আচমকাই ছুরি নিয়ে তিনি তার মেয়েকে মারতে উদ্যত হন..."


 এতদূর অব্দি শুনেই টিভিটা বন্ধ করে দিল অর্জুন। উহু আর শুনতে ভালো লাগছে না। একজন মানুষের পক্ষে আর কতটাই বা সহ্য করা সম্ভব? সেদিন কেদারের সঙ্গে কথা বলে ফেরার পর ফ্ল্যাটে ঢুকতেই দেখে হই হই রই রই কান্ড। পুলিশ, এম্বুলেন্স, মিডিয়ার লোক। পুরো ফ্ল্যাট চত্বর জুড়ে মানুষ গিজগিজ করছে।


সব সরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই যেন মাথায় বাজ পড়ল অর্জুনের। স্ট্রেচারে করে রক্তাক্ত কাকলীদিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এম্বুলেন্সের দিকে। পিছনে পুলিশ নিয়ে বেরোচ্ছে কাকলীদির বাবাকে। লোকটা উন্মাদের মত হাসছে, কাঁদছে, চিৎকার করছে। তাকে তাক করে মুহুর্মুহু ঝলসে উঠছে ক্যামেরার আলো। সাংবাদিকরা যাকে পারছে জিজ্ঞেস করছে এখানকার ঘটনা...


উফ সেদিনকার ঘটনা এখন ভাবলেও দম বন্ধ হয়ে আসে অর্জুনের। কাকলীদি এখন একটু স্টেবল। কিন্তু এই কদিন ক্রমাগত পুলিশি জেরা আর মিডিয়া ইন্টারভিউ দিতে দিতে এতটাই বীতশ্রদ্ধ হয়ে গিয়েছে অর্জুন যে এখন এসবের নাম শুনলেই গা রি রি করে উঠছে। কেন যে সেদিন কাকলীদিকে ওদের ঘরে থাকতে দিয়ে গেছিল তন্দ্রাদের দেখাশোনা করতে কে জানে! উনি সেদিন নিজের ঘরে থাকলে এত ঝামেলা সহ্য করতে হত না। 


আরেকটা কথা ভেবেও অর্জুনের মনের ভিতরটা খচখচ করছে ক্রমশ। সেদিন ওদের ঘরে না থাকলে আদৌ কি কাকলীদির সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটত। কাকলীদির বাবা মানসিক ভাবে অসুস্থ বহুদিন। কিন্তু এমন হিংস্র কোনো কাজ তো উনি এর আগে কখনও করেননি। শুধু তাই নয়। উনি পুলিশ কাস্টডিতে অদ্ভুত বয়ানও দিয়েছেন। উনি বলছেন উনি নিজে থেকে এসব নাকি করেননি। একটা বাচ্চা ছেলে ওকে দিয়ে এসব করিয়েছে। পুলিশ অবশ্য এটাকে পাগলামিরই একটা পর্যায় ভাবছে যদিও অর্জুনের মনটা ক্রমাগত খচখচ করেই চলেছে। 


-" বাবা আমাকে ওই লকেটটা দিলে না তো যেটা পরশু আমার থেকে নিলে?"- তুলির কথায় হুশ ফিরল অর্জুনের। এসব ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন হারিয়েই গেছিল ও।


-" কোন লকেটটা?" অর্জুন এমনভাবে জিজ্ঞেস করে যেন ও ভুলে গেছে।


-" ওই যে ওই লকেটটা যেটা স্কুলের নতুন ম্যাডাম আমায় দিয়েছে। সেদিন তুমিই জিজ্ঞেস করছিলে তো আমায় যে ম্যাডাম আমায় অ্যানাগ্রাম শিখিয়েছে তার নাম কি! সে আর কি কি বলেছে। আমায় কিছু দিয়েছে কি না।"


তুলির মুখটা এই কদিনেই কেমন শুকিয়ে গেছে। যদিও গত দুদিন ধরে ওর চোখে মুখে সামান্য হলেও যেন একটু প্রাণের ছোয়া ফিরেছে। অর্জুন এবার ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দিতে দিতেই বলে, 


-" কি জানি ওই লকেটটা কোথায় রাখলাম। পেলেই তোমায় দেব কেমন? মা ঘুমোচ্ছে?" 


-" হুম।"- মাথা নাড়ায় তুলি। তন্দ্রার শরীরের অবস্থা বিগত কয়েকদিনে আরও খারাপ হয়েছে। মাঝে মাঝেই ব্লিডিং হচ্ছে। যদিও ডাক্তার বুঝতে পারছে না এই ব্লিডিং এর আসল কারণ কী! এভাবে বাড়তে থাকলে অবশ্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। 


-" কন্যে কেমন আছে বাবা? কবে বাড়ি আসবে কন্যে!"


তুলির প্রশ্নে বুকের ভেতরটা যেন মোচড় দিয়ে ওঠে অর্জুনের। কি বলবে এইটুকু বাচ্ছা মেয়েকে! কি করে বলবে যে ডাক্তাররা কোনো আশার কথা বলতে পারছে না। গায়িত্রী দেবীর অবস্থা ক্রমশ খারাপ থেকে খারাপ হচ্ছে। কিভাবে বলবে তুলিকে যে ওর কন্যে এই বাড়িতে আর কখনও ফিরতে নাও পারে।


-" ফিরে আসবে মা। খুব শিগগিরই ফিরে আসবে।"- তুলির মাথায় হাত বোলায় অর্জুন।


-" কন্যের গোপাল ঠাকুর কি কন্যের সঙ্গেই আছে?"- তুলির প্রশ্নে চমকে ওঠে অর্জুন। সত্যিই তো! মায়ের সবকিছু হাসপাতাল থেকে দিল গোপাল ঠাকুরটা তো দিল না। ওটা কি তবে পায়নি ওরা? এক্সিডেন্টের জায়গাতেই কোথাও পড়ে আছে? একবার দেখতে হচ্ছে। আসলে তালেগোলে ব্যাপারটা একদম মাথায় আসেনি।


-" হু আছে তো। কন্যের সঙ্গেই আছে গোপাল ঠাকুর সবসময়।"- তুলির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতেই বলে অর্জুন। 


-" আমাদের সঙ্গেও আছে। কন্যে বলত গোপাল ঠাকুর সবসময় আমাদের রক্ষা করছে। তুমি গীতা পড়েছ বাবা?" 


-" হু? না সোনা পড়িনি..."


-" দাঁড়াও তোমাকে পড়ে শোনাই। কন্যে আমাকে রোজ পড়ে শোনাত..."


অন্যদিন হলে হয়তো তুলির এই আবদার ফিরিয়ে দিত অর্জুন। বলাই বাহুল্য এসবে ওর একদমই মতি নেই। কিন্তু আজ আর বাচ্চা মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে ওকে ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছে হল না। 


অর্জুন শুধু বলল, " হু যাও নিয়ে এসো বই। শুনবো।"


তুলি খুশি হয়ে ছুটল ঠাকুর ঘরের দিকে। ঠিক এই মুহূর্তে হঠাৎই বিদিশার দেওয়া লকেটটার কথা আবারও মনে পড়ে গেল অর্জুনের। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই চোয়ালটা শক্ত হয়ে গেল ওর। বিদিশা জ্ঞানত এমনটা ওর সঙ্গে করল কী করে? ও কি ভুলে গেল একসময় অর্জুনকে ভালোবাসত ও! 


-" মার্কিং বোঝেন অর্জুনবাবু? শিকার করার আগে শিকারী সবসময় দূর থেকে তার শিকারকে মার্ক করে নেয়। কে সবচেয়ে দুর্বল, কে সবচেয়ে সহজ শিকার!"- সেদিন কেদারের বলা কথাগুলো আবারও যেন স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠতে থাকে অর্জুনের। 


-" ঠিক তেমনই চালান বিদ্যাতেও একধরণের মার্কিং করা হয়। সহজে বললে যাকে চালান করা হচ্ছে সেই অপশক্তি যাতে সহজে বুঝতে পারে যে কোথায় আঘাতটা হানতে হবে তার একটা সূক্ষ ব্যবস্থা। কখনও কোনোরকম রান্নায় মন্ত্রপুত কিছু মিশিয়ে খাইয়ে দেওয়া, কখনও বা শিকড়, চুল বা ওইরকম অতি ক্ষুদ্র মন্ত্রপুত কোনো জিনিস শরীরের সঙ্গে লাগিয়ে দেওয়া। এইরকম আরকি। আপনার মেয়ে তুলিকেও এভাবেই মার্ক করা হয়েছে কুরকুট্টার শিকার বানানোর জন্য। এবং ঠিক যেদিন কালরাত্রি আসবে সেদিন রাতে কুরকুট্টাও আসবে তার শিকারের জন্য..."


  কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বুকের ভিতরটা ক্রমশ যেন রাগে ঘেন্নায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছিল অর্জুনের। এতকিছুর পরেও ও কেন কেদারের বলে দেওয়া পথ অনুসরণ করতে এত সংকোচ করছে? হাতের সময় যে বেরিয়ে যাচ্ছে তা কি ও বুঝতে পারছে না? কিসের এত সংকোচ ওর! বিদিশাকে কি এখনও ভালোবাসে অর্জুন নাকি...


  উহু ঠিক ভালোবাসা নয়। সে তো মরেই গেছে বহুদিন আগে। তবু কি একটা যেন অদৃশ্য সুতো ওর এখনও জড়িয়ে আছে বিদিশার সঙ্গে। এই পরিস্থিতিতে এসব কথা শুনলে হয়তো আর পাঁচটা লোকে হাসবে, ওকে বলবে কাপুরুষ। কিন্তু তবু সত্যি কথাটা এটাই যে এমন কোনো কাজ অর্জুন জ্ঞানত করতে পারবে না যাতে বিদিশার ক্ষতি হয়। একজন মানুষ যাকে ও একসময় নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবেসেছিল, আজ সময় পরিস্থিতি না হয় পাল্টেই গেছে, কিন্তু তবুও তাকেই নিজের হাতে  কি করে বিপদের মুখে ঠেলে দেবে ও? এ কি আদৌ সম্ভব? বিশেষ করে যখন ও জানে এই বিপদে ওর সেই আগের ভালোবাসার মানুষটির মৃত্যুর সম্ভাবনাও প্রবল... কি করে সব জেনেশুনে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে ও? 


-" এ আমি কাদের হত্যা করব বাসুদেব? আমার সামনে যুদ্ধক্ষেত্রে আজ যারা দাঁড়িয়ে আছেন, তারা তো আমারই পরম আত্মীয়। একসময় এদেরকে আমি ভালোবেসেছি!"- হঠাৎই তুলির কণ্ঠে যেন সম্বিৎ ফিরে আসে অর্জুনের। তুলি কখন যেন ঠাকুরঘর থেকে গীতা এনে নিজের মনে পড়তে শুরু করেছে। যদিও ওর পড়া দেখলে বোঝাই যায় যে আদৌ ও বইটি দেখে কিছু পড়ছে না। বরং ওর ঠাকুমার কাছ থেকে এতদিন ধরে শোনা কথাগুলোই মুখস্থ আওড়াচ্ছে। আর বইটা পড়ার ভান করছে। তুলি আবারও বলে ওঠে, 


-" অর্জুনের এই কথা শুনে শ্রীকৃষ্ণ হাসলেন। তারপর বললেন, তুমি কাকে বধ করবে অর্জুন। তুমি কাউকেই বধ করতে পারো না। আত্মা যে অনাদি, অবিনশ্বর। তার বিনাশ নেই। আগুন তাকে পোড়াতে পারে না, ধারালো অস্ত্রেও তাকে বিদ্ধ করা যায় না। সে শুধু পুরাতন জীর্ণ পোশাক ছেড়ে নতুন পোশাক ধারণ করে..."


কে জানে কেন তুলির প্রত্যেকটা কথা শুনতে শুনতেই অর্জুনের গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কোথাও যেন ওর মনে হচ্ছে আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মানুষটার সঙ্গে ওর কোনো পার্থক্য নেই। আর শুধু ও কেন এই সমাজের, এই সভ্যতার কোনো মানুষেরই কোনো পার্থক্য নেই। এও তো কুরুক্ষেত্রই। প্রত্যেকদিন এখানেও প্রতিটি মানুষ অর্জুনের মতই হাজারও আত্ম জিজ্ঞাসায় বিদ্ধ হচ্ছে। প্রত্যেকে নিজের ভেতর ভেতর কোনো না কোনো কিছু নিয়ে দ্বন্ধে ভুগছে। প্রত্যেকটা মানুষ আসলে নিজের নিজের ক্ষেত্রে কখনও না কখনও লড়াইটা ছেড়ে পালাতে চাইছে। সমাজের ভয়ে, পরিবার পরিজনের ভয়ে, কাছের মানুষের ভয়ে অথবা অনাগত ভবিষ্যতের ভয়ে... মানুষের বেঁচে থাকার সঙ্গে, তার নিজের সত্তার সঙ্গে এমনকি তার প্রতিটা কাজের সঙ্গেও জুড়ে যাচ্ছে এই ভয়! এই দ্বন্ধ!


-" মামেকং শরনং ব্রজঃ! আমার শরণে এসো। তুমি কার্য করো অর্জুন, ফল আমি দেব!"- তুলির মুখে গীতা শুনতে শুনতে অর্জুন যেন বিভোর হয়ে গেছিল। এবারে এই কথাটা শুনেই ওর সারা গায়ে যেন কাটা দিয়ে উঠল। এই কি তবে ঈশ্বরের সংকেত! হাজার হাজার বছর আগে স্বয়ং ঈশ্বরের মুখের বার্তা আজ কি এভাবেই এসে পৌঁছাচ্ছে এক অন্য কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থাকা অর্জুনের কাছে? কী বোঝাতে চাইছেন তিনি? মামেকং শরনং ব্রজঃ...আমার স্মরণে এসো...


  কে জানে কেন সেদিন রাতে অর্জুনের আর ঘুমই এল না ঠিক করে। সারারাত শুধু এই কথাটাই ঘুরতে থাকল মাথার মধ্যে। একটা তীব্র অস্বস্তিতে নিজের বিছানায় এ পাশ ওপাশ করতে লাগল ও। তবে ঠিক ভোর রাতের দিকে ওর চোখটা একটু লেগে এল। আর সেই আধো ঘুম আধো তন্দ্রার মধ্যেই এক ভারী আশ্চর্য স্বপ্ন দেখল ও। 


অর্জুন দেখল ও নিজের ঠাকুরঘরে হাটু মুড়ে বসে আছে। দুহাত জড়ো করা সামনে। আর ওর ঠিক সম্মুখেই সিংহাসনে রাখা গোপালের মূর্তি থেকে এক অদ্ভুত জ্যোতি বেরোচ্ছে। সেই সুতীব্র আলোকচ্ছটায় আলোকিত হয়ে উঠছে পুরো ঠাকুর ঘর। আর ওস্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সিংহাসনে বসেই গোপাল ঠাকুর ওকে বলছে, 


-" মামেকং শরনং ব্রজঃ! আমার শরণে এসো। তুমি কার্য করো অর্জুন, ফল আমি দেব!"


*** 


৫ ই জুন, ২০১৭


বাইরে ভোরের আলো ফুটছে। এরমধ্যেই জেগে গেছে কেদার। কাল সারারাত ওর ঘুম হয়নি। নিষ্পাপ তুলির মুখটা ওর চোখে ভেসেছে। তার সঙ্গেই ভেসেছে মোহনের মুখটাও। দুদিকে দুটো অসহায় শিশু। ওর কি কিছুই করার নেই। আজ এই ভোরে গুরুমার বলা কথাগুলো যেন বারংবার কানে বেজে উঠছে কেদারের, 


-" অসহায়ের বিপদে সবসময় ঝাঁপিয়ে পড়বে কেদার। মনে রেখো যে নিজের ভিতরে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে পারে সে সর্ব জীবেও তাকে অনুভব করতে পারে। অসহায় জীবের বেদনায় যার হৃদয় ব্যথিত হয় না, সে মনুষ্য কখনও ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতেও পারে না!"


ধীরে ধীরে হাটতে হাটতে নিজের ধ্যানের ঘরে এসে পৌঁছায় কেদার। তারপর দরজা খুলে ভিতরে ঢোকে। ঘরের ঘুলঘুলি বেয়ে নেমে আসা এক চিলতে আলো কেদারের সুঠাম পেশীবহুল শরীরে যেন আশ্রয় খুঁজে নেয়। খানিকটা এগিয়ে এসে একটা বেশ বড় বাক্সের সামনে এসে দাঁড়ায় কেদার। 


-" এ কোনো যে সে অস্ত্র নয় কেদার! যখন প্রতিপক্ষ প্রচন্ড শক্তিধর হবে, যখন তাকে পরাস্ত করার আর কোনো উপায় অবশিষ্ঠ থাকবে না। তখন বুঝবে এটি ব্যবহারের সময় এসেছে। তখন এর শরণাপন্ন হয়ো!"


গুরুমার কথাগুলি মনে করেই চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে কেদারের। মনে মনেই সে বলে ওঠে, " এবার সময় হয়েছে গুরুমা!" 


তারপর মুহূর্তেই বাক্সটি খুলে ধরে সে। কিন্তু কি অদ্ভুত বাক্সটি সম্পূর্ণ ফাঁকা। যদিও অদ্ভুতভাবে সেটার ভিতরে তাকিয়েই কেদার ওরফে অনন্তদৃষ্টির মুখে এইবার ফুটে ওঠে প্রশস্ত হাসি! 


// ১৮ //


৪ ঠা জুলাই, ২০১৭


-" তাহলে শেষমেষ আমাদের আবার মুখোমুখি হতেই হল!"

বিদিশার মুখে স্মিত হাসি। ওর মুখোমুখি এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে সেই মানুষটা যাকে এই পৃথিবীতে ও সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিল। একসময়। এখনও কি ভালোবাসে? কে জানে...


অর্জুন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখছিল বিদিশাকে। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে স্রোতবতী গঙ্গা। বিকেলের মরা রোদ সেই ধীরগামিনী স্রোতস্বিনীর বুকে শীতলপাটি বিছিয়ে কাঁদতে বসেছে। কে জানে কার বিরহে তার এই ক্রন্দন! শুধু তার চোখের জল মাঝে মধ্যেই ঝিকমিক করে উঠছে নদীর ঢেউয়ের বুকে। বিকেল যেন ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে বাগবাজার ঘাটে। আর যে দুটো মানুষ সেই ঘাটের ধার বরাবর আজ বহুকাল পর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে তাদের বিকেল ফুরিয়ে গিয়েছে বহুকাল হল...


-" কতটা সময় কেটে গেল তাই না বিদিশা! সেই বাগবাজার ঘাট, সেই গঙ্গা, সেই পড়ন্ত বিকেল। সবই এক আছে।  শুধু আমি আর তুমি আমূল বদলে গেছি!"- অর্জুনের কথাগুলো শুনতে শুনতে বুকের ভিতর চাপান উতোরটা ক্রমশ যেন টের পাচ্ছিল বিদিশা। উহু এমন কিছু তো সে আশা করেনি...


-" আমায় এখানে কী কারণে ডেকেছ রঞ্জু! আমার হাতে বিশেষ সময় নেই..."- এই অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে যেন এই মুহূর্তে পালাতে পারলে বাঁচে বিদিশা। 


অর্জুন অবশ্য একইভাবে চুপ থাকে কিছুক্ষণ। তারপর আচমকাই গঙ্গার বুকের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে, " ঠিক এইখানে বসে একদিন তুমি আর আমি খুব হেসেছিলাম মনে আছে। সেদিন তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে আমাদের ভালোবাসা শেষ হয়ে গেলে আমরা কি শত্রু হয়ে যাব। মনে পড়ে বিদিশা?"


বিদিশা এইবার যেন ভিতর ভিতর কেঁপে ওঠে। হে ঈশ্বর, কেন এই দুর্বলতা গ্রাস করছে ওকে। ও তো আর ভালো মানুষ নেই! ওর ভেতরের ভালো মানুষটা তো মরে গেছে। বিদিশা তো এখন অত্যন্ত খারাপ নোংরা বিষাক্ত একটা মানুষে পরিণত হয়েছে ! যে মানুষটার সবচেয়ে বড় ক্ষতি করতে চেয়েছে ও, তার কথাতেই এই দুর্বলতা কি সাজে! 


  বিদিশার নীরবতা দেখে অর্জুন এইবার ধীরে ধীরে বিদিশার সামনে এগিয়ে আসে। ওর নিজের বুকের ভিতরেও ক্রমশ জমাট বাঁধছে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা। বিদিশার চোখের দিকে চেয়েই অর্জুন এবার বলে, 


-" এমনটা কেন করলে বিদিশা? কেন করলে এমনটা? আমাদের ভালোবাসাটাকে এতটা ছোট না করলেই কি হত না!"


বিদিশার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল অর্জুন আজকে ওর সঙ্গে ভয়ঙ্কর দুর্ব্যবহার করবে। ও নিশ্চয়ই কিছু বুঝতে পেরেই আচমকা ওর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে। ও নিশ্চয়ই প্রচন্ড রেগে আছে। ও চিৎকার করবে, অশ্রাব্য ভাষায় বিদিশাকে তিরস্কার করবে! বিদিশার তো সেটাই প্রাপ্য। কিন্তু তা না করে এ কি করছে অর্জুন! কেন এতদিন ধরে ওর বুকের ভিতর জমিয়ে রাখা সমস্ত ঘেন্নার পাহাড়গুলোকে এভাবে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিচ্ছে ও!


অর্জুন এবার আবারও বলে ওঠে, " শুধুমাত্র আমার ক্ষতি করবে বলে এতগুলো নিষ্পাপ মানুষের জীবন নিয়ে খেললে! একবারও ভাবলে না এরা তো কোনো দোষ করেনি। দুটো নিষ্পাপ শিশু তাদেরকে এতটা অন্ধকারে ঠেলে দিতে একবারও বুক কেঁপে উঠল না তোমার!"


 বিদিশার নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। অর্জুন তারমানে সবটাই জানতে পেরেছে।


-" না বুক কাঁপেনি! কেন কাঁপবে! তোমার বুক কেঁপেছিল যখন আমায় ছেড়ে চলে গেছিলে!"- এই তো বিদিশার ভেতরকার সাপটা ফণা তুলেছে। উহু, দুর্বল হলে হবে না। ভালোবাসার কাছে যারা দুর্বল হয় তারা শুধু মরে। তার বদলে বিষ চাই, ঘেন্না চাই, প্রতিশোধ চাই। বিদিশা চিৎকার করে ওঠে, 


-" একটা সামান্য দুর্ঘটনা। আমি মায়ের সঙ্গে সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গেছিলাম। তাতে আমার বেবিটা নষ্ট হয়ে যায়। শুধুমাত্র এই অজুহাত দেখিয়ে তুমি আমায় ছেড়ে চলে গেছিলে রঞ্জু! একবারও ভাবোনি আমার কেমন লাগবে! একবারও চিন্তা করোনি আমি তোমাকে ছাড়া কি করে বাঁচবো।"


 এইবার বুঝি অর্জুনের চুপ থাকার পালা। ভালোবাসার পরিবর্তে বিষাক্ত ছোবল পাওয়ার সময়। অর্জুন চুপ করে শুনতে থাকে। বিদিশা বলে যায়, 


-" আমি অনেক ওয়েট করেছি। অনেক অনেক। আমার প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত মনে হয়েছিল আমাদের ভালোবাসা মিথ্যে না। তুমি আবার আমার কাছে ফিরে আসবে। শুধু আমার মাকে পছন্দ করো না বলে তুমি দূরে সরে যাবে এটা হতেই পারে না। কিন্তু...উহু তুমি ফেরোনি। কোনোদিন ফেরোনি। বরং অন্য একজন মানুষের সঙ্গে আচমকাই জীবন কাটাতে শুরু করলে..."


  কথাগুলো বলতে বলতে বিদিশা যেন হাঁপিয়ে উঠছে।   যে নদী, যে আকাশ, যে অস্তরাগ বিকেল একসময় ছিল তার একান্ত ভালোবাসার সাক্ষী, আজ তারাও যেন হা করে দেখছে তার বুকে জমে থাকা অভিমানকে। এ আসলে অভিমান নাকি বিষ? নাকি ভালোবাসা?


-" যখন তুমি আর আমার কাছে ফিরলে না, অন্য একজনের সঙ্গে থাকতে শুরু করলে তখনও নিজের মনকে আমি বুঝিয়ে নিয়েছিলাম। চেষ্টা করেছিলাম তোমার থেকে বহু বহু দূরে সরে যেতে। কিন্তু পারলাম না। যখন খবর পেলাম তুমি বাবা হচ্ছ। তোমার নতুন ভালোবাসার মানুষটার গর্ভে তোমার সন্তান আসছে। তখন আর পারলাম না। প্রচন্ড রাগ হল। ঈর্ষা হল। মনে হল সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিই। যা আমার হল না তা অন্য কারও হতে দেব কেন?" 


- " কাউকে ভালোবাসলে কি তার ক্ষতি করার অধিকার জন্মায় বিদিশা?"- অর্জুনের প্রশ্নে আবারও এক মুহূর্ত থমকে যায় বিদিশা। উহু, এতগুলো বছর পরেও ওর স্বভাব বদলাল না। মাঝে মাঝে এমন গভীর প্রশ্ন করে যে অন্তর পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। বিদিশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই চোখের কোনায় জমে থাকা জলটা মুছে অর্জুন এবার বলল, 


-"যাই হোক তোমার সঙ্গে এমনি এমনি দেখা করতে আসিনি। একটা সত্যি তোমাকে জানাতে এসেছি। আমারই ভুল। পাঁচ বছর আগেই এটা তোমায় জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। তাতে হয়তো তোমার আমার দুজনেরই ভালো হত। সেই পাঁচ বছর আগেও তোমার মা তোমার চোখদুটো বেঁধে রেখেছিল। আজও তেমনি বেঁধে রেখেছে।"


-" আমার মায়ের নামে কোনো বাজে কথা বলবে না রঞ্জু..."- কথাটা বলতে গিয়েই থেমে যায় বিদিশা। অর্জুন ওর পকেট থেকে খামের মত কি একটা বের করল যেন। তারপর সেটা খুলে তার থেকে একটা কাগজ বের করে এগিয়ে দিল বিদিশার দিকে। 


-" এটা কী? দেখে তো মনে হচ্ছে কোনো মেডিক্যাল রিপোর্ট!"- বিদিশা ভুরু কুঁচকায়। 


-" নিজেই দেখো!"


অর্জুনের হাত থেকে এইবার কাগজটা নেয় বিদিশা। ভালো করে চোখ বোলায় সেটায়। পরমুহূর্তেই ওর পায়ের নীচের মাটিটা যেন টলে যায়। ও নিজের চোখে যা দেখছে সেটাকে যেন বিশ্বাস করতে পারে না। বিস্মিত চোখ তুলে শুধু তাকায় অর্জুনের দিকে। স্মিত হাসে অর্জুন, 


-" তখন তোমাকে এটা দিলেও তুমি বিশ্বাস করতে না। আজকেও করবে কি না জানি না। কিন্তু সেদিনও আমি ভুল ছিলাম না, আজও ভুল নই। আমি সেদিনও চাইনি কেউ তোমায় নিজের স্বার্থে ব্যবহার করুক আজও চাই না। তাই সত্যিটা তোমায় জানালাম। কারন কালকের পর হয়তো এই সত্যিটা জানানোর জন্য আমি আর এই পৃথিবীতেই থাকবো না। অবশ্য সেটাই তো চাও তুমি বিদিশা!" 


  অর্জুনের শেষ কথাগুলো যেন কাঁটার মত বেঁধে বিদিশার বুকে। ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। পায়ের তলার মাটি কাঁপছে। এ কি সম্ভব! না না না...ওর এতদিনের বিশ্বাস ভরসা এভাবে ভেঙেচুরে যেতে পারে না। এইবার বিদিশাকে চমকে দিয়ে আচমকাই ওর হাতটা চেপে ধরে অর্জুন। তার মুখে ফুটে ওঠে সকরুণ আর্তি। পরক্ষণেই ও বলে ওঠে, 


-" অনেকগুলো নিষ্পাপ প্রাণ অন্ধকার তলিয়ে যাবে বিদিশা। কিন্তু তুমি চাইলেই ওরা বাঁচতে পারে। প্লিজ বিদিশা..."- কথাগুলো বলতে বলতে আচমকাই আবার হেসে ওঠে অর্জুন। তারপর নিজের মনেই বলে, " অবশ্য তোমায় এসব বলে কি লাভ! তুমি তো আর সেই আগের বিদিশা নও। আমি জানি সে মারা গেছে..."


 অর্জুন এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর শেষবারের মত বিদিশার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলে, " ভালো থেকো।" তারপর ধীর পায়ে পিছন ফিরে ক্রমশ হেঁটে চলে যেতে থাকে। দূরে...দূরে...আরও দূরে। ঠিক যেমন করে প্রবল ঝরে মেঘ সরে যায় মেঘের থেকে। ঢেউয়ের ধাক্কায় একটি নৌকা দূরে ভেসে যায় আরেকটি নৌকার থেকে...


 "ভালো থেকো" কথাটা কানে যেন মৌমাছির গুঞ্জনের মত বাজতে থাকে বিদিশার। ওর শরীর যেন এই মুহূর্তে অবশ হয়ে আসে। ঠিক এই মুহুর্তেই একটি বছর ছাব্বিশের যুবা তার সামনে এসে দাঁড়ায়। বিদিশাকে চমকে দিয়েই সে বলে, " আপনার সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে ম্যাডাম? কুরকুট্টা চালানের ব্যাপারে?"


  বিদিশা এইবার যেন ভূত দেখার মত চমকে ওঠে। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সেই যুবকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ওঠে, " ক...ক...কে তুমি?" 


ছেলেটি শুধু হাসে। তারপর বলে, " বাবার দেওয়া নাম কেদার, কেদার চ্যাটার্জি! কিন্তু ওই ওপরে যিনি বসে আছেন সেই ভোলেবাবার দেওয়া নাম অনন্তদৃষ্টি!"


// ১৯ // 


৫ ই জুলাই, ২০১৭ 

( কালরাত্রি )


নিকষ অন্ধকারে ডুবে থাকা কক্ষটির মাঝখানে এইবার হঠাৎ করেই একটি দেশলাইয়ের শিখা ফস করে জ্বলে উঠল। আর তার পরক্ষণেই কক্ষের মাঝখানে অন্ধকারের বুকে লাল শালুকের মত ফুটে উঠল পাঁচখানা প্রদীপের শিখা। সেই প্রদীপগুলির উজ্জ্বল শিখার আলোয় ঘরের অন্ধকার যেন রাঙা হয়ে উঠল লজ্জায়। প্রদীপের পিছনে এলোচুলে বসে আছে এক রমণী। মাথায় তার বড় গোলাকার সিঁদুরের টিপ। মুখে অদ্ভুত গাম্ভীর্য। তার সামনে রাখা একটি মাটির কলস মধ্যে মধ্যে কেঁপে কেঁপে উঠছে। 


  রমণীটি একমনে কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করছিল ঠিক এই সময়ে কক্ষের দরজা সশব্দে খুলে গেল। এক ভয়াল দর্শন বৃদ্ধা ছুটতে ছুটতে ঢুকলেন কক্ষের ভিতর, " ঢেমনি মাগী! তোকে বারবার বলেছিলাম ওই বাচ্ছাটাকে দেখে রাখতে। দেখ কি কান্ড বাধিয়েছিস! ছেলেটা ঘরে নেই..."


কথাগুলো বলতে বলতে সামনের দৃশ্য দেখে যেন হঠাৎ থমকে গেলেন বৃদ্ধা। তারপর খানিকটা বিস্ময় ভরা কণ্ঠেই বলে উঠলেন, " এ...এই রকম সাজে তুই কী করছিস মা?" 


প্রদীপের শিখায় এইবার বিদিশার মুখটা স্পষ্ট বোঝা গেল। তার ঠোঁটের কোনায় ফুটে উঠল বঙ্কিম হাসির রেখা। 


-" উপাচারে বসেছি মা! উপাচারে বসেছি।" 


বিদিশা এবার তার মাকে চমকে দিয়েই সামনের কলসিটাকে তুলে ধরে সজোরে আঘাত করল মাটির সঙ্গে। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই কলসিটা ভেঙে গিয়ে তার ভেতরকার লালচে তরল ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।প্রদীপের আলোয় এইবার স্পষ্ট দেখা গেল সেই লালচে তরলের মধ্যে ছটফট ছটফট করছে একটা কুচকুচে কালো সাপ।


-" ঢেমনি মাগী!এ কোন মরণ খেলায় মেতেছিস তুই!"- বৃদ্ধা এবার পাগলের মত চিৎকার করতে করতে ছুটে আসে সামনের দিকে।


-" উহু একদম না! আর এক পাও সামনে এগোবে না!"- বিদিশা এইবার এক লহমায় খপাত করে চেপে ধরে সাপটার গলা। তারপর তাকে প্রদীপের শিখার সামনে তুলে ধরে অন্য হাতে ধরে রাখা ধারালো ছুরিটা সাপটার গলার সামনে চেপে ধরে। বৃদ্ধা এইবার যেন আতঙ্কে পাগল হয়ে যান।


-" খবরদার না! তুই কি পাগল হয়ে গেছিস! তুই জানিস না ওই সাপ হল সাক্ষাৎ কুরকুট্টার আধারস্বরূপ। কুরকুট্টা তার স্থায়ী শরীরে প্রবেশ করার আগে ওর কোনো ক্ষতি হলে..."- বৃদ্ধার কথা শেষ হয়নি তার আগেই বিদিশা এবার বলে ওঠে, 


-" আমার পেটের বাচ্চাটা কেন নষ্ট করে দিয়েছিলে মা? কী ক্ষতি করেছিলাম তোমার!"


বৃদ্ধার মুখ এক মুহূর্তে যেন ফ্যাকাশে হয়ে যায়। পরের মুহূর্তেই তিনি আমতা আমতা করে বলে ওঠেন, " এ...এসব কি বলছিস তুই...আমি তোর পেটের বাচ্ছা কেন নষ্ট করব! তুই তো সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে..."


-" মিথ্যে! মিথ্যে মিথ্যে মিথ্যে!"- হাতে ধরে রাখা সাপটা নিয়েই এবার প্রচন্ড গর্জে ওঠে বিদিশা, " আমি রিপোর্ট দেখেছি মা। আমার বাচ্চা সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার ফলে নষ্ট হয়নি। নষ্ট হয়েছিল বিষক্রিয়ায়। একধরনের গাছের শিকড়ের বিষ আমার পেটে পাওয়া গিয়েছিল। যা আমাদের উপাচারে লাগে। যা তুমি আমার সামনেই বহুবার ব্যবহার করেছ অন্য মেয়েদের গর্ভ নাশ করতে... কিন্তু আমি ভাবতেও পারিনি নিজের মেয়ের সঙ্গেও তুমি!"


  বৃদ্ধা অনেকটা সামনে এগিয়ে এসেছেন ধীর পায়ে। তার চোখে মুখে অকৃত্রিম ভয়। নিজের মেয়েকেই যেন তিনি চিনতে পারছেন না।


-" এসব তুই কি বলছিস মা! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না..."- বৃদ্ধা মায়া ভরা স্বরে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসতে থাকে বিদিশার দিকে। 


-" বুঝতে পারবে! বুঝতে পারবে! যখন কুরকুট্টা তোমার শরীরটাকে দুমড়ে মুচড়ে একশা করে দেবে তখন বুঝতে পারবে।"- কথাগুলো বলে এবার নিজেই পাগলের মত খিলখিল করে হেসে ওঠে বিদিশা। ঠিক সেই মুহূর্তেই ওর হাত থেকে সাপটা কেড়ে নেওয়ার জন্য ঝাঁপ দেয় বৃদ্ধা। কিন্তু তার আগেই বিদিশার ছুরি কামড় বসায় তার হাতে ধরা কালো কুচকুচে সাপটার গলায়। বৃদ্ধা বিদিশার সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিস্মিত চোখে দেখেন সাপটির ধর মুন্ড থেকে আলাদা হয়ে গেছে! 


   এরপর ঠিক এক মুহূর্ত। তারপরেই বিদিশার চুলের মুঠি ধরে সেই বৃদ্ধা পাগলের মত চিৎকার করে ওঠে, " খানকি মাগী ঢেমনি! কেন করলি এরকম! কেন করলি বল! তোকে ছোট থেকে এনে বড় করলাম এই কারণে!"


বৃদ্ধাকে চমকে দিয়েই তার মুখে এবার এক দলা থুতু ছিটিয়ে দেয় বিদিশা। তারপরক্ষনেই বলে ওঠে, " আমাকে তুমি এমনি এমনি বড় করোনি মা। আমার মধ্যে বিশেষ দেহ লক্ষণ ছিল যা তন্ত্রের কাজে উপযোগী। সেইজন্য আমাকে ঘটা করে দত্তক নিয়েছিলে যাতে নিজের তন্ত্রের কাজে আমাকে লাগাতে পারো। আমি তোমার কাছে একটা পুতুল ছাড়া আর কিচ্ছু ছিলাম না কোনোদিন।"


  এইবার বৃদ্ধার ধৈর্য্যের বাঁধ যেন ভেঙে যায়। হিংস্র শ্বাপদের ন্যায় তিনি গর্জে ওঠেন, " হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ তাই তাই তাই! ঐজন্যই তোকে নিয়ে এসেছিলাম। ঐজন্যই তোকে বিয়ে দিতে চাইনি। ঐজন্যই তোর সম্পর্কটা বিষিয়ে দিয়েছিলাম। শুধু তোকে নিজের কাছে রাখব বলে! তোকে খাইয়ে পড়িয়ে বড় করেছি আমার কাজে লাগাবো বলে, অন্যের কাছে পাঠানোর জন্য নয়! ঠিক এই জন্যই তোর বাচ্ছাটাকেও শেষ করে দিয়েছিলাম..."- বৃদ্ধা কথা শেষ করার আগেই বিদিশা এবার তার মায়ের গলা টিপে ধরে। 


-" শয়তান... রাক্ষুসী! আজ তোর এতদিনের এত পাপের শাস্তি তুই পাবি!"


 বিদিশাকে এইবার এক ঝটকায় ঠেলে ফেলে দেয় বৃদ্ধা। বিদিশার সঙ্গে ধাক্কা লেগে প্রদীপ পড়ে যায় মাটিতে। তারপরক্ষণেই বৃদ্ধা চিৎকার করে ওঠে, " তুই বোধহয় ভুলে যাচ্ছিস মাগী! তুই ওর আধার শেষ করে দিয়েছিস। ও তোকেও মারবে। আমাকেও মারবে। এই উপাচারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সবাইকে মেরে ওর শান্তি হবে। ওই বাচ্ছা ছেলেটাও বাঁচবে না। আর তোর ওই প্রেমিকের মেয়েও বাঁচবে না! আমাকে আর তোকে মারার পর ও ওদেরকেই আগে শেষ করবে! "


  এই কথায় বিদিশা এবার স্মিত হাসে। তারপর বলে, " যাদের রক্ষা করার জন্য স্বয়ং ঈশ্বর আছেন তাদের কোনো ক্ষতি কেউ করতে পারবে না! আর তুই তো মরবিই রাক্ষুসী! সঙ্গে আমি যদি মরি কোনো ক্ষতি নেই। তোর সঙ্গে এতদিন ধরে থেকে আমি যে পাপ করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত হবে আমার!"


-" নাআআআ..."- প্রচন্ড আক্রোশে চিৎকার করে ওঠেন বৃদ্ধা। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা ভয়ঙ্কর পূতি গন্ধে ভরে ওঠে সারা ঘর। আর তারপরের মুহূর্তেই অন্ধকারের বুকে জমাট বেঁধে ওঠে একটা দীর্ঘ ছায়া। এইবার সেই অন্ধকারের বুকে দুটো আগুনের মত চোখ ধকধক করে জ্বলতে দেখা যায়। বৃদ্ধা এই দৃশ্য দেখে আতঙ্কে যেন স্থির হয়ে যান। কিছু করতে যাবেন তার আগেই ওনার শরীরটা পালকের মত ভেসে ওঠে শূন্যে। তারপর মচমচ শব্দে একটা একটা করে ভেঙে যেতে থাকে ওনার সমস্ত শরীরের হাড়! প্রচন্ড যন্ত্রনায় ককিয়ে ওঠেন তিনি। 


-" আআআআ!"


বিদিশা দেখে তার চোখের সামনেই তার মায়ের শরীরটা দুমড়ে মুচড়ে এক হয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই মুহূর্তে তার হাতে মোবাইলটা উঠে আসে। একটা নম্বরে কিছু একটা পাঠায় সে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। পরমুহূর্তেই সামনে তাকিয়ে দেখে সেই অন্ধকারে জ্বলতে থাকা চোখদুটো এবার এগিয়ে আসছে তার দিকেই। 


এইবার আচমকাই খিলখিল করে হেসে বলে ওঠে সে। তারপর সেই আঁধারের দিকে তাকিয়েই বলে ওঠে, " তোর মত নরকের কীটের হাতে মৃত্যুর চেয়ে স্বেচ্ছা মৃত্যু অনেক ভালো।"


এরপর ঠিক কয়েক মুহূর্ত। মাটিতে পড়ে যাওয়া প্রদীপের উপর নিজের আঁচল লুটিয়ে দেয় বিদিশা। পরমুহূর্তেই দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে তার শাড়ি। তাকে ঘিরে যেন তৈরি হয় পুণ্য অগ্নিবলয় যাকে স্পৰ্শ করার ক্ষমতা কোনো অশুভ শক্তির নেই। সেই অগ্নি বলয়ের ভিতর দাঁড়িয়ে ক্রমশ দগ্ধ হতে হতেই বিদিশা হাত জোড় করে বলে ওঠে, " হে পুণ্য অগ্নি আমায় গ্রহণ করো! আমার সকল পাপ কালিমা তোমাতে দগ্ধ করো! হে মহাজ্যোতি আমার অন্তরের সমস্ত রিপু, সমস্ত আধার তোমায় আহুতি দিলাম! আমায় স্বীকার করো..."


আগুনের শিখা লকলক করে ওঠে।  একটি রিপুমলিন জীর্ণ বস্ত্র পুড়ে ছাই হয় শুধু! এই বস্ত্রটিকেই শাস্ত্রকাররা বলেছেন " শরীর "!


// ২০ //


বিদিশার মেসেজ চলে এসেছে। তারমানে ঐদিককার কাজ শেষ। এইবার যেকোনো মুহূর্তে সেই ভয়ঙ্কর কুটিল অপশক্তি ঝড়ের মত আছড়ে পড়বে এখানে। কেদার আবারও ভালো করে চোখ বুলিয়ে নেয় চারিদিকে। এটি তার ধ্যান করার কক্ষ। সুবিশাল ঘরটিতে হাতে গোনা যে কয়টি আসবাবপত্র ছিল তা কেদার বের করে দিয়েছে। তার বদলে ঘরের ঠিক মধ্যিখানে রাখা আছে একটা চেয়ার। সেই চেয়ারে বসে আছে ছোট্ট তুলি। আর তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে মোহন! 


  হ্যাঁ মোহন। মোহনকে বিদিশার ওখান থেকে আজ বিকেলেই নিয়ে এসেছে ও। গতকাল বিদিশার সঙ্গে বলা কথাগুলো যেন আরেকবার মনে পড়ে যায় ওর, " দেখুন একবার কুরকুট্টা তুলির শরীরে প্রবেশ করলে তাকে আর আটকানো সম্ভব হবে না। কিন্তু তার আগে যদি কুরকুট্টার আধারকে নষ্ট করা যায়। তাহলে তার শক্তি অনেকাংশে কমে যায়। হ্যাঁ সে তবুও আঘাত করবে বটে কিন্তু তখন তার সঙ্গে মোকাবিলা করার একটা সুযোগ অন্তত থাকবে...দুটো নিষ্পাপ বাচ্চাকে এইভাবে শেষ হয়ে যেতে দেবেন বিনা দোষে? আপনি তো নিজে সারা জীবন ব্যবহৃত হয়ে এসেছেন আপনার মায়ের দ্বারা। সবই তো বললাম আপনাকে। একবার শেষ চেষ্টা কি করা যায় না বিদিশা দেবী? মনুষত্বের খাতিরে? ভালোবাসার খাতিরে!"


 কথাগুলো শুনে চমকে উঠেছিল বিদিশা। বেশ কিছুক্ষণ স্থির থেকে উত্তর দিয়েছিল, " বেশ যা বলবেন করব। আজকের পর নিজের প্রানের মায়া আর নেই। আমার চোখের কাপড়টা খুলে গেছে। এতদিনে আমার মায়ের সঙ্গে সঙ্গত দিয়ে অনেক অনেক পাপ করেছি বুঝলেন। হাতদুটো রক্তাক্ত। এই হাতে যাতে দুটো নিষ্পাপ শিশুকে বাঁচানো যায় তার জন্য সব করতে রাজি!"


  কালকের কথাগুলো ভাবছিল কেদার আচমকাই ঘরের আলোগুলো দপদপ করে একবার কেঁপে উঠল। পরক্ষণেই বাচ্ছাদুটোর দিকে তাকিয়ে সে একবার নিঃশব্দে কি ইশারা করল। দুজনেই ঘাড় নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল তারা প্রস্তুত। পরমুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল কেদারের। ঘরের আলো দপদপ করে কাঁপছে আবারও। প্রচন্ড পূতি গন্ধে ঘর ভরে উঠছে ক্রমশ। একসময় দপ করে আলোটা নিভে গেল। পুরো ঘর ডুবে গেল অন্ধকারের বুকে। 


 আর তার ঠিক পরক্ষণেই অন্ধকারের বুকে স্পষ্ট হয়ে উঠল একটা লম্বা চেহারা। আর সেই দুটো আগুনের মত ধকধক করে জ্বলতে থাকা চোখ। এক পা এক পা করে সে ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল অর্জুনদের দিকে। বেশ অনেকটা চলে এসেছে, আচমকাই সামনে এগিয়ে এসেও এক পা পিছনে ফিরে গেল সেই ছায়া মূর্তি। তার পরমুহূর্তেই জাদুর মত কেদারদের ঘিরে এক গোলাকার আগুনের চক্রব্যূহ তৈরি হল ঘরের ভিতর। নীলচে শিখায় জ্বলতে থাকা সেই অগ্নিবলয়ের মধ্যেই এবার হেসে উঠল কেদার।


-" এই চক্রব্যূহ প্রচন্ড শক্তিশালী এক শক্তিক্ষেত্র। এর ভেতর যতক্ষণ আমরা আছি ততক্ষণ আমাদের কোনো ক্ষতি করার ক্ষমতা নেই তোর! তাই ভালো হয় এক্ষুনি এখান থেকে ফিরে যা..."- কেদারের কণ্ঠে এই মুহূর্তে যেন এক অন্য কাঠিন্য। এক অন্য তেজ। 


 আগুনের আলোয় সেই অপশক্তিকে এইবার স্পষ্ট দেখা গেল। সুদীর্ঘ কঙ্কালসার চেহারা। শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে যেন গলে গলে পড়ছে মাংস। ক্ষত বিক্ষত মুখের মধ্যে আগুনের মত জ্বলছে এক জোড়া চোখ। সেই অপশক্তি একবার যেন প্রানপন চেষ্টা করল ভিতরে ঢোকার। প্রচন্ড ঝড় বয়ে গেল ঘরের ভিতর। কিন্তু না আগুন নিভল না। ঠিক এই মুহূর্তে আচমকাই প্রচন্ড ভয় পেয়ে তুলি চিৎকার করে উঠল, " বাবা..."


  এইবার ঠিক এক মুহূর্তের জন্য কেদারের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ও চিৎকার করে কিছু বলতেই যাবে। তার আগেই অর্জুন আর তন্দ্রা ছুটতে ছুটতে এসে প্রবেশ করল এই ঘরে। 


-" তুলি! কি হয়েছে তুলির!"- অর্জুনের চোখে মুখে প্রচন্ড ভয়। 


- " এটা কী করলেন অর্জুনবাবু! আপনাকে বারবার বললাম যাই হয়ে যাক ওই ঘর ছেড়ে বেরোবেন না..." 


কেদারের কথা শেষও হয়নি। তার আগেই অর্জুনের শরীরটা এইবার শূন্যে ভেসে উঠল। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই কুরকুট্টার মুখে ফুটে উঠল বিষাক্ত হাসি। এইবার সে তার ঘুঁটি পেয়ে গেছে। এইবার তাকে আটকানোর আর উপায় নেই। 


-" বাবা!"- অর্জুনকে শূন্যে ভাসতে দেখে কাঁদতে থাকে তুলি। একবার তার দিকে একবার অর্জুনের দিকে তাকিয়েই এইবার কেদারের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, " ওকে ছেড়ে দাও! এই দুটো শিশু তোমার। চক্রব্যূহের আগুন আমি নিভিয়ে দিচ্ছি!"


  কুরকুট্টার মুখে আবারও একবার ফুটে ওঠে বিষাক্ত হাসি। কেদার এইবার একবার হাত নাড়ায়, আর তাতেই আগুনের শিখা স্তিমিত হয়ে আসে। শূন্যে ভাসমান অর্জুনের শরীরটা এবার ধপ করে পড়ে যায় মাটিতে। কুরকুট্টাও এইবার ধীরে ধীরে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসে চক্রব্যূহর ভিতরে। এরপর ঠিক কয়েক মুহূর্ত, আচমকাই কেদারের শরীরটাও শূন্যে ভেসে উঠে ছিটকে পড়ে চক্রব্যূহের আরেক প্রান্তে। ওর কপাল ফেটে বইতে থাকে রক্তের ধারা। সেই অবস্থাতেই ও দেখে ওকে অতিক্রম করে কুরকুট্টা ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে তুলিদের দিকে। 


  ঠিক তুলির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চা ছেলেটার অনেকটা কাছে এগিয়ে এসেছে কুরকুট্টা, এমন সময় আচমকাই পিছনের চেয়ারের উপর তুলি আচমকা উঠে দাঁড়ায়। তারপর দুহাতে ধরে থাকা কিছু একটা জিনিস উপরে তুলে ধরে। কি অদ্ভুত! সেটা দেখে সেই শয়তানও এক মুহূর্তের জন্য যেন কেঁপে ওঠে। এক পা এক পা করে পিছিয়ে আসতে থাকে সে। ঠিক তখনই চক্রব্যূহের আগুন আবারও দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। 


-" খুব ভুল করেছিস এই চক্রব্যূহে তুই প্রবেশ করে। আমি জানতাম ছলের আশ্রয় না নিলে তুই এই চক্রব্যূহের কারসাজি বুঝে যাবি। দেখ এইবার কেমন নিজে থেকে মৃত্যুব্যূহে প্রবেশ করেছিস তুই। এই দুটো নিরপরাধ শিশুকে বধ করার লোভে তুই টেরই পাসনি যে এই চক্রব্যূহের ভিতর তোর কোনো শক্তি কাজ করবে না!"- কেদারের বজ্র কঠিন কণ্ঠে এবার যেন সেই অপশক্তিও কেঁপে ওঠে। 


 ঠিক এমনি সময় সবাইকে চমকে দিয়ে ছোট্ট তুলি জোরে জোরে বলতে শুরু করে, 


"যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।

 অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥"


ঠিক এই মুহূর্তে এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তুলির মুখের এই শ্লোক শুনে কেদারের গায়েও যেন কাঁটা দিয়ে ওঠে। মনে মনে সে বলে ওঠে, " এবার সময় হয়েছে গুরুমা!"


তারপরমুহূর্তেই কি যেন একটা মন্ত্র পড়ে কেদার। আর তারপরই কেদারের ডান হাতের ভিতর এক আশ্চর্য আলোর বিচ্ছুরণ দেখা যায়। যেন সম্পূর্ণ বায়ু থেকে এক আশ্চর্য অস্ত্র তার হাতের ভিতর ঘনীভূত হচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড পরেই দেখা যায় কেদারের হাতে ধরা আছে এক বিশাল ত্রিশূল। সেই ত্রিশূল থেকে নির্গত জ্যোতিচ্ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে থাকে সম্পূর্ণ কক্ষ। 


-" হর হর মহাদেব!"


 কুরকুট্টা কোনো আঘাত হানার আগেই এইবার প্রচন্ড গর্জন করে সেই জ্যোতির্ময় ত্রিশূল কেদার ঢুকিয়ে দেয় কুরকুট্টার শরীরের ভেতর। এরপর ঠিক কয়েক সেকেন্ড তারপরেই প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দে যেন কেঁপে ওঠে সারা ঘর।


-" আআআআআ"- প্রচন্ড শব্দ করে সেই ভয়ঙ্কর অন্ধকার অপশক্তি যেন ক্রমশ বিলীন হয়ে যেতে থাকে এক অভূতপূর্ব আলোর বিস্ফোরণের ভিতর। সেই প্রচন্ড আলোকে ঘরে উপস্থিত সকলের চোখ যেন ধাঁধিয়ে যায়। একসময় আলো কমে আসে। ঠিক তখনই আবার ভেসে আসে তুলির কন্ঠস্বর, 


"পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাং। ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥"


  এইবার ঘরে ভিতর সেই স্তিমিত আলোতেই স্পষ্ট দেখা যায় তুলি চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে ধরা আর কিছুই নয়, তার কন্যের একান্ত প্রিয় গোপালের মূর্তিটি! 


// উপসংহার // 

 

অক্টোবর, ২০১৭ 


-" আচ্ছা কন্যে এই যে শ্রীকৃষ্ণ বললেন, যখনই যখনই অধর্ম হবে, মানুষ বিপদে পড়বে তিনি বাঁচাতে আসবেন। এ কি সত্যি কথা? শ্রীকৃষ্ণ সত্যিই বাঁচাতে আসেন?"- গায়িত্রী দেবীর কোলে বসে জিজ্ঞেস করে ছোট্ট তুলি। তিনি এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো আছেন। হাঁটা চলা করতে পারছেন। রান্না বান্নাও করছেন টুকটাক। 


-" না গিন্নি মা! এইখানেই তো সবাই ভুল করে! সবাই ভাবে বিপদে পড়লে ভগবান বুঝি রক্ষা করবে। কিন্তু তা নয় আসলে বিপদে পড়লে ভগবান শুধু পথ দেখান। সেই পথে চলতে হয় আমাদেরই। বিপদের সমাধানও আমাদেরই বের করতে হয়। শ্রীকৃষ্ণ তো আলাদা কেউ নন, তিনি আমাদের মধ্যেই আছেন। শুধু বিপদের সময় তিনি বেরিয়ে আসেন!"


গায়িত্রী দেবীর কথা শুনে বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ায় তুলি। অর্জুনও এতক্ষন মন দিয়ে শুনছিল সবটা। সেও মাথা নাড়ায়। এইবার তার দিকে তাকিয়ে গায়িত্রী দেবী বলে ওঠেন, " বৌমা কেমন আছে রে?" 


-" ভালো। পরশুই ছুটি দিয়ে দেবে!"


- " আর আমার গোপাল কেমন আছে?"- গায়িত্রী দেবীর কথায় অর্জুন মৃদু হাসে। এই মাসের শুরুর দিকে তন্দ্রার ডেলিভারি হয়েছে। ওদের ফুটফুটে একটা ছেলে হয়েছে। 


-" তিনিও ভালো আছেন। রাতের বেলা মাকে খুব জ্বালাচ্ছেন!"


গায়িত্রী দেবী হেসে ওঠেন। তারপর হঠাৎই বলেন, " এই তোর একটা চিঠি এসেছে জানিস তো। ফ্রিজের ওপর রাখা। লোকটা বলছিল অনেকদিন নাকি ওদের দপ্তরে পড়েছিল। দেখ দেখি কার চিঠি।"


-" আমার? চিঠি?" - অবাক হয়ে যায় অর্জুন। উঠে গিয়ে ফ্রিজের ওপর রাখা খামটা খোলে সে। চিঠিটা খুলে পড়তে গিয়েই বুকের ভিতরটা যেন থমকে যায় অর্জুনের। হাতের লেখাটা ওর বড্ড চেনা। 


" প্রিয় রঞ্জু, 


 এই চিঠি যখন তোমার কাছে পৌঁছাবে তখন এই দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে আমি বহু দূরে পরপারের জগতে চলে গিয়েছি। হাজার খুঁজলেও আমায় আর পাওয়া যাবে না! কলেজ জীবনে অনেক চিঠি দেওয়া নেওয়া করেছি কিন্তু শেষ চিঠি এরকম হবে কখনও ভাবিনি। 


 তোমারই একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে এই চিঠি লেখা রঞ্জু। তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে মানুষকে ভালোবাসলেই কি তার ক্ষতি করার অধিকার জন্মায়? না...জন্মায় না রঞ্জু। আমি ভুল ছিলাম। আমি যেটাকে ভালোবাসা ভাবতাম সেটা আসলে সুতীব্র অধিকার বোধ। আসলে আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি তার উপর একটা প্রচন্ড অধিকার বোধ জন্মায় আমাদের। একসময় ভালোবাসাটা হয়তো মরে যায়। কিন্তু অধিকার বোধটা মরে না...সেইজন্যই এত রক্তারক্তি...এত আঘাত প্রত্যাঘাতের খেলা...


  পারলে তোমার বিদিশাকে ক্ষমা করে দিও রঞ্জু। ভালোবাসা যে আসলে অধিকার বোধে নয়, বরং সমর্পণ আর আত্মত্যাগে সুন্দর হয়ে ওঠে সেটা বুঝতে আমার বড় দেরি হয়ে গেল। পারলে আমায় ক্ষমা করো। ভালো থেকো। তুলিকে দেখে রেখো। 

 

  সুখী হও। ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুক। পারলে আমাকে মনে রেখো...


 ইতি, 

তোমার  বিদিশা" 


চিঠিটা হাতে ধরে অর্জুনের চোখ ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসে। জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। জানলা দিয়ে বাইরের শরতের আকাশ দেখা যায়। অর্জুনের যেন মনে হয় আজ এই সকালে সেই শরতের আকাশ বাতাস জুড়ে চারিদিক থেকে ভেসে আসছে বিদিশার নরম গানের সুর, 


" যদি জল আসে আঁখিপাতে,

  এক দিন যদি খেলা থেমে যায় মধুরাতে,

       তবু মনে রেখো আমায়।


এক দিন যদি বাধা পড়ে কাজে 

শারদ প্রাতে

 তবু মনে রেখো।


 যদি পড়িয়া মনে

ছলোছলো জল নাই দেখা দেয় নয়নকোণে,

 তবু মনে রেখো।

  তবু মনে রেখোওও আমায়...."


// শেষ নাকি শুরু   //


২৫ শে এপ্রিল , ১৯৯২ 

মধ্যরাত


বিগত দুদিন ধরেই গোটা কলকাতা শহর যেন একরকম স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। সংবাদপত্র, খবরের চ্যানেল সর্বত্রই একই খবর। সত্যজিৎ রায় প্রয়াত। গত ২৩ শে এপ্রিল শুধু কলকাতা ছেড়ে নয়, এই ইহ জগতের মায়া ত্যাগ করে তিনি যাত্রা করেছেন পরলোকের দিকে। নশ্বর জীর্ণ বস্ত্র ত্যাগ এক প্রবাদ প্রতিম শিল্পীর এই চির বিদায়ে এই কলকাতা শহর যেন এখন অবগুণ্ঠনবতী। এক মন খারাপ করা শোকের চাদরে মুখ লুকিয়ে সে যেন মুহুর্মুহু বিলাপ বকে চলেছে নিজের মনে। তার সেই অন্তরের নিঃশব্দ ক্রন্দনই আজ এই মধ্যরাতে আকাশের বুক চিড়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরছে। 


   এদিকে রাত্রি প্রায় দ্বিপ্রহর অতিক্রান্ত। কিন্তু তবুও কলকাতার হাতিবাগানের সন্নিকটে একটি বিশাল বাড়িতে এখনও সকলে জেগে। এক বয়স পঞ্চান্ন ষাটের সুদীর্ঘ ব্যক্তি গম্ভীর হয়ে পায়চারি করছেন এ বাড়ির বিশাল বসার ঘরটিতে। ইনি রুদ্রপ্রসাদ চ্যাটার্জি। হাতিবাগানে এনার কাঠের আসবাবপত্রের বেশ বড় ব্যবসা। নামডাকও আছে বেশ। এনার জামাতা প্রবীর বাবুও এই মুহূর্তে একটি কাঠের চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছেন। তার পায়ের অস্থির কম্পন দেখলেই বোঝা যায় তার বুকের ভেতর ভয়ঙ্কর ঝড় চলছে। 


ঠিক এই মুহূর্তে বসার ঘরের পাশের একটি ঘর থেকে এক রমণীর যন্ত্রনাকাতর চিৎকার শোনা গেল। তার পরমুহূর্তেই রাত্রির নিঃস্তব্ধতা আলোড়িত হয়ে উঠল একটি সদ্যজাতের ক্রন্দনের শব্দে। ঘরটির দরজা দরজা খুলে গেল। প্রবীর বাবু তার স্ত্রীকে দেখতে সেই ঘরে ঢুকতেই যাবেন, রুদ্রপ্রসাদ তাকে আটকে দিলেন। 


-" তুমি এখানে দাঁড়াও বাবা কিছুক্ষণ। আমি ভিতরের পরিস্থিতি দেখে আসছি..."


রুদ্রপ্রসাদ এইবার সেই ঘরে ঢুকে তৎক্ষণাৎ দরজা বন্ধ করে দিল। বিদ্যুৎ নেই, তাই ঘরটিতে একটি লন্ঠন জ্বলছে। তার আলোয় এই বার এক অতি তেজস্বিনী মহিলাকে দেখা গেল। মহিলাটির হাতে একটি সদ্যজাত শিশু কাঁদছে। রুদ্রপ্রসাদ আনন্দে আত্মহারা হয়ে এগিয়ে গেলেন, 


-" সরযূ তুমি পারলে শেষমেশ! তুমি পারলে! আমি ভাবিনি এত বড় সর্বনাশের পরেও আমরা এই বাচ্চাটার মুখ দেখতে পারব!"


রুদ্রপ্রসাদ উচ্ছসিত অথচ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বছর পঞ্চাশের সরযূবালার চোখে মুখে হাসি নেই। বদলে বিষাদের ছায়া। এবার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সে বলে উঠল,


- " রুদ্রদা, দময়ন্তী..."


-" দময়ন্তী!"- রুদ্রপ্রসাদ যেন বজ্রাহত হলেন। পরের মুহূর্তেই পাগলের মত ছুটে গেলেন ঘরের এক প্রান্তে রাখা শয্যার দিকে। শয্যায় একটি নারী শায়িত। তার সারা শরীরে অজস্র বেগুনি রঙের ব্যাঙের ছাতার মত কিসব গজিয়েছে। চোখদুটি বন্ধ। দেখলে মনে হয় ঘুমোচ্ছে। অদ্ভুত ব্যাপার, মেয়েটির বয়স হয়তো পঁচিশ ছাব্বিশ কিন্তু ইতিমধ্যেই তার সমস্ত চুলগুলি সাদা হয়ে গিয়েছে! 


- " পারলাম না...পারলাম না। দময়ন্তীকে বাঁচাতে পারলাম না...দিদিকে দেওয়া কথা আমি রাখতে পারলাম না..."- শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে সরযূবালা এবার হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। 


রুদ্রপ্রসাদ কাঠের পুতুলের মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখে তার মেয়ের দিকে। কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল! সে, সরযূবালা তারা তো বহুকাল আগে সমস্ত ছেড়েছুড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিল। তবু ওরা কেন এখনও ওদের পিছন ছাড়ছে না! 


-" ওরা কী চায় সরযূ! ওরা কী চায়! ওরা কি আমাদের মুক্তি দেবে না?"


-" আহুকদের তুমি চেনো না রুদ্রদা! ওদের কাল্টের সঙ্গে যখন ছিলাম তখনই বুঝেছিলাম ওরা ঠিক কতটা ভয়ঙ্কর! আর দময়ন্তীকে ওরা কেন গর্ভবতী অবস্থাতেই মেরে ফেলতে চাইছিল তার কারণ বোধহয় এবার আমি বুঝতে পারছি।"- সরযূবালা এবার শিশুটিকে নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় তার মৃত জননীর দিকে। 


-" কেন সরযূ?"- রুদ্রপ্রসাদের চোখে মুখে বিস্ময়। 


সরযূবালা এইবার শিশুটিকে লণ্ঠনের কাছে নিয়ে আসে। তারপর আস্তে করে তার পিঠের কাছের কাপড়টা সরিয়ে দেন। আর তার ঠিক পরের মুহূর্তেই রুদপ্রসাদের মুখে ফুটে ওঠে অপার বিস্ময়। তিনি দেখেন শিশুটির পিঠে ঠিক মেরুদণ্ড বরাবর একখানা ত্রিশূলের মত চিহ্ন স্বয়ং ঈশ্বর যেন এঁকে দিয়েছেন। 


-" অসম্ভব!"- রুদ্রপ্রসাদের মুখ থেকে অজ্ঞাতসারেই বেরিয়ে আসে কথাটা। 


-" এ কোনো যে সে ছেলে নয় রুদ্রদা। বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই। শুধু তাই নয় আপনার মেয়ে দময়ন্তীর সমস্ত ক্ষমতা ও নিয়ে জন্মেছে। এবং তার সঙ্গে দেবাদীদেব মহাদেবের আশীর্বাদ। 'হল' উপজাতির সেই প্রাচীন প্রবাদ আপনি জানেন নিশ্চয়ই!" 


 সরযূবালার কথা শুনতে শুনতেই থরথর করে কেঁপে উঠছিলেন রুদ্রপ্রসাদ। এ কি সম্ভব! জীবনে কম আশ্চর্যের ঘটনা কিছু তিনি দেখেননি। কিন্তু এ যে প্রায় অবিশ্বাস্য ঘটনা...এই পৃথিবীতে যে গুটিকয়েক হাতে গোনা মানুষ এই চিহ্নের মানে জানে তারাই বুঝবে কি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটছে আজ রাতে কলকাতার সামান্য এক গলির বুকে!


-" যতদিন না সময় আসছে ওকে কিছুই জানানো যাবে না রুদ্রদা। ওর মায়ের পরিচয়ও না। সঠিক সময় এলে আমিই জানাবো ওকে সবটা। তবে ওকে আপনি দেখে রাখবেন। আপনার ঘরে যে জন্ম নিয়েছে সে কোনো সাধারণ ছেলে নয়।খুব ছোট থেকেই ওর নানান আশ্চর্য অলৌকিক ক্ষমতা প্রকাশ পাবে!"- সরযূবালা একটু থামে। তার কোলের বাচ্চাটি এইবার আচমকাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে।  নরম নরম গোলাপী দুহাত দিয়ে ছুঁতে চায় মুখ। 


   সরযূবালার গলায় পরে থাকা লকেটটি শিশুটির নাগালের মধ্যেই ছিল। এইবার শিশুটি দুহাত দিয়ে সেটা ধরার চেষ্টা করে। কি অদ্ভুত! শিশুটি লকেটটিতে হাত দেওয়া মাত্রই সেটির থেকেই আচমকাই প্রচন্ড নীল জ্যোতির বিস্ফুরণ হয় যেন। সারা ঘর ভরে ওঠে সেই মায়াবী আলোর জ্যোৎস্নায়। সরযূবালা দেবী এবার স্মিত হাসেন। তারপর বলে ওঠেন, 


-" উহু, অকুলোমোটারিস তোমার চিনতে কোনো ভুল হয়নি! এই শিশু সত্যিই একসময় এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডকে অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সঠিক সময় আসলে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কোনো কিছুই ওর কাছে আর লুকানো থাকবে না। ওর দৃষ্টি হবে সাক্ষাৎ মহাকালের সমান। সেই জন্য আজ আমি ওর নাম দিলাম " অনন্তদৃষ্টি "! আর আজ থেকেই আমি সরযূবালা গোমস, হলাম ওর গুরুমা!"


*******

 

২০ শে অক্টোবর, ২০১৭ 


-" সরযূবালা গোমস! তিনি কে? "- অর্জুনের চোখে মুখে বিস্ময়। আজ বহুদিন পর কেদারের সাথে দেখা করতে এসেছে সে। 


-" আপনার জানার কথা নয়। ইনফ্যাক্ট এখনকার অনেকেই ওনার ব্যাপারে জানেন না। তবে ষাটের দশকে উনি ছিলেন কিংবদন্তি এক প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর। বিশ্বজোড়া খ্যাতি ছিল ওনার ক্লেয়ার লভয়েন্স ক্ষমতার জন্য। ষাট সত্তরের দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, দেশ বিদেশে একের পর ভয়ঙ্কর সব অলৌকিক রহস্যের সমাধান উনি করেছেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উনি পরিচিত ছিলেন " দি লেডি উইথ দা থার্ড আই" নামে।" - কেদার এবার থামল। অর্জুন অবাক হয়ে তাকিয়েছিল বসার ঘরে ঝোলানো সেই ছবিটার দিকে। ছবির ভিতর দিয়েই সেই অসম্ভব তেজস্বিনী মহিলা যেন অর্জুনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। 


-" তারপর? তারপর কী হল? উনি এই কাজ এখন আর করেন না?"- অর্জুন বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে।


-" না। সত্তরের দশকের শেষের দিকে এক ট্রেন দুর্ঘটনার পর থেকে উনি ধীরে ধীরে এই সমস্ত কিছু থেকে সরে যান। আমার দাদু রুদ্রপ্রসাদ চ্যাটার্জি ছিল ওনার সহকারী। উনি দাদুকে দাদা বলে সম্বোধন করতেন। দাদুর মুখেও কিছু কিছু শুনেছি গুরুমার সঙ্গে তার ভয়ঙ্কর সব অভিযানের কাহিনী..."-কেদারের কথাগুলো যেন গিলছিল অর্জুন। এখন অলৌকিকের প্রতি সন্দেহ তার ঘুচে গেছে। বরং সেই সন্দেহের জায়গাটুকু দখল করেছে অকৃত্রিম কৌতূহল।


কেদার এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। " গুরুমা ওই কাজ ছেড়ে দেওয়ার পরই আমার দাদু এখানে এসে কাঠের আসবাবপত্রের ব্যবসা দেন। এই বিশাল অট্টালিকা তারই তৈরি। আর আমি তার অকালকুষ্মান্ড নাতী আপাতত ইতিহাসে মাস্টার্স কমপ্লিট করে ভারতবর্ষ ও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাচীন ধর্মগুলির ওপরে রিসার্চ করছি। আর অফটাইমে লোকের বাড়ির ভূত তাড়াচ্ছি!"


  অর্জুন এই কথায় হো হো হেসে ওঠে। " এরকম বলবেন না কেদার। আপনি আমার চেয়ে বয়সে ছোট, কিন্তু তবুও আপনি না থাকলে আজ আমার পরিবারটা ভেসে যেত। আপনি সেদিনকে না বাঁচালে..."


-" থাক থাক আর প্রশংসা নয়। বেশি প্রশংসা শুনলেই আমার এসিডিটি হয়। লোকে ভাবে অপমান হজম করা কঠিন, কিন্তু প্রশংসা হজম করাও কিন্তু তার চেয়ে শতগুণ কঠিন। ঠিকঠাক হজম না হলেই মাথা ঘুরে যাবে..."- কেদার এবার চেয়ারে এসে বসে।তারপর বলে, " তুলি কেমন আছে?"


-" ভালো। আপনার কথা জিজ্ঞেস করে মাঝে মাঝে। আজ আসছি শুনে আপনাকে থ্যাংকস জানাতে বলেছে।"


-" কেন?"- কেদার অবাক হয়।


-" ওই যে সেদিন আপনি ওদের বাঁচলেন। তাছাড়াও ওর ঠাকুমার গোপালের মূর্তি, সেও তো সেদিন আপনিই খুঁজে এনে দিলেন।"


 কেদার এবার মুচকি হাসল। তারপর বলল, " যিনি নিজে এই পুরো ব্রহ্মাণ্ডের সবজায়গায় বিরাজমান তাকে আমি খুঁজে দেব কী করে? আমি শুধু তার বিগ্রহটুকু খুঁজে দিয়েছি। গৃহদেবতার বিগ্রহের সঙ্গে সবসময় একটা শুভ শক্তি জড়িয়ে থাকে। এইজন্য দেখবেন বাড়ির ঠাকুর ঘরে ঢুকলে সবসময় একটা পজিটিভ ভাইব পাওয়া যায়!"


-" ঠিক ঠিক!"- কেদারের কথায় সমর্থন জানায় অর্জুন। তারপর বলে, " মোহনের কী খবর কিছু জানেন?" 


-" হু মোহন ভালো আছে। আমার পরিচিত একটি হোমে ওকে রাখার ব্যবস্থা করেছি। মাঝে মাঝে গিয়ে দেখা করে আসি ওর সঙ্গে। এখন অনেকটা হাসি খুশি।" 


   অর্জুন এইবার একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে। যাক আর কোনো দুশ্চিন্তার পাথর ওর বুকে চেপে নেই। নিজেকে অনেকটা হালকা লাগছে, " আচ্ছা এবার আসল কথাটা বলি। যার জন্য আসা। ফোনেই বলা যেত কিন্তু মুখোমুখি বলাটাই উচিৎ বোধ করলাম। আমার মা এবং স্ত্রী দুজনেই কিন্তু আপনাকে আমাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছে। একদিন এই গরীবের ফ্ল্যাটে গিয়ে পেট পুড়ে খেতে হবে..."


 অর্জুনের কথাতেই এইবার হেসে ওঠে কেদার। " অর্জুন বাবু আপনি গরিব কিনা জানি না, কিন্তু আমি আপনার বাড়ি খেলে গরীব অবশ্যই হয়ে যেতে পারেন। বাঙালি তো এখন খেতেই ভুলে গেছে। আমি কিন্তু সেই বিরল ভোজনরসিক বাঙালিদের মধ্যে পড়ি যারা খেতে বসলে আশপাশের লোকজন রীতিমত ভয়ে ভয়ে থাকে!" 


-" আরে বলেন কি! আমিও কিন্তু ওই এক ক্যাটাগরিতে পড়ি। মশাই বাঙালি হয়ে জন্মে যদি তেমন তেমন খেতে না পারলাম তাহলে এ জন্মের আর মানে কী রইল!"- অর্জুন কেদার দুজনেই এবার হো হো করে হেসে উঠল। বাইরে শরতের আকাশে পেঁজা তুলোর মত অলস মেঘের সারি ভেসে যাচ্ছে। জানলা দিয়ে হঠাৎ চোখ পড়লে মনে হয় বহুদূরে আদিগন্ত বিস্তৃত কোনো স্বচ্ছ নীল সরোবরের মধ্যে জলকেলি করছে শ্বেতশুভ্র রাজহংসীর দল।


-" আচ্ছা কেদার বাবু একটা প্রশ্ন সেদিন থেকেই মনে ঘুরছে। সেই চক্রব্যূহ আপনি তৈরি করেছিলেন কুরকুট্টাকে ফাঁদে ফেলার জন্য। আপনি জানতেন যে এমনি এমনি তার সঙ্গে ক্ষমতায় পেরে ওঠা সম্ভব নয়, তাই সেই শক্তি ক্ষেত্রের ভিতর তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন যেখানে ওর শক্তি কাজ করবে না। ঠিক তো?"- অর্জুনের হঠাৎ প্রশ্নে একটু চমকেই ওঠে কেদার। অন্যমনস্কভাবে উত্তর দেয় " হুম... একবার এই কারসাজি টের পেয়ে গেলে ওই চক্রব্যূহে কুরকুট্টা কখনও প্রবেশ করত না। সেইজন্য যাতে ও ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ না করতে পারে সেইজন্য আপনাদের দিয়েও অভিনয় করিয়েছিলাম।"


-" হ্যাঁ সেটা বুঝেছি। কিন্তু সেদিন আপনার হাতে যে বিশাল ত্রিশূলটা দেখেছিলাম সেটা কী ছিল?" - অর্জুনের প্রশ্নে এবার যেন খানিকটা বিব্রত হয় কেদার ওরফে অনন্তদৃষ্টি। বেশ অনেকক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবে। তারপর একসময় অতি সংক্ষেপে উত্তর দেয়,


 " ওটি আমার জন্মগতভাবে প্রাপ্ত একটি দৈবাস্ত্র! গুরুমা বলেন কর্ণের কবজ কুণ্ডলের মত আমিও ওই ত্রিশূল সঙ্গে নিয়েই জন্মেছি!"


****


নভেম্বর, ২০১৭ 


-" আমায় ডেকেছিলেন গুরুমা!"- কেদারের ভরাট কণ্ঠস্বরে প্রায়ান্ধকার সুবিশাল কক্ষটি যেন গমগম করে উঠল। 


বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। নিন্মচাপের বৃষ্টি। দু তিনদিন ধরে একেবারে জ্বালিয়ে মারল। এটি সরযূবালা দেবীর নিজের বাড়ি। তার জরুরি তলবেই কেদার আজ এখানে এসে উপস্থিত। 


-" ভিতরে এসো কেদার।"- সরযূবালা দেবীর সুগম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে এল ঘরের ভিতর থেকে। ঘরটিতে কোনো বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে না। তার বদলে ঘরের মাঝখানে মেঝেতে রাখা ছোট্ট জলচৌকির ওপর একটি বেশ স্বাস্থ্যবান মোমবাতি সদর্পে নিজের অস্তিত্ব জাহির করছে। তার উজ্জ্বল শিখায় দেখা যাচ্ছে এক বৃদ্ধা তার জল চৌকির উপর ঝুঁকে পড়ে ডায়েরিতে কিসব যেন লিখছেন। 


  কেদার এবার ভিতরে ঢুকে এল। গুরুমা এইভাবে অন্ধকারে মোমবাতি জ্বালিয়ে ডায়রি লিখছেন। তারমানে একটাই। তিনি আবারও তার অবশিষ্ট ক্ষমতাকে দগ্ধ করছেন কোনো বিশেষ কারনে। সরযূবালা দেবীর মুখোমুখি এবার বসতেই তার গলার লকেটটা উজ্জ্বল নীল বর্ণের আলোয় জ্বলে ওঠে নিজে থেকেই শূন্যে ভেসে উঠল। কেদার মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম জানাল, 


" ফগিথিলিস ডেল লার্মা !" 


 লকেটটি এইবার শূন্যে ভাসমান অবস্থাতেই জীবিত প্রাণীর মত উপরে নীচে মাথা নাড়াল একবার। সরযূবালা দেবী এবার ডায়রি থেকে মাথা না সরিয়েই বলেন, " তোমায় দেখলেই ওর ছুতে ইচ্ছে করে। তুমি জন্মানোর পর তোমার হাতদুটো ওকেই প্রথম স্পর্শ করেছিল!"


  উজ্জ্বল লকেটটি যেন চুপ করে সবকথা শুনছিল। এইবার তার আলোর জ্যোতি যেন আরও খানিকটা বেড়ে গেল। যেন সে সম্মতি জানাচ্ছে বৃদ্ধা সরযূবালার বক্তব্যে। 


-" হয়েছে হয়েছে! এবার শান্ত হও। আমার কেদারের সাথে কথা আছে।"- সরযূবালা দেবীর এই বিশেষ লকেটটির নাম অকুলোমোটারিস। সেটি যেন তার কথায় এইবার আপনা থেকেই নিজের ভিতরকার আলো কমিয়ে এনে পুনরায় ফিরে গেল নিজের জায়গায়। তারপরেই আবার শোনা গেল সরযূবালা দেবীর কন্ঠ, " আসার সময় পথে কিছু অদ্ভুত খেয়াল করেছিলে কেদার?" 


-" অদ্ভুত! কই না তো..."- কেদার বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায়।


-" কিছুই খেয়াল করোনি?" 


-" উহু! না তো!"- কেদারের কথা শুনে সরযূবালা এবার উঠে দাঁড়ান। তারপর ধীরে ধীরে জানলার দিকে এগিয়ে যান। এক মুহূর্তের জন্য জানলার পর্দাটা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকান, " কিছুই অদ্ভুত চোখে পড়ছে না?"


 প্রথম কয়েক মুহূর্ত ব্যাপারটা বুঝতে পারে না কেদার। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঘন নীল আকাশের বুক চিড়ে মাঝে মাঝেই উঁকি দিচ্ছে বিদ্যুৎ শিখা! এখানে অদ্ভুত কী আছে? কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ এক নাগাড়ে দেখার পরই ব্যাপারটা বুঝতে পারে কেদার। হু! ব্যাপারটা তো ঠিক স্বাভাবিক নয়। 


এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যেও নীল আকাশের বুকে বেশ কয়েকটি সাদা সাদা বিন্দু এক নাগাড়ে ঘুরে চলেছে। ভালো করে দেখলে বোঝা যায় ওগুলি আর কিছুই নয়, বক। কিন্তু এত ঝরে বক কেন কোনো পাখিই কি আকাশে উড়ে বেড়ায়? কেদারের ভ্রু কুঁচকে গেছে দেখে সরযূবালা দেবী এইবার জানলার পর্দাটা আবার দিয়ে দেন। তারপর নিজের টেবিলের দিকে ফিরে আসতে আসতে বলেন, 


" ওরা তোমায় ফলো করছে কেদার। ওরা তোমায় ফলো করছে। আমি জানতাম এমনটা হবে। ঠিক যেদিন থেকে তুমি তোমার পিনাক ব্যবহার করেছ সেইদিন থেকে ওরা তোমায় ফলো করতে শুরু করেছে। এতদিন তোমায় অনেক কষ্টে লুকিয়ে রেখেছিলাম কিন্তু আমি জানতাম এমনটা একদিন ঘটবেই। তাই তোমায় বলেছিলাম একদম কোনো উপায় না থাকলে সব শেষে ওই অস্ত্র ব্যবহার করতে..."


-" আপনি কী বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কারা আমায় ফলো করছে? ওই বকগুলো?"


  কেদারের প্রশ্নে সরযূবালার চোয়াল এবার যেন শক্ত হয়ে ওঠে। সামনে খোলা ডায়রিটার দিকে তাকিয়ে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। তারপর বলেন, " তুমি তো জানো কেদার। আমার আয়ু ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। আর বড় জোড় দুবছর। তার বেশি আমাকে তুমি পাবে না..." 


-" এমন বলবেন গুরুমা..."- এসব কথা শুনলেই কেদারের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। 


-" নিয়তি কেদার, নিয়তি। আমরা কেউ নিয়তির উর্দ্ধে নই। মানুষের শরীর নিয়ে জন্মেছি, মরতে তো হবেই। সময় এলে সেই ভয়ঙ্কর মৃত্যুর কাছে আমার নিয়তিই আমাকে টেনে নিয়ে যাবে..." এবার একটু থামেন বৃদ্ধা সরযূবালা। ওনার বয়স প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই। তবুও এই বয়সেও চেহারায়, কথাবার্তায় কি অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব!


-" তোমাকে সমস্তটা বলার সময় হয়েছে কেদার। কে বা কারা তোমার মাকে মেরেছিল। কীসের জন্য মেরেছিল? কারা কেন তোমায় ফলো করছে সবটা তোমার জানা দরকার..."


-" আমার মাকে কেউ মেরেছিল? কিন্তু আমার বাবা যে বলতেন আমার মা আমায় জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়..."- কেদারের চোখে মুখে বিস্ময়। 


-" সেইটা অর্ধসত্য। আমিই বলেছিলাম তোমায় সবটা না জানাতে। ছোটবেলায় এত কিছু তুমি সহ্য করতে পারতে না। যতই তোমার মা তো কোনো সাধারণ মহিলা ছিলেন না!"


-" সাধারণ মহিলা ছিলেন না! মানে!"- কেদার যেন ক্রমশ বিস্মিত হচ্ছে। 


-" তোমার যে এই অদ্ভুত ক্ষমতা, তা কোথা থেকে এল কেদার? হঠাৎ করেই পেয়ে গেলে? উহু এই সকল ক্ষমতা তোমার মায়ের থেকে পাওয়া। তোমার মা ছিলেন একজন শান্ডূকী!"


-" শান্ডূকী! সেটা কী?"- কেদারের জন্য যেন চমকের পর চমক অপেক্ষা করেই আছে। আজ গুরুমার বলা সমস্ত কথাই যেন ধোঁয়াশার মত শোনাচ্ছে। কোন রহস্য এতদিন গুরুমা লুকিয়ে রেখেছিল তার কাছ থেকে? 


  সরযূবালা দেবী বেশ কিছুক্ষণ ধরে কেদারের মুখটা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সেই ছোট্ট কেদার যার জন্ম হওয়ার কথাই ছিল না। ডাক্তাররাও যাকে গর্ভের মধ্যে মৃত ঘোষণা করেছিল আতঙ্কে। দময়ন্তীকে দেখে ঘেন্নায় ভয়ে ছুঁতে পর্যন্ত চায়নি কেউ সেই রাতে। সেইদিন বহু কষ্টে সেই শিশুটিকে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। অবশ্যই অকুলোমোটারিস ছিল তার সঙ্গী। তার হাতেই প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেছিল কেদার। 


-" কী হল গুরুমা! বলুন শান্ডূকী কী ?" 

    

   সরযূবালা যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন কোথায়। এইবার কেদারের কণ্ঠে আবার যেন সম্বিৎ ফিরে পেলেন। মৃদু হেসে বললেন, 


-" শান্ডূকী হল এক ধরণের বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন নারী। শোনা যায় সাক্ষাৎ মহাদেবের বর থাকে এদের ওপর। এদের অতীত ও ভবিষ্যৎ দেখার অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে। এদের ক্ষমতা থাকে এই ত্রিমাত্রিক জগতের বাইরেও বহু মাত্রার জগতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার। সেখানকার বিভিন্ন জীবদের আহ্বান করার। দময়ন্তীর মা অর্থাৎ তোমার দিদা ছিলেন ধুলোচড়া গ্রামের মেয়ে। শোনা যায় একমাত্র সেই গাঁয়ে মেয়েদের গর্ভেই 

শান্ডূকীরা জন্ম নিতে পারে।" 


-" ধুলোচড়া!"- নামটা বড্ড যেন চেনা লাগে কেদারের। নিজের মনে শব্দটাকে নিয়ে দু একবার নাড়াচাড়া করতেই আচমকাই বিস্ময়ে বলে ওঠে সে, " উমনি বুমনি ঝুমনি...আমার কাছে আসিসনি! ঝুমনি...ছোটবেলায় দিদার কাছ থেকে ধুলোচড়ার গল্প শুনেছিলাম। সেখানে ঝুমনি বলে নাকি এক ভয়ঙ্কর অপশক্তি আছে যে প্রতিবার ঝড়ের সময় গ্রামে হানা দেয়। কিন্তু সেসব তো গল্প!"


-" উহু গল্প নয়! কোনো কিছুই গল্প নয় কেদার!"- এইবার জানলার ফাঁক দিয়ে উকি মারা নীল আকাশের দিকে তাকিয়েই বলতে থাকেন সরযূবালা, " সব সত্যি। সব একে অপরের সঙ্গে কানেক্টেড। ধুলোচড়ার ত্রাস এই ঝুমনির সৃষ্টিও হয়েছিল এমনই এক শান্ডূকীর জন্যই।"


-" দিদা বলত ধুলোচড়ায় নাকি একজন দাইমা আছেন যিনি ঝুমনির হাত থেকে সবাইকে রক্ষা করেন! সত্যি?"- কেদারের চোখে মুখে বিস্ময়। 


-" নির্যস সত্যি! তোমার নিজের দাদুকে তো ঝুমনি আঁচড় দিয়েছিল ওই গ্রামে থাকাকালীন। তখন দাইমাই তাকে বাঁচান। তারপর সেই যে তোমার দিদাকে নিয়ে তিনি কলকাতা চলে এলেন আর কোনোদিন ওইমুখো হননি..."


 দীর্ঘক্ষণ কথা বলার অভ্যেস বহুদিন সরযূবালা দেবীর নেই। সেইজন্য এটুকু বলতেই তিনি যেন হাপিয়ে উঠেছেন। তার কথা শুনে কেদার মনে মনে কিসব যেন ভাবছিল। এইবার হঠাৎ বলে উঠল, " আমার মাকে কারা মারতে চেয়েছিল গুরুমা? কেনই বা মারতে চেয়েছিল?"


   সরযূবালা দেবী এইবার কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়ান। তারপর আবারও ধীরে ধীরে এগিয়ে যান জানলার দিকে। তারপর কেদারকে চমকে দিয়েই এক লহমায় জানলার পর্দাটা সরিয়ে বলেন বাইরে আঙুল দেখিয়ে বলেন, " ওরা!"


  এইবার জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কেদারের বুকটা যেন ঠান্ডা হয়ে আসে! ও কি সত্যি দেখছে! এ কি সম্ভব! কেদার দেখে জানলার বাইরে ঘন নীল আকাশের বুকে এই মুহূর্তে ক্ষুধার্ত শিকারীর মত উড়ে বেড়াচ্ছে শয়ে শয়ে সাদা বক!


-" ওরা কারা গুরুমা?"- কেদার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে। 


সরযূবালা কিছুক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকেন। তারপর ফিসফিস করে উত্তর দেন, 


" আহুক!"


*****


-" আহুক! আহুক কারা গুরুমা? আমার মাকেই বা তারা মারতে চাইবে কেন! কোন রহস্য লুকিয়ে আছে বলুন আমার অতীতে?"- কেদার যেন ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। ওর এই অস্থিরতা দেখে স্মিত হাসেন সরযূবালা। তারপর বলেন, 


-" শুধু তোমার অতীত নয় কেদার। এরসঙ্গে জড়িয়ে আছে তোমার, আমার, তোমার দাদুর...আমাদের সকলের অতীত। এক ভয়ংকর ইতিহাস। ফগিথিলিসের ইতিহাস!"


-" মানে?"


-" মানে একসময় তোমার দাদু রুদ্রপ্রসাদ চ্যাটার্জি এবং আমি সরযূবালা গোমস আমরা দুজনেও আহুক ছিলাম। আমরাও ছিলাম ওদেরই দলে!"


  এইবার কেদারের মাথা গুলিয়ে যেতে শুরু করছে। গুরুমা কী বলছেন, কেন বলছেন কিছুই যেন বুঝতে পারছে না ও। সব যেন ওর মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। এইবার পাগলের মতোই ও বলে ওঠে, " এসবের মানে কী গুরুমা আমি কিছুই বুজছি না!"


 সরযূবালা দেবী এবার হাসেন। তারপর বলেন, " বুঝবে বুঝবে সবটাই বুঝবে। শুধু একটু সময় লাগবে। তবে একটা সত্য তোমায় প্রথমে বুঝতে হবে কেদার। এই মহাবিশ্বে আমরা একা নই! মোট নয়খানা সমান্তরাল মহাবিশ্ব পরস্পরের সঙ্গে চক্রাকারে জড়িয়ে পেঁচিয়ে এই অদ্ভুত ব্রহ্মান্ড তৈরি করেছে। যার চক্রে চক্রে ভাঁজ পড়ে তৈরি হয়েছে বহু মাত্রার কোটি কোটি জগৎ। সেখানে লক্ষ লক্ষ জীবের বাস। তারা কেউ আমাদের মত নয়। তারা ভয়ঙ্কর,কুটিল, নৃশংস। এই মহাবিশ্বের অনাদি অন্ধকারের সময় থেকেই তারা আমাদের সঙ্গে আছে। বিভিন্ন মাত্রায়, বিভিন্ন সমান্তরাল জগতে। এই ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন অন্ধকার খাঁজে। আমরা তাদের কাছে কী! কিচ্ছু না! অত্যন্ত তুচ্ছ, ক্ষুদ্র, ক্ষমতাহীন জীব মাত্র!"


  সরযূবালা দেবীর কথা শুনে এই মুহূর্তে উন্মাদগ্রস্ত মনে হবে। যদিও কেদারের তা মনে হচ্ছে না। সে জানে তার গুরুমা কখনও মিথ্যে কথা বলে না। আজ এই মুহূর্তে গুরুমা যা যা বলছে সব সত্যি। আর সেটা উপলব্ধি করেই এক অদ্ভুত অজানা আতঙ্কে কেদারের বুকটা যেন হিম হয়ে যাচ্ছে ভয়ে। সরযূবালা দেবী আবারও বলে ওঠেন, 


-" মানুষ ভাবে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে তারা বুঝি একা। উহু সর্বৈব ভুল ধারণা। আমরা একা নই। কোনোদিন ছিলাম না। শুধু আমাদের প্রতিবেশীদের দেখার ক্ষমতা আমাদের নেই। এমনকি এই পৃথিবীতেও মানুষরা একা নাও। এখানে মানুষের সমাজের মধ্যেই মিশে আছে নাহুং, চক্রশিরা, সর্পকৃতি আরও কত জীবেরা..."


 কেদার এবার যেন বিস্মিত হওয়ার শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। " এরা কারা গুরুমা?" 


 সরযূবালা দেবী আবারও হাসেন। তারপর বলেন, " কেদার তুমি বিভিন্ন প্রাচীন ধর্ম নিয়ে পড়াশুনা করেছ। তুমি অবাক হওনি এই ভেবে যে প্রত্যেকটা ধর্মের মাইথলজিতে কিছু বিশেষ শক্তিধর মানুষের উল্লেখ থাকে। কিছু মানুষ যারা পশুর রূপ ধারণ করতে পারে, কিছু মানুষ যাদের অদ্ভুত মায়াবী ক্ষমতা, কিছু মানুষ যাদের অর্ধেকটা মানুষ অর্ধেকটা পশু...তোমার কখনও মনে হয়নি এত এত ধর্মের মাইথলিজিতে একইরকমের জীবেদের বর্ণনা কিভাবে বারবার উঠে এসেছে।"


-" হ্যাঁ এই বিষয়েই তো ইয়ুঙ এর একটা থিওরি আছে। কালেক্টিভ আনকনশাসনেস নিয়ে..."- কেদারের কথা শেষ করার আগেই তাকে মাঝপথে থামিয়ে দেন সরযূবালা।


-" শশশশ...আমরা এই পৃথিবীতেও একা নই কেদার। এখানে আমাদের থেকেও শতগুন বুদ্ধিমান জীব আছে। এটা যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে ততই মঙ্গল। ওরা আমাদের মধ্যেই আছে। আমাদেরই সমাজে। হয়তো আমাদের সঙ্গে কথাও বলছে কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না যে ওরা মানুষ নয়..."


  সরযূবালা দেবী হাপিয়ে ওঠেন। এইবার এগিয়ে এসে মাটিতে বসে পড়েন তিনি। তারপর ফের কেদারের চোখের দিকে চেয়ে বলেন, " নটা চাবি আছে কেদার! নয়টা মহাবিশ্বের নয়খানা চাবি! এই পৃথিবীতেই সেগুলো আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে শুধু মনুষ্য নয়, বিভিন্ন জাতি জীবেরা এই চাবি রক্ষা করছে। কিন্তু সামনেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে কেদার। প্রচন্ড অন্ধকার। আহুকরা এই নটা চাবি হস্তগত করতে চায়! তারা এই চাবি দিয়ে জাগিয়ে তুলতে চায় ফগিথিলিসকে!"


  - " ফগিথিলিস?"- বিস্ময়ভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করে কেদার, " দাদুর মুখে এই নামটা বহুবার শুনেছি। আপনার মুখেও শুনেছি অনেকবার। এমনকি আপনিই শিখিয়েছিলেন ওই মন্ত্রটা বলতে। কিন্তু ফগিথিলিস আসলে কী কখনও জিজ্ঞেস করিনি। ফগিথিলিস কী গুরুমা!"  


-" বলবো! বলবো...সময় এসেছে তোমার সবটা জানার। তবে তার আগে তোমায় মনে মনে শক্ত হতে হবে কেদার। কারণ অদূর ভবিষ্যতে এমন সময় আসবে যখন এই পৃথিবী ডুবে যাবে অন্ধকারে। তখন আমি থাকব না। তোমাকেই ওদের মুখোমুখি হতে হবে। ওদের প্রতিরোধ করতে হবে। এই গোটা মনুষ্য সভ্যতাকে রক্ষা করতে হবে ফগিথিলিসের উপাসক... আহুকদের হাত থেকে। পারবে তো?" 


 সরযূবালার কন্ঠে যেন কেঁপে ওঠে। কেদারের বুকটাও যেন ধক করে ওঠে একবার। পরমুহূর্তেই মাথা নাড়িয়ে সে বলে, " পারবো। কিন্তু আগে বলুন ফগিথিলিস কে?" 


 সরযূবালা আবারও রহস্যময়ী হাসি হাসেন। তারপর বলেন, " তার আগে তোমায় জানতে হবে কেদার ' ফগিথিলিস ডেল লার্মা' এই কথাটার মানে কী!"


 ওপর নিচে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায় কেদার তারপর জিগ্গেস করে, " হ্যাঁ, ' ফগিথিলিস ডেল লার্মা ' এই কথাটার মানে কী গুরুমা?" 


  সরযূবালা আবারও স্মিত হাসেন। তার মনে পড়ে যায় বহু বছর আগের সেই দিনটির কথা যেদিন মিশরের এক অন্ধকার গুহায় বসে প্রথম এই কথাটার মানে শিখেছিলেন তিনি। মোমবাতির স্থির হয়ে যাওয়া শিখাটার দিকে তাকিয়েই তিনি উত্তর দেন, 


-" ফগিথিলিস ডেল লার্মা মানে হল... ফগিথিলিস সব দেখছেন!"


( সমাপ্ত )


" আখিদা"র সরযূবালা গোমস থেকে " ঝুমনি "র দাইমা কিংবা ক্ষণদেবী, "কুরকুট্টা"র কেদার ওরফে অনন্তদৃষ্টি থেকে " বেঁশো"র রুপু, সিদ্ধার্থ কাহিনী আলাদা আলাদা হলেও...সকলের নিয়তি যেন বাঁধা কোনো এক অদৃশ্য সুতোর বন্ধনে। ফগিথিলিস। কী এই ফগিথিলিস? আহুকরাই বা কারা? তাদের আসল উদ্দেশ্যটাই বা কী? কী করতে চলেছে তারা এরপরে?

অনেকগুলো কাহিনী। অনেকগুলো চরিত্র। কিন্তু একটাই ইউনিভার্স! কী ঘটতে চলেছে এখানে পরবর্তী সময়ে! কোন অন্ধকার নেমে আসবে পৃথিবীর বুকে? সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে চোখ রাখতে হবে ভূত ভুতুমের দেওয়ালে। 


কাহিনী তো শেষ নয়, আসলে এখান থেকেই কাহিনী শুরু! এখান থেকেই শুরু এক নতুন ভয়াবহ হরর ইউনিভার্সের! 


ফগিথিলিস ডেল লার্মা! ভয়ের এই নতুন ইউনিভার্সে ভুতুমিয়ান্সদের স্বাগত জানাই!!!




Post a Comment

0 Comments